আত্মসমর্পণ নাকি পশ্চাৎপসরণ?

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 18 May 2017, 04:24 AM
Updated : 18 May 2017, 04:24 AM

বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কি না– সেই প্রশ্নের নিশ্চিত জবাব কোনো রাজনৈতিক ভবিষ্যৎবক্তাই দিতে পারছেন না।

বিএনপির যেসব নেতা নানা উপলক্ষে নিয়মিত কথা বলে থাকেন তারা সবাই এক সুরে কথা বলেন না। কেউ বলেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ফাঁকা মাঠে গোল দিতে দেওয়া হবে না। আবার কেউ বলেন, শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না। কারোবা বক্তব্য নির্বাচন সহায়ক সরকারের দাবি আদায় না করে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। কেউ বলেন, বিএনপি নির্বাচনপন্থী দল, কিন্তু সব দলের জন্য সমান সুযোগ না থাকলে, অর্থাৎ 'লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড' না থাকলে বিএনপি নির্বাচনে যায় কী করে?

এসব বক্তব্য থেকে বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়া না-নেওয়া নিয়ে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, যে যা-ই বলুক না কেন আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে। আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়া ছাড়া বিএনপির সামনে আর কোনো বিকল্প নেই।

সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীরা ক্রমাগতই বলছেন যে, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে, কারণ তা না হলে বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, শুধু নিবন্ধন বাতিল নয়, আগামী নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপির রাজনৈতিক অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে। দলে হয় ভাঙন দেখা দেবে, না হয় নির্বাচনে অংশগ্রহণে আগ্রহী অনেকেই দলত্যাগ করবেন।

বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার খুব একটা আগ্রহ না থাকলেও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত 'না' বলতে পারবেন না বলেই মনে হয়।

আগামী নির্বাচন যে সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই হবে– সেটাও প্রায় নিশ্চিত। সরকার তার অবস্থান থেকে সরে আসবে না। আন্দোলন করে দাবি আদায় করার মতো সাংগঠনিক সক্ষমতাও বিএনপির নেই। ২০১৪-১৫ সালের আন্দোলনের যে পরিণতি হয়েছে– সেটা নিশ্চয়ই বিএনপির মনে আছে।

বিএনপির কর্মীবাহিনী আছে, জনসমর্থনও আছে, কিন্তু আন্দোলনের মাধ্যমে বিজয় আনতে পারার অভিজ্ঞতা নেই। উল্টো আন্দোলনের নামে ব্যাপক সন্ত্রাস-সহিংসতা করে মানুষের মধ্যে একধরনের আন্দোলনভীতি তৈরি হওয়ায় দেশের নিয়মাতান্ত্রিক-গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়েছে। বিএনপির নীতিনির্ধারকরাও এটা জানেন যে, আন্দোলন করে তারা দাবি আদার করতে পারেন না। তারপরও সরকারকে চাপে রাখার জন্য তারা নির্বাচন সহায়ক সরকারের কথা, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশের কথা, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা বলতেই থাকবেন।

খ.
২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য যেভাবে যেনতেন উপায়ে একটি সাজানো-পাতানো নির্বাচন হয়েছে, পরবর্তী নির্বাচনও ঠিক একইভাবে হবে বলে অনেকেই মনে করেন না। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাও জোর দিয়েই বলছেন যে, আগামী নির্বাচন নিয়ে কোনো ধরনের প্রশ্ন উঠুক– সেটা তিনি চান না। কাজেই আগামী নির্বাচন হবে অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ।

যদি আগামী নির্বাচনে বিএনপিসহ নিবন্ধিত সব দল অংশগ্রহণ করে, নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠু হয়, তাহলে ফলাফল কী হবে? আওয়ামী লীগ কি ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবে?

রাজনীতির সামান্য খোঁজ-খবর যারা রাখেন তারাই জানেন যে, আওয়ামী লীগ অন্তত আরেক দফা ক্ষমতায় থাকতে চায়। এর একটি কারণ, সরকার যেসব উন্নয়নমূলক মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে সেগুলো শেষ করতে হলে আরও এক মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে হবে। এর বাইরেও আরও দুটি বড় কারণ আছে:

১. ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী এবং
২. ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হবে।

এ দুটি বার্ষিকী আওয়ামী লীগ অত্যন্ত সাড়ম্বরে উদযাপন করতে চায়, যার প্রস্তুতি এখন থেকেই শুরু হয়ে গেছে। ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতার বাইরে থাকার মধ্যে যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য এটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন হয় না। ক্ষমতায় না থাকলে বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন জৌলুসময় করার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা তৈরি হবে। এজন্যও আওয়ামী লীগ চাইবে আরেক দফা ক্ষমতায় থাকতে।

আরেক দফা ক্ষমতায় থাকতে চাওয়ার একটি রাজনৈতিক বিবেচনাও আছে। আওয়ামী লীগের অনেকেই হয়তো মনে করেন, আরও এক মেয়াদে যদি বিএনপিকে ক্ষমতার বাইরে রাখা যায় তাহলে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে দলটি চরম সংকটের মধ্যে পড়বে। বিএনপির সমর্থক গোষ্ঠীর মধ্যেও ভাঙন তৈরি হবে।

এখন প্রশ্ন হল, আওয়ামী লীগ যা চাইছে, সবকিছু কি সেভাবেই ঘটবে?

কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক পরিকল্পনা ও কৌশলকে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার পরিকল্পনা ও কৌশল টেক্কা দিতে পারছে না। শেখ হাসিনা যা করতে চাইছেন, তা করতে পারছেন। খালেদা জিয়া যা চাইছেন, তা করতে পারছেন না।

গ.
আগামী নির্বাচনের ফলাফল কী হবে, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে নানা ধরনের জল্পনা-কল্পনা শোনা যাচ্ছে। একটা সাধারণ ধারণা অনেকের মধ্যে চালু আছে যে, দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে মানুষ বিএনপিকে ভোট দেবে। বিএনপি নেতারাও এই দাবি করে থাকেন, এই প্রচারণা চালিয়ে থাকেন। এমন ধারণা ও প্রচারণার বাস্তব ভিত্তি আছে বলে মনে হয় না।

এটা ঠিক যে, দেশে অসংখ্য রাজনৈতিক দল থাকলেও নির্বাচন এলে প্রকৃতপক্ষে দল দাঁড়ায় দুটিতে। একটি আওয়ামী লীগ, অন্যটি 'অ্যন্টি-আওয়ামী লীগ'। এই অ্যান্টি-আওয়ামী লীগেরই স্বাভাবিক নেতৃত্ব পায় বিএনপি।

বিভিন্ন জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে এটা দেখা যায় যে, দেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোট কাছাকাছি। এই দুই দলের যারা কট্টর সমর্থক তারা খুব সহজে পক্ষ বদল করেন না। নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণ করে থাকে মূলত 'ভাসমান' ভোটাররা, অর্থাৎ যারা কোনো দলের অন্ধ সমর্থক নন।

সুষ্ঠু ভোট হলেই মানুষ বিএনপিকে ভোট দেবে– এটা যেমন ঠিক নয়, তেমনি এটাও ঠিক না যে, বর্তমান সরকার দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিচ্ছে বলেই মানুষ 'নৌকায়' ভোট দেবেন। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দুটি মোটামুটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ফলাফল আমরা বিবেচনায় নিতে পারি। একটি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন, অন্যটি কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন।

নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভি আর কুমিল্লায় বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছেন। দুই সিটিতে দুই ধরনের ফলাফল হল কেন? মানুষ ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে বলেই নারায়ণগঞ্জে বিএনপি প্রার্থীকে যেমন ভোট দেয়নি, তেমনি উন্নয়নের গান কুমিল্লার আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে সফলতা দেয়নি। আমার ধারণা 'প্রার্থী' ছিল এই জয়-পরাজয়ের বড় 'ফ্যাকটর'। সেজন্য আগামী নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণে দল যেমন, তেমনি প্রার্থী মনোনয়নও হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

ঘ.
সম্ভবত আগামী নির্বাচন সামনে রেখেই হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। হেফাজতে ইসলামের প্রধান মাওলানা আহমদ শফি– যিনি 'তেঁতুল হুজুর' হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন– সদলবলে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আতিথ্য গ্রহণ ও এক মঞ্চে আসন লাভের ঘটনা রাজনীতিতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

বেশ কিছুদিন থেকেই এই অভিযোগ জোরালো হয়ে উঠেছে যে, হেফাজতের দাবি মেনেই স্কুল পাঠ্য ইয়ে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে, সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হয়েছে। হেফাজতের গণভবন অভিযানের পর দেশে নতুন করে এই প্রশ্ন সামনে এসেছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হেফাজতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভালো করলেন, না খারাপ করলেন?

কেউ বলছেন: শেখ হাসিনা হেফাজতের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন; কেউ বলছেন: না, এটা আত্মসমর্পণ নয় কৌশলগত পশ্চাৎপসরণ।

'আত্মসমর্পণ' মানে একেবারে পরাজয় মেনে নেওয়া, আর 'পশ্চাৎপসরণ' হল সাময়িক পিছু হটা।

শেখ হাসিনাকে যারা চেনেন-জানেন, তারা এটা মানতে রাজি নন যে, তিনি আত্মসমর্পণ করেছেন। বরং এটাই ঠিক যে, হেফাজতকে আগামী নির্বাচনের আগে দেশে 'ধর্মের কার্ড' ব্যবহার করে অহেতুক উত্তেজনা ছড়ানোর সুযোগ না দিয়ে বাগে রাখার কৌশল হিসেবেই আপাতত কিছুটা পিছু হটেছেন, নমনীয়তা দেখিয়েছেন। শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতের দখল হটানোর জন্য যিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার পরিচয় দিতে পারেন, তিনি কোনো উগ্রবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারেন না।

ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনা যেমন শতভাগ ধর্মানুরাগী, তেমনি তিনি একইসঙ্গে শতভাগ অসাম্প্রদায়িক-ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার অধিকারী।

গত শতকের নব্বইয়ের দশকে জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীর সঙ্গে একটি বৈঠক নিয়েও শেখ হাসিনা ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। দেশের বাম-প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক মহল তখন জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়টি সুনজরে দেখেননি। কিন্তু জামায়াতকে বিএনপি থেকে দূরে রাখার কৌশল হিসেবেই শেখ হাসিনা তখন জামায়াতের প্রতি নমনীয় ছিলেন। তাঁর এই কৌশল যে রাজনৈতিকভাবে সঠিক ও কার্যকর ছিল, তা পরের নির্বাচনেই বোঝা গেছে।

বিএনপির সঙ্গে থেকে একানব্বইয়ের নির্বাচনে জামায়াত সংসদে ১৮টি আসন লাভ করেছিল, আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করার পর ছিয়ানব্বইয়ের নির্বাচনে জামায়াত পায় মাত্র তিনটি আসন।

শেখ হাসিনা যে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা পালনকারী উগ্র সাম্প্রদায়িক জামায়াতের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি, তার বড় প্রমাণতো দেশ-বিদেশের নানা চাপ-ষড়যন্ত্র-বাধা উপেক্ষা করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও বিচারের রায় কার্যকর করা। এখন হেফাজতের ব্যাপারেও যে সন্দেহ ও বিতর্ক দেখা দিয়েছে তা-ও দূর হবে, যদি পরবর্তী নির্বাচনে এই শক্তি বিএনপি থেকে দূরে থাকে।

বিপুল সমর্থক গোষ্ঠী নিয়ে হেফাজত যদি বিএনপির 'ভোট ব্যাংকে'র কাজ না করে তাহলে নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলেও বিএনপির জয়লাভের আশা ক্ষীণ।