এই কোলকাতায় বড় অসময়ে রবীন্দ্রনাথ

সুখরঞ্জন দাশগুপ্তসুখরঞ্জন দাশগুপ্ত
Published : 15 May 2017, 04:50 AM
Updated : 15 May 2017, 04:50 AM

ট্রাজেডিতে পরিমিত হাস্যরসের উপস্থিতি ক্লাসিক সাহিত্যের লক্ষ্মণ। সেই অর্থে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধ্রুপদী এবং বঙ্গ তথা গোটা দেশে, এমনকি বিদেশেও তিনি অমরত্ব লাভ করেছেন। কিন্তু তাঁর জন্মতিথিতে দাঁড়িয়ে গভীর একটি সংশয় মাথাচাড়া দিয়েছে।

অমর হয়তো হলেন, কিন্তু তিনি আর কতদিন বাঙালির প্রাণের কবি হয়ে থাকতে পারবেন? বর্তমান আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কতখানি প্রাসঙ্গিক তিনি? আর কতদিন থাকবেন প্রাসঙ্গিক?

কারণ ট্র্যাজেডিতে অপরিমিত ও বল্গাহীন হাস্যরসের প্লাবন বইতে শুরু করেছে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। কেন্দ্র, রাজ্য এমনকি পড়শি দেশ বাংলাদেশেও একই ছবি। এমননিতেই বঙ্গবাসীর নিয়মিত রবীন্দ্র রচনাবলী বা গীতবিতানের ধুলো ঝাড়ার অভ্যেসটুকুও নেই। বাঙালির দিনমন্ত্র হল:

"অনন্ত সময় আছে, বসুধা বিপুল…"

এইরকম একটা পরিস্থিতিতে হচ্ছে এবারের রবীন্দ্রস্মরণ এবং উঠছে এই সঙ্গত প্রশ্নটাও।

হয়তো এটাই আসল কথা। অমরত্ব লাভের জন্য কেউ শচীন টেন্ডুলকর হন না। স্যার এডমুন্ড হিলারিও হন না। বাংলার অত্যন্ত জনপ্রিয় কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন:

"মরার পরে লাইব্রেরির অনেক বইয়ের ভিড়ে আরেকটা বই হয়ে বেঁচে থাকার জন্য আমি আমার জীবন অপচয় করতে চাই না।"

তানপুরার তারে যখন ধুলো জমবে, কাঁটালতায় ভরে যাবে আঙিনা, জংলি ঘাসে ভরে যাবে তাঁর বাগান, সেখানে নিছক 'অমর কবি' হয়ে দেয়ালে ঝুলতে কি রবীন্দ্রনাথেরও ইচ্ছে হত? তাহলে কেন এই চেতনার অনর্গল রক্তপাত? সে কি কেবল বেদনাবিধূর দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকা, যখন নিজের গান শুনে বাকশক্তিহীন গায়কের নিজেরই মনে হয়, আমিও একদিন এরকম গান করতুম? একথা মনে হচ্ছে কারণ নীতিহীন, বন্ধ্যা এক বঙ্গজীবনে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করতে হচ্ছে বলে।

ট্রাজেডি মনে হচ্ছে? হতেই পারে। কারণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রয়ে গিয়েছেন 'সেন্স অব ট্র্যাজেডি' যাদের বিন্দুমাত্র নেই সেইসব নির্বোধ কোরাসের জন্মতিথি পালনের উদ্যোগে। রবীন্দ্রনাথের লেখা একেকটি লাইন, তাঁর বলা একেকটি কথা, তাঁর উচ্চারিত একেকটি সুর বাঙালিকে জীবনের রূপ-রস-রং-বর্ণ-ছন্দ এবং বর্তমান সমাজচেতনার মধ্যে প্রতি মুহূর্তে তৈরি হয়ে চলেছে দুস্তর ব্যবধান। উনি বলেছিলেন:

"ভয়ের তাড়া খেলেই মানুষ ধর্মের মূঢ়তার পিছনে মানুষ লুকাতে চেষ্টা করে।"

আজকের 'স্বচ্ছ ভারতে' তাঁর ঐ বাক্যের কী অর্থ করা সম্ভব? মানুষ ভীত? তাই ধর্মের মূঢ়তার আশ্রয় নিচ্ছে? নাকি ধর্মই গোটা দেশে এবং কবির প্রিয় বাংলাদেশেও ত্রাসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে?

রবীন্দ্রনাথের প্রয়ানের (১৯৪১) পর ৭৬ বছর অতিক্রান্ত। শুধু বাংলা নয়, গোটা বিশ্বেই প্রচণ্ড পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। ডব্লিউটিও, গ্যাট চুক্তি, বিশ্বায়ন, পশ্চিম ইওরোপের দেশগুলির ভাঙন এবং পুনর্গঠন, মুক্ত অর্থনীতি গোটা প্রেক্ষাপটই পাল্টে দিয়েছে। পাল্টে গিয়েছে রবি ঠাকুরের বঙ্গভূমিও।

তিনি বলেছিলেন:

"পৃথিবীতে বালিকার প্রথম প্রেমের মতো সর্বগ্রাসী প্রেম আর কিছুই নাই। প্রথম জীবনে বালিকা যাঁকে ভালোবাসে, তাহার মতো সৌভাগ্যবানও আর কেহই নাই। যদিও সে প্রেম অধিকাংশ সময় অপ্রকাশিত থেকে যায়, কিন্তু সে প্রেমের আগুন সব বালিকাকে সারাজীবন পোড়ায়…"

সেই অনির্বচনীয় প্রেমই-বা কোথায়? আজকের প্রেম তো বাঙ্ময়, সোচ্চার এবং অনেকটাই পারমুটেশন-কম্বিনেশনের অংকের মতো। যেখানে তীব্র দহন নেই বরং রয়েছে প্রকাশের সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা। সারা জীবনের দহন তো কাব্যের কথা, তা নিয়ে এ যুগে এক মুহূর্তও পড়ে থাকার সময় নেই। ফলে সেই সৌভাগ্যবান বালকরাও আর নেই।

রবীন্দ্রনাথও বিজ্ঞান-যুগের মানুষ। তাঁর সময় বিজ্ঞানের নবজাগরণ হচ্ছিল, তিনি তাঁর উৎসাহী সাক্ষী ছিলেন। কিন্তু একই সঙ্গে গুরুদের সংস্কৃতি এবং মানবতারও পূজারী ছিলেন। বিজ্ঞানের প্রসার চাইতেন কবি। বিজ্ঞানচেতনার মাধ্যমে সমাজ গঠনের কথা ভাবতেন। আজও সবাই বিজ্ঞানের প্রসার চায়। আজ বিজ্ঞান আরও উন্নত, আরও সুসংহত, আরও লক্ষকেন্দ্রিক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মানবিকতার কোনো রেশ সেখানে থাকে না।

ব্যক্তি এবং সমাজের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান তৈরি হয়ে গিয়েছে গত সাত দশকে। উন্নততর বিজ্ঞানের যুগে উন্নততর মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন কবি। কিন্তু আমরা পৌঁছেছি এমন একটা যুগে যেখানে পশুকে বাঁচাতে মানুষকে হত্যা করাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনই একটা পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন।

কালজয়ী কবি কিন্তু সতর্ক করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন:

"চোখ কতটুকুই দেখে, কান কতটুকই শোনে, স্পর্শ কতটুকুই বোধ করে। কিন্তু মন এই আপন ক্ষুদ্রতাকে কেবলই ছড়িয়ে যাচ্ছে।…"

কিন্তু ওই, তাঁর বলা অনেক লাইনের মতো এই লাইনটাই রয়ে গিয়েছে লাইব্রেরির কোনো তাকে ধুলোলাঞ্ছিত কোনো বইয়ের মধ্যে। প্রথামতো, রবীন্দ্র-গান, রবীন্দ্র-নাট্য, রবীন্দ্র-সাহিত্য, রবীন্দ্র চর্চা হল এবারও। কবির শান্তিনিকেতন থেকে শুরু করে রবীন্দ্রভারতী, বিশ্বভারতী, একাডেমি, নন্দন, নবান্ন এবং অফিসে অফিসে, স্কুলে-কলেজে, পাড়ার ক্লাবে ক্লাবে। কিন্তু অন্যান্যবারের মতো এবারও 'মনের আপন ক্ষুদ্রতা' দূর করার শপথ নেওয়া হয়নি না কোথাও। কোথাও কোথাও দেখা যায় কোনো মুখ্যমন্ত্রীর বিশালাকার কাট-আউটের তলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মালা-পরানো ছবি, অমরত্বের প্রতীক।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন:

"মনুষ্যত্বের শিক্ষাটাই চরম শিক্ষা, আর সবকিছু তার অধীন।"

ঘুম থেকে উঠে চারপাশে তাকালে এই দুটো ব্যাপারেই চরম অবক্ষয়ের স্বাক্ষর মেলে। মনুষ্যত্ব এবং মনুষ্যত্বের শিক্ষা। কাগজে কাগজে প্রায় প্রতিদিনই খবর দেখা যায়, এ রাজ্যে মানুষ গড়ার যে প্রতিষ্ঠানগুলি রয়েছে সেখানে নাকি গণতন্ত্র নেই। তার জন্য যত্রতত্র আন্দোলন চলে। গণতন্ত্র তো দূরের কথা, এ দেশে টোকাটুকি করার অধিকারের দাবিতে শিক্ষকের মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। পাঁচিল টপকে, দেয়াল বেয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে নকল সরবরাহ কাগজের প্রথম পাতায় চার কলামজুড়ে ছাপা হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় টোকাটুকিও বোধহয় কারও কারও গণতান্ত্রিক অধিকার।

এই গণতন্ত্রের পক্ষে আজীবন সওয়াল করে গিয়েছেন কবিগুরু? তাই প্রশ্নটা উঠেছে সঙ্গত কারণেই। এমনই একটি শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে এবারের রবীন্দ্রস্মরণ।

কবি আরও বলেছিলেন:

"অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার ধরিয়া রাখার মতো বিড়ম্বনা আর হয় না।"

যথার্থ বলেছিলেন। কবির অধিকার, কাব্যের অধিকার তো কবেই হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। এখন শুধু শুধু কবির অধিকার ধরে রাখার বিড়ম্বনা তৈরি হয়েছে বঙ্গজীবনে। বঙ্গজীবনে কেন, গোটা দেশেই। নাহলে যে যুগে মানুষের হাতে চাঁদ এসে গেছে, সেই যুগে দাঁড়িয়ে এমন কথাও শুনতে হয় যে, অসমে নাকি ফতোয়া জারি হয়েছে, স্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করা হলে কড়া শাস্তি পেতে হবে। বিড়ম্বনা ছাড়া আর কী?

কবি গেয়েছিলেন:

"আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়
আমি তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথে যে জন ভাসায়।"

যথার্থ গেয়েছিলেন।

লিগ অব নেশনস, কিংবা ইউনাইটেড নেশনস তৈরি হওয়ার অনেক আগে রবীন্দ্রনাথই সেই আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব যিনি বলেছিলেন:

"মানুষে মানুষে বিভেদ হয় না। দেশ, কাল, জাতি, ধর্ম, রাজনীতি, রঙের বিচারে মানুসে মানুষে ভোদাভেদ সম্ভব না।"

বিশ্বসংসারের ব্যাখ্যা দিয়ে গিয়ে বলেছিলেন:

"সংসারে সাধু-অসাধুর মধ্যে পার্থক্য এই যে, সাধুরা কপট আর অসাধুরা অকপট।"

সেই কপটতা এখন সীমাহীন। সেই অসীম কপটতার মাঝে আবারও প্রথামাফিক রবীন্দ্রবন্দনা। কবি বলেছিলেন:

"এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না, শুধু সুখ চলে যায়।"

প্রেম ও সুখ দুই চলে যাওয়া এক তপ্ত বঙ্গ-বৈশাখে ফের পালিত হল রবীন্দ্রজয়ন্তী। ঋতুর কবি তিনি। বৈশাখ থেকে চৈত্র বারে বারে এসেছে তাঁর লেখায়। বঙ্গজীবনে এখনও ফিরে ফিরে আসে ঋতুচক্র। আষাঢ়-শ্রাবণ কিংবা বৈশাখে ফিরে আসে তাঁর গানও:

"আকাশে কার বুকের মাঝে ব্যথা বাজে
দিগন্তে কার কালো আঁখি
আঁখির জলে যায় ভাসি
ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি…
এই সুরে কাছে-দূরে।"