কিছু ‘মানুষ’ও দেখেছি

সেরীন ফেরদৌস
Published : 13 May 2017, 02:01 AM
Updated : 13 May 2017, 02:01 AM

জানি, পশ্চিমের এই শহরটাতে তুলনামূলকভাবে আমার দুই কন্যাসন্তান নিরাপদ। কোনো অপরাধের শিকার হলেও, প্রচলিত আইনে ন্যায্য বিচার তারা পাবে। পাবেই, কোনো মন্ত্রী-আমলা-টাকার কুমিরও সেই শাস্তি থেকে ছাড় পাবে না। একচুলও নয়। আহ্‌, এইটুকু নিরাপত্তাবোধ যে কী বিশাল স্বস্তি!

আমার মেয়ে যতই বুক চিতিয়ে হাঁটুক না কেন, হাঁটুর উপরে স্কার্ট পরে ঘোরাঘুরি করুক না কেন, ওর মাথাতেই নেই এতে ওর নিরাপত্তার কোনো সমস্যা হতে পারে। ওর দিকে কেউ বাঁকা চোখে তাকাতে পারে। ও পরিষ্কার জানে, একটি ছেলে তিন সেকেন্ডের বেশি ওর শরীরের কোনো অংশে মনোযোগ দিলে ওর কর্তব্য কী। ও জানে, সেলফোনে তিনটি নম্বর ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ এসে ওকেই বিশ্বাস করবে সবার আগে। শুধু মেয়েই নয়, সম্ভাব্য ধর্ষকও এ তথ্য জানে। স্কুল ওকে প্রতি পলে পলে শিখিয়েছে সব। ছেলেশিশুদের যথাযোগ্য মগজ ধোলাইয়ের কাজও সারা হচ্ছে স্কুলে, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে। পরিবার কী ভাবল বা না ভাবল, রাষ্ট্র তার থোড়াই পরোয়া করে। রাষ্ট্রের কাজ নাগরিকের সুরক্ষা দেওয়া। তাই সমাজ-আইন-রাষ্ট্র আমার মেয়েকে নিরবচ্ছিন্ন সহায়তা দিতে তৈরি হয়ে আছে।

ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কানাডার ক্লাসে যখন সামাজিক অপরাধ, অ্যাবিউজ, জেন্ডার নিয়ে পরিষ্কার সতর্ক উচ্চারণে খোলামেলা আলোচনা হয়, তার মধ্য দিয়েই ছেলেশিশুটি পরিষ্কার বার্তা পেয়ে যায় তার শরীর, শরীরের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক কর্তব্য আর দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে। মেয়েশিশুটিও জেনে যায় তার শরীর আর সুরক্ষার বিষয়গুলো। মেয়েদেরকে শত হাতে সাহায্য করবার জন্য মুখিয়ে থাকে নানা প্রতিষ্ঠান। ছেলেরা জেনে যায় ধর্ষণ তো দূরের কথা, মেয়েদের সামান্য অ্যাবিউজ করে কেউ ছাড় পাবে না আইন ও প্রতিষ্ঠানের হাত থেকে, সামাজিক অবমাননা থেকে। এমনকি এ-ও দেখা গেছে যে, ধর্ষকের বাবা-মা সোচ্চার হয়েছেন ছেলের বিরুদ্ধে, অংশ নিয়েছেন সামাজিক সচেতনতায়। ব্যতিক্রম আছে, তবে সেটা এখানে মূখ্য নয়।

কিন্তু আমার মেয়ের উপর হওয়া যে কোনো অন্যায়ের, যে কোনো অপরাধের শাস্তি হবে, এই নিশ্চিত বোধও আমাকে সম্পূর্ণ শান্ত রাখে না, আমার স্বস্তি হয় না। আমার শান্তি হয় না যখন শুনি বাংলাদেশ নামের দেশটিতে ৯ বছর বয়সী কন্যার পিতা ধর্ষণের বিচার না পেয়ে ট্রেনের তলায় কাটা পড়তে যান। রাতে আমার ঘুম আসে না যখন শুনি পুলিশের কাছে গিয়ে অসহায় হয়ে উল্টো অপরাধের বোঝা মাথায় নিয়ে ফেরে আমার দেশের ধর্ষণের শিকার কন্যারা।

মেয়েদেরকে নিয়ে যখন 'পিংক' ছবিটি দেখেছি, ওরা সহ্য করতে পারছিল না। দুয়েকবার উঠে গেছে টিভির সামনে থেকে। ছোটটি কান্না শুরু করে দিয়েছিল ইংরেজি সাবটাইটেল পড়তে পড়তে। এইবার যখন ধর্ষণের সত্যিকারের গল্প আমার মেয়েরা শোনে, তারা কেঁপে ওঠে, ফুঁসে ওঠে। তাদের চোখ ছলছল করে অচেনা সেই মেয়েদের জন্য। তারা জানতে চায়, "মা, ওরা কী করবে এখন? ওদেরকে যদি মেরে ফেলে খারাপ লোকগুলো?"

মেয়েরা তাদের ঘৃণা প্রকাশ করে রাষ্ট্রের ভূমিকায়। তারা করুণা করে জিজ্ঞেস করে, "প্রধানমন্ত্রীসহ সকল মন্ত্রী-সাংসদদের লজ্জা লাগে না? তারা যে তাদের পদের যোগ্য নয়, এটা কি অনুভব করে না তারা? হাউ অ্যাবাউট আদার ইনফ্লুয়েন্সেয়াল পিপল?"

আমি কী উত্তর দেব? লজ্জা আমারই লাগে যে!

সুদুর বাংলাদেশে থাকা বোনের কন্যার মুখ, বন্ধুর কন্যার মুখ, আত্মীয়ের কন্যাদের সারি সারি মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ভেসে ওঠে চাষীর কন্যা আর শ্রমিকের কন্যার মুখ। ধর্ষণের শিকার মৃত আর জীবিত কন্যাদের চেহারা দেখতে পাই মনের চোখে। যতদিন পর্যন্ত একটি মেয়েও অনিরাপদ, একটি মেয়েও ধর্ষণের বিচার না পাবার অসহায়ত্বে ভুগবে, ততদিন স্বস্তি পাবার সুযোগই নেই যে। শান্তিও নেই। শুধু আমার কন্যাই নিরাপদ, আমার কন্যার ধর্ষকদেরই বিচার হবেই হবে, এই নিরাপত্তাবোধ আর আমাকে নিশ্চিত করে না। বেদনার্ত হই, মুষড়ে পড়ি, অসহায় বোধ করি।

তারপর, আমি শাহবাগের মুখগুলো তুলে ধরি কন্যাদের সামনে। ফেসবুক ঘেঁটে ঘেঁটে প্রতিবাদের শব্দগুলো পড়ে শোনাই তাদের। আঙুল দিয়ে দিয়ে পয়েন্ট করে দেখাই, "এই দেখ মা, এঁরা আমার দেশের মানুষ। এঁরা প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নেমেছে। এরা সাহস করেছে। এরা মানুষ, দেখ মা, মানুষের মুখ দেখ! হতে পারে এরা সংখ্যায় কম, হতে পারে এরা 'ইনফ্লুয়েন্সিয়াল পিপল' নয়, হতে পারে এদের কথা কেউ কানে নেবে না। কিন্তু দেখ মা, এরা মানুষ। এরা প্রকাশ্যে বলতে পেরেছে, ধর্ষণ অপরাধ, অপরাধীর শাস্তি হওয়া দরকার।"

গলা আর্দ্র হয়ে এলেও সেই ভেজা কণ্ঠে মেয়েদের শোনাই: "দেখ মা, বাংলাদেশে কিন্তু মানুষও আছে।"