কারা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়?

শবনম নাদিয়া
Published : 6 March 2012, 01:44 PM
Updated : 6 March 2012, 01:44 PM

তিন-চার বছর আগের কথা | এক লেখক বন্ধু আমাকে আরেকজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, এটা নাদিয়া, ও অনুবাদক| আমি ঠিক আপত্তি করলাম না, কিন্তু বলে ফেললাম, আমি অনুবাদ করি, কিন্তু আমি নিজেও লেখক| লেখক বন্ধু স্মিত হেসে বললেন, কিন্তু তুমিতো ইংরেজিতে লেখো | অর্থাৎ ইংরেজিতে লিখি বলে তার হিসেবে আমি গ্রাহ্যের বাইরে |

একটু তর্ক করার ইচ্ছে হচ্ছিল | আমি বাংলায় কবিতা লিখি, আমি বাংলায় প্রবন্ধ লিখি | আমার নিজের যেসব লেখা বেশ তরে গেছে বলে আমার ধারণা, তার মধ্যে রয়েছে একটি ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা — বাংলায় লেখা | আমার গল্পগুলো বাংলায় আসে না, এটা ঠিক | কিন্তু তা বলে আমার লেখক পরিচয় কোন পরিচয় নয়?

চুপ করে রইলাম | অতীত অভিজ্ঞতা বলে, যারা এরকম দাপটের সঙ্গে তামাম জগতের সব কিছুতে সাদা নয় কালো তকমা এঁটে দেয়, তাদের সঙ্গে তর্কে ঢোকা বাতুলতা, অযথা বাক্য ব্যয়, অনর্থক শক্তি ক্ষয় |

তবে মাঝে মাঝে সাদা-কালো দেখনে-ওয়ালারা বেশ গা ঝাড়া দিয়ে বসে, দাপট যায় বেড়ে | তখন ফজুল মনে হলেও, মুখ বন্ধ রাখা একটু কষ্টের হয়ে পড়ে|

***

ছোটকালে বাংলা ব্যাকরণ পড়তে হত স্কুলে | সে সব নিয়ম রীতির খুব বেশি কিছু মনে নেই–ইংরেজি বাংলা দোনো ভাষাতেই আমার দক্ষতা ব্যাকরণ শিক্ষা থেকে নয়, নিতান্তই গল্প-কবিতা পড়ার মাধ্যমে, আর আড্ডার তুবড়ি তুলে | আহা, মুখের ভাষা! এর চেয়ে মিঠা কিছু আছে? লেখার ভাষা যদি হয় পরিশীলিত মধু, তো আমাদের প্রতিদিনকার কথা বলা তাজা ফুলের তেরঙ্গা নির্যাস | সেই মুখের ভাষাকে নিয়ন্ত্রনের খুপড়িতে আনা যায় কি?

মা ছিলেন, ছিলেন কি এখনও আছেন, বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, হাবিজাবি শব্দ সহজে আমাদের ঘরে ঠাঁই পেতো না | একটু বড় হয়ে আমি বুঝলাম আমার ভাষা দুটি নয়, তিনটি: ইংরেজি একটি, আর বাংলা দুটি | ঘরে এবং শিক্ষকদের সামনে মান-বাংলা, জিভ ঠেলে প্রমিত বাংলার যত কাছাকাছি নেয়া যায় | আর তারপর রয়েছে দোকান-পাট, রাস্তাঘাট, বন্ধু বান্ধবের সাথে তেড়েমেড়ে চালানো আরেক বাংলা, যে বাংলায় 'খেয়েছি' হয়ে যায় 'খাইসি', যে বাংলায় 'আমি যাচ্ছি' হয়ে যায় 'আমি ফুটলাম', 'দুষ্টামি করিস না' হয়ে যায় 'তাফালিং করিস না', 'দারুণ' হয়ে যায় 'ফ্যান্টাস্টিক চুকা ডাইল' কিংবা 'জোশ' কিংবা 'ঝাকাস" কিংবা 'জটিল' (বি: দ্র: 'ফ্যান্টাস্টিক চুকা ডাইল' কেউ না চিনলে দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই; এটা বোধহয় আমাদের মফস্বল স্কুলের কয়েক জাহাবাজের উদ্ভাবন, সেই স্কুলের গন্ডি ছাড়ানোর সুযোগ পায়নি বেচারা শব্দ-গুছি |)

পরে আরেকটু ভেবে দেখলাম, শুধু আমার না, অনেকেরই দেখি একাধিক বাংলা | যেমন আমার বাবা, তিনিও অধ্যাপক মানুষ, তার সবসময়কার একটা ভাষা আছে, কিন্তু যখন আমার চাচা-ফুপুরা আসেন, তারা আড্ডায় মাতেন, তখন তাদের চানফুইরা ভাষা ঠেলে আমরা সবসময় ঢুকতে পারি না | তবে ঝুলে থাকি, আশেপাশে ঘোরাঘুরি করি | আশা-ভরা ঘোরাঘুরির তালে সেই ভাষা জিভে পশে না, কিন্তু মগজে পশে: বলতে পারি না, কিন্তু বুঝতে শিখি |
ভাষা কি আর এক রংয়ের, এক সুরের, এক ছাঁচের হয়? কোন দিন কি তাই ছিল?

***

বাংলাদেশের ক'জন মানুষ মান-বাংলা ব্যবহার করেন দৈনন্দিন আলাপচারিতায়? করেন কিংবা করেন না বলে কি তাদের বাঙালিত্ব সেই অনুযায়ী কমে বা বাড়ে? যারা করেন না, তারা কি প্রতিদিন ঝাড়ে-বংশে বাংলা ভাষা এবং বাঙালিয়ানাকে নিধন করে চলছেন? যারা আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেন, তাদের সেই ভাষা কি ভাষা হিসেবে মর্যাদা পাওয়ার দাবি রাখে না?

শরত্চন্দ্রের বাংলা আর আলাওলের বাংলা আর লালনের বাংলা আর রবীন্দ্রনাথের বাংলা আর সৈয়দ মুজতবা আলীর বাংলা আর জসীমউদ্দিনের বাংলা –সব কি এক কাতারের, এক ছাঁচের? এদের আদলের বাংলার বাইরের বাংলা কি বাংলা নয়? লেখার ভাষা কি মুখের ভাষার ওপর কখনো জায়গা পেতে পারে, বা পাওয়া উচিত? আমজনতা যখন রিক্সা চালায়, কলপাড়ে ঝগড়া করে, শাড়ির দোকানে দামাদামি করে, ঝালমুড়ি বেচে, চায়ের ঠেকে গলাবাজি করে, রাস্তার মোড়ে ঘুগনি খায়– তখন আর যাই ব্যবহার করুক, বইয়ের ভাষা ব্যবহার করে না, 'ভদ্রলোকের' ভাষা ব্যবহার করে না |

এর মানে এই নয়, যে প্রমিত বাংলার প্রয়োজন নেই | এর মানে এ-ও নয় যে ফেব্রুয়ারী এলে বাংলা-বাংলা করে জবান ঝামা করে ফেললেই বাংলা ভাষা এবং বাঙালিয়ানা খুব রক্ষা পেল | কিন্তু কমিটি-মারফত ভাষার বিশুদ্ধি রক্ষার চিন্তাটি ভয়াবহ | এই কমিটি কি বাংলাদেশের প্রতিটি কোনা-কাঞ্চিতে টহল মেরে হিসেব রাখবে যে কারা কোথায় কিভাবে কোন শব্দ উচ্চারণ করে, শব্দ প্রয়োগ, বাক্য গঠন করে? ক'জন মানুষ একই ধরণের গঠন করলে সেটি গ্রহনযোগ্য হবে? একটি এলাকার বিশেষ জনগোষ্ঠী যদি কোন শব্দ বা বাক্য বা বাগধারা ব্যবহার করেন (সেই জনগোষ্ঠির নির্ধারক হতে পারে পেশাগত, বয়সজনিত (তরুনদের বৈঠকি ভাষা সকল যুগেই বোধহয় আলাদা মাত্রা পায়), বা অঞ্চলগত (ঢাকার কোন কোন এলাকার বাংলার রস উর্দুতে চারানো), সেইমত ভাষা ব্যবহার কি আমাদের ভাষার সোনার বাক্সে জায়গা পাবে? বাংলাদেশের চৌহদ্দির মধ্যে যে ভিন্নভাষী বাংলাদেশী রয়েছে (আমাদের জুম্মা-ভাষীদের জবান কাড়তে তো গত চার দশক চেষ্টার কসুর করিনি আমরা), তাদের ওপর আমাদের কমিটি কোন ভাষা বর্তাবে? এই 'আমরা' কারা, 'আমাদের ভাষা' কোনটি? 'আমাদের' ভাষার শুদ্ধতা রক্ষার্থে আমরা কি 'অন্যদের' ভাষার সার্বভৌমত্বে হানা দেবো?

***

প্রাইমারি স্কুলে পড়াকালে বন্ধুবান্ধবের গালি খেয়েছিলাম, আমার বাড়িতে শেখা 'খেয়েছি-গিয়েছি টাইপের' বাংলা শুনে ওদের বিরক্ত লাগতো | ওই বয়সে এসব বিষয় মারাত্মক গায়ে লাগে, আমি তড়িঘড়ি করে আমার ভাষা বদলালাম | কিন্তু তারপর একটা সময়, মনে হয় ছয় বা সাত ক্লাসে পড়ার সময়, আমরা মেয়েরা খুব করে শরত্চন্দ্র পড়া ধরলাম | কি উত্তেজনা! প্রতিদিন এসে গল্প করা, কে কোন কাহিনীতে মজে আছি, সেই উপন্যাসের ঘটনা এখন কতদুর গড়িয়েছে, আর একজন আরেকজনকে তেড়ে ওঠা, 'উফ, বলে দিস না, তাহলে আমি পড়ে মজা পাব?' সেই ম্যারাথন উপন্যাস পড়ার ক'মাসে আমাদের ভাষা গেল বদলে, সক্কলে মিলে জল খাওয়া ধরলাম পানির বদলে, খাইসিলাম-গেসিলাম তো দূরের কথা খেয়েছিলুম-গিয়েছিলুম বলে কূল পাচ্ছিলাম না | আমার বাপমা, যদ্দূর মনে পড়ে, অত্যন্ত বুদ্ধিমানের মতন বিষয়টি এড়িয়ে গেলেন | কিন্তু একজন বন্ধু, কে এখন মনে নেই, তার মা'র কাছে জল চেয়ে বেধড়ক পিটুনি খেলো | আহা, তার জন্য আমাদের কি কষ্ট! বাপমা যদি এমন নাদান হয়, সাহিত্যের মূল্য না বোঝে!

পরে বুঝেছিলাম, জল তো 'হিন্দু' শব্দ; রাগটা সেই কারণে |

জল কি বাংলা? পানি কি বাংলা? পানি কবে থেকে বাংলা হল? একটি শব্দ কতদিন কত মানুষ ব্যবহার করলে সেটি প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে বাংলার অন্তর্ভুক্ত বলে দাবি করা যাবে? আমি যে দুই-ই বোঝাতে 'দোনো' লিখলাম, তাতে কি বাংলার অশুদ্ধি ঘটালাম? আর যারা দোনো বলেন না, বলেন দুনো–তারা ভুল না আমি ভুল? আমি যে স্কুল লিখলাম, ক্লাস লিখলাম, বিদ্যালয় আর শ্রেণী না লিখে, এতে কি ভাষার দূষণ ঘটলো? কিন্তু বিদ্যালয় আর শ্রেনীর মত চমত্কার শব্দ থাকা সত্ত্বেও যে আমাদের লোকজন মহা সুখে ক্লাস, স্কুল এসব আংরেজী শব্দ ব্যবহার করছে? লেখকরাও যে ব্যবহার করেন? যেসব শব্দ বাংলায় ইংরেজি থেকে আমদানী হয়নি, এসেছে অন্য ভাষা থেকে (ধরা যাক আরবি, ফার্সি, ফরাসী থেকে) তাদের বেলায় কী রফা? সে সব শব্দ যদি অধুনা আমদানি হয়ে থাকে?

সৈয়দ মুজতবা আলী, নমস্য গপ্পো-বলিয়ে, তিনি ইংরেজী, জার্মান, ফরাসী, ফার্সি থেকে ধার করে শব্দ আর ভাষা নিয়ে কি জব্বর খেলাই না খেলে গেছেন | তার লেখনী কি বাংলার পবিত্রতাকে ক্ষুন্ন করে? বিভিন্ন ভাষার ঠোকাঠুকিতে, বিভিন্ন বাক-রীতির ল্যাং মারামারি আর গা ঘষাঘষিতে যে শব্দ, চিন্তা, চেতনার জেব ভরে ওঠে, ভারী হয়ে ওঠে নয়া স্বর্ণ মোহরে, তার কী হবে?

আজকে যেসব বাংলা পত্রিকা 'উচ্চ আদালত'-এর মত সুন্দর শব্দ-গোছা থাকা সত্ত্বেও, মহামান্য উচ্চ আদালতের ভাষা শুদ্ধি কমিটি গঠনের নির্দেশ সম্প্রচারে ইংরেজী হাই কোর্ট ব্যবহার করেছে, কমিটি বা আদালত কি তাদের শাস্তিদানের মাধ্যমে শুদ্ধি প্রক্রিয়া বিসমিল্লাহ করবেন? তাহলে যে প্রায় তাবত পত্রিকার মুখ-শুদ্ধি করতে হয় |

ভাষার পবিত্রতা কি আসলে এতো ঠুনকো? আর যদি তা এতটা ভঙ্গুর হয় যে তাকে নানারকমের বেড়াজালে না ঘিরলে সে বাঁচবে না, তবে মুক্ত আলো-হাওয়া থেকে দূরে থাকলে কি সে মাথা উঁচু করে শিরদাড়া খাড়া করে সোজা হতে পারবে? তাকে যদি এরকম ঘেরাটোপের মধ্যে রেখে, তুয়ো-তুয়ো করে বাঁচিয়ে রাখতে হয়, তবে যে চেহারায় সে বেঁচে থাকবে, সে কি দেখবার মত হবে?

***

বাংলা ভাষার মালিক কে? আজকে এই প্রশ্নটি বড় করে বিধছে |ভাষা একটি বেশ ছাড়া গরুর মত থাকা দরকার; সাত ঘাটের জল আর বারো মাঠের ঘাস খেলেও সাঝ বেলায় নিজ ঘরের পথে হানা দেবে | নাহলে ভাষা হয়ে যায় পানসে, জোলো | তো বেশ আটঘাট করে তাকে এখন বাধার ব্যবস্থা হচ্ছে, মুখে ঠুলি দেয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে |

বাংলা কি এক জগদ্দল বোঝা হয়ে বাঙালির ঘাড়ে চাপবে নাকি ভাষার পিঠে সওয়ার হওয়ার তাকদ আমাদের এখনও আছে?

শবনম নাদিয়া: লেখক ও অনুবাদক।