বীভৎস হিংস্রতায় পৌঁছনোর সাধনা চলছে যেন!

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 17 June 2017, 03:59 PM
Updated : 17 June 2017, 03:59 PM

মা-বাবা নাম রেখেছিলেন সুখিয়া। গরিব, হিন্দু, রবিদাস, নারী; হায়রে, মা-বাবা তাঁকে আবার আদর করে ডাকতেন 'সুখিয়া'! না, সুখিয়া সুখী হতে পারেননি, শেষ পর্যন্ত বাঁচতেও পারেননি। আমাদের বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের আইন-কানুন, আমাদের বহু গর্বের সমাজ, সমাজের সুসভ্য মানুষ– কেউ সুখিয়ার বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে পারেনি!

গত ১০ জুন যখন আমরা বর্ষার আগমনী বার্তা নিয়ে মোহন-মদিরায় মত্ত ছিলাম, যখন আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সেমিফাইনালে ভারতের সঙ্গে সম্ভাব্য জয় নিয়ে ফেসবুক ভরে ফেলছিলাম, তাহমিমা আনামের সাহিত্য কতটুকু সাহিত্য, আর কতটুকু বাবার সুনামের গুণ– এই নিয়ে যখন সৌখিন বুদ্ধির অপচর্চা করছিলাম, যখন আমরা মত্ত ছিলাম রাজনীতি, ধর্ম, ব্যবসা, আসন্ন ঈদ উপলক্ষে কেনাকাটা নিয়ে, তখন হবিগঞ্জে চলছিল মানবতা হত্যা করার এক দমবন্ধ উৎসব!

শাইলু মিয়া নামে একজন নরপিশাচ ৩০ বছরের সুখিয়া রবিদাস নামে একজন দলিত নারীকে প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। শাইলু মিয়া যখন সুখিয়ার মাথায় উপর্যুপরি লাঠি দিয়ে আঘাত করছিল তখন তাঁর বাঁচার আর্তনাদ আশপাশের মানুষদের পাথর কঠিন মন গলাতে পারেনি। তাঁকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেনি! আমাদের ভোঁতা মানবতা এতটুকু আলোড়িত হয়নি!

হবিগঞ্জের সুতাং বাজারের সেতুর পশ্চিম পাশে সুখিয়া রবিদাস তাঁর একমাত্র ১২ বছরের ছোট ভাইকে নিয়ে বাস করে আসছিলেন। বিভিন্ন সময় সুখিয়াদের বাড়ির জায়গা দখলের জন্য এলাকার একটি প্রভাবশালী মহল তাদের নির্যাতন করে আসছিল। হত্যার আগে সুখিয়াকে ধর্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। দ্বিতীয়বার নির্যাতন করতে চাইলে তিনি দৌড়ে ঘর থেকে বের হন। তখন শাইলু তেড়ে গিয়ে একটি কাঠ দিয়ে আঘাত করে তাঁকে হত্যা করে। এলাকার অনেকেই এ দৃশ্য দেখেছেন!

আট বছর আগে সুখিয়ার স্বামী মনি লাল দাসকেও একইভাবে বাড়ির পাশে রাতের আঁধারে হত্যা করা হয়। টাকার অভাবে মামলা পরিচালনা করতে না পারার কারণে সেই হত্যাকাণ্ডের অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। সুখিয়ার চাচা অর্জুন রবিদাসও ২০১৩ সালে হত্যার শিকার হন। শাইলু মিয়া ওই হত্যা মামলার প্রধান আসামি। মামলাটি বর্তমানে উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। ওই হত্যা মামলার সাক্ষী ছিলেন সুখিয়া রবিদাস। সুখিয়া ও তাঁর স্বামী মনিলাল দাস এবং তাঁর চাচা অর্জুন হত্যাকাণ্ডের যোগসূত্র একই।

তারা দলিত বলে, তাদের শিক্ষা নেই বলে, তারা এ সভ্যতার তথাকথিত বিচারে অস্পৃশ্য বলে, তারা প্রান্তিক বলে, তারা নিতান্তই শক্তিহীন বলে পরিবারটির পক্ষে কেউ দাাঁড়ায়নি? কোথায় আইন, আইনের শাসন, সংবিধানের সাম্যের বাণী? কোথায় আমাদের ধর্ম, কোথায় মানবিকতা? কোথায় দেশের মানবাধিকার সংগঠনসমূহ?

সুখিয়ার এই নির্মম মৃত্যু আমাদের বিবেককে কি একটুকুও নাড়া দেবে না? আমরা কি একবারের জন্যও সরব হব না সুখিয়ার এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে? নাকি হিংসা, বিদ্বেষ আর পেশিশক্তিনির্ভর যে মাৎস্যন্যায়ের সমাজ আমরা নির্মাণ করেছি, তারই অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে এই সুখিয়াদের এভাবে অকালে চলে যাওয়া?

আমরা কিসের আশায়, কোন ভরসায় বেঁচে আছি? আমাদের এই সমাজ, এই সমাজের মানুষগুলো সুখিয়াকে শুধু নয়, তাঁর স্বামীকে, চাচাকে বাঁচতে দেয়নি! আমাদের রাষ্ট্র, আইন, প্রশাসন ন্যূনতম সান্ত্বনা হিসেবে ওই দুটি হত্যার বিচার নিশ্চিত করতে পারেনি! এই দেশে, এই সমাজে সুখিয়ারা কিসের আশায় বেঁচে থাকবে? আমরাই বা কোন মুখে নিজেকে মানুষ হিসেবে পরিচয় দেব? 'আশরাফুল মাখলুকাত' হিসেবে নিজের অহংকারী পরিচয় জাহির করব?

এ কোন আজব দেশ আমরা প্রতিষ্ঠা করলাম, যেখানে নারী হত্যার অধিকার আছে, কোনো সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বাড়িঘরে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার অধিকার আছে, কিন্তু প্রতিবাদ করার অধিকার নেই! শ্রমিকদের না খেয়ে মরার অধিকার আছে, প্রতিবাদ করার অধিকার নেই! সমতল কিংবা পাহাড়ি, আদিবাসী বা হিন্দুদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার অধিকার আছে, কিন্তু প্রতিবাদ করার অধিকার নেই! মুসলমানদের রোজা রাখার অধিকার আছে, কিন্তু অন্য ধর্মাবলম্বীদের খাওয়ার সুযোগ নেই! তাইতো হোটেল বন্ধ রাখার 'নিয়ম' করা হয়েছে। এ রাষ্ট্রে বাস করার অধিকার আছে, সরকার কিংবা রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করার অধিকার আছে, কিন্তু সরকার কিংবা রাজনৈতিক দলের সমালোচনা করা যাবে না!

দেশে চলছে এখন ক্ষমতার বাহাদুরি। যার যেখানে ক্ষমতা আছে, তার চূড়ান্ত প্রয়োগ করা হচ্ছে। জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর ক্ষমতাবানরা জুলুম-নির্যাতন চালাচ্ছে। নারীদের উপর ক্ষমতাবান পুরুষরা নির্যাতন-হয়রানি-ধর্ষণ চালাচ্ছে। সরকারি দলের নেতাকর্মীরা তুলনামূলক কম ক্ষমতাবানদের হুমকি-অপমান-নির্যাতন-হামলা-মামলা দিয়ে সন্ত্রস্ত রাখছে।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে গেছে নারী ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপর ভয়ংকর আক্রমণ। যেন আদিম অন্ধকার নামছে যত্রতত্র। ধর্ষণ বা দলগত ধর্ষণ বা আরও ভয়ংকর যেসব অত্যাচারের শিকার নারীকে হতে হচ্ছে, তাতে আক্রান্ত শুধু নারী নন, আক্রান্ত সমগ্র মানবতা।

প্রাগৈতিহাসিক আরণ্যক আদিমতা থেকে পথ চলা শুরু করে বর্তমান সভ্যতার উত্তুঙ্গ শিখর পর্যন্ত মানবজাতির যে সুদীর্ঘ যাত্রাপথ, তার পুরোটাই যেন বার বার মিথ্যায় পর্যবসিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে, মানবজাতি সামগ্রিকভাবে এগোয়নি মোটেই, কিছু মানুষ বা অনেক মানুষ এগিয়েছেন। কিন্তু নিজের নিজের অস্তিত্বের গভীরে অনেক মানুষই এখনও সভ্যতার পূর্ববর্তী কোনো আদিমতায় পড়ে রয়েছেন এবং আরও প্রাচীন, আরও হিংস্র কোনো অন্ধকারের দিকে পৌঁছনোর সাধনা করছেন!

এসব দেখে-শুনে কেবলই মনে হচ্ছে, এর শেষ কোথায়? আর কতবার এমন জঘন্য, বর্বর, ঘৃণ্য আক্রমণ নেমে আসবে মানবতার উপর? মানবজাতির উত্তরণের ইতিহাসকেই তো বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করবে না এরপর!

লংগদুতে মিথ্যা একটা ভাবাবেগ সৃষ্টি করে শত শত আদিবাসীর বাড়িঘর পুড়িয়ে আক্ষরিক অর্থেই 'ভিটায় ঘুঘু চড়ানো'র ঘটনা ঘটেছে। একের পর এক নারকীয় সব নারী নির্যাতনের ঘটনা চলেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে 'ভাবমূর্তি' ক্ষুণ্নের অভিযোগ এনে নিরীহ মানুষদের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে মামলা করা হচ্ছে। সবখানে ক্ষমতার দাপট, ক্ষমতার প্রদর্শনী!

এত কথা, এত টকশো, পত্রপত্রিকায় নিবন্ধ, সমাবেশ, মানববন্ধন, অথচ প্রতি সপ্তাহেই অসংখ্য বীভৎস নারকীয়তার সাক্ষী হতে হচ্ছে আমাদের! ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। বার বার প্রশ্ন জাগছে, মানবিক মূল্যবোধ বলে সত্যিই কি কিছু আছে? মানবিক মূল্যবোধ বলে সত্যিই যদি কিছু থেকে থাকে, তাহলে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ন্যূনতম মাত্রায় অন্তত তা থাকার কথা। আর সেটুকু মূল্যবোধ থাকলেই এমন ভয়ংকর কাণ্ড ঘটানো অসম্ভব।

পিশাচবৃত্তির কোন পর্যায়ে নেমে দাঁড়ালে এমন নারকীয় কাণ্ডকারখানা করতে পারে মানুষ! মানুষের এই অমানবিকতা, এই নিষ্ঠুরতার কি শেষ নেই? একের পর এক ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। যেন কোনো শেষ নেই! সাময়িক বিরতিও নেই!

একটা ঘটনা নৃশংসতায় ছাপিয়ে যাচ্ছে অন্যটাকে। যেন কে কত নৃশংস হতে পারে তার 'কমপিটিশন' চলছে সমাজে-সংসারে। তুচ্ছ কারণে কেবল যে মানুষ খুন হচ্ছে তা-ই নয়, খুন হচ্ছে আশ্চর্য নিষ্ঠুরতা ও পিশাচবৃত্তির স্বাক্ষর রেখে! ঘটনাগুলি সামনে এলে তাই ভয়ের চেয়ে ভবিষ্যৎ চিন্তাটাই বড় হয়ে ওঠে। নিজেদের বিকৃত কাম চরিতার্থ করতে আর সম্পদ কুক্ষিগত করতে ক্ষমতার দাপটে মানুষজন যদি এমন নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে, তাদের ভয়াবহ কাণ্ডকারখানা যদি নিত্যই ঘটতে থাকে, তবে হতভাগ্য সুখিয়াদের মতো নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষগুলি যাবে কোথায়?

বিপদের এ-ও এক অশনিসংকেত। হিংসা-নিষ্ঠুরতার রক্তস্রোতে ভেজা, স্নেহ-মায়া-মমতা-বিশ্বাসের থেঁতলানো মুখে বীভৎস এ কোন পৃথিবী, এ কোন সমাজে আমরা এসে পড়লাম? যে কোনো মুহূর্তে যে কেউ হয়ে উঠতে পারে নৃশংস আততায়ী, ঘটিয়ে ফেলতে পারে অভাবনীয় কোনো হিংসার ঘটনা! শিশু, বৃদ্ধ, নাবালক, মহিলা রেহাই নেই কারও! এই বিকৃত রুচির ঘাতকদের জন্য কি শেষ পর্যন্ত আমাদের স্বাভাবিক জীবনের স্বাদ-গন্ধ-ছন্দ-আনন্দ সবকিছু হারিয়ে যাবে? এক অদ্ভুত অবিশ্বাসের বাতাবরণে দিনরাত শঙ্কা-সন্দেহ নিয়ে বাঁচতে হবে আমাদের?

প্রশ্ন হল, এ ব্যাপারে সরকারের কি কিছুই করার নেই? সবার জন্য আইন, আইনের শাসন– এসব কি ফাঁপা বুলি হয়ে থাকবে? বিচারহীনতার সংস্কৃতিই কি দেশে একমাত্র স্বীকৃত 'নীতি' হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে? সুখিয়াদের জীবন কি কোনোদিন ক্ষমতাসীনদের কাছে মর্যাদা পাবে না?