‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’: অসুন্দরের বিরুদ্ধে লড়াই

শামস্ রহমানশামস্ রহমান
Published : 23 May 2017, 05:22 AM
Updated : 23 May 2017, 05:22 AM

"লেখকের একটাই গল্প, যা তারা বার বার বলে"— মন্তব্যটি নোবেল বিজয়ী লাতিন আমেরিকার ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের 'পাক সার জমিন সাদ বাদ' পড়ে স্মরণে আসে দীর্ঘদিনের পরিচিত মার্কেজের এই মন্তব্যটি। দেশে-বিদেশে প্রখ্যাত বহু লেখকের মতো হুমায়ুন আজাদও খণ্ডাতে পারেননি মার্কেজের এই মন্তব্য।

'আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম'সহ ১৯৯০-উত্তর তাঁর লেখা বেশ কয়েকটি গ্রন্থই এর প্রমাণ। এই গ্রন্থগুলি রচিত হয়েছে মাটি ও মানুষকে ঘিরে, অন্যায়, অবিচার আর অসুন্দরের বিরুদ্ধে। সামগ্রিক অর্থে মেলে জাতির মূলধারার প্রতি তাঁর বিশ্বাস। তবে এটা সত্য, উপন্যাসগুলির মূল বক্তব্যে ভিন্নতা না থাকলেও, গ্রন্থের পটভূমি, লেখার ঢং, শব্দের বাহার, ভাষার ব্যবহার, চরিত্র চিত্রায়ন ও বিন্যাসের কায়দা এক একটি গল্পকে ভিন্ন ভিন্ন সাজে সাজায়। আর পাঠকের কাছে যা ধরা দেয় ভিন্ন স্বাদ ও আমেজে। এখানেই একটি উপন্যাসের সার্থকতা। আর এভাবেই মেলে একজন ঔপন্যাসিকের দক্ষতার সাক্ষর।

'পাক সার জমিন সাদ বাদ' কোনো ব্যতিক্রম নয়। ব্যতিক্রম শুধুই উপন্যাসের প্রেক্ষাপটে, লেখার ঢংয়ে এবং ভাষার ব্যবহারে। পাঠক হোঁচট খায় পড়তে গিয়ে। শব্দ কানে বাজে। তবে লেখার এ কায়দা নতুন নয়। পশ্চিমা বিশ্বে তো বটেই, এশিয়া, লাতিন আমেরিকার ঔপন্যাসিকদের মাঝেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে লেখার এ ধরন। যুক্তি একটাই। এখানে অনুভূতি উন্মোচিত হয় সরলভাবে। তাই এতে সংকুচিত হয়ে আসে লেখার বিষয়বস্তুর প্রকাশ আর পাঠকের উপলব্ধির মাঝের ফাঁক।

শুধু সাহিত্যে নয়, সংগীতের ভুবনেও এর প্রভাব লক্ষণীয়। যেমন 'র‍্যাপ' বা 'হিপ-হপ' সংগীতের ধারা। ভাষা, শব্দ ও ছন্দে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তরুণ আফ্রো-আমেরিকানদের রাজপথের ভাষা ও শব্দে রচিত এ সংগীতের সুর ও প্রকাশের ভঙ্গিতে তাদের দৈনন্দিন জীবনের আচার-আচরণের ছাঁপ স্পষ্ট। অনেকের কাছে আদিমতা মনে হতে পারে, তবে ধারণাটি মৌলিক ও অকৃত্রিম। 'পাক সার জমিন সাদ বাদ' এসব থেকেও এক ধাপ উপরে। বাস্তবতার এক বিশেষ পরিবেশ সৃষ্টির তাড়নায়, শুধু ভাষায় নয়, হুমায়ুন আজাদ ভিন্নতা এনেছে শব্দ উচ্চারণে, এমনকি বানানেও।

এ ধরনের ভাষার ব্যবহার পূর্বে কি দেখিছি হুমায়ুন আজাদের লেখায় কখনও? তাহলে? শুধু প্রথাবিরোধী লেখক বলেই কী এমন? নাকি অন্য কিছুর তাড়না থেকে এ রচনা? স্বাধীনতার পর পর বাঙালির অনুভূতি ছিল অত্যন্ত তীক্ষ্ণ সময়ে তা যেন ভোতা হয়ে যায়। স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতিতে পুনঃআগমন বাঙালি যেন মেনে নেয়। মেনে নেয় দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন প্রশাসন ও শাসন। উগ্র মৌলবাদীদের উত্থান ও বিস্তারে বাঙালি থাকে চুপ। জাতীয় মূল্যবোধের যে কোনো ধরনের অবক্ষয়েও আর যেন কিছু আসে-যায় না তাদের। প্রতিবাদী ও সাহসী বাঙালির দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তবু সয়ে যায়।

হুমায়ুন আজাদ কি বাঙালির সেই অনুভূতিতে আঘাত করতে চেয়েছে রূঢ় ও কর্কশ ভাষায় রচনার মাঝে? তাদের সেদিনের ভোতা অনুভূতিকে শানিত করাই কি 'পাক সার জমিন সাদ বাদ'এর উদ্দেশ্য?

অনেকের ধারণা 'পাক সার জমিন সাদ বাদ'ই হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুর কারণ। আবার অনেকে ভাবে এই উপন্যাসের মাঝেই তিনি বেঁচে থাকবেন দীর্ঘদিন। যে উপন্যাসের কারণে ঔপন্যাসিকের অমরত্ব আর মৃত্যুর মাঝের তফাৎ এক সূক্ষ্ম রেখার এপাশ-ওপাশ; কী আছে সে উপন্যাসে?

গ্রন্থটি পড়ার শুরুতে মনে হয়, এটা বাংলাদেশের উগ্র মৌলবাদীদের নিয়ে লেখা। আসলে তা নয়। তবে স্বীকার্য যে তাদের কথা আছে এখানে। উপন্যাসের এক পর্যায়ে মনে হতে পারে, গ্রন্থটি উগ্র বামপন্থীদের নিয়ে লেখা। আসলে তা-ও নয়। তবে তাদেরও কথা আছে এখানে। উপন্যাসটা কি বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের কাহিনি? তা-ও নয়। তবে এ অত্যাচারের বিশদ বর্ণনা আছে এখানে। এটা কি ভোগ-বিলাসে জীবন ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপসংক্রান্ত কোনো রচনা? তা-ও নয়। জিক্সাস পাজলের মতো খণ্ড খণ্ডভাবে এসবই আছে এখানে। আর এসব খণ্ড খণ্ড বিষয়ের সঠিক সমন্বয়ে ফুটে ওঠে এক ভয়ংকর চিত্র।

হুমায়ুন আজাদের 'পাক সার জমিন সাদ বাদ' ১৯৭৫ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের এক সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এ ইতিহাস সুকৌশলে 'আমার সোনার বাংলা'কে 'পাক সার জমিন সাদ বাদে' রূপান্তরের প্রক্রিয়ার ইতিহাস। আর এ রূপান্তর রাষ্ট্রীয়ভাবে পুনরায় এক হওয়ার অর্থে নয়, কেবল মন-মানসিকতা আর চিন্তা-চেতনায় রূপান্তর। এ ইতিহাসে নেই কোনো সন-তারিখ। নেই আহত-নিহতের কোনো পরিসংখ্যান। সরাসরি কোনো ঘটনাও নেই। আছে শুধু কয়েকটি ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত।

স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পুনঃপ্রবর্তন, উগ্রমৌলবাদী ও জঙ্গিবাদের উত্থান ও বিস্তার এবং বাংলাদেশের ২০০১'এর নির্বাচনের প্রক্রিয়া, ফলাফল ও প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে রচিত হয়েছে এ ইতিহাস। '৭৫এর পটপরিবর্তনের পরই যে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রবর্তন ঘটে তার প্রতি আছে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। আর তা কোন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন (!) নেতার কারণে ঘটে, উপন্যাসে তারও ইঙ্গিত স্পষ্ট:

"…আমরা বুঝতে পারিনি, বুঝেছিলেন আমাদের মহান নেতা, সানগ্লাসের ভেতর দিয়েও তিনি তা দেখেছিলেন। তার সানগ্লাস ছিল দূরদৃষ্টির সানগ্লাস…।"

('পাক সার জমিন সাদ বাদ', পৃষ্ঠা ১৯)

হুমায়ুন আজাদের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা কে, তা পাঠকের বোঝার জন্য কল্পনা বা গবেষণার প্রয়োজন নেই।

২০০১এর নির্বাচন এ উপন্যাসের একটি প্রধান অধ্যায়। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এক অভিনব অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সম্প্রতি দেওয়া বক্তব্য অতন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। হুমায়ুন আজাদের ভাষায়:

"…জানতামই যে আমরা জিতব – আমাদের নেতারা ওপরের দিকে সব কাজ চমৎকারভাবে করে রেখেছিলেন, তত্ত্বাবধায়কদের তাঁরা তত্ত্বাবধান করছিলেন; আমরা জানতাম জিতবই।"

('পাক সার জমিন সাদ বাদ', পৃষ্ঠা ২১)

২০০১এর নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনে যে ব্যাপক রদবদল ঘটে, তাতে জনসাধারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে। ১৯৯১ সালে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রেক্ষাপটে এক অভিনব ধারণা– তত্ত্বাবধায়ক সরকার– এই প্রথমবারের মতো বিতর্কিত হয়ে পড়ে। নির্বাচন-উত্তর দিনগুলি ছিল আতঙ্কজনক। কোনো কোনো সময় তা ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। আক্রান্ত হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।

উপন্যাসটি 'থিসিস, অ্যান্টি-থিসিস অ্যান্ড সিন্থিসিস' এর সমন্বয়ে গড়া একটি ছক বা মডেলে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। কোনো ব্যক্তি (কোনো একসময়), কোনো একটি বিষয়ে বা ধারণায় বিশ্বাসী– এটাই 'থিসিস'। পরবর্তীতে, তার পুরনো ধারণা পাল্টিয়ে অন্য একটি ধারণায় বিশ্বাসী হয়ে ওঠা, যা পূর্বের ধারণার ঠিক উল্টো বা বিপরীত– এটা 'অ্যান্টি-থিসিস'। আর দুই মেরুতে অবস্থানরত দুটি বিশ্বাসের সংঘাতে উদ্ভূত রূপ হচ্ছে এ ছকের 'সিন্থিসিস'। অর্থাৎ 'থিসিস', 'অ্যান্টি-থিসিস' ও 'সিন্থিসিসে'র মাঝে ব্যক্তি বা জাতির রূপান্তরই হচ্ছে 'পাক সার জমিন সাদ বাদ' বইয়ের মূল বিষয়।

উপন্যাসে 'থিসিস' কী? একজন অপরিপক্ক, সমাজ সম্পর্কে অজ্ঞ– "সমাজের সঙ্গে তো আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না, সমাজ কীভাবে কাজ করে তা আমি জানিনি", পৃষ্ঠা ৫৪-৫৫), অথচ সৎ, উগ্র বামপন্থী যুবকের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের মাঝে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী হয়ে ওঠাই– "আমিই জানতাম সমাজ হচ্ছে শ্রেণিদ্বন্দের ব্যাপার, আর আমাদের কাজ হচ্ছে শোষণকারীদের শোধন ও নিধন করা। এজন্য দরকার কাটা রাইফেল, গ্রেনেড, বোমা, মাইন"– হচ্ছে এ উপন্যাসের 'থিসিস'।

বাংলাদেশের সর্বহারা পার্টি এবং ৭০ দশকের প্রথম ভাগের জাসদসহ বেশ কয়েকটি উগ্র বামপন্থী দলের সাধারণ সদস্যের যথেষ্ঠ মিল আছে উপন্যাসের উগ্র বামপন্থী যুবকের। অসংখ্য বুদ্ধিদীপ্ত যুবক যোগ দেয় এসব দলে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে ছিল তাদের অটল বিশ্বাস। একপর্যায়ে কৌশল হিসেবে বেছে নেয় ধ্বংস, হত্যা ও লুণ্ঠনের পথ। স্বাধীনতার পর বিশেষ করে ১৯৭৪-৭৫, দেশ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে জাসদের জঙ্গিপনায়। পশ্চিমবঙ্গে ১৯৬৯-৭০এ চারু মজুমদারের দলও যুবকদের নিয়ে মেতে ওঠে একই খেলায়। উগ্র বামপন্থীদের কার্যকলাপ ও তাদের রাজনীতিকদের পরিণতি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে মৃণাল সেনের ছবি 'মহাপৃথিবী'তে।

বিপ্লবী দলগুলোর অতিবিপ্লবী নেতারা যুবকদের ঠেলে দেয় অনিশ্চিতের পথে। ধ্বংস করে তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ। ১৯৭৫এর পর এইসব অতিবিপ্লবীর আসল চেহারা সহজেই উন্মোচিত হয়। সমাজতন্ত্রের লেবাস ছেড়ে কেউ কেউ রাতারাতি হয়ে ওঠে একনায়কত্বের ধারক-বাহক ("আমাদের নেতারা একের পর শ্রেণিসংগ্রাম ছেড়ে একনায়কের বুটের নিচে পড়েছে", পৃষ্ঠা ৫৮), কেউ আবার সরাসরি মৌলবাদপন্থী। এ যেন মৌসুমী ভৌমিকের গানে সেই কলির মতো–

"অনেক হল দেয়াললিখন
লাল কালিতে নীলে লেখা
এখন বরং তাবিচ-কবচ
ভাগ্যলিখন পড়তে শেখা।"

সেদিন এ শ্রেণির বামপন্থীদের আদর্শের ডিগবাজিতে দেশের মানুষ হতবাক; প্রশ্ন করে: কেন এ হঠকারিতা? শুধু কি ক্ষমতার জন্য? তবে কেন শত-সহস্র যুবকের উজ্জ্বল জীবনের বিনিময়ে? বামপন্থী নেতারা আজও তাদের ভুল স্বীকার করেননি।

অন্যদিকে পথভ্রষ্ট যুবকদের জীবনে নেমে আসে একরাশ নৈরাশ্য। ব্যর্থতা ও অনিশ্চিত আগামী। এরা নীরবে নিজেদের অতীত ঘাটে: ("আমি তো খারাপ ছাত্র ছিলাম না", পৃষ্ঠা ৫৮)। নিজেকে জিজ্ঞেস করে: "কেন এ ধোঁকা, বিশ্বাসঘাতকা?" তারা নিজেদের বাস্তবায়ন দেখেনি। দেখেছে শুধু স্বার্থান্বেষী নেতাদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি প্রাপ্তির প্রতিযোগিতা। ক্রমশ পথভ্রষ্ট যুবকদের পেয়ে বসে ক্ষমতার নেশা– 'নিয়ন্ত্রক হতেই হবে, তা যে করেই হোক'। আর এভাবে, বিভ্রান্তে জড়িত, নৈরাশ্যে জর্জরিত ও ক্ষমতার নেশায় আক্রান্ত ("নেতা হওয়ার মত সুখ ও স্বাদ ও কাম আর নেই", পৃষ্ঠা ১৭) অতি (বৈজ্ঞানিক) সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী একজন সৎ, চরিত্রবান উগ্র বামপন্থী যুবকের অসৎ, ধূর্ত, উগ্র মৌলবাদে বিশ্বাসী হয়ে উঠাই হচ্ছে এ উপন্যাসের 'অ্যান্টি-থিসিস'।

সমাজতন্ত্র থেকে সরাসরি মৌলবাদে বিশ্বাসী! এ রূপান্তর কী করে সম্ভব? বাহ্নিকভাবে দুই মেরুতে অবস্থান করলেও, দুটি বিশ্বাসের মাঝে অকল্পনীয় সাদৃশ্য লক্ষণীয়। মিলগুলি হল–

· সংগঠনের অবকাঠামোগত;
· সদস্যদের স্বভাব-চরিত্রগত এবং
· সংগঠনের আর্দশ বাস্তবায়নের কৌশলগত।

সংগঠনের অবকাঠামোর বিচারে দুটি আদর্শই 'টপ-ডাউন' পদ্ধতিতে বিশ্বাসী। স্বল্পসংখ্যক শীর্ষস্থানীয় নেতার আশা-আকাঙ্ক্ষার জগদ্দলের মতো চেপে বসে সংগঠনের বাকি সবার ওপর। সমতার কথা বললেও, নেতারা সমানের চাইতে একটু বেশি। নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বাকি সবার উপর চাপিয়ে দিতে পারার এটাই কারণ। এ ধরনের বিপ্লবী নেতারা সমতা বলতে কী বোঝান, তা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে জর্জ অরওয়েলের বহু আলোচিত 'Animal Firm' বইয়ে মাত্র একটি বাক্যে:

"All are equal but some are more equal than others."

উল্লেখ্য, উগ্রপন্থীদের সমতা সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদের 'পাক সার জমিন সাদ বাদ' জর্জ অরওয়েলের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি হয়েছে:

"আমরা সবাই সমান, তবে কেউ কেউ সমানের থেকে একটু বেশি।"

('পাক সার জমিন সাদ বাদ', পৃষ্ঠা ৭৭)।

উভয় শ্রেণির সংগঠনেই আদর্শে দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ বা রীতি নেই বললেই চলে। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে তারা অবিশ্বাসী:

"নির্বাচন-টির্বাচনে, ইলেকশন-টিলেকশনে, আমরা বিশ্বাস করি না।"

('পাক সার জমিন সাদ বাদ', পৃষ্ঠা ২১)

মোট কথা, নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে উভয় সংগঠনই 'রেজিমেন্টেড' এবং একনায়কত্বের সরূপ। স্বভাব-প্রকৃতিতে সাধারণ সদস্যরা বিশ্বস্ত ও অনুগত। প্রশ্ন করার কোনো অবকাশ নেই। তারা শুধু আদেশের অপেক্ষায় থাকে। তাই সংগঠন বা নেতাদের আদর্শ অথবা ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাস্তবায়নে সদস্যদের কাজে লাগায় যেমন খুশি তেমনভাবে। উপন্যাসে এ বাস্তবতা ফুটে ওঠে এমনভাবে:

"যে প্রশ্ন করে না, যার সন্দেহ নেই, সে অন্ধ, তাকে দিয়ে সব করানো যায়; সে যে প্রশ্নহীন অগ্নিকাণ্ড, খাপখোলা তলোয়ার।"

('পাক সার জমিন সাদ বাদ', পৃষ্ঠা ৭৭)

তাইতো উভয় শ্রেণির সংগঠনই ধ্বংস আর সন্ত্রাসের মাঝে সংগঠনের আদর্শ বাস্তবায়নের কৌশল হিসেবে বেছে নেয়।

সংগঠনের অবকাঠামো, সদস্যের স্বভাব-চরিত্র এবং সংগঠনের আর্দশ বাস্তবায়নের কৌশলে যখন এত মিল, তখন উভয় ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য-আর্দশ যদি হয় ক্ষমতা আর প্রাপ্তি, তাহলে উগ্র বামপন্থী থেকে উগ্র মৌলবাদে রূপান্তর অসম্ভব নয়। হয়তো সে কারণেই দু-দুজন সেনাপ্রধান রাষ্ট্রপতি পেরেছিলেন বামপন্থী ও মৌলবাদীদের এক প্লাটফর্মে দাঁড় করাতে।

শুরুতে অত্যাচার-অনাচারে যে যুবক এত পারদর্শী; হত্যা ও লুণ্ঠনে যার যত তৃপ্তি; শহর সভ্যতা ধ্বংসে যার শত আনন্দ; শেষে সামান্য একটি মঠ ধ্বংসের চিন্তায় কম্পিত হয় তার হৃদয়। উপন্যাসে 'থিসিস' ও 'অ্যান্টি-থিসিসে'র দ্বন্দ্বের এখানেই শুরু। অতীতের ধ্বংসে সবুজ চাঁদ-তারা ভেসে উঠত যার কল্পনায়, আজ ধ্বংসের ভাবনায় সে ভীত। ধ্বংসের মাঝে আজ ভেসে ওঠে সবুজ মাঠ। মাঠে দ্যাখে রং আর আলোয় মেশানো জীবনে হাহাকার, মৃতের গন্ধ। ধ্বংসে আজ সে দ্যাখে শুধুই শূন্যতা। উপন্যাসের নায়কের এ যেন এক ভিন্ন রূপ। এই প্রথমবারের মতো সে প্রশ্ন করতে শেখে 'মঠটিকে না ভেঙে' অন্য কিছু করা যায় কী? ইতিহাসে এ ধরনের দৃষ্টান্ত ঢের।

অটোমানরা জয় করেছে, ঘটিয়েছে রূপান্তর। গির্জা রূপ নিয়েছে মসজিদে। ইস্তাম্বুলে যা আজও দেশি-বিদেশি পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ। আবার অটোমানদের তৈরি কর্ডোবার বিখ্যাত মসজিদ, পরিণত হয়েছে গির্জায়, স্পেনে অটোমানদের পতনের পর। এতে অন্তত সভ্যতার ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। উগ্রমৌলবাদী তালিবান শুধু ধ্বংসই বোঝে। বিশ্ববাসীর শত আপত্তি সত্যেও হাজার বছরের বৌদ্ধমূর্তি ধ্বংস করতে দ্বিধা করেনি এতটুকু। বিশ্ববাসীর অজান্তে আইএস ধ্বংস করে পালমিরার অংশ (সিরিয়ায় অবস্থিত), পুরাতত্ত্ববিদদের মতে যা নির্মিত হয় যিশুখ্রিস্টের জন্মের দুই শত বছর পূর্বে।

উপন্যাসের নায়ক আর্দশ বাস্তবায়নের ব্যর্থতা, ধোঁকা ও বিশ্বাসঘাতকতার মাঝে সৃষ্ট নৈরাশ্যের সঙ্গে ভোগ-বিলাসে জীবন, অমানবিক ও অসৎ কার্যকলাপে সৃষ্ট নৈরাশের সংঘাতের মুখোমুখি। এখানে অতীতের অপূর্ণতা ও বর্তমানের পূর্ণতা– এ দুয়ে সৃষ্ট হয় এক গভীর শূন্যতা। এটা উপন্যাসের 'থিসিস'-'অ্যান্টি-থিসিসে'র দ্বন্দ্বের ফসল।

একসময় ধ্বংসে যে বিজয় খুঁজে পেত, আজ সে ধ্বংসে দেখতে পায় পরাজয়ের গ্লানি। ধ্বংসে আজ আর কোনো অভিনবত্ব নেই তার কাছে। চারিদিকে দ্যাখে সৃষ্টিধর্মিতার অভাব– নারীতে, প্রকৃতিতে, কবিতে, রাজনীতিতে, চিত্রকরে। এ থেকে সে মুক্তি চায়। এবং একসময় উত্তীর্ণ হয় এসব থেকে। আজ তার চাওয়া পাওয়া শুধুই শাড়ি, সিঁদুর আর সবুজ মাঠ ঘিরে; সবুজের মাঝে লাল সূর্য নিয়ে। উগ্র বামপন্থী যুবকের উগ্র মৌলবাদে বিশ্বাসী হয়ে ওঠা এবং এ দুই বিশ্বাসের সংঘাতে প্রকৃত দেশপ্রেমিক বাঙালি রূপে আত্নপ্রকাশ করাই উপন্যাসের 'সিন্থিসিস'।

এভাবেই হুমায়ুন আজাদ বাঙালিকে দেখান আশার আলো।