লংগদুর ঘটনা ও আমাদের বিকার!

রাহমান নাসির উদ্দিন
Published : 4 June 2017, 07:00 AM
Updated : 4 June 2017, 07:00 AM

পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাসরত পাহাড়ি আদিবাসীদেরকে খুন করা, তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, তাদের সম্পত্তি লুঠপাট করার জন্য দুর্বৃত্তরা, যারা বেশিরভাগে ক্ষেত্রে সেটেলার বাঙালি, সব সময় একটা অজুহাতের অপেক্ষায় থাকে। তবে সব সময় যে অজুহাত লাগে তা-ও নয়, বিনা অজুহাতেও পাহাড়িদের আক্রমণ করা, লুঠপাট করা এবং হত্যা করার অসংখ্য নজির বাংলাদেশ আমলের বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি।

আবার কোনো কোনো সময় নিজেরাই অজুহাত তৈরি করে। তারপর শুরু হয় তাণ্ডবলীলা। ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়া, ঘরবাড়ি লুঠপাট করা, সুযোগ পেলে হত্যা করা– এসবই নিয়মিত ঘটনা।

গত ২ জুন একই ঘটনা ঘটেছে রাঙামাটি জেলার লংগদু উপজেলার তিনটিলা এলাকায়। ১ জুন নুরল ইসলাম নয়ন নামে লংগদু নিবাসী ভাড়ায়চালিত মোটর সাইকেল ড্রাইভারের লাশ পাওয়া যায়। কে বা কারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে তা জানা না গেলেও এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সহস্রাধিক বাঙালির একটা মিছিল থেকে ২ জুন রাঙামটি জেলার লংগদু উপজেলায় তিনটিলা এলাকার আদিবাসীদের গ্রামে সাম্প্রদায়িক হামলা, লুঠপাট, অগ্নিসংযোগ এবং হত্যার তাণ্ডবলীলা চালায়। এ হামলা ও অগ্নিসংযোগে আদিবাসীদের ২০০ ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে, শত শত নারী, পুরুষ ও শিশু পালিয়ে গিয়ে কোনোরকমে প্রাণে রক্ষা পেলেও ৭০ বছরের বৃদ্ধা গুনবালা চাকমা হত্যার শিকার হন। এরই মধ্যে প্রশাসন লংগদুতে ১৪৪ ধারা জারি করেছে। অথচ কারো কোনো মাথাব্যথা নেই; মিডিয়ার কোনো নজর নেই।

কারণ গোটা বাংলাদেশ, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া এবং সেনসেটিভ শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্ত এখন বাজেট, ব্যাংকের টাকা রাখার শুল্ক, ভোট আর ভ্যাট নিয়ে ব্যস্ত। সবাই 'অর্থনীতিবিদ' হয়ে উঠছেন, তাই সবাই বাজেট ও অর্থকড়ির বিষয়-আশয় নিয়ে ব্যস্ত। মানুষ ও মানবতার বিষয়-আশয় এখন 'নন-এজেন্ডা'!

ফলে লংগদুতে দিনদুপুরে আদিবাসী গ্রামে অগ্নিসংযোগ হয়, দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন, পুড়ছে আদিবাসীদের ঘরবাড়ি এবং প্রাণভয়ে মানুষ দৌড়ে পালানোর দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়, কিন্তু আমাদের মানবিক অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গেছে, তাই আমাদের টনক নড়ে না। আমাদের মানবিক সেনসিটিভিটি কর্পোরেট হয়ে গেছে, তাই বাজেটের লাভ-ক্ষতি এবং জিনিসপত্রে দাম হ্রাস-বৃদ্ধি নিয়ে আমরা ব্যস্ত।

প্রাণভয়ে পলায়নরত আদিবাসী মানুষের তীব্র আত্মনাদ এবং করুণ আহাজারি তাই আমাদের কানে-মনে পৌঁছায় না। এ জন্যই বাজেটের আকার বাড়ে কিন্তু মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বাড়ে না। আদিবাসীদের জীবন দিন দিন আরও অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ছে। লংগদুর ঘটনা তারই নজির। আদিবাসীদের গ্রামে আগুন দিয়ে, মনে হচ্ছে, সাড়ে চার লাখ কোটি টাকার বাজেট সেলিব্রেশন হচ্ছে! চিয়ার্স!

আজ থেকে ঠিক ২৮ বছর আগে ১৯৮৯ সালের ৪ মে রাঙামাটি জেলার লংগদু উপজেলার ছয়টি গ্রামে এক বিরাট হত্যাযজ্ঞ ঘটেছিল, যা নৃশংসতার বিচারে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত অসংখ্য হত্যাকাণ্ডের মধ্যে অন্যতম। শত শত ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। লুটপাট করা হয়েছিল আদিবাসী জনপথ। গুলি করে পশুপাখির মতো খুন করা হয়েছি আদিবাসী আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা।

'অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল'-এর তৎকালীন রিপোর্ট অনুযায়ী ৩৬ জন নারী-পুরুষকে হত্যা করা হয়। আদিবাসীদের দাবি অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। আহত হয়েছিলেন শত শত। হত্যার পর, এমনকি লাশ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি নিহত পরিবারের কাছে যাতে পরিবারের লোকজন যথাযথভাবে সৎকার করতে পারে। এ ঘটনায় দুটি গির্জাসহ অসংখ্য বৌদ্ধমন্দির ধ্বংস হয় এবং ভেঙে বা পুড়িয়ে দেওয়া হয় অসংখ্য বুদ্ধমূর্তি।

এ ঘটনা কোনো উপনিবেশিক শাসন আমলে বিদেশি শাসকের অধীনের ঘটেনি। এ ঘটনা ঘটেছিল স্বাধীন বাংলাদেশে এবং রাষ্ট্রের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায়, কেননা এ ঘটনায় সেটেলার বাঙালিদের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, আনসার ও ভিডিপির সদস্যরাও অংশ নিয়েছিলেন বলে জোরালো অভিযোগ আছে।

২০১৭ সালে এসে সেই লংগদুতেই প্রায় একই কায়গায় (তিনটিলা এলাকায়) চললো আরেক সন্ত্রাস, অগ্নিসংযোগ ও লুঠপাটের ঘটনা। একটি গণতান্ত্রিক দাবিদার সরকারের আমলে আদিবাসীদের উপর এভাবে নৃশংস ও নারকীয় ঘটনা ঘটল যা ২৮ বছর আগের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা অনেককে মনে করিয়ে দিয়েছে। রাঙামাটির লংগদুর ঘটনার পর লংগদুর অধিবাসীদের অনেকেই বলেছেন, '১৯৮৯ সালে একবার সর্বস্বান্ত হয়েছিলাম। এখন আবার হলাম।'

অর্থাৎ ১৯৮৯ সাল আর ২০১৭ সালের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কোথায়? হয়তো মৃতের সংখ্যা ও অগ্নিসংযোগের তীব্রতার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে, কিন্তু ঘটনার অনুঘটক, প্রতিক্রিয়া ও প্রতিফল মোটামুটি একই রকম। কেননা, লংগদুর তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান জনাব আব্দুর রশীদ সরকার নিজ অফিসে অজ্ঞাতনামা বন্ধুকধারীদের গুলিতে নিহত হন। এর জের ধরে লংগদুর উপজেলার ছয়টি গ্রামে যে তাণ্ডবলীলা ও গণহত্যা চালানো হয, সে কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা প্রতিবছর ৪ মে 'লংগদু গণহত্যা দিবস' পালন করে।

২০১৭ সালের ১ জুন একইভাবে একজন ভাড়াটে মোটরসাইকেল ড্রাইভারের লাশ পাওয়া যায়। লংগদুর আদিবাসীদের ভাষ্য অনুযায়ী যার সঙ্গে যে গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, সে গ্রামের অধিবাসীদের কোনো সম্পর্ক নাই। সুতরাং এটা কেবল একটা অজুহাত, যাকে 'সেন্সিটাইজ' করে আদিবাসী গ্রামকে জ্বালিয়ে দেওয়ার পেছনে একটা ন্যায্যতা তৈরির চেষ্টা করা হয়। সেই ১৯৮৯ সাল যেন ২০১৭ সালে ফিরে এসেছে!

লংগদুর ঘটনাকে নিয়ে সবচেয়ে অদ্ভুত আচরণ করেছে বাংলাদেশের মিডিয়া। লংগদুর হত্যাকাণ্ডের খবর প্রকাশ/প্রচার করেছে 'একজন যুবলীগ নেতার হত্যার জের ধরে লংগদুতে ২০০ ঘরবাড়িতে আগুন' প্রায় এই শিরোনামে। অর্থাৎ যে বয়ান (নেরেটিভ) আদিবাসীদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ড জায়েজ করার জন্য রাষ্ট্র ও বাঙালি সেটেলাররা উৎপাদন করেছে, সেটাকেই আনক্রিটিক্যালি মিডিয়া পুনরোৎপাদন করেছে। অদ্ভুত আমাদের ইন্টেলেজেন্সিয়া! অদ্ভুত আমাদের মিডিয়ার দায়িত্বশীলতা ও গণমাধ্যমতা।

এখানে মনে রাখা জরুরি যে, দুর্বৃত্তদের হাতে মোটরসাইকেল চালকের প্রাণ হারানোর ঘটনা যে রাঙামাটিতে এবারই প্রথম ঘটেছে তা নয়। এ ধরনের ঘটনা পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্যবার ঘটেছে।

সেখানে কেবল বাঙালি চালক নয়, বহু আদিবাসী চালকও প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার যথাযথ তদন্ত করার দায়িত্ব সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের। আমরাও চাই, এরকম সব হত্যাকাণ্ডের যথাযথ বিচার হোক এবং দুর্বৃত্তদের এ হত্যাযজ্ঞ বন্ধ হোক। কিন্তু এ হত্যাকাণ্ডের জের ধরে নির্দোষ আদিবাসীদের গ্রামে এভাবে আগুন দিয়ে শত শত ঘরাবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার কোনো অধিকার ও বৈধতা কারো নেই।

এখানে প্রশাসনের 'ডাবল' ব্যর্থতা প্রমাণিত হয়। মোটর সাইকেল চালকের হত্যাকারীদের গ্রেপ্ততারের ব্যর্থতা এবং আদিবাসী গ্রামকে বাঙালি সেটেলার কর্তৃক অগ্নিসংযোগ থেকে রক্ষা করতে না-পারার ব্যর্থতা।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৪৪ ধারা জারি করার পরও লংগদুর আদিবাসী গ্রামে এ আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কীভাবে ১৪৪ ধারা জারি থাকা অবস্থায় ২০০ ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হল, সেটা একটা বিরাট প্রশ্ন। তাই 'তাহলে কি সেটেলার বাঙালিদের এ তাণ্ডবলীলায় প্রশাসসের পরোক্ষ সমর্থন ছিল'– কেউ যদি এরকম অভিযোগ তোলে, তবে তাকে একেবারে ফেলে দেওয়া যাবে না।

লংগদুর ঘটনা নতুন কিছু নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে সারা বছর ধরে আদিবাসীদের উপর হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুঠপাঠ এবং অকারণ গ্রেপ্তারের ঘটনা নিয়মিতভাবেই ঘটে। তার কিছু কিছু মিডিয়ার সুবাদে আমাদের কানে আসে এবং আমরা কিছুটা মৌসুমি কানাকানি করি। আমাদের নির্বিকার চৈতন্যে কিঞ্চিত বিকার আসে এবং সে বিকারের ঠেলায় কিছুটা ফেসবুকিং করি, সম্ভব হলে গো-বেচারা মানববন্ধন করি এবং টুকটাক বিবৃতি দিই। যার মধ্য দিয়ে মূলত 'আদিবাসী বান্ধব' আর 'স্ব-দাবিকৃত মানবাধিকার কর্মী' হওয়ার আইডেনটিটি ঝালাই করে নিই! কিন্তু বেশিরভাগ ঘটনাই আমাদের জানাজানির ও কানাকানি বাইরে পাহাড়েই নীরবে-নিভৃতে বাতাসের সঙ্গে হাওয়া হয়ে যায়।

কী পাহাড় কী সমতল আদিবাসীদের অবস্থা প্রায় একই রকম। কেননা স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও আদিবাসীদের প্রতি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি, বাঙালির মেজরিটারিয়ান মানসিকতা এবং প্রশাসনের বৈমাত্রেয় সুলভ আচরণে তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। সে কারণেই ফি-বছর আদিবাসী হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ক্রমবর্ধমান।

'কাপেং ফাউনডেশন'-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৬ সালেই পাহাড় ও সমতল মিলে হত্যা করা হয়েছে ১৭ জন আদিবাসীকে, গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করা হয়েছে ১৬১ জন আদিবাসীকে, লুঠপাট করা হয়েছে ৯৭টি ঘরবাড়ি এবং আগুন দেওয়া হয়েছে ২০৭টি ঘরবাড়ি।

এর কোনোটারই কোনো বিচার হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। ঘটনা ঘটার পর যেমন লোক দেখানো কিছু আনুষ্ঠানিকতা হয়, লংগদুর ঘটনার পরও কিছু আনুষ্ঠানিকতা হয়েছে। যেমন: প্রশাসনের উচ্চপদস্থ লোকজন এলাকা ভিজিট করেছেন, শত শত অজ্ঞাত লোকের নামে মামলা করা হয়েছে, তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে এবং দোষীদের যথাযথ বিচারের জন্য শাস্তির আওতায় আনা হবে বলে আশ্বাস দেয়া হয়েছে… ইত্যাদি। কিন্তু ঘটনা ও উত্তেজনার তীব্রতা সময়ে সঙ্গে সঙ্গে কমে যাবে আর আমাদের সাময়িক উত্তেজনা প্রশমিত হবে। মামলা-মোকাদ্দমা-আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার সব 'লাল ফিতা'র নিচের চলে যাবে!

দুর্বৃত্তরা নতুন অজুহাতের অপেক্ষায় থাকবে, যাতে করে নতুন করে অন্য কোনো গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া যায়, নতুন কোনো গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া যায় এবং নতুন করে আদিবাসীদের সর্বস্বান্ত করা যায়। কিন্তু এভাবে আর কত?

আদিবাসী মানুষ এদেশে এখনও আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পায় না, জীবনের কোনো নিরাপত্ত পায় না, নিজের সহায়-সম্বলটুকু আগলে রাখার অধিকার পায় না। এভাবে আর কত? অর্থনৈতিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নৈতিক বিকাশও যে জরুরি সেটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।

যতই আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করি না কেন, যতই আমরা গণতন্ত্রের জিগির করি না কেন, যতদিন এদেশে ভিন্ন ভাষার, ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন বর্ণের, ভিন্ন জাতিসত্তার এবং ভিন্ন চিন্তার মানুষের সুযোগ ও অধিকারের সাম্যতা নিশ্চিত না হবে, ততদিন এদেশ একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দাবি করতে পারবে না। তাই লংগদু ঘটনা এবং লংগদুর মতো সব ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই। আদিবাসী মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতি, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার চাই।

রাষ্ট্রের সত্যিকার গণতন্ত্রায়ণের জন্য সবার সুযোগ এবং অধিকারের সাম্যতা অধিকতর জরুরি।