চিকিৎসকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা

খলিলুর রহমান
Published : 28 May 2017, 04:52 PM
Updated : 28 May 2017, 04:52 PM

কিছুদিন আগে এক চিকিৎসক বন্ধু মেডিক্যাল-ডেন্টাল শিক্ষার্থী ও পেশাজীবীদের সংগঠন ফেসবুকের 'প্লাটফর্ম' গ্রুপে আমাকে যোগ করায় এখন তাদের প্রচুর পোস্ট দেখতে পাই। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় যে ন্যূনতম নিরাপত্তা নেই, এটা এর আগে এতটা বুঝতে পারিনি।

গত ১৮ মে ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালে এক রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে চিকিৎসকদের মারধর ও ভাঙচুর, ২৭ মে টুংগীপাড়া হাসপাতালে আরেক চিকিৎসকদের মাথায় আঘাত করে গুরুতর আহত করা এবং প্রায়শ এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি পরিস্থিতি যে কতটা খারাপ তারই জানান দেয়। এসব খবরের অনেককিছুই মূল স্রোতের পত্রপত্রিকায় আসছে না। ডাক্তারি পাস করার পরপরই এই পেশা ছেড়ে এসে যে ভালো করেছি, আজ তা আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করছি!

আমি সবচেয়ে অবাক হচ্ছি এসব বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চরম নির্লিপ্তিতা দেখে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য তাদের প্রকাশ্য কোনো উদ্যোগ দেখছি না। একই অবস্থা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষেরও। সবকিছুই যেন একমাত্র প্রক্টর সাহেবের হাতে। 'প্রাচ্যের অক্সফোর্ড' খ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যাতে অছাত্রসুলভ আচরণের জন্য পরিচিত না হয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালায়ের সুনামহানিকর কোনো কাজে লিপ্ত না হয়, সেদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের খেয়াল রাখা এবং এসব কাজে লিপ্তদের প্রশ্রয় না দেওয়া অত্যন্ত দরকার। অনেক ক্ষেত্রেই বহিরাগত অছাত্ররা কিছুসংখ্যক ছাত্রদের সঙ্গে মিশে এসব ধংসাত্মক কাজ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নাম ছড়ায়।

জীবনের সর্বক্ষেত্রেই সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই। যে কারোরই ভুল হতে পারে; এটা স্বীকার করে সবার বৃহত্তর স্বার্থে সমঝোতা দরকার।

যে কোনো দেশে মিডিয়া বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে দেশের সার্বিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। আমাদের দেশেও তাদের অবদান কম নয়। তবে ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুসংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশনে তাদের বেশিরভাগই যথাযথ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। বেশিরভাগ মানুষ খবরের শিরোনাম দেখেই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। মানুষ সাংবাদিক সমাজের কাছ থেকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা আশা করে।

কিছুসংখ্যক চিকিৎসকও হয়তোবা অনেক পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী। তাদের বিরুদ্ধে অপেশাদার আচরণের অভিযোগে আছে। রোগীদের কম সময় দেওয়া, প্রাইভেট প্রাকটিসে রোগীর সংখ্যা সীমিত না করে অগণিত রোগী দেখা থেকে শুরু করে আরও নানাবিধ আপেশাদার আচরণের অভিযোগ তাদের জনগণের কাছে অপ্রিয় করে তুলেছে।

আর চিকিৎসক সমাজের সবচেয়ে বড় সর্বনাশ করেছে 'ড্যাব'-এর সৃষ্টি ও পরবর্তীতে 'স্বাচিপ-এর আত্মপ্রকাশ। এ দুই সংগঠন চিকিৎসকদের মূল প্রতিনিধিত্বকারী পেশাদার সংগঠন 'বিএমএ'কে অত্যন্ত দুর্বল করেছে। দল-মত নির্বিশেষে সব চিকিৎসকদের উচিত 'বিএমএ'-এর পতাকাতলে সমবেত হয়ে একে আগের মতো শক্তিশালী করা এবং চিকিৎসকদের ন্যায্য দাবিদাওয়া আদায়ের সংগ্রামে কার্যকরভাবে সামিল হওয়া।

সবাইকে একটা কথা স্পষ্টভাবে বুঝতে ও জানতে হবে যে, দুনিয়ার সব দেশে, এমনকি আমেরিকা, ইউরোপের হাসপাতালেও রোগী মারা যায়; ভুল চিকিৎসাও হয়। তবে এসবের প্রতিকারও আছে। ক্লিনিক-হাসপাতালে চিকিৎসার মান উন্নয়নের জন্য রেগুলেশনেরও ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এসব করার জন্য আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের সময় ও ইচ্ছা কতটা আছে, সেটা নিয়ে ভাবা বা রিসার্সের প্রয়োজন আছে।

সবকিছুর ব্যাপারেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকে চেয়ে না থেকে কীভাবে এসব সমস্যার সমাধান করা যায়, সেটা তাদের দেখা দরকার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় উদ্দোগ নিয়ে সব পক্ষকে একসঙ্গে করে সহজেই সেন্ট্রাল হাসপাতাল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যার সমঝোতা করে দিতে পারে। আর চিকিৎসকদের নিরাপদ কর্মক্ষেত্র ও কর্মপরিবেশ তৈরির জন্য গণসচেতনতা তৈরি করা এবং স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। এটাও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অগ্রাধিকারভিত্তিতে বিবেচনা করা উচিত।

বাংলাদেশের সমপর্যায়ের অনেক দেশে রোগীর নিরাপত্তা ও চিকিৎসকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি বিষয়ক অনেক 'Best Practice' দৃষ্টান্ত রয়েছে; এগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ও আমাদের দেশের পরিস্থিতি ও প্রয়োজনীয়তার প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দেশের জন্য যুগপোযোগী নীতি ও রেগুলেশন তৈরি করতে পারে। এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও অন্যান্য সংস্থার সহযোগিতাও নেওয়া যেতে পারে। সরকার ও আমাদের সবারই মনে রাখা দরকার যে নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট 'টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা' (Sustainable Development Goal – 3) ছাড়াও আরও আটটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের সঙ্গে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট ও নির্ভরশীল। এসব লক্ষ্য অর্জনের জন্য চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের কার্যকর ভূমিকা ও অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।

এটা নিশ্চিত করতে হলে আরও অনেককিছুর সঙ্গে দরকার তাদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা প্রদান। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে চিকিৎসকরা সাধারণ মানুষের শত্রু বা রোগী সুস্থ হোক– এটা তারা চায় না। একজন চিকিৎসকের বড় সন্তুষ্টি এবং পেশাগত সাফল্য নির্ভর করে রোগীকে ভালো করার মাধ্যমে, কোনো রোগীকে মেরে ফেলার মধ্যে নয়।

আর আজ যারা চিকিৎসক বা যারা ডাক্তারি পড়ছে, তাদের বেশিরভাগই দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের প্রথমদিকের অংশ। এরা যেমন মানুষকে সেবা দেওয়ার ব্রত নিয়ে এই মহান পেশায় আছে, তেমনি সরকার ও জনগণকেও তাদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে, যাতে করে তারা সেবা দিতে পারে এবং জনগণ সেবা পেতে পারে।

সরকারসহ সাধারণ জনগণকে বুঝতে হবে যে, এখনও এ দেশের চিকিৎসকরাই ব্যাপকসংখ্যক সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে। দেশে বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা আছে। এসবের অনেককিছুর জন্যই হাসপাতালগুলো ও চিকিৎসকদের একাংশ যেমন দায়ী, তেমনি সরকারের দুর্বল ও অকার্যকর নীতি, রেগুলেশন ও অব্যবস্থানা আরও বেশি দায়ী। এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত আছে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত চক্র।

আর এসবের বাইরে বিশেষায়িত চিকিৎসার নামে যারা বিদেশে যায়, তাদের একটি বড় অংশ অর্থ পাচারের সঙ্গে যুক্ত। ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, মালেয়েশিয়াসহ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে এদের অবিরাম ও অবাধ পদচারণা দেখলেই যে কেউ এটা বুঝতে পারবে। বিদেশে চিকিৎসার নামে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বৈধভাবে যে অর্থ আনা হয়, তা শুধুমাত্র ভংগ্নাংশ মাত্র; গভীর সমুদ্রের 'Tip of the Iceberg'! এর চেয়ে হাজার হাজার গুণ অর্থ চিকিৎসার নামে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।

সরকার, বিশেষকরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যথাযথ ও কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে বিশেষায়িত চিকিৎসার মান উন্নয়ন ও সব পক্ষের জবাবদিহিতার মাধ্যমে এই পাচার হয়ে যাওয়া অর্থের অনেকটাই দেশে রাখা ও বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। এজন্যই আমাদের দরকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যথাযথ ক্ষমতায়ন, একে গতিশীল করা এবং যোগ্য ও সৎ কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে পদায়ন। এর মাধ্যমেই কেবল বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর রূপরেখা অনুযায়ী স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব।