বাড়িওয়ালা মওদুদ ও বাড়িছাড়া মওদুদ

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 11 June 2017, 09:28 AM
Updated : 11 June 2017, 09:28 AM

"২০০৫ সালে খালেদা জিয়ার বোনের ছেলে মাইক্রোবাসে করে গুণ্ডা ভাড়া করে এসে বাড়ি খালি করার জন্য আমার মাকে হুমকি দেন। হুমকি দিয়েই ক্ষান্ত হননি, আমাদের সে বাড়ি থেকে অবৈধভাবে বের করে দিয়েছিলেন। না কোনো আদালতের আদেশে, সম্পূর্ণ গুণ্ডামি করে আমাদের বাড়ি দখল করে নেন।"

মাহজাবিন খালেদ বলেছেন কথাগুলো। যার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফ। একাত্তরের রণাঙ্গনে মাথার খুলি উড়তে উড়তে বেঁচে যাওয়া বীরের পরিবারের প্রতি এই ছিল বিএনপির উপহার!

শহীদ সুরকার আলতাফ মাহমুদের একমাত্র সন্তান শাওনের একটি লেখা ফেসবুকে আলোড়ন তুলেছে– বলা উচিত, মানুষের অন্তর ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। সে এক কাহিনি। আশির দশকে তাদের উচ্ছেদ করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের দেওয়া বাড়ি থেকে। সে অবৈধ উচ্ছেদের নেপথ্যে থাকা মওদুদের স্মিত হাসি আজ সময়ের বিচারে ধরা খেয়েছে।

এমন আরও অজস্র ঘটনা আছে যেখানে মওদুদ আহমেদকে অনায়াসে নাটের গুরু হিসেবে চিহ্নিত করা চলে। মনে পড়ছে ১৯৯০এর ডিসেম্বরের কথা। এরশাদের গদি তখন টলটলায়মান হলেও ঠিক কবে তার পতন হবে কেউ জানত না। ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ছটার খবর দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। ঠিক সন্ধ্যায় দেশে কেউ বাড়িতে থাকে না। কেন যেন সে সন্ধ্যায় টি্ভির খবরে দেখলাম এরশাদ পতনের ঘনঘটা। তাদের ভাষায়, 'গণতন্ত্রের স্বার্থে পদত্যাগ'। এরশাদের খুব কাছে দাঁড়িবে ছিলেন দুজন নেতা; একজন প্রয়াত কাজী জাফর আহমেদ, আরেকজন মওদুদ আহমেদ।

মনে পড়ে এক পর্যায়ে মওদুদ এরশাদের বুকে হাত বুলিয়ে সান্তনা দেন। বিশ্বাস না হলে ফাইল ফুটেজ বের করে দেখুন। তখনও তার মুখে প্রশান্তির স্মিত আসি। কারণ তিনি জানতেন, এসবে তার মাথার একটি চুলও ছেঁড়া যাবে না।

কিছুদিন পর তিনি ঠিকই বিএনপিতে যোগ দিয়ে মন্ত্রিসভায় নিজের জায়গা করে নেন। কত বড় নির্লজ্জ হলে একজন মানুষ দেশের প্রধানমন্ত্রী ও উপরাষ্ট্রপতি হবার পর অন্য দলের মন্ত্রিসভায় সামান্য মন্ত্রী হতে দ্বিধা করেন না ভাবতে পারেন? নোয়াখালীর এমন আরেক নেতা ছিলেন মাহমুদউল্লাহ। বঙ্গবন্ধুর আমলে রাষ্ট্রপতি পদে থাকা এই লোক জীবন শেষ করেন বিএনপির সাংসদ হিসেবে।

মওদুদের কথায় ফিরে আসি। দেশে যুবদলের বেশ বড় পদে থাকা এক নেতার কাছ থেকে মজার একটা গল্প শুনেছিলাম। এই যুবক এখন বয়সী, আর আমার প্রিয়ভাজনদের একজন। বলছিল, স্বয়ং খালেদা জিয়াও নাকি মওদুদকে বিশ্বাস করেন না। তার কাছে জানলাম, মওদুদের দেওয়া এক পার্টিতে খালেদা জিয়া নাকি পানিও পান করেননি। গল্পটি অবিশ্বাস করার কারণ দেখি না।

কিছুদিন আগে মুন্নী সাহার পরিচালনায় এটিএন নিউজে মওদুদ আহমেদের সঙ্গে আলাপচারিতার অনুষ্ঠানটির নাম ছিল 'তুমি বন্ধু কেমন বন্ধু'। এর চেয়ে ভালো শিরোনাম আর হতে পারে না। এই মানুষটি যে আসলে কার বন্ধু আর কার দুশমন তিনি নিজেও বোধকরি জানেন না।

জনশ্রুতি আছে মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে তরুণ আইনজীবী মওদুদ আহমেদকে স্বাধীন বাংলা সরকারের পোস্টমাস্টার জেনারেলের সহকারী পদে রাখা হয়েছিল যেখান থেকে তিনি তহবিল তছরূপের মামলায় পড়েন। কথিত আছে যে, বাংলাদেশের জন্য কনসার্ট করে আমাদের পরম বান্ধব জর্জ হ্যারিসন ও রবিশঙ্কর যে অর্থ তুলে দেন তিনি সেখানেও ভাগ বসান। বলাবাহুল্য শাস্তিও হয়েছিল তাঁর।

পরে শ্বশুরের বদৌলতে বঙ্গবন্ধুর অনুকম্পায় মুক্ত হয়ে বিলেত চলে যাওয়া মওদুদ আজীবন বঙ্গবন্ধুর সরকার ও তাঁর দলের বিপরীত স্রোতে থেকে গেছেন। খাঁটি বেঈমানির এমন উদাহরণ সব দেশে দেখা যায় না।

মওদুদের আরেকটি বড় পরিচয়, চাণক্য মতে, তিনি বাদুড়ের মতো। কেবল বিপদ দেখলেই ডানা ঝাপটান। এখন যারা বিএনপির আন্দোলন 'হচ্ছে না, কেন হচ্ছে না' বলে মাথা কুটে মরেন তাদের সবসময় বলি, যতদিন মওদুদকে খালেদা জিয়ার পাশে আসল চেহারায় না দেখবেন ততদিন জানবেন আশা নেই।

নিন্দুকেরা বলে, এতদিন তিনি নাকি সরকারের একটা অংশের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখে নিরাপদে ছিলেন। জানি না হিসাবের খাতায় কোথায় ভুল হয়েছে। আজ সারাদেশে দখলকৃত বাড়ির সামনে দাঁড়ানো কালো কোট-পরা জনাব মওদুদ ও তার বাড়ি হারানোই সংবাদ শিরোনাম।

প্রথমেই প্রশ্ন করতে চাই, কী কারণে তিনি উকিলের পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছেন? ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বা ফায়ার সার্ভিসের লোকজন কি পেশার পোশাক পরে বাসায় ঘোরাফেরা করেন?

পরের প্রশ্ন, বাড়ি থেকে বেরুনোর আগেই রাস্তায় থাকবেন বলে তিনি যে সমবেদনা কুড়াতে চাইছেন সেটার জবাব কি জনগণ জানে না?

ঢাকায় তার প্রাসাদোপম একাধিক বাড়ি-জমি-সম্পত্তির কথা এখন ফেসবুকের পাতায় পাতায়। নিজেকে দরিদ্র প্রমাণ করতে গিয়ে এককালের প্রধানমন্ত্রী ও উপরাষ্ট্রপতি নিজেকে মিথ্যুক প্রমাণ করলেন আরও একবার। সবচেয়ে বড় কথা, এত বড় পদে থাকা মানুষ যদি এমন লোভী ও দখলদার হন তাহলে এই দেশ ও সমাজের ভবিষ্যত কী?

বাড়ি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করাটাই তার জন্য মঙ্গলের হবে। ইতোমধ্যে খবর বেরিয়েছে মতিঝিলে টয়োটা ভবনে তার যে অফিস, বিগত ত্রিশ বছরে তিনি নাকি ভাড়াই দেননি তার। মালিকও ভয়ে চুপ। মন্ত্রী-নেতা-কাম-ব্যরিস্টার কখন কী প্যাঁচ লাগিয়ে দেন কে জানে!

আসলে 'মাগনা পাবার মাগনা সুযোগ' ভোগ করার এক ধরনের বিকৃত আনন্দ আছে। সেটি বড় হতে হতে কখন যে সীমা পেরিয়ে ভয়ংকর হয়ে ওঠে ভোগী নিজেও জানে না। একতরফা ভোগের পর শাস্তি ও বিচারহীন থাকার সমাজে মওদুদ আহমেদ বাড়িছাড়া হতে পারেন সেটা কেউ ভাবেনি। কিন্তু সময়েরও একটা বিচার থাকে বৈকি।

আমার মতো যারা বয়সে-অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশকে কাছ থেকে দেখেছি একথা বুক ফুলিয়ে বলতে পারি, অপরাধ করে এদেশে কেউ মাফ পায়নি। লোকটি আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা এরশাদের জাতীয় পার্টি– যে দলেরই হন না কেন। শাস্তির সময়টা হয়তো কমবেশি মনে হয়, কিন্তু একসময় যুদ্ধাপরাধী খুনিরাও ফাঁসিতে ঝোলে।

মওদুদ আহমেদ সে তুলনায় তেমন কিছু নন। দেশের রাজনীতিতে তার ইমেজ কী বা কেমন সেটা একটা শিশুকে প্রশ্ন করলেও জানা যাবে। মনে আছে, একবার এক সভায় মওদুদ আহমেদের শীলিত বক্তব্যের পর পাশে বসা এক বয়স্কজন বলছিলেন, "এ মানুষ তো ঠাণ্ডা মাথায় যে কোনো কিছু করতে পারে রে, ভাই।"

যা কিছু ক্যারিশমা জৌলুস বা ইমেজ সব হারিয়ে বাড়ি-দখলদার পরিচয়ে বেঁচে থাকা একজন মন্ত্রী ও নেতার জন্য রাজনীতি লজ্জায় মুখ লুকাবে কি না জানি না। তবে আমরা সবাই ছবিটা দেখে কৌতুক অনুভব করেছি। অজান্তে নজরুল গেয়ে উঠেছেন–

"চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়।"