অনেক দিন ধরে চললেই অন্যায্য ন্যায্য হয়ে যায় না

ডা. মো. খায়রুল ইসলাম
Published : 5 June 2017, 02:19 PM
Updated : 5 June 2017, 02:19 PM

ব্যাংক খাতে আবগারি শুল্ক নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। সরকার ও তার সমর্থকরা বোঝাবার চেষ্টা করছেন যে, ব্যাংক সেবায় আবগারি শুল্ক তো অনেক বছর ধরেই ছিল, এখন শুধু শুল্কহার একটু বাড়ানো হয়েছে। দেশের উন্নয়নের স্বার্থে তা মেনে নেওয়াই ভালো। কেউ কেউ যুক্তি দিচ্ছেন যে, এতে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বিমুখ হয়ে আমানতকারীরা ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ করবেন। ফলে বিনিয়োগের চাকা ঘুরে আরও কর্মসংস্থান হবে, দেশের উন্নয়নে তা সহায়ক হবে।

স্রোতের বিপক্ষে দাঁড়ানো বড় অংশ দাবি করছেন এটা দিনেদুপুরে ডাকাতির সামিল। সরকার জোর-জুলম করছেন। এতে অনেকেই ব্যাংকবিমুখ হবেন, অন্যত্র বিকল্প খুঁজবেন। ফলে অনেকের কষ্টার্জিত সঞ্চয় ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। ব্যাংকারদের বেশিরভাগও এর বিপক্ষে মতামত দিচ্ছেন। এফবিসিসিআই বলেছে আবগারি শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যহার করে নিতে। বাংলাদেশ ব্যংকের প্রাক্তন গভর্নর এ নিয়ে নেতিবাচকতা আরও ছড়াবার আগেই সরকারকে এটা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেবার আহ্বান জানিয়েছেন।

যে টাকা ব্যাংকে রাখা হয়, তা ব্যবসায়ীরই হোক কী চাকুরীজীবীর, টাকার উপর আয়কর দেওয়া হয়। যদি টাকাটা চাকুরীজীবীর হয় তাহলে তো কথাই নেই, উৎসে আয়কর কাটার পরেই চাকুরীজীবীর টাকা ব্যাংকে আসে। কাজেই যে পরিমাণ টাকাই ব্যাংকে থাকুক না কেন তা আয়কর দেওয়া বা দেওয়া হবে। যদি এর ব্যত্যয় হয় তবে তা হবে আয়কর বিভাগের সক্ষমতার অভাবে বা অন্য কোনো সমঝোতায়।

ব্যাংককে ব্যবসা করার অনুমতি দিয়েছে সরকার। ব্যাংকগুলো যে মানুষের টাকা তাদের ব্যংকে রাখে তা দয়া করে রাখে না। আমানতকারীরা ব্যাংককে রীতিমতো বাৎসরিক সার্ভিস চার্জ দেন। সেই সার্ভিস চার্জের উপর সরকার ভ্যাট আদায় করেন ১৫ শতাংশ হারে। এরপর ব্যাংক যে কোনো সেবার জন্য আলাদা করে সার্ভিস চার্জ আদায় করেন। যেমন, চেক বইয়ের পাতার জন্য, ঢাকার বাইরে থেকে চেক এলে তা ক্লিয়ার করার জন্য, ইত্যাদি। এসবের একটা বিরাট তালিকা আছে যা বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন করে দিয়েছেন।

এর বাইরেও ব্যাংক অনেক সময় নানা প্রকার নতুন শব্দ দিয়ে টাকা কেটে নেয়। যেমন, একবার দেখলাম লিখেছে, রিলেশনশিপ ফি ৫০০ টাকা। এই নানা প্রকার মাশুলের সঙ্গে অবধারিতভাবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট কাটা হচ্ছে। আমানতের বিপরীতে যে সুদ আসে তার উপর উৎসেই ব্যাংক টিআইএন থাকলে ১০ শতাংশ আর না থাকলে ১৫ শতাংশ হারে আয়কর কেটে নেওয়া হচ্ছে। এ সমস্ত কিছু কাটার পরও গত প্রায় ১৫-২০ বছর ধরে ব্যাংক একাউন্ট থেকে আবগারি শুল্ক কেটে নেওয়া হচ্ছিল।

আমি ব্যক্তিগতভাবে ২৮ বছর ধরে নিয়মিত আয়কর দিই। প্রায় ২০ বছর যাবত আমাকে ব্যাংক বিবরণী জমা দিতে হয়। ঠিক কবে থেকে আবগারি শুল্ক আরোপিত হল সঠিক মনে পড়ে না। তবে মনে হয় শুরুতে এ অংক ছিল ১০০ বা ১৫০ টাকা। সরকার বাজেটে ঘটা করে না বলে চুপচাপ এসআরও করে হার বাড়িয়ে নিয়েছে। আবার কখনও বছরে দু কিস্তিতে টাকাটা কেটে নিয়েছে যাতে আমানতকারীরা তেমন একটা টের না পায়। এভাবেই আবগারি শুল্কের বাৎসরিক অংক ধীরে ধীরে ৫০০ টাকায় এসে দাঁড়িয়েছিল।

সম্পূর্ণ তালিকা উল্লেখ না করে ৫০০ টাকা উল্লেখ করলাম, কারণ আমি এই স্ল্যাবের অন্তর্ভুক্ত। এই হার যখন ৫০০ থেকে ৮০০ টাকায় এবারের প্রস্তাব করা হল তখন একটা বিস্ফোরন ঘটল। একেই বলা হয়েছে গুপ্ত সুপ্ত ইস্যু অগ্নিগর্ভ বানানো। মনে হয় বাজেটের অনেক ইস্যুর মধ্যে কেন এই বিষয়টি এমন নেতিবাচকতার জন্ম দিল তা সরকার ও সরকার সমর্থকদের বোঝা দরকার।

প্রথমত বুঝতে হবে যে, এটি একটি উপলক্ষ মাত্র। এখানে শুল্কের টাকার অংকের বৃদ্ধি কেন্দ্র করে মানুষের মনের সুপ্ত ক্ষোভ প্রকাশিত হচ্ছে। এই ক্ষোভ হল, ব্যাংক খাতের বিশৃঙ্খলা-কেন্দ্রিক, রাজস্ব আদায়ে অপ্রমাণেয় প্রক্রিয়া-কেন্দ্রিক এবং অন্যায্যতার অনুভূতি-কেন্দ্রিক। ব্যাংক খাতে দুর্নীতির ব্যাপারে নিস্পৃহ থাকা, একের পর এক ঘটনা ঘটে যাওয়া সত্ত্বেও দৃশ্যমান পদক্ষেপ না নেওয়া, রাঘব বোয়ালের বদলে চুনোপুঁটি ধরা এবং সর্বোপরি জনগণের করের টাকায় নিমজ্জমান ব্যাংকগুলো বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা। জনগণ এসব ভালোভাবে নেয়নি।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্থমন্ত্রীর অসংবেদনশীল কথাবার্তা এবং সাম্প্রতিককালে ব্যাংক আইনে পরিবর্তনের প্রক্রিয়া। এ রকম অবস্থায় অনেক নাজুক প্রশ্ন উঠছে, সরকার কি দুর্নীতি দমনে আন্তরিক? তাহলে সংসদে দাঁড়িয়ে খোদ অর্থমন্ত্রীকে ব্যাংক-লুটের বিষয়ে তাঁর অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে হয়? আমাদের করের টাকা নিয়ে কয়েকটি ব্যাংককে বাঁচানোর নামে দুর্নীতি লালন করা হচ্ছে কি?

নাগরিক অধিকার এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে এমন কথা এখন সবার মুখে মুখে এবং ক্ষোভের মূল সেখানেই।

বুঝতে হবে যে, এমন সময়ে এই আবগারি শুল্ক হার বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে যখন আমানতের উপর সুদ স্মরণকালের সর্বনিম্ন। ব্যাংকগুলো যে বাৎসরিক সুদ দেবে মুদ্রাস্ফীতির হার তার চেয়েও বেশি। ফলে এমনিতেই আমানত একপ্রকার নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে রয়েছে। তার উপর এই অতিরিক্ত শুল্ক বোঝার উপর শাকের আঁটি নয় বরং তার চেয়েও ওজনদার মনে হচ্ছে।

বেসরকারি খাতের চাকুরীজীবীরা যারা সবচেয়ে নিয়মিতভাবে আয়কর দেন এবং দিতে বাধ্য হন তাদের ক্ষোভ সবচেয়ে বেশি। কারণ নিয়মিত আয়কর দিয়েও নথি হালানাগাদ করতে জান বেরিয়ে যায়। তাদের জন্য পেনশন নেই। সরকারকে সততার সঙ্গে সারা চাকুরিজীবন আয়কর দিয়ে অবসর নেওয়ার পর তাঁকে সরকার কী দেবে? তারই করের টাকায় তাঁর সতীর্থ সরকারী চাকুরিজীবী যে সুবিধা পাবে তার ছিটেফোঁটাও সে পাবে না। উপরন্তু তাঁর অবসরের টাকা থেকে কেটে নেওয়া হবে আবগারি শুল্ক! অংকটি যাই হোক, তাঁর কাছে এই প্রস্তাবনা একবারেই অন্যায্য বা জুলুম বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক।

যারা ভাবছিলেন এতে লোকজন ব্যাংক খাত থেকে সরে নতুন নতুন বিনিয়োগ করবেন তাদের বলব বাস্তবতা মিলিয়ে দেখতে। বিনিয়োগের জন্য মানুষ প্রথমেই খুঁজে নিরাপত্তা। শেয়ার মার্কেট কতটা নিরাপদ তা তো সবার জানা। বাকি রইল সঞ্চয়পত্র। এর বাইরে মানুষ কোথায় যাবে? কী উপদেশ দেবেন মানুষকে? যারা এর পক্ষে বলছেন নিজে কী করেছেন বুকে হাত দিয়ে ভাবুন তো। সাধারণ মানুষ চাকুরি করবে নাকি ব্যবসার জন্য ঘুরবে? বিনিয়োগের পক্ষে এই যুক্তি এবং অনুমান একান্তই তত্ত্বীয়।

আমার মনে হয়েছে এই ভাবনার জন্মদাতা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। তারা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য সহজ কিছু পথ বেছে নিয়েছে। ব্যাংক আমানতে আবগারি শুল্কের হার বাড়ানো এরকম একটা সহজ পথ। যারা বাজেট বাস্তবায়নে সক্ষমতার ঘাটতির কথা বলেন তাদের জন্য এটা একটা চমৎকার উদাহরণ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড হয়তো এ প্রস্তাবে এরকম প্রতিক্রিয়া আশা করেনি। তারা হয়তো বুঝতে পারেনি যে, লেবু চিপে রস বের করা হয়ে গেছে। যা প্রস্তাব করা হয়েছে তা লেবুর খোসা চিপে তিতা রস বের করার মতো।

তবে এই আলোচনা আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে: ব্যাংকের আমানতের উপর আবগারি শুল্ক আরোপ আদৌ ন্যায্য কিনা। প্রশ্নটির উত্তরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড হয়তো পক্ষে অনেক কিছু বলবে। কিন্তু প্রতিবেশি দেশসহ বিভিন্ন দেশের ব্যাংক খাতের এরকম আবগারি শুল্কের আরোপ দেখা যায় না। সচরাচর আবগারি শুল্ক স্বাস্থ্যহানিকর পণ্যের উপর উৎপাদনকালে আরোপ করা হয়। বাংলাদেশেও সেরকমই প্রচলিত। সেবা খাতে এর প্রয়োগ হয়েছে বলে জানা নেই।

আয়কর দেওয়া টাকা ব্যাংকে রাখা হচ্ছে, ব্যাংক সেবা দেওয়ার জন্য নির্ধারিত হারে মাশুল নিচ্ছে, সেই মাশুলের উপর ভ্যাট কাটা হচ্ছে, তাহলে আবার কেন আবগারি শুল্ক দিতে হবে? ব্যাংক-সেবা স্বাস্থ্যহানিকর সেবা নয়। কাজেই ব্যাংক আমানতে আবগারি শুল্কের আরোপ একেবারেই অন্যায্য। এটি পুরোপুরি তুলে দেওয়া উচিৎ।

হয়তো অর্থমন্ত্রী বলবেন, "ঠিক আছে, বাড়তি হার নেওয়া হবে না– এতদিন দিচ্ছিলেন যখন বাড়তি হারে না দেন, চলমান হারে তো দেবেন।"

আমাদের উত্তর হবে, "না; একটি অন্যায্য অনেক দিন ধরে চললেই তা ন্যায্য হয়ে যায় না। সামরিক শাসনের সকল ফরমান প্রায় ৩০ বছর ধরে আইনসম্মতভাবে চলে আসছিল। প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক ও তাঁর সাথী বিচারকবৃন্দ সামরিক শাসনের ৩০ বছরের ফরমান এক রায়ে বাতিল করে দিয়েছেন। বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে চললেই বেআইন কখনও আইন হয়ে যায় না; অন্যায্য ন্যায্য হয় না। কাজেই দেরিতে হলেও এই অন্যায্য শুল্ক সম্পূর্ণভাবে তুলে নেওয়া উচিত।"