উন্নয়নের মহাসড়কে আমাদের গন্তব্য: বিপত্তি আর সতর্কীকরণ চিহ্নসমূহ

মাকশুমুল হক
Published : 6 Nov 2011, 08:05 AM
Updated : 7 June 2017, 01:13 PM

চার লক্ষ কোটি সংখ্যাটি ভাবতে গেলে আমার মতো অনেকেরই আসলে দৃশ্যমান ফ্রেমে আনতে কষ্ট হবে। বাঁ থেকে শুরু করে ডানে যেতে যেতে হয় চার হারিয়ে যাবে নয়তো ডান থেকে বাঁয়ে আসতে আসতে দু'চারটা শূন্য টুপটাপ পড়ে যাবে।

স্বাধীনতার পর বাজেটের সংখ্যাটি মাত্র সাতশ ছিয়াশি দিয়ে শুরু হয়ে আজ চার লক্ষে পৌঁছেছে। লাখের ঘর পার করেছে বছর দশেক আগে মাত্র। হামাগুড়ি দিতে, হাঁটতে, দৌড়ুতে শিখতে বেশ অনেকটা সময় লেগেছে ঠিকই, কিন্ত দৌড়ুনো যখন একবার শিখে গেছে আমাদের অর্থনীতি তখন থেকেই আর পিছু ফেরা নেই, ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছেই।

সংখ্যায় যেহেতু বোঝা গেল না ব্যপারটা তো নাহয় আমরা জীবনমান নিয়েই খানিক তুলনা করি।

আশি-নব্বইয়ের দশকে উচ্চবিত্তরা কোটির ঘর ছাড়িয়ে বাড়ি করলে অনেকেই তা দূর-দূরান্ত থেকে দেখতে আসত। আমার মনে আছে, চট্টগ্রামে আগ্রাবাদ সিডিএ. যা ছিল একসময়কার উচ্চবিত্তের লোকালয়, সেখানে প্রথম কোটি টাকার বাড়ি করেন মার্কিনপ্রবাসী একজন। লোকজন দূর থেকে যাওয়ার সময় আঙুল তুলে বলাবলি করত, এটা সেই বাড়ি। আর এখন পত্রপত্রিকায় দেখতে পাই অনেক উচ্চবিত্তের ছেলেদেরই মাসে পার্টি-নেশা-বান্ধবীদের পেছনে কোটি টাকার বরাদ্দ থাকে।

তখন রিকশা চড়ে বাজারে গিয়ে সপ্তাহে দুচারবার মাছ-মাংস কেনার টাকা হয়তো মধ্যবিত্তের পকেটে থাকত, কিন্ত কিছুদিন পরপর ছুটিতে ঘুরতে যাওয়ার মতো সঞ্চয় থাকত না। আর এখন মধ্যবিত্ত দামি গাড়িতে চড়ে, হুটহাট এমেক্স লাউঞ্জে চেক-ইন দেয়, বছরে দুএকবার দেশের বাইরে হাওয়া-বদলে যায়।

আর নিম্নবিত্ত কিংবা দরিদ্র? টিভি, ফ্রিজ থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় ইলেকট্রনিক গেজেট এখন অনেকেরই আছে। শ্রমের দাম বেড়েছে অনেকগুণ, সে গ্রামের জমিতে চাষার শ্রমই হোক কিংবা ইট কাঠের শহরের রাস্তায় রিক্সাচালকের।

বিভিন্ন প্রাকৃতিক বা সামাজিক সমস্যার কারণে চূড়ান্ত দারিদ্রসীমায় যে কেউ নেই তা বলছি না, তবে এখানে বলছি সাধারণ চিত্রের কথা। বাসাবাড়িতে কাজের লোক যখন অনেক বেতন দিয়েও পাওয়া যায় না বলে মা আফসোস করেন তখন বুঝতে পারি আমাদের অর্থনৈতিক উত্তরণ সঠিক পথেই আছে। যে সময়টাতে বিশ্বমন্দায় অন্যরা পেছন দিকে হেঁটেছে, বাংলাদেশ তখন দৃপ্ত পায়ে সামনেই এগিয়েছে।

নব্বইয়ের দশকের পর থেকে আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা– প্রায় সব ক্ষেত্রেই পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। বিশেষত শিক্ষায় উন্নয়ন বহির্বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। শতভাগ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে বিনামূল্যে বই বিতরণ, মাধ্যমিক পর্যন্ত উপবৃত্তি প্রদান এর অসাধারণ কিছু উদাহরণ। মাস ছয় আগে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে পারিবারিকভাবে গড়ে তোলা ভাঙাচোরা স্কুলঘরের চেহারা দেখি সম্পূর্ণ বদলে গেছে। ভেতরে গিয়ে শিক্ষিকাদের সঙ্গে আলাপ করে উপলব্ধি করতে পারলাম, সরকারিকরণের সঙ্গে সঙ্গে স্কুলগুলোর দেখভালের কাজ বেশ আন্তরিকভাবেই করা হচ্ছে। পাশের হার বেড়েছে অনেক। পরীক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন এসেছে।

ঠিক একইভাবে অর্থনৈতিক সূচকে পরিবর্তনের সঙ্গে উন্নয়ন এসেছে স্বাস্থ্যসেবা, নারীর ক্ষমতায়ন, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি, সর্বক্ষেত্রে। এত এত উন্নয়ন সূচক নিয়েও ঠিক কোথায় যেন হিসাবগুলো গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে। মাঝেসাঝেই এখানে-সেখানে ভয়ংকরভাবে তাল কেটে যাবার মতন।

২ মেতে আকস্মিক একটি খবর বেরোয় পত্রিকার পাতায়, ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির তথ্যমতে, ২০০৫ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭২,৮৭২ কোটি টাকা। তার মানে হল, উপরে উল্লিখিত বিষয়সমূহের বাইরেও সূচক লোকচক্ষুর আড়ালে আরও বেশ কিছু ক্ষেত্রেই এগিয়েছে! যদিও অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য হল "এগুলো রংচঙ দিয়ে বলা হয়। আমাদের অর্থপাচার খুব বেশি নয়।"

খুব স্বাভাবিক। উনি ম্যক্রো দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন। যেমন হলমার্ক ঘটনার পর বলেছিলেন, সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা বড় অঙ্কের অর্থ নয়। আমরা যারা সাড়ে চার লক্ষ কোটি সংখ্যাটা ভিজ্যুয়ালাইজ করতে পারি না তাদের জন্য অঙ্কগুলো অনেক বড় বলে ভ্রম হয়!

আবার সেই মুহিত সাহেব যখন বলেন– 'ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে লুটপাট হয়েছে, সেটা শুধু পুকুরচুরি নয়, সাগরচুরি'– তখন সেই চুরির ব্যাপ্তি নিয়ে আমরাও সংশয়ে পড়ে যাই।

যুগান্তরের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ফ্লাইওভার নির্মাণে বাংলাদেশের খরচ দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি। উদাহরণ, মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার– শুরুতে যার প্রকল্প-ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৫০ কোটি টাকা তা ধাপে ধাপে বেড়ে দাঁড়ায় ২৩০০ কোটি টাকা। যা ছয় গুণের বেশি।

কাজেই দেখা যাচ্ছে সূচক আমাদের অর্থনীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দুর্নীতিতে এবং তার উল্লম্ফন উন্নয়ন সূচকটি নিশ্চিতভাবে ছাড়িয়ে গেছে। আর তাই বাজেটের অংক যত বাড়ে তা ঘিরে শঙ্কাও বাড়ে।

এদিকে জিপিএ ৫ পাওয়ার সংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে প্রশ্নফাঁস। ২০১৭তে এসে তো ফলাফল ফাঁসেরও ঘটনা ঘটে গেল যদিও প্রশ্নফাঁসের ঘটনা সরকারিভাবে আজ পর্যন্ত স্বীকার করা হয়নি। প্রতিটি পরীক্ষার আগেই বেশ তর্জন গর্জন করে এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা দেওয়া হলেও ফলাফল যে-কে-সেই। পরীক্ষার আগের রাতে অতীতে ছাত্রছাত্রীরা বইয়ে ডুব দিয়ে থাকত। এখন এক চোখ অনলাইনে ব্যস্ত রাখতে হয়। তাদের সঙ্গে বাবা-মায়েরাও প্রশ্নের খোঁজে নির্ঘুম রাত পার করেন। ফলাফলে মুড়ি-মুড়কির মতো জিপিএ ৫ পাওয়ারাই এসে আবার আটকে যাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মেডিকেল ভর্তিপরীক্ষায়।

ঠিক এরকম আরও অনেক সূচক বেড়েছে। বেড়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক হয়রানি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নিষ্পেষণ, পাহাড়ে সেটেলার আর সামরিক বাহিনীর আগ্রাসন, শিশু ও নারীধর্ষণ ও নির্যাতন, রাজনৈতিক দল ও সরকারি বাহিনী কর্তৃক চাঁদাবাজি ইত্যাদি।

এ সবের সঙ্গে দিনমান অভিযোজন দিয়ে চলেছে আমাদের সামাজিক ও ধর্মীয় আচার, মূল্যবোধ আর চিন্তা-চেতনা। নব্বইয়ের দশকের পর থেকে আমাদের সম্ভাষণ-রীতি কেমন যেন পরিবর্তিত হয়ে যেতে লাগল। 'কেমন আছেন'এর উত্তরে 'ভালো আছি'এর জায়গা দখলে নিল 'আলহামদুলিল্লাহ' বা 'ইনশাল্লাহ ভালো আছি'। রমযানের শুভেচ্ছা হয়ে গেল 'রামাদানুল কারিম'।

ধর্মানুভূতি ধীরে ধীরে প্রখর হতে লাগল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের। নব্বইয়ের শেষদিকে কিংবা দুহাজারের প্রথম সময়টাতেও ব্যস্ত রাস্তায়, ঈদ শপিংএ, অনুষ্ঠানে-আয়োজনে হিজাব-পরিহিতার সংখ্যা হাতে গোণা যেত। এখন হিজাবহীনের সংখ্যা গোনা যায়। এর মানে এই নয় যে, মেয়েদের অংশগ্রহণ কমে গেছে আমাদের চিরায়ত উৎসবে-আয়োজনে। বরং ছেলেমেয়েনির্বিশেষে অংশগ্রহণ বহুগুণে বেড়েছে। এটা একটা অদ্ভুত বৈপরীত্য যা আমাদের পরিচয় সঙ্কট প্রকাশ করে।

অনুভূতিপ্রবণতা আবার সব ক্ষেত্রে বেড়েছে বলা যাবে না। ক্ষেত্রবিশেষে কমে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। আমরা দারুণ সহনশীল হয়েছি দুর্নীতি বিবেচনায়। ঘুষগ্রহণ, অর্থ-আত্মসাৎ, শক্তিমানের তোষামোদ করে কাজ পাওয়া– এগুলো আমরা এখন আর ঠিক পাপ বা অপরাধ হিসেবে ধরি না। আমাদের মূল্যবোধগুলো পরিবর্তিত হচ্ছে। অপরাধ পাশ কাটিয়ে যাওয়া, দুর্নীতিতে অংশগ্রহণে এখন আমরা আগের চেয়ে অনেক বেশি সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত। কাজ করে দেবার প্রতিশ্রুতিতে ঘুষের টাকা পকেটে রেখেই আমরা নামাজের সময় টুপি মাথায় দাঁড়িয়ে যাই। সন্তানদের মধ্যেও একই মূল্যবোধ প্রবাহিত। ন্যুনতম প্রচেষ্টায় দ্রুততম সময়ে সাফল্য আজ সবার লক্ষ্য।

তাই উন্নয়নের গুণগত মাণের চেয়ে সংখ্যাগত সমৃদ্ধি দেখিয়ে রাজনৈতিক জয় ধরে রাখতে সরকারও নিবিড়ভাবে প্রচার করে চলে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক কিংবা সমষ্টিগতভাবে, সর্ব ক্ষেত্রেই এখন সাফল্য প্রদর্শনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। সন্তানের শিক্ষাগত অর্জনই হোক আর জিডিপির প্রবৃদ্ধি হোক, সবাই সংখ্যার মাপকাঠিতে তার মূল্যায়নে বিভোর। গুণগত মানের বাছ-বিচার নেই।

দুর্নীতি আর ধর্মীয় লেবাস আজ মিথোজীবী, পারস্পরিক নির্ভরতায় একটি আরেকটির অবস্থান শক্তিশালী করে তুলেছে দিনকে দিন। যারা ব্যাংক থেকে সাধারণ জনগণের টাকা মেরে দেয়, তারাই মাদক থেকে শুরু করে হুন্ডি কিংবা আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে– তারাই রাজনীতি করে– উপাসনালয়ে ডোনেশন দিয়ে সমাজের মান্যবর হয়ে থাকে।

মাস ছয়েক আগে দেশের মাটিতে নেমেছি। সেদিন শুক্রবার। সকাল এগারোটার মতো বাজে। গাড়ি এয়ারপোর্ট সীমানা ছাড়িয়ে লোকালয়ে ঢুকতেই প্রথম যে চীৎকার কানে ভেসে এল তা হল 'মুসলমানদের ধ্বংসের ষড়যন্ত্র আজ আমার এই দেশে'। মসজিদের মাইক থেকে হুযুরের গগনবিদারী হুঙ্কার। বুঝলাম জুমার বয়ান শুরু হয়ে গেছে বেশ আগেভাগেই এবং যথারীতি ধর্মীয় হিংসাত্মক বাণী প্রচার চলছে। যদিও বাস্তবতা হল, মুসলমান ছাড়া অন্য সকল সংখ্যালঘুদের উৎখাতের দারুণ উৎসব দেশজুড়ে, তারপরও তৌহিদী জনতাকে সর্বদা উদ্দীপ্ত রাখতে হবে।

আমরা বেশিরভাগই মসজিদে, ঈদগাহে, ইসলামি মাহফিলে ইহুদি-নাসারা-খ্রিস্টান-কাফের সকলের অমঙ্গল ও ধ্বংসের মোনাজাত শুনে ও তার সঙ্গে 'আমিন' বলে এই হিংসাত্মক ইচ্ছার সঙ্গে একাত্মতা জানাতে বহু আগে থেকেই অভ্যস্ত। কিন্ত গত দশ বছরে তা যেন নতুন মাত্রা পেয়েছে। মিডিয়ার সহজলভ্যতা পুঁজি করে এর প্রচার হচ্ছে মুড়ি-মুড়কির মতো। মেরুকরণের প্রভাবে একসময়ের নিরীহ ধর্মভীরু বাঙালি হয়ে উঠছে সাচ্চা মুসলমান। চল্লিশ পেরোনোর আগেই মক্কা মদিনা ঘুরে এসে চাপদাড়িতে মেহেদি রঙ করে রাতারাতি ভোল পাল্টে ফেলছেন। যিনি কিছুদিন আগেই পার্টিতে বা বিয়েবাড়িতে রঙিন পানীয়তে বুঁদ হয়ে রাতভর নাচানাচি করতেন, সেই তিনিই ভোল পাল্টে বাণী দেওয়া শুরু করেন, 'মঙ্গল শোভাযাত্রা হারাম'।

এই ভোল পাল্টানোর দুটো উপকার। প্রথমত, ক্রমশ মৌলবাদী হতে থাকা সমাজে নিজের অবস্থান নিরাপদ করা; দ্বিতীয়ত, দুর্নীতিতে শক্তিশালী পক্ষের সঙ্গে আঁতাতের মধ্যে থেকে ইহকাল ও পরকাল দুটোরই প্রাপ্তি ও ভোগ নিশ্চিত করা।

এভাবে ক্রমশ ধর্মীয় মেরুকরণে আর দুর্নীতির জালে জড়াতে থাকা একটি দেশের অর্থনৈতিক ও জীবনমানের আপাত দৃশ্যমান উন্নতি নিয়ে কি আদৌ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা যায়? আমরা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব আমাদের সন্তানদের জন্য আমরা ছেড়ে যাচ্ছি যে ভূখণ্ড তা গুণগতমানে ফেলে আসা সময়ের চেয়ে নিরাপদ, সুখী আর প্রাঞ্জল হতে যাচ্ছে?

আমার মনে হচ্ছে না। রাক্ষুসে মাছ জলে রেখে আপনি যতই পোনা ছাড়ুন না কেন একসময় সে রাক্ষুসের অধিকারেই সব যাবে। আমরা সব একই ট্রেনের যাত্রী। একজন পচা মাছ সঙ্গে নিয়ে উঠলে সে গন্ধ অন্যদের গায়েও ছড়ায়।

এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আমাদের নাম আসছে। বেশিরভাগ দেশে এখনই আমাদের বিনা ভিসায় যাওয়ার অধিকার নেই। তার কারণ বিবিধ। কিন্ত অন্ততপক্ষে পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের মতো ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের ছাপ এখনও আমাদের গায়ে লাগেনি। এখনও উন্নত বিশ্বের সরকারি সাইটগুলোতে তাদের অধিবাসীদের অন্য দেশ ভ্রমণে ট্র্যভেল এডভাইস ঘাঁটলে তুলনামূলক বিচারে বাংলাদেশ অনেক পরিচ্ছন্ন দেখায়। এই ছাপ আমরা কতদিন ধরে রাখতে পারব সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ।

ধর্মভিত্তিক রাজনীতির চর্চা এ দেশের ইতিহাসে জন্মলগ্ন থেকেই রয়েছে। কিন্ত ধর্মভিত্তিক দেশভাগের মূলমন্ত্রের বিপরীতে লড়াই করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা সহজ মনের প্রগতিশীল মানুষজনকে ধর্মের বড়ি গেলাতে পারেনি জামায়াত দীর্ঘ চল্লিশ বছরেও। যত তারা ধর্ম বোঝাতে গেছে এ মানুষদের ততই তারা একদলা থু দিয়ে মুখের উপর বলে দিয়েছে, 'যা ব্যাটা, তুই রাজাকার'। কিন্ত তাদের এ দীর্ঘ শ্রম একেবারে বিফলে যায়নি। রাজাকার ট্যাগ থাকার কারণে তাদের ফসল অধিকারে নিয়েছে হেফাজত।

তবে সত্যি বলতে, কোথা দিয়ে কী করে আমাদের নিরীহ অসাম্প্রদায়িক মানুষেরা দিনে দিনে বদলে গেল সেটার হিসাব আমারও ঠিক মেলে না। সমাজবিজ্ঞানীরা ভালো বলতে পারবেন।

সমাধান কী? দুর্নীতি আর ধর্মভিত্তিক রাজনীতির লাগাম টানতে হবে সবার আগে। একসময়ের শক্তিশালী বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে দুর্বল করতে গিয়ে ধর্মীয় শক্তির সঙ্গে হাত মেলানোতে সরকার সাময়িক স্বস্তিলাভ করলেও অদূর ভবিষ্যতে এটা বুমেরাং হতে বাধ্য। কারণ মৌলবাদের হাত ধরে আসে সাংস্কৃতিক-সামাজিক-ধর্মীয় বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ; বিজ্ঞানচর্চার বদলে অপবিজ্ঞানের বিকাশ; জাতিগতভাবে মননের ক্ষয় আর পেছনে চলা।

অন্যদিকে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আনা বেশ সময়সাপেক্ষ হবে নিঃসন্দেহে। সর্বস্তরে তথ্যপ্রযুক্তির যথাসাধ্য প্রয়োগের মাধ্যমে সরকারি সকল সেবা ও দাপ্তরিক কার্যপ্রক্রিয়া ইলেকট্রনিক ফর্মে সম্পাদনের আওয়ামী লীগ সরকারের একুশ শতকে ডিজাটাল বাংলাদেশের রূপরেখা যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করতে হবে। স্বচ্ছতা, সেবা বা কার্যপ্রক্রিয়া সম্পাদনের সময়সীমা (Turn Around Time), স্বয়ংক্রিয় নিরীক্ষা ইত্যাদি বিষয়সমূহ নজর দিয়ে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে।

এছাড়া যথাযথ প্রক্রিয়ায় যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে মেধাভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সুশাসনের নিশ্চয়তা ছাড়া শুধু ডিজিটাল করে খুব বেশি সফলতার মুখ দেখা যাবে না। অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাগরচুরি সুশাসনবিহীন ডিজিটাল ব্যবস্থার সার্থক উদাহরণ।

যে কোনো বিনাশী শক্তির একটা নিয়ন্ত্রণযোগ্য সীমারেখা থাকে। তারপর সে তার ধ্বংসের পথে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কিছুতেই তাকে আর রুখে দেওয়া যায় না। তখন একটাই উপায় থাকে, ভোরের জন্য অপেক্ষা। কারণ ধ্বংসের পরেই শুধু পুননির্মাণ সম্ভব। যদি পুননির্মাণেরও অযোগ্য হয়ে পড়ে তবে তা হয়ে পড়ে ওয়্যাস্ট ল্যান্ড বা পতিত। তা ছেড়ে তখন অন্যত্র চলে যেতে হয়।

২০১৬এর বক্স অফিস সাড়াজাগানো ও রেকর্ডসংখ্যক ছয়টি ক্যাটাগরিতে অক্সার জেতা Mad Max Fury Roadএ প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া ভূমির অধিকার ফিরে পেতে নগরে ফিরে আসে ফ্যুরিওসা। দখলদার জোএর হাত থেকে ছিনিয়ে নেয় অধিকার। আমরাও ছাড়তে চাই না। দুর্নীতি আর মৌলবাদের মিথোজীবী শক্তিকে এখনই রুখে দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সময়।

অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতা শেষ করেছেন রবার্ট ফ্রস্টের উক্তিতে– miles to go before I sleep– চোখ বুজে আসার আগে আমরাও দেখে যেতে চাই 'ধনধান্যে পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা'।