একজন সুলতানা কামাল ও শিক্ষিত মৌলবাদীরা

পারভীন সুলতানা ঝুমা
Published : 13 June 2017, 04:43 AM
Updated : 13 June 2017, 04:43 AM

চিলে কান নিয়ে গেল বলে চিলের পিছনে ছোটা বাঙালিদের স্বভাব। যুগ যুগ ধরে তা চলে আসছে। অন্যের কথা বিকৃত করা, অতিরঞ্জিত করা, অপব্যাখ্যা দেওয়া ইত্যাদি গুণ বাঙালি জীবনে অাষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। এসব গুণ তারা প্রয়োগ করে থাকে অনেকাংশে নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য, অন্যের অনিষ্ট করার জন্য, আবার কিছুটা স্রেফ বিনোদন পাওয়ার জন্য। সম্প্রতি হেফাজতিরা বিশিষ্ট নাগরিক সুলতানা কামালের 'কথার কথা' একটি কথাকে নিয়ে যে লম্ফঝম্ফ দিচ্ছে তাকে অবশ্যই 'নিষ্পাপ বিনোদন'-এর খোরাক হিসেবে বিবেচনা করা যায় না।

আর বাঙালি ও হেফাজতিদের এক কাতারে নেওয়াটাও অযৌক্তিক। যারা বাঙালি সংস্কৃতি বিশ্বাস করে না, তাদের বাঙালি স্বভাবদোষে দোষী করা ঠিক নয়। 'পাকিস্তানি জিনে'র অধিকারী হেফাজতিরা বাঙালিদের থেকে পৃথক– এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেকে আবার 'বাঙালি', 'বাংলাদেশি', 'বাঙালি মুসলমান' ইত্যাদি শ্রেণিভাগ করে বলেন এরা সবাই নিজ নিজ সত্তার অধিকারী।

যে চেতনায় '৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে সেখানে আমরা সবাই ছিলাম বাঙালি। এরপর পাহাড়ি ও আদিবাসীদের কথা বিবেচনা করে 'বাঙালি'-কে 'বাংলাদেশি' পরিচয়ে স্থানান্তর করা হল। সে যা-ই হোক, হেফাজতি ধরনের যে জনগোষ্ঠী আছে তারা নিজেদের 'বাঙালি' থেকে 'বাংলাদেশি' বলতে বেশি তৃপ্তিবোধ করে। হয়তো তারা 'বাংলাদেশি' শব্দটির মধ্যে 'মুসলমান', 'মুসলমান' গন্ধ পায়। যদিও এদেশের যে কোনো ধর্মের নাগরিকের পাসপোর্টে জাতীয়তা 'বাংলাদেশি' লেখা থাকে। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আজ পর্যন্ত হেফাজতিদের কোনো বিবৃতি বা কথায় 'বাঙালি' শব্দটি ভুলেও উচ্চারিত হয়নি।

একটি টিভি টকশোতে একজন হেফাজতকর্মীর সঙ্গে হাইকোর্টের সামনে থেমিস দেবীর ভাস্কর্য সরানোর বিষয়টি নিয়ে বাকবিতণ্ডার ফাঁকে সুলতানা কামালের একটি 'বেফাঁস মন্তব্য' হেফাজতিরা লুফে নিয়েছে এবং তা বাজারজাতকরণে উঠেপড়ে লেগেছে। 'বেফাঁস' বলছি এ কারণে যে, অনেক প্রগতিশীল ও নীতিনির্ধারকরাও সুলতানা কামালের এ বক্তব্যর সমালোচনা করছেন, কী পরিপ্রেক্ষিতে তিনি কথাটা বলেছেন তা সেইসব প্রগতিশীল যেমন জানতে চাননি তেমনি হেফাজতিরাও তাদের 'স্বভাবসুলভ' নিয়মে বিষয়টি উপেক্ষা করে গেছে।

বিষয়টি সবার জানা, অন্ততপক্ষে যারা এ ঘটনা নিয়ে কৌতুহলি। হেফাজতের কর্মীটি বলেছিলেন: "হাইকোর্ট প্রাঙ্গন থেকে সকল ধর্মীয় স্থাপনা সরিয়ে নেওয়া উচিত।"

তার এই কথার সূত্র ধরে সুলতানা কামাল বলেন: "আমিও আপনার সঙ্গে একমত। হাইকোর্টের সামনে কোনো ধর্মীয় স্থাপনা থাকা উচিত না, তাহলে মসজিদও থাকা উচিত না।"

হয়তো তাদের কথপোকথন হুবহু হয়নি, তবে অনেকটা এমনই।

এরপর একটা উন্নত দেশে হলে যা হত, সুলতানা কামালের এই মন্তব্য কেন সঠিক নয় তার একটা চুলচেলা বিশ্লেষণ হত। একটা ভালো বিতর্ক এদেশের মানুষ দেখতে বা শুনতে পারত এবং পরবর্তী প্রজন্ম এর থেকে শিক্ষণীয় কিছু গ্রহণ করতে পারত। যৌক্তিক বিতর্কে না গিয়ে সুলতানা কামালের 'হাড়-মাংস' এক করার যে ব্রত হেফাজতিরা নিয়েছে তা তাদের জন্য স্বাভাবিক বিষয়। তারা কারোর হাড়-মাংস, কারোর কল্লা চাইবে। এবং তাদের ভয়ে সেই হাড়-মাংস বা কল্লার অধিকারীদের দেশত্যাগ করতে হবে। এ ধরনের ঘটনা তো স্বাধীনতার পর থেকে দেখে আসছি।

গণতান্ত্রিক সরকার, সামরিক সরকার, আধা সামরিক সরকার, স্বৈর সরকার, কখনও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। দাউদ হায়দার থেকে শুরু করে তসলিমা নাসরিন। তাদের ভাগ্যে এসব ঘটেছে একটি সরকারের আমলে নয়, ভিন্ন ভিন্ন সরকারের আমলে। দেশে থাকছে কারা, আর দেশ ত্যাগ করছে কারা? যারা এদেশের স্বাধীনতা মানে না, যারা মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করে, যারা মুক্তিযোদ্ধাদের 'জারজ সন্তান' বলে, তারা দিব্যি এদেশে থেকে যায়, ব্যবসাবাণিজ্য করে সরকারি পদ পায়, সরকারি সুয়োগসুবিধা পায়, সরকারের জমি পায়, আনুকূল্য পায়।

যারা মুক্তমনা, যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, যে চেতনা আমাদের মুক্তিযুদ্ধর অনুপ্রেরণা তাকে বুকে ধারণ করে, তারাই এদেশ থেকে বহিষ্কৃত হয়। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ তারা পরভূমিতে বসবাস করে। কোনো সরকারই তাদের ফিরিয়ে আনার মতো 'সাহস' দেখাতে পারে না। সাহস দেখাতে পারে না সাম্প্রদায়িক কদর্য ও মধ্যযুগীয় মনমানসিকতার ধারকদের বিরুদ্ধে যেতে।

হতভাগ্য আমরা, হতভাগ্য আমাদের দেশ।

সেসময় দাউদ হায়দার তার একটি কবিতায় হজরত মুহাম্মদ (সা.), যিশু খ্রিস্ট আর গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে 'অবমানকর' মন্তব্য করার অভিযোগে মৌলবাদীরা খেপে যায়। হ্যাঁ, তখনও মৌলবাদীদের আস্ফালন ছিল।

১৯৭৩-৭৪ সালের কথা। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ। এরপরও তাদের ক্ষমতার কমতি ছিল না। দাউদ হায়দারকে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে কলকাতায় পৌঁছে দেওয়া হয়। সেখান থেকে জার্মানি। বঙ্গবন্ধুর সরকারও কেন মৌলবাদীদের এভাবে পুছল?

অনেকের মতে তখন সদ্যস্বাধীন দেশে ইসলামি রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন প্রয়োজন ছিল, এ কারণে তখনকার সরকার বাধ্য হয় দাউদ হায়দারকে নির্বাসনে দিতে। এখনকার সরকার তো সে তুলনায় অনেক শক্তিশালী। আমরা এখন আর সেভাবে বৈদেশিক সাহায্যর উপর নির্ভরশীল না। আমরা এখন দরিদ্রতম দেশ নই, মধ্য আয়ের দেশ। তারপরও আমরা সেই মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে তোয়াজ করে যাব?

যে সরকারপ্রধান পৃথিবীর শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মুখের উপর নিজেদের গ্যাস না দেওয়ার কথা বলার সাহস দেখাতে পারেন, সেই সরকারপ্রধান কেন মৌলবাদীদের তোয়াক্কা করছেন, বোধগম্য নয়। মৌলবাদীদের সরকারি সমর্থন কতটা ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি অনুগত থাকা আর কতটা নিজ ভোটের বা আন্তর্জাতিক রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচের ব্যাপার তা বোঝার মতো ক্ষমতা আমাদের মতো গণ্ডমূর্খের থাকার কথা নয়। কিন্তু আমরা যারা ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করি এবং সেভাবে থাকতে চাই তাদের জন্য মৌলবাদীদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব শুধু স্বচ্ছন্দে জীবন চলার প্রতিবন্ধকতা নয়, জীবন সংহারেরর ত্রাস তৈরি করে।

১৯৭৩-৭৪ সালে দাউদ হায়দারের বিরুদ্ধে তথা সরকারের পক্ষে তৎকালীন ক্ষমতাশীল দলের অঙ্গ সংগঠন বা স্বয়ং বঙ্গবন্ধুকে বিরূপ মন্তব্য করতে শোনা গেছে কি না, জানি না। নিশ্চয়ই না। সেসময় যারা এসব বিষয়ে সচেতন ও সক্রিয় ছিলেন এবং এসব বোঝার বয়স হয়েছিল তারা বলতে পারবেন।

এখন রাজা যত না বলে পরিষদবর্গ তার থেকেও বেশি বলে। নারয়ণগঞ্জের সেই 'অতিভদ্র' রাজনীতিবিদ তো সুলতানা কামালকে 'বদমাইশ' বলে বসলেন। যার যা স্বভাব তার মুখ থেকে সেরকম কথাই বের হবে। ধর্মের ফেক ধরার মতো সহজ এদেশে আর কিছুই নেই। কোনো কোনো রাজনীতিবিদ মনে করেন, ধর্মের অনুভূতির মতো একটা বিমূর্ত বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারা হচ্ছে জনগণের কাছে যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায়। আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী, লতিফ সিদ্দিকির মতো ব্যক্তিদেরও ধমীয় অনুভূতির সুড়সুড়ি সহ্য করতে হয়েছে। উনারা কী বলতে চেয়েছেন আর কী ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনার প্রশ্নই আসে না। কথার আগাপাছা বাদ দিয়ে জনসমক্ষে অন্যদের কটূক্তি করা মৌলবাদী, প্রগতিশীল সবার কাছেই সহজলভ্য আমোদ। সমাজে সম্মানীয় বর্ষিয়ান ব্যক্তির বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করে যা ইচ্ছা বলার স্বাধীনতা রয়েছে সবারই। তবে সেটি ক্ষমতাবানদের ধামাধরাদের জন্য শুধু প্রযোজ্য।

কবি নজরুল ইসলাম যখন 'মৌলভী'-কে 'মৌ-লোভী' আখ্যায়িত করেছিলেন, তখন মৌলভীরা তাঁকে 'মুরতাদ' ঘোষণা করে। কিন্তু সে কারণে তাঁকে পালিয়ে বেড়াতে হয়নি। বেগম রোকেয়া ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে বলেছিলেন:

"আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগুলোকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রচার করিয়াছেন।"

ভাবা যায়? তসলিমা নাসরিনের চেয়েও 'সাংঘাতিক' কথা বলেছেন তিনি। তখন তাঁর গর্দান কেউ খুঁজছিল, এমনটি শোনা যায়নি। বরং শিক্ষিত মহলে তিনি ছিলেন একজন সম্মানীয় ব্যক্তি। আজ ধর্মের অনুভূতি নিয়ে তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তিরাও যেমন সুড়সুড়ি দিতে পছন্দ করে তাতে বোঝাই যায় হেফাজতিদের মতো তারাও ধর্মকে এমন এক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চান যার দ্বারা তারা তাদের আখের গোছাতে পারেন।

হেফাজতিদের পাত্তা না দেওয়ার দলেও অনেক মানুষ রয়েছে। কিন্তুু 'কুকুরের কাজ কুকুর করেছে' বলে বসে থাকা তখনই সম্ভব যখন সেইসব পাগলা কুকুরকে মিউনিসিপলির লোকেরা ধরে নিয়ে যায়, কিন্তুু কুকরের কামড়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে যখন আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় তখন বিপদের আশঙ্কা বাড়তেই থাকে।

যতদিন ধর্ম নিয়ে সুড়সুড়ি দেওয়ার কাজ অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত মোল্লাদের ছিল ততদিন সমাজে ততটা বিপদ দেখা যায়নি। যখন তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তিরা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা বা অপব্যাখ্যা শুরু করল তখনই সমাজে মহাবিপদ সংকেত দেখা দিল। এসব শিক্ষিত এমনকি উচ্চশিক্ষিতরা এমন সব বয়ান করে যাতে মনে হয় সমাজের অগ্রগতি সেই মধ্যযুগে আটকে রাখাই সবচেয়ে ভালো পন্থা, বিশেষ করে নারীদের বা নারী অধিকার নিয়ে এদের মনমানসিকতা অত্যন্ত দুঃখজনক।

একটি সংগঠনের উচ্চপদে আসীন এক নারী যিনি নারী অধিকার বিষয়ক বিভিন্ন সভা-সমিতিতে অংশ নিতে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ান, দুঃখ করে বলছিলেন, যতদিন সৌদি আরব বা মৌলবাদী রাষ্ট্রগুলো থেকে এসব সভায় কেউ যোগ দিত না ততদিন তেমন কোনো অসুবিধা ছিল না। এখন ওখান থেকে 'শিক্ষিত' নারীরা যাচ্ছে এবং তারা নারী বিষয়ক তাদের সেই রক্ষণশীল অবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে।

এসব জ্ঞানপাপীরা সমাজকে পিছিয়ে নিয়ে যেতে বড় ভূমিকা পালন করছে। এদেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ মুসলিম– এ মন্তব্য ইদানীং এত শোনা যাচ্ছে যে, মনে হয় গত ২০-৩০ বছর আগে এদেশে মুসলমানরা যেন শতকরা ৩০ ভাগ ছিল। চর্বিত-চর্চিতভাবে শুধু মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতির কথা বলা হয়। আর সব ধর্ম অনুসারীরা যেন অনুভূতিহীন।

যারা এর ওর কল্লা বা হাড়-মাংসের দাবি করে তারা শুধু পার পেয়ে যায় না, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদের কাছ থেকে সহানুভূতি এমনকি সমর্থনও পেয়ে থাকে। আর অনেক প্রগতিশীল নিজেদের গা বাঁচানোর জন্য নিলির্প্ততা বেছে নেন।

মনে রাখতে হবে লোকালয়ের আগুনে দেবালয়ও পোড়ে।