আবু বাকারের লেখা ও আমাদের পুরুষতান্ত্রিক মনস্তত্ত্ব

পারভীন সুলতানা ঝুমা
Published : 17 May 2017, 03:11 PM
Updated : 17 May 2017, 03:11 PM

সম্প্রতি কাশেম বিন আবু বাকার নামের এক লেখকের উপন্যাস নিয়ে খুব সোরগোল হচ্ছে, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তার সাক্ষাৎকারও প্রচারিত হয়েছে টিভি চ্যানেলে। কারো কারো মতে আবু বাকার একজন 'নিষ্পাপ লেখক'। যুব ও তরুণ বয়সীদের সবচেয়ে আকষর্ণীয় বিষয় 'প্রেম' নিয়ে লিখেছেন মাত্র। তবে তার ভেতর ইসলামি মূল্যবোধের মশলা ঢুকিয়েছেন তিনি।

একদিকে ইসলামি মূল্যবোধ অন্যদিকে 'অশ্লীলতা' ঢুকিয়ে তিনি তার লেখাকে মুসলমান তরুণ সমাজের কাছে লোভনীয় করে তুলছেন। টিভি সাক্ষাৎকারে তিনি 'অসাম্প্রদায়িকতার' কথা বলেছেন। হিন্দু-মুসলমানে তার কাছে কোনো ভেদাভেদ নেই বলেও তিনি জানিয়েছেন। এরপরও কেন তিনি শুধু মুসলমানদের জন্য লিখছেন এর উত্তর অনেকটা ছিল এরকম:

"আমি যা অনুসরণ করি তা লিখি।"

'ধর্মীয় অনুভূতি' পুঁজি করে লিখলেও তার এই অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য প্রগতিশীলরা হয়তো তাকে ক্ষমা করে দেবেন। তবে কথা হচ্ছে, তার লেখা নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু তার লেখনিতে নারীদের কীভাবে উপস্থাপনা করা হচ্ছে তা নিয়ে কেউ আলোচনাও করেননি, উদ্বিগ্নও নন। তার 'ফুটন্ত গোলাপে'র নায়িকা চা-কফি খান না এ কারণে যে, চা-কফি খাওয়া 'মেয়েদের' জন্য ভালো না। যদিও তার নায়িকা কলেজে পড়ে, ক্লাসে ফাস্ট হয়, কিন্তুু সে উর্দু গজল গায়, কারণ অন্য গান গাওয়া 'হারাম'। অবশ্যই তার নায়িকারা বোরকা পরিহিতা।

এদেশের গড়পড়তা পুরুষ যেভাবে নারীদের দেখতে চায় ঠিক সেভাবেই তার লেখায় নারী চরিত্র উঠে এসেছে। নারী থাকবে পুরুষের অনুগত। স্বামীর পায়ের নিচে বেহেস্ত, এই চর্বিত-চর্চিত বাণী জায়গামতো উপস্থাপন করতে তিনি ছাড়েননি। প্রায় ৩০ বছর আগের বাংলা সিনেমার গানের কথা মনে পড়ে যায়:

"আমি তোমার বঁধু, তুমি আমার স্বামী
খোদার পরে তোমায় আমি বড় করে জানি…"

এখনও যদি এ ঘরানার গান বা সংলাপ সেই একইভাবে জনপ্রিয় হয় তাহলে দুঃখ করতে হয় এই ভেবে যে, আমাদের মনমানসিকতা এক জায়গায় আটকে আছে।

গ্রাম বাংলায় নারীরা এগিয়েছে। একসময় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেশি ছিল। এখন বাংলাদেশে থেকে পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেশি। এর কারণ হচ্ছে এদেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সফল হয়েছিল, আর তা সম্ভব হয়েছে গ্রামের নারীদের জন্য। একটি বেসরকারি সংগঠনের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, স্বামীর কাছে গোপন রেখে গ্রামের নারীরা জন্ম নিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহার করতেন।

এখন আমাদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ঢিলে হয়ে গেছে। এর কারণ এনজিওগুলো দ্বারে দ্বারে গিয়ে নারীদের কাছে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী সরবরাহ করছে না। ফলে ইচ্ছা থাকলেও গ্রামের বহু নারী জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারছে না। জন্ম নিয়ন্ত্রণের দায়ভার শুধু নারীদের– এ মানসিকতা যেমন দাম্পত্য জীবনে তেমনি রাষ্ট্রীয় এমনকি বিশ্বজুড়েও বিরাজমান।

শুধু জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নয়, শিশু মৃত্যুহার কমানোর সফলতার পিছনেও গ্রামের নারীদের ভূমিকা অনেক বড়। তারা এখন জানে, শিশুর কোন বয়সে কী টিকা দিতে হবে, ডায়রিয়া হলে ওরাল স্যালাইন খাওয়াতে হয়। মানুষকে একধরনের আত্মবিশ্বাস এনে দেয়। এর সঙ্গে সংসারে তার একটা মর্যাদা তৈরি করে নিতে সাহায্য করেছে। কোনো কোনো গ্রামে মেয়েদের সাইকেল চালাবার দৃশ্য সহজ হয়ে উঠছে, ঘোড়া সওয়ার হচ্ছে গ্রামবাংলার মেয়েরা। বাড়ির পুরুষদের সহযোগিতা পাচ্ছে কেউ, কেউ অগ্রাহ্য করছে পুরুষের বৈরিতা।

সুতরাং বিষয়টা ইসলামের ভাবধারা বা প্রেমের বিষয় নয়। প্রেমও খারাপ কিছু না, ধর্মও না। বিষয়টি হচ্ছে নারীদের সে বইগুলোতে কী স্থান দেওয়া হচ্ছে। মেয়েদের বিয়ের বয়স কমিয়ে যে পশ্চাতপদতা প্রশাসনের তরফ থেকে দেখানো হল বা পাঠ্যবই হেফাজতিকরণ এবং কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রিকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির মর্যাদা প্রদানের ঘোষণা, হাইকোর্টের সামনে থেকে গ্রিক দেবী থেমিসের ভাস্কর্য সরানোর হেফাজতিদের দাবি উচ্চপর্যায় থেকে সমর্থন দেওয়া, এগুলোর পাশাপাশি আবু বাকারের বই সমাজকে আরও পিছিয়ে নিতে ইন্ধন যোগাচ্ছে কি না, তা নিয়ে মনে একটা ভীতি কাজ করছে।

আগেই বলেছি পরপর ঘটে যাওয়া প্রশাসন কর্তৃক হেফাজতি তোষণনীতি আমাদের উদ্বেগ ক্রমশ বাড়িয়ে তুলছে। পাঠ্যবই থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সত্যেন সেন, জ্ঞানদাস, ভারতচন্দ্র রায় গুনাকর, রনেশ দাসগুপ্ত, রঙ্গলাল বন্দোপোধ্যায় আর সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো অমুসলিম লেখকদের লেখা যেমন, তেমনি হুমায়ুন আজাদ, এস ওয়াজেদ আলী, কাজী নজরুল ইসলাম, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সানাউল হক এবং এমনকি গোলাম মোস্তফার মতো মুসলিম লেখকদের লেখাও।

অক্ষর শেখাতে গিয়ে শিশুদের শেখানো হচ্ছে 'ও'-তে 'ওড়না'। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা হাই কোর্টের সামনে থেকে লেডি জাস্টিসের ভাস্কর্য সরানোর পক্ষে, এবং সেটি জানাতে উচ্চপর্যায়ে গিয়ে দেখা করছেন। অথচ একটা প্রজন্মকে সাম্প্রদায়িক করার লক্ষ্যে যে পাঠ্যপুস্তকের পাঠ্যসূচি পরিবর্তন করা হচ্ছে তা নিয়ে কোনো বিকার নেই, শীর্ষপর্যায়ে গিয়ে প্রতিবাদ জানানো তো দূরের কথা, তেমনি মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানো নিয়েও নয়।

হয়তো দুয়েক বছর পর পাঠ্যপুস্তক আবার তার অসাম্প্রদায়িক অবয়ব ফিরে পাবে, কিন্তুু মাঝখান দিয়ে ওই পুস্তক পড়ে যে প্রজন্ম বের হবে, তাদের সামলাবে কে? তারপর কওমি মাদ্রাসার ডিগ্রিকে স্বীকৃতি দেওয়া, কওমি মাদ্রাসায় কী পড়া হয়, আমরা জানি না। অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানচেতনামূলক, বিশ্বসেরা সাহিত্য বা আধুনিক আইনসমূহ পড়ানো হলে তো ভালো, আর যদি না পড়ানো হয়– যেটার আশঙ্কা বেশি– সেটির পরিণতি হবে মারাত্মক। হয়তো এরপর তারা সরকারি চাকরিতে কোঠার জন্য দাবি জানাবে, বলা বাহুল্য সেই দাবি পূরণ করা হবে।

মধ্যযুগীয় আইন পড়ে এরা কীভাবে আধুনিক রাষ্ট্র চালাবে? পাকিস্তানে দাওয়ায়ে হাদিস ডিগ্রি স্বীকৃত। তাহলে কি আমরা পাকিস্তানকে অনুসরণ করছি? দুঃখ হয় যখন দেখি টিভি চ্যানেল সমাজের কিছু বিজ্ঞজন এ স্বীকৃতি প্রদান সমর্থন জানান; তারা পরোক্ষভাবে ধর্মভিত্তিক শাসনব্যবস্থাই সমর্থন করছেন।

ধর্মীয় রীতিনীতি অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা হলে তা কোনোক্রমেই একটি সম-অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র হতে পারে না। এটি ন্যূনতম জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ মাত্রই উপলদ্ধি করতে পারেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠা যদি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনা করার মূল উদ্দেশ্য হয় তাহলে নারীর সম-অধিকার কেন উপেক্ষা করা হবে? কেন পৈত্রিক সম্পত্তিতে কন্যা ও পুত্রসন্তান সমান ভাগ পাবে না? তেমনি সন্তানের উপর বাবার মতো মায়ের অধিকারের বিষয়টিও আমল দেওয়া হচ্ছে না।

'সিডও'এর এ-সংক্রান্ত দুই ধারার উপর সংরক্ষন রেখে বাংলাদেশে নারী উন্নায়নের জন্য যত কাজই করা হোক না কেন, সবই হবে শুভঙ্করের ফাঁকি। শুধু নারীর অধিকার নয়, যাদের কথা মুখে আনলেই মোল্লারা চাপাতি নিয়ে ছুটে আসবে, বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলে তারা আর দশটা মানুষের মতোই স্বাভাবিক, তাদেরও কোনো স্বীকৃতি দেবে না ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র। আধুনিক যুগে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা মানে একটা জাতিকে পিছিয়ে নিয়ে যাওয়া; আফগানিস্তান এর জ্বলন্ত উদাহরণ।

এসব প্রগতিশীল এসব ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র কায়েমের আশঙ্কা দেখেও চুপ করে আছেন। তারা মনে করছেন হেফাজতিদের কথা শোনা একটা কৌশল মাত্র। অথবা মনে করতে পারে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র শাসিত হলে নারীরা ঘরে আটকে থাকবে মাত্র, তাদের কী? নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার সুপ্ত ইচ্ছা তথাকথিত অনেক প্রগতিশীল পুরুষের মধ্যেও লুকায়িত থাকে। তাই তাদের স্ত্রীরা যখন হিজাবে আবৃত হয় তখন তাদের মধ্যে 'অসাম্প্রদায়িক' মানসিকতাও উধাও হয়ে যায়।

ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র কায়েম হয়নি, এরপরও ঢাকার রাস্তায় আমার নারী সহকর্মীরা দাড়ি-টুপিওলা পুরুষদের দ্বারা হেনেস্থা হচ্ছে। একা পেয়ে পাশে যেতে যেতে তারা ঘোমটা বা হিজাব ছাড়া নারীদের বলছে: "মাথায় ঘোমটা দে।"

কী দুঃসাহস!

আবু বাকারের লেখা নারীর পর্দা নিয়ে উদ্বিগ্ন পুরুষদের আরও উৎসাহিত করবে। তবে আবু বাকারের লেখা নতুন নয়। 'এএফপি'র মতো একটি আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা তাকে হাইলাইট করায় বর্তমানে তা 'বুদ্ধিচর্চাকারীদের' আলোচনার টেবিলে চলে এসেছে।

আবু বাকার 'চটি বই' লেখেন। 'চটি বই' সবসময় একশ্রেণির পাঠকের কাছে আদরনীয়। তবে এই চটি বইতে ধর্ম অনুসরণ অন্তর্ভুক্ত করার কারণে একটা ভীতি কাজ করছে। ভয় হচ্ছে হেফাজতিরা না আবার আবু বাকারের লেখা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানায়; তেমন দাবি জানালে সেটি যে পূরণ করা হবে না সে গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না।