মুম্বাই ডাব্বাওয়ালা: সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত

সাজ্জাদুল হাসান
Published : 21 July 2017, 01:56 PM
Updated : 21 July 2017, 01:56 PM

আধুনিক সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় তাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি নেই, নেই ন্যূনতম কোনো প্রশিক্ষণ। 'সিক্স সিগমা' (Six Sigma) তত্ত্ব নিয়ে হয়তো তাদের বেশিরভাগেরই নেই তেমন কোনো জ্ঞান। তারা সবাই একেবারে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ যাদের বেশিরভাগেরই শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। অথচ বিশ্বের অনেক নামি-দামি প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে গবেষণা সংস্থা 'মুম্বাই ডাব্বাওয়ালা'দের বিস্ময়কর সাফল্য নিয়ে করেছে বিস্তর গবেষণা। তৈরি হয়েছে প্রামাণ্যচিত্র, এমনকি চলচ্চিত্র।

১৯৯৮ সালে বিশ্বখ্যাত ব্যবসা বিষয়ক সাময়িকী 'ফোর্বস' কর্তৃক পরিচালিত এক গবেষণার ফল অনুযায়ী 'সিক্স সিগমা দক্ষতা রেটিং'-এ তাদের প্রাপ্ত স্কোর ৯৯.৯৯৯৯! এর অর্থ প্রতি ষাট লাখ কর্মসম্পাদনে (transactions) মুম্বাই ডাব্বাওয়ালাদের ভুল করার সম্ভাবনা মাত্র একবার!

কারা এই ডাব্বাওয়ালা? কী তাদের কাজ? 'ডাব্বা' একটি হিন্দি শব্দ যার অর্থ 'পাত্র'; টিফিন ক্যারিয়ার হিসেবে যা সমাধিক পরিচিত। ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাই শহরে একশ্রেণির মানুষ যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত লোকেদের দুপুরে খাওয়ার জন্যে তাদের বাসা থেকে 'ঘরে প্রস্তুতকৃত' খাবার বহন করে কর্মস্থলে পৌঁছে দেয়। খাওয়া শেষে আবার একইভাবে খালি পাত্রসমূহ পৌঁছে দেয় যথাস্থানে। প্রশ্ন জাগে, এ নিয়ে এত হইচইয়ের কী আছে?

একটু পেছনের দিকে তাকানো যাক। আজ থেকে ১২৭ বছর আগে ১৮৯০ সালে মুম্বাই শহরে পার্সি ব্যাংকে কর্মরত মহাদেও হাভাজি বাচ্চে কর্মস্থলে দুপুরে 'বাড়িতে তৈরি' খাবার খাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন এবং তার এই বাসনা পূরণের জন্যে একজনকে নিয়োগ দেন। ধীরে ধীরে আরও অনেকে এই ধারণা পছন্দ করতে শুরু করেন এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যে তা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জনাব হাভাজি ১০০ জন কর্মীবাহিনী নিয়ে অফিসগুলোতে দুপুরে 'বাড়িতে তৈরি' খাবার সরবরাহের যাত্রা শুরু করেন। ১৯৩০ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে তার কর্মীবাহিনীকে শ্রমিক ইউনিয়নের আওতায় নিয়ে আসার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালে 'নতুন মুম্বাই টিফিন বক্স সাপ্লায়ারস অ্যাসোসিয়েশন' নামে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান রেজিস্ট্রিভুক্ত করেন। ১৯৬৮ সালে এই দাতব্য প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক অংশ হিসেবে 'মুম্বাই টিফিন বক্স সাপ্লায়ারস অ্যাসোসিয়েশন' নথিভুক্ত হয়। শত বছর পরেও তাদের ব্যবসা বেশ সফলতার সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। আজ তাদের কর্মীর সংখ্যা প্রায় ৫,০০০ জন এবং তাদের গ্রাহক সংখ্যা ২,০০,০০০। মোট আয় ৫০ কোটি ভারতীয় রুপি!

অনুসন্ধিৎসু মন নিশ্চয়ই জানতে চায়, কীভাবে পরিচালিত হয় এই ব্যাপক কর্মযজ্ঞ? প্রতিদিন সকালে একদল কর্মী বাসা অথবা যেখানে খাবার তৈরি হয় সেখান থেকে ডাব্বা বা টিফিন বক্স সংগ্রহ করে একটি নির্দিষ্ট স্থানে জড়ো করেন। এ কাজে সাধারণত বাইসাইকেল অথবা হাতে টানা গাড়ি ব্যবহৃত হয়। প্রত্যেকটি ডাব্বার আছে একটি বিশেষ কোড যার মাধ্যমে একজন অল্পশিক্ষিত কর্মী অতি সহজে বুঝতে পারে তার উৎপত্তি ও গন্তব্যস্থল।

পরে জড়ো করা পাত্র বা ডাব্বাসমূহ গন্তব্য অনুযায়ী সাজানো হয়। এই স্থানটি সাধারণত নিকটবর্তী রেলওয়ে স্টেশনের কাছে হয়। সেখান থেকে পরবর্তীতে গন্তব্য অনুযায়ী পাত্রসমূহ বিভিন্ন ট্রেনে ওঠানো হয়। ট্রেন থেকে নামার পর আবার একটি নির্দিষ্ট স্থানে পাত্রসমূহ জড়ো করা হয়, সেখান থেকে চূড়ান্ত গন্তব্য অনুযায়ী পাত্রসমূহ স্থানীয় কর্মী বাহিনীর হাতে হস্তান্তর করা হয় গ্রাহকের কাছে পৌঁছানোর জন্যে। খাওয়া শেষে আবার একই প্রক্রিয়ায় পাত্রসমূহ পৌঁছে যায় যার যার নির্দিষ্ট উৎপত্তিস্থলে।

সহজ শোনালেও কাজটা কিন্তু বেশ কষ্টসাধ্য। বিশেষ করে মুম্বাইয়ের মতো ব্যস্ত জায়গায় যেটি পৃথিবীর চতুর্থ জনবহুল শহর। এখানকার গণপরিবহন বিশেষ করে ট্রেন সার্ভিস সবসময় থাকে ভীষণ ব্যস্ত আর অসহনীয় ভিড়ে ঠাসা। মাঝে মাঝে রয়েছে আবহাওয়ার বিপত্তি– ঝুম বৃষ্টি এবং তার ফলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা। এতকিছুর পরেও মুম্বাই ডাব্বাওয়ালাদের সঠিক সময়ে খাবার সরবরাহ করার রয়েছে অনন্য রেকর্ড।

তারা এক অর্থে নির্ভরতার প্রতীক। এ প্রসঙ্গে ১৯০৫ সালের জুলাই মাসে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। মাত্র ১২ ঘণ্টায় মুম্বাইবাসী প্রত্যক্ষ করে প্রায় ২৫ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত। পুরো শহর হাঁটুজলে নিমজ্জিত এবং কার্যত অচল হয়ে যায় শহর। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি। এরকম এক দূর্বিষহ পরিস্থিতিতেও পরের দিন পুরো শহর যখন থমকে, মুম্বাই ডাব্বাওয়ালারা নিজ নিজ কর্মস্থলে যথাসময়ে উপস্থিত!

বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী তাদের এই সফলতার মূলমন্ত্র–

সহজ সাংগঠনিক কাঠামো: পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাহী কমিটি, তাদের অধীনে ২০-২৫ জনের এক একটি গ্রুপ যার নেতৃত্বে থাকেন একজন দলপতি এবং সর্বশেষ একজন ডাব্বাওয়ালা যারা প্রত্যেকে ৩০ জন পর্যন্ত গ্রাহক সেবায় নিয়োজিত থাকেন।

নিবেদিত প্রাণ কর্মীবাহিনী: প্রত্যেক কর্মী মনে করে প্রতিষ্ঠানটি তার নিজস্ব।কর্মীদের কল্যাণে তাদের দাতব্য অংশ থেকে পরিচালিত হয় বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রম।

চরম শৃঙ্খলা: ঘড়ির কাঁটা ধরে চলে তাদের প্রতিটি কার্যক্রম। সকাল ১০টা থেকে ১টা– এ সময়টা তারা মনে করে রীতিমতো যুদ্ধ! মুম্বাই ট্রেন নেটওয়ার্কের সময়কে কেন্দ্র করে তারা পরিচালিত করে তাদের কর্মকাণ্ড। এ ছাড়াও তারা কঠোরভাবে মেনে চলে কিছু নিয়মনীতি। যেমন: কাজের সময় অ্যালকোহল পান একেবারে নিষিদ্ধ, পরিচয়পত্র বহন, সাদা টুপি পরিধান ইত্যাদি।

সহজ কর্মপদ্ধতি: এ কথা বলাই বাহুল্য যে, তাদের কর্মপদ্ধতি একেবারেই সহজ যা তাদের অল্পশিক্ষিত কর্মীবাহিনী খুব সহজে আত্মস্থ এবং প্রতিপালন করতে পারেন।

অতিরিক্ত/বাফার জনবল: যে কোনো জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য রয়েছে রিজার্ভ কর্মীবাহিনী।

প্রক্রিয়া ও মানের (Process and Standards) প্রতি কঠোর দায়বদ্ধতা: দক্ষতা আনায়নের লক্ষ্যে তারা প্রতিনিয়ত চেষ্টায় লিপ্ত। যেমন, ডাব্বা/পাত্রের আকার এবং আকৃতি, তারা সবসময় গ্রাহককে উৎসাহিত করে একটি নির্দিষ্ট আকার বা আকৃতির পাত্র ব্যবহারের জন্যে।

মুম্বাই ডাব্বাওয়ালাদের এই বিস্ময়কর সাফল্য নজর কেড়েছিল প্রিন্স চার্লসেরও। তিনি তাঁর ভারত ভ্রমণের সময় দেখা করেন এই প্রতিষ্ঠানের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে। উল্লেখ্য যে, প্রিন্স চার্লসকে তাঁর সফরসূচি সাজাতে হয়েছিল ডাব্বাওয়ালাদের সময় মাথায় রেখে।

কাজের প্রতি ভালোবাসা, একাগ্রতা, দায়বদ্ধতা আর কঠোর পরিশ্রম যে কাউকে নিয়ে যেতে পারে সাফল্যের চূড়ান্ত পর্যায়ে, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত 'মুম্বাই ডাব্বাওয়ালা'।