কিডনী সংযোজন: সেবার বিস্তারে প্রয়োজন আইন সংশোধন

এম এ সামাদ
Published : 7 March 2012, 03:56 PM
Updated : 7 March 2012, 03:56 PM

বিশ্বব্যাপী কিডনী রোগ মহামারী আকারে দিন দিন বেড়েই চলেছে। কিডনী রোগের ভয়াবহ পরিণতি ঠেকাতে সমস্ত পৃথিবীর মানুষকে সচেতন করতে প্রতিবছর বিশ্ব কিডনী দিবস উৎযাপন করা হয়। এবার পালিত হচ্ছে সপ্তম বিশ্ব কিডনী দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় 'জীবন বাঁচাতে কিডনী দান করুন'।

বিভিন্ন উপাত্ত থেকে জানা যায় বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি লোক কোন না কোন কিডনী রোগে আক্রান্ত। প্রতিবছর ৩৫-৪০ হাজার লোক সম্পূর্ণ কিডনী বিকল হয়ে অকাল মৃত্যুবরণ করে। কিডনী সম্পূর্ণ বিকল হওয়ার পরে বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় হলো ডায়ালাইসিস অথবা কিডনী সংযোজন। ডায়ালাইসিস এর মাধ্যমে শরীর থেকে দূষিত পদার্থ বের করে নেয়া হয়। ডায়ালাইসিস দুই প্রকার – মেশিনের সাহায্যে যে ডায়ালাইসিস করা হয় তাকে বলে হিমো ডায়ালাইসিস আর পেটে ছিদ্র করে যে ডায়ালাইসিস করা হয় তাকে বলে পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস বা CAPD। হিমো ডায়ালাইসিস সাধারণত সপ্তাহে ৩ দিন করতে হয়। একজন কিডনী রোগীর প্রতি বছর ঔষধসহ ডায়ালাইসিসের খরচ ৪-৬ লক্ষ টাকারও বেশী। ডায়ালাইসিসের খরচ বেশী হওয়ার কারণে এদেশের শতকরা ১০ জন রোগীও এই দীর্ঘ মেয়াদী ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারে না। ফলে বলতে গেলে শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশী রোগীর মৃত্যু হয় বিনা চিকিৎসায়।

পক্ষান্তরে, কিডনী সংযোজন কিডনী বিকল রোগীর সর্বোত্তম চিকিৎসা। একজন মৃত্যু পথযাত্রী রোগী প্রায় স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায় এই চিকিৎসায়। কিডনী সংযোজনের পর রোগী কর্মক্ষেত্রে ফিরে যেতে পারে; বিয়ে, ঘর, সংসার ও সন্তানের বাবা-মা হতে পারে। বাংলাদেশে কিডনী সংযোজনের জন্য সাধারণত খরচ তুলনামূলক কম। এর পর নিয়মিত কিছু ঔষধ খেয়ে যেতে হয়।

সর্বপ্রথম সফল কিডনী সংযোজন হয় ১৯৫৪ সালে। ১৯৬২ সালে মৃত ব্যাক্তি থেকে কিডনী সংগ্রহ করে সংযোজন করা হয়। ১৯৬৭ সালে হার্ট ও লিভার সংযোজন করা হয়। এরপর থেকে কিডনী সংযোজন দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশ্বব্যাপী কিডনীর চাহিদা বেড়ে যায়। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় বিশ্বব্যাপী কিডনী বেচা-কেনার অশুভ ব্যবসায়ী দালাল চক্র গড়ে ওঠে। মানুষের অঙ্গ নিয়ে অমানবিক ব্যবসা রোধ করার জন্য বিভিন্ন দেশে তখন অঙ্গ সংযোজন আইন প্রণয়ন করা হয়। বাংলাদেশেও মানবদেহে অঙ্গ-প্রতঙ্গ সংযোজন আইন ১৯৯৯ সালে প্রণয়ন করা হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী রক্ত সম্পর্কীয় স্বজন ও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অঙ্গ লেনদেন বৈধ। রক্ত সম্পর্কীয় বলতে বুঝায় আপন ভাই-বোন, মা-বাবা, চাচা, ফুপু, মামা, খালা। এর বাইরে কেউ স্বেচ্ছায় দান করতে চাইলেও কিডনী দেয়া বা নেয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এছাড়া মৃত ব্যাক্তি বা Brain death হয়েছে এমন কোন ব্যক্তির কিডনী নেয়া যেতে পারে। দাতার পূর্ব সম্মতি থাকলে অথবা অভিভাবকের তাৎক্ষণিক অনুমতি স্বাপেক্ষে মৃত ব্যক্তি থেকে কিডনী বিযুক্ত করা যেতে পারে। কিন্তু যখন কোন আকষ্মিক রোগে অথবা দূর্ঘটনায় মৃত্যু পথযাত্রীর আপনজনদের কাছে এই অবেগময় মূহূর্তে অঙ্গ কেটে নেয়ার অনুমতি চাওয়া অনেক সময় বিব্রতকর। তাছাড়া বর্তমান আইনে সম্পর্ক নির্ণয়ের সুস্পষ্ট কোন বিধান না থাকায় অনেকেই কাগুজে সম্পর্ক তৈরি করে নিয়ে আসে, সেক্ষেত্রে অঙ্গ সংযোজনের সাথে সম্পৃক্ত ডাক্তারদের রোগী ও কিডনী দাতার মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ক ঘোষণার সত্যতা নিরুপণের কোন মাপকাঠি বা উপায় থাকে না।

তাই অঙ্গ সংযোজনের প্রধান অন্তরায় দাতা সংকট। যে কেউ চাইলেই আরেক জনকে কিডনী দিতে পারে না। দাতা ও গ্রহীতা উভয়েরই রক্তের গ্রুপ ও টিস্যুর মিল থাকতে হবে। দাতার ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, সংক্রমনজনিত ব্যধি, পর্যাপ্ত কিডনী কার্যক্ষমতাসহ অনেকগুলো বিষয় সম্পূর্ণ সুস্থ থাকলে এবং দাতার স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে তবেই তার কিডনী বা অঙ্গ সংযোজনের জন্য নেওয়া যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে আপনজনদের মধ্যে বিভিন্ন ভয়-ভীতি ও ভুল ধারণার কারণে কিডনী দিতে রাজী হয় না, আবার যারা হয় তারাও এতগুলো ফিটনেস পরীক্ষার মানদন্ডে কোন না কোন জায়গায় বাতিল হয়ে যায়। পরিশেষে খুব অল্প ক্ষেত্রেই প্রকৃত দাতা পাওয়া যায়। আর এজন্যই আমাদের দেশে কিডনী দাতার সংকট এত প্রকট।

এর সাথে যুক্ত হয় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সংঘাত। এ বিষয়ে বিশ্বের প্রখ্যাত ধর্মীয় নেতাদের মতামত থেকে জানা যায় প্রায় সকল ধর্মেই জীবিত অথবা মৃত ব্যক্তির কিডনী দান করা একটি মহান মানবিক কর্ম হিসাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষও অঙ্গদানে জীবন বাঁচানোকে মহৎ কর্ম হিসাবে স্বাগত জানায়। আমাদের দেশে ধর্মীয় নেতা ও বিভিন্ন সংস্কৃতির প্রতিনিধিদের কিডনী দানে উৎসাহিত করতে ভূূমিকা রাখতে হবে।

কিডনীদাতার আরথিক সংকটের সুযোগে দালাল চক্র আইনের ফাঁক গলিয়ে অবৈধভাবে অঙ্গ কেনা-বেচার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা মানুষের অঙ্গ নিয়ে মধ্যস্বত্তভোগীর মাধ্যমে এধরনের অমানবিক ব্যবসার ঘোর বিরোধী। অঙ্গ বেচা-কেনা নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়াতে অনেক তর্ক-বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটি দিকই আছে। ইতিবাচক হলো ঃ কেনা-বেচার ব্যপারে জনগণ সচেতন হয়েছে। সরকারও অবহিত হয়েছে। আর নেতিবাচক দিক হলো : মিডিয়া থেকে পাওয়া তথ্য থেকে সাধারণ মানুষের ধারণা হয়েছে কিডনী দান করলে দাতা অসুস্থ হয়ে পড়ে, দুর্বল হয়ে যায়, কোন কাজ-কর্ম করতে পারে না। এটা সম্পূর্ন ভূল ধারণা। এর ফলে অঙ্গ দানের প্রতি সাধারণ মানুষের চরম ভীতি ও অনিহা জন্মেছে। অন্যদিকে অহেতুক ডাক্তারদের এর সাথে জড়িয়ে হেয় করার চেষ্টা করায় অঙ্গ সংযোজনের সাথে সম্পৃক্ত ডাক্তারগণও শংকিত। ফলে বিগত সেপ্টেম্বর ২০১১ইং থেকে এ দেশে কিডনী সংযোজন প্রায় বন্ধ। রোগীদের বেঁচে থাকার আকুতি আমরা প্রতিনিয়ত শুনি। আমরা চাই সমস্ত প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে আবার জীবন বাঁচাতে কিডনী সংযোজন চালু হোক। আমরা আগেই বলেছি, কিডনী সংযোজনের যে সকল প্রতিকূলতা বিদ্যমান তার মধ্যে অন্যতম হলো দাতা সংকট। এছাড়া অর্থনৈতিক সমস্যা, অঙ্গ দান সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা, কোন কোন ক্ষেত্রে ধর্মীয় ভুল ব্যাখ্যা, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোক- বলের অভাব ইত্যাদি-তো রয়েছেই। বাংলাদেশে কিডনী সংযোজন বিশ বছর পূর্ব থেকে শুরু হলেও এ ক্ষেত্রটি দ্রুত প্রসার লাভ করেছে বিগত ৪-৫ বছর ধরে। বিগত সেপ্টেম্বর ২০১১ইং পর্যন্ত বাংলাদেশের ১০টি সেন্টারে এক যোগে কিডনী সংযোজন ও ২টি সেন্টারে লিভার সংযোজন চলছিল। কিন্তু এটি আমাদের জাতির দূর্ভাগ্য যে সে গতি আজ থেমে গেছে । আমরা যদি সংকটের মূলে প্রবেশ করি তবে দেখতে পাই, কিডনী সংযোজনের মূল অন্তরায় দাতা সংকট। উন্নত দেশে মৃত ব্যক্তির অঙ্গ নিয়ে চাহিদার একটি অংশ পূরণ করে। অমাদের দেশে এখনও মৃত ব্যক্তির অঙ্গ নিয়ে সংযোজন শুরু হয়নি, চেষ্টা চলছে। দাতা সংকট নিরসনে বর্তমান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন সংশোধন প্রয়োজন । দাতা সংকট উত্তরণে উন্নত দেশগুলো মৃত ব্যক্তির কিডনীর উপর জোর দিয়েছে। তারপরও কিডনী গ্রহীতার অপেক্ষমান তালিকা দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। এই জন্য স্পেন, ফ্রান্স, বেলজিয়ামসহ অনেক দেশ আইন সংশোধন করেছে। সংযোজনের জন্য মৃত ব্যক্তির অঙ্গ বিযুক্ত করার পূর্বে কোন পূর্ব অনুমতির বা অভিভাবকের তাৎক্ষণিক অনুমতির প্রয়োজন হয় না। Brain death ঘোষণার পরে সার্জন অঙ্গ বিযুক্ত করে নেবে। তবে কারো যদি আপত্তি থাকে সেক্ষেত্রে অভিভাবক বিযুক্ত না করার জন্য আবেদন করবে। এই আইন এই জন্যই করা হয়েছে যে, যখন মানুষ কোন দূর্ঘটনা বা আকস্মিক কোন রোগে মৃত্যু পথযাত্রী তখন আপনজনদের আবেগঘন মানবিক কষ্টের মুহূর্তে অঙ্গদানের অনুমতি চাওয়া অনেক সময় বিব্রতকর। মৃত ব্যক্তির অঙ্গ নেবার সমস্ত অবকাঠামো, প্রযুক্তি, লোকবল থাকা সত্বেও চাহিদার তুলনায় দাতার বিশাল ঘাটতি দিন দিন বাড়ছে বিশ্বের উন্নত দেশেও । এজন্য তারা জীবিত দাতার উপর গুরুত্ব দিচ্ছে। জীবিত দাতার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন দেশে যে যে আইনের পরিবর্তন এনেছে তার আলোকে কিছু উদাহরণ ও প্রস্তাব দেশের সচেতন নাগরিক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিবেচনার জন্য উল্লেখ করা হল :

) বর্তমান আইনে দাতার পরিধি আরও বৃদ্ধি করে মামাতো, চাচাতো ভাই-বোন, ভাগনা-ভাগনি, ভাতিজা-ভাতিজি পর্যন্ত বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
) রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও বন্ধু-বান্ধবী ও মহৎ ব্যক্তির নিঃস্বার্থ দান গ্রহণ করা যেতে পারে।
) ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে সেচ্ছায় কিডনী দাতাকে রাষ্ট্রীয় খেতাব ও এওয়ার্ড প্রদান করে উৎসাহিত করা হয়।
) ইরানে কিডনী রোগী কল্যাণ সমিতি, ডায়ালাইসিস কল্যাণ সমিতি ও সরকারের সমন্বয়ে একটি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কিডনী সংযোজন নিয়ন্ত্রণও কার্যকর করা হয়। প্রথমে রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবকে দাতা হিসেবে প্রধান্য দিবে। না পেলে অঙ্গ দানে আগ্রহী যে কোন দাতার কাছ থেকে কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল এর মাধ্যমে নিতে পারে। সেখানে দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে কোন সরাসরি যোগাযোগ হবেনা, মধ্যসত্ত্বভোগী দালালের কোন সুযোগ নেই। দাতা কিছু সুযোগ পাবে, যেমন . সরকার থেকে ফ্রি জীবন বীমা প্রদান করবে। . সরকার থেকে আর্থিক সাহায্য দেয়া হবে । . দাতা সংস্থা ও এনজিও আর্থিক সহায়তা দিবে। . কিডনী গ্রহীতা সেন্ট্রাল কমিটির মাধ্যমে আর্থিক অনুদান দিবে।

রোগী জীবন পাবে, দাতা পাবে আর্থিক সচ্ছলতা । মধ্যসত্ত্বভোগী কোন দালাল থাকবে না। কোন বিদেশী কিডনী নিতে বা দিতে পারবে না। ইরানে এই আইন পাশ করার পর কিডনী সংযোজনে এতটাই সফলতা এসেছে যে, আর কোন রোগীকে কিডনী সংযোজনের জন্য অপেক্ষমান তালিকায় থাকতে হয় না।
) কোন কোন দেশে কিডনী রোগীদের স্বামী-স্ত্রী ও নিকট আত্মীয় মিলে সমিতি করেছে । এদের মধ্যে মিল অনুযায়ী কিডনী বিনিময় করা যায়।
) চীনে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামির অঙ্গ পরিবারের অনুমতি স্বাপেক্ষে নিতে পারবে। ১৯৮৮ থেকে এই আইন বলবৎ আছে। প্রতিবছর ৪-৬ হাজার কিডনী সংযোজন হয় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী থেকে। আবার আমেরিকায় কোন মৃত্যদন্ড প্রাপ্ত আসামি যদি একটি কিডনী দান করে তবে মৃত্যুদন্ড মওকুফ করে যাবৎজীবন কারাদন্ডে নিয়ে আসা হয়।

সময়ের চাহিদায় আমাদের দেশের অঙ্গ-প্রতঙ্গ সংযোজন আইন সংশোধন প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। উপরোক্ত উদাহরণের আলোকে আইনের সংশোধন হলে অঙ্গ সংযোজন যে প্রতিকূলতার সৃষ্টি হয়েছে আশা করি তা শ্রীঘ্রই নিরসন হবে।

এম এ সামাদ: কিডনী এওয়ারনেস মনিটরিং এন্ড প্রিভেনশন সোসাইটি (ক্যাম্পস)-এর সভাপতি।