ফাঁসি বনাম যাবজ্জীবন: ‘আমি নয়নজলে ভাসি’

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 16 May 2017, 04:27 AM
Updated : 16 May 2017, 04:27 AM

কাঙালের কথা বাসি হলে ফলে। যখন চারদিকে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব, শাহবাগে উচ্চকিত লাখো মানুষের সামনে নেতা এক নতুন সরকার, তখন আমি খুব ভয়ে ভয়ে, সন্তর্পণে 'বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম'এ লিখেছিলাম, হিসাব বলছে আসল সরকারের হাতে গোলাম আযম, দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসি হবে না।

আমার ঘোর সন্দেহ ছিল নিজামীর বেলায়ও। কিন্তু নানাবিধ চাপে নিজামীকে ঝোলাতেই হয়েছে।

আজ যখন এ লেখা লিখছি দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর আমৃত্যু কারাগারে থাকা বা যাবজ্জীবন সাজা বহাল রয়েছে বিচারে। সামাজিক মিডিয়ায় 'জয় বাংলা' লিখে দলবাজী যেমন থেমে আছে, তেমনি থেমে গেছে রায় ও ফাঁসি নিয়ে উচ্ছ্বাস। আমরা মোটামুটি ধরে নিতে পারি শাহবাগের শক্তি নির্জীব করার রাজনীতি এখন 'কম্পলিটেড', তার আর দরকার নেই রাজনীতির।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি কেন্দ্র করে বাংলাদেশে কম অশান্তি হয়নি। একটি জাতির জীবনে যখন শান্তি ও প্রগতি আসলেই অনিবার্য এবং যখন তার সামনে যাওয়ার সময় তখন তাকে অতীতমুখী করার পরও আমরা একে ইতিহাসের দায় মোচন ও অপরাধের হাত থেকে দেশ জাতির মুক্তি বলে মেনে নিয়েছি।

শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও তাঁর হঠাৎ ঝলসে ওঠার শুরুতে জাতি পেয়েছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও শাস্তি। সে বিষয়ে জাতিকে কোথাও ঐক্যবদ্ধ হয়ে মিছিল বা সমাবেশ করার প্রয়োজন পড়েনি। জনগণের মনে এক বিষাদময় অধ্যায় জাতির জনকের করুণ বিদায়। কিন্তু তারা কোনো প্রতিকার বা বিচার পায়নি। একের পর এক সামরিক শাসন আর বিএনপির আমলে সে ইচ্ছা মনের ভেতর গুমরে মরেছিল মানুষের। যখন এই বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত হল, দেশ-বিদেশে মানুষের মনে স্বস্তি দেখেছি। কারণ ততদিনে সবাই বুঝে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার হত্যাকাণ্ডের পরই এদেশে মূল অশান্তির শুরু। দেশ যে ধীরে ধীরে পাকিস্তানের ছায়ারাষ্ট্রে পরিণত হতে চলেছিল তার কারণও পঁচাত্তরের সেই হত্যাকাণ্ড।

নেতৃত্বহীনতা আর দেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় বড় হতে দেওয়ার আরেকটি বড় সূত্র যে জেলহত্যা, তার সুরাহা বা বিচার আওয়ামী লীগ মুখে বললেও এখনও তা হয়নি। ফলে আমার মতো সন্দেহপ্রবণ মানুষের মনে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি নিয়ে কিছুটা সন্দেহ থাকাটা তাই দুদিক থেকেই ছিল যৌক্তিক।

একদিকে যেমন দলীয় রাজনীতির ছদ্মবেশ আরেকদিকে মানুষের দোদুল্যমানতা। জনগণকে দোষী করা যাবে কোন উপায়ে? যে জামায়াতের নেতাদের অনেককাল পর জনরোষের শিকার হতে হল তারাই তো বাঘা বাঘা নেতাদের ভোটে হারিয়ে সাংসদ হয়েছিলেন। মন্ত্রী হয়েছিলেন।

সময়ের কাজ সময়ে না করলে যা হয় পাপের বোঝা বাড়তে বাড়তে একসময় তা পুণ্য আড়াল করে ফেলে। দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর কাছে হেরেছিলেন সুধাংশু শেখর হালদারের মতো জনপ্রিয় নেতা। অন্যদিকে দেশজুড়ে জামায়াতের নেটওয়ার্কের পেছনে যেমন ছিল মীর কাশেমের অঢেল অর্থ, মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলার ও আইএসের মদদ তেমনি ছিল সাঈদীর অসাধারণ বাগ্মিতা। তার ওয়াজের ক্যাসেট যারা শুনেছেন, মানবেন, সে এক সম্মোহনী শক্তির ব্যাপার। আমি বেশ কয়েকবার শুনেছি পুরনো সেই কুমির রচনার মতো সবকিছু আখেরে রাজনীতির পচা পানিতে ডুবিয়ে নিলেও তার ক্যাসেটবন্দি ভাষণ বা ওয়াজ যারা তার মুরিদ তাদের জন্য দাওয়াইতূল্য। সময়ের ফাঁকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক বিশাল ভক্তগোষ্ঠীর কথা আওয়ামী লীগের অজানা নয়। তাদের দাবার ছকে শাহবাগের গুরুত্ব যত ফুরিয়ে আসছিল ততই আমি নিশ্চিত ছিলাম এমনটা হবেই।

যারা আমাকে ইতোমধ্যে ভুল বুঝতে চাইছেন তাদের বলি, রাজনীতি এমন এক নেশা বা এমন এক খেলা যেখানে জাপানের সঙ্গে আমেরিকার দোস্তি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আনবিক বোমায় মুছে যাওয়া শহর হিরোশিমা-নাগাসাকির দেশে একসময় মানুষ জানত এই বোমা ফেলেছিল হিটলার বাহিনী। ভিয়েতনাম সফরকালে দেখেছি তারা তাদের নাপাম বোমায় ঝলসে যাওয়া স্বজনদের ভুলে ওবামাকে মেনে নিয়েছে মনের মানুষরূপে।

বিচিত্র এই দুনিয়ায় আমরা কি আর আগন্তুক? আমাদের জনগণের এক বিরাট অংশের মনে জামায়াত প্রীতি আর সাঈদী প্রীতির কথা আওয়ামী লীগের জানা। তা ছাড়া এটা তারা ভালো বোঝে এখন জামায়াত চাইলেও আর কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না। কোমর ভাঙার জন্য যা যা দরকার সেটা হয়ে গেছে। এখন তাদের মূল টার্গেট বিএনপি ও হেফাজত।

যেসব কারণে মনে হয়েছিল গোলাম আযম ও সাঈদীর ফাঁসি হবে না সে কারণগুলো এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট। ব্যালান্সের রাজনীতি বা ভারসাম্যের পলিটিক্সে এগুলো বিষয় নয়। সব দলে এখন মুড়ি-মুড়কি একাকার। আওয়ামী লীগের দিকে তাকলেই চোখে পড়বে তারা এখন প্রাণপন চেষ্টা করছে সমঝোতা করে দেশশাসনে থাকতে। ইতোমধ্যে দলীয় আদর্শ বা আদর্শিক ব্যাপারগুলো প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এমনই হাল বিএনপি ২০৩০ সালের যে রূপকল্প দিয়েছে তাকেও তারা বলছে এটি তাদের 'নকল'। তার মানে 'আসল' বলতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। অথবা সব মিলেমিশে এখন একাকার।

বিচারপতি এস কে সিনহার বক্তব্যে যারা রাগ করছেন তাদের বলি, ইতিহাসটাও জানুন। নামে অমুসলিম হলেই যদি মুক্তিযুদ্ধের কারিগর বা অনুগত হত তাহলে এদেশে একাত্তরে যেমন মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা বা রাজা ত্রিদিব রায়ের জন্ম হত না, তেমনি এখন কোনো গয়েশ্বর রায়েরও দেখা মিলত না। তবে ভদ্রলোক নিঃসন্দেহে স্পষ্টবাদী। এ পর্যন্ত একবারই তাঁর সঙ্গে সামনাসামনি সময় নিয়ে কথা বলার সুযোগ হয়েছে আমার। সিডনিতে বেড়াতে আসা প্রধান বিচারপতির মুখে এমন সব কথা শুনেছি যা লিখলে নতুন এক ইতিহাস হবে হয়তোবা। তবে তিনি বারবার বলেছিলেন, তাঁর ওপর অর্পিত রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনে তিনি একশ পার্সেন্ট দলমুক্ত থাকতে চাইবেন। এ-ও বলেছিলেন, তিনি সব দলের বিচারপতি। এমনকি প্রয়োজন মতো জামায়াতের বেলায়ও তিনি তাঁর ভূমিকা বজায় রাখবেন।

আমার স্পষ্ট মনে আছে, তিনি অভিযোগ করেছিলেন, এখন নাকি চল্লিশোর্ধ্ব মানুষকেও একাত্তরের ভূমিকার নামে ফাঁসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একজন বিচারপতি হিসেবে তাঁর ভূমিকা তিনি কীভাবে পালন করবেন সেটা আমরা নির্ধারণ করব না। কিন্তু ইতিহাস ও অতীতের বিচারে অপরাধীদের বেলায় দেশ, সরকার ও চেতনা নামের বিষয়গুলো মাথা উঁচু করে জানতে চায়, এ কারণেই কি স্বাধীন হয়েছিলাম আমরা?

কথিত আছে– উপমহাদেশের রামায়নে অসুর রাজা রাবণের পতনের পর রাম তার অনুজ লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে রাবণের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল দুটো: স্বর্ণলঙ্কা নামে পরিচিত লঙ্কার কান্ডারি রাবণের কাছে তার সাফল্যের কারণগুলো জানা, আর কীভাবে দেশশাসন করা উচিত সে বিষয়ে মতামত নেওয়া।

পতিত রাবণ বলেছিলেন, দেশ শাসনে জরুরি কাজ কখনও পরে করব বলে ফেলে রাখতে নেই। তিনি যদি স্বর্গের সঙ্গে সিঁড়িটি তখনই বানিয়ে নিতেন তবে তাকে রামের হাতে মরতে হত না।

গল্পটা বললাম এই কারণে, আওয়ামী লীগকে গোলাম আযম ও সাঈদীর কাছ থেকে সবক নিতে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছিল বা চাইছে? আর যদি তা হয়ও আওয়ামী লীগ কি একাত্তরের পর কখনও ঠিক সময়ে ঠিক কাজটি করতে পেরেছে?

সময়ের স্রোতে এদেশের রাজনীতি যে কীভাবে পাল্টায় কীভাবে চোখ উল্টাতে পারে, সেটা আমরা বহুবার দেখেছি। আমাদের চোখের সামনে শাহ আজিজ এদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। মাওলানা মান্নানের মতো দাগী লোক সর্বোচ্চ পুরস্কার পেয়েছে, মন্ত্রী হয়েছে। সাকা চৌধুরীর লাশের জানাজা পড়তে গিয়েছিলেন আওয়ামী মেয়র মহিউদ্দীন চৌধুরী।

যে কেউ ধর্মীয়ভাবে কারো মৃত্যুতে দোয়া করতেই পারেন। কিন্তু আপনি যার মৃত্যুর জন্য আন্দোলন করেন, যাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্য আন্দোলনের নামে দেশের মানুষকে জাগিয়ে তোলেন, সেই আপনি যখন লাশের জানাজায় গিয়ে দাঁড়ান, তখন কি আদর্শ-অনাদর্শ সব চুকেবুকে যায় না?

এমন গোলমেলে রাজনীতির সমাজে দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসি হবে না; হতে পারে না। আর সেই শাহবাগের নেতারা ও এখন গৃহবন্দি ঘরজামাই। কারো শক্তি নেই সামনে এসে দাঁড়ায়। কেবল কিছু অসহায় মানুষের মুখ, পরদেশে পালিয়ে বাঁচা মানুষ, পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া ঘরবাড়ি, মাটিতে মুখ লুকিয়ে পড়ে থাকা মূর্তি আর চেতনাবাহী জনগণের ভাঙা মন কেঁদে বেড়ায়। তারা জানতে চায় এ কোন লীলাখেলা? মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এ কোন ধরনের পরিচয়? স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সমঝোতা ও আপসের দলীয় রাজনীতি এখন গদি ছাড়া আর কিছুই বোঝে না।

এই রায় আপিল খারিজের পর অরণ্যে রোদনের বাকি আর কিছুই রইল না আমাদের। লাখো মানুষের আত্মা আর ইজ্জত হারানো মা-বোনের মাটিতে কেঁদে বেড়ানো স্বপ্ন আর হতাশা হাত ধরাধরি করে হাঁটে আর চোখ মুছতে মুছতে বলে:

"তোমার বদনখানি মলিন হলে আমি নয়নজলে ভাসি।"

ফাঁসি আর যাবজ্জীবনের এই খেলায় একদিন এই গান পতাকা-স্বাধীনতা কোথায় ঝুলে যায় সেটাই এখন ভাবার বিষয়।