মানসিক ব্যাধি ও সহমর্মিতা

সীনা আক্তার
Published : 2 June 2017, 05:20 AM
Updated : 2 June 2017, 05:20 AM

প্রতিটি মানুষের উপলব্ধি, আবেগ-অনুভূতি ভিন্ন, এর প্রকাশ এবং তা সামলানোর প্রক্রিয়াও ভিন্ন। মনোকষ্ট, হতাশা ও বিষণ্ণতা প্রায় প্রত্যেক মানুষের জীবনে স্বাভাবিক ঘটনা, তবে মাত্রা ভেদে তা ভিন্ন।

জীবনের কোনো না কোনো সময়, কোনো না কোনো কারণে মানুষ হতাশাগ্রস্ততায় আক্রান্ত হতে পারে। দীর্ঘদিন কেউ মর্মপীড়া, বিমর্ষ ও বিপর্যস্ত বোধ করলে তা পরবর্তীতে বিষণ্ণতায় রূপ পায়। মানে, মনোকষ্ট ও বিপর্যস্ত অবস্থা হচ্ছে বিষণ্ণতার প্রাথমিক ধাপ। বিষণ্ণতাকে বলা হয় 'মানসিক ব্যাধি' (Mental disorder)।

পরিবেশ-পরিস্থিতি ও অবস্থানের কারণে একেকজন একেক কারণে বিমর্ষ হতে পারে। যেমন: শারীরিক-মানসিক অত্যাচার, বিচ্ছেদ, প্রতারনা-বঞ্চনার শিকার, জীবনের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থতা বা অপূর্ণতা, নিয়ন্ত্রিত হওয়া, দীর্ঘ অসুস্থতা, স্বজনের মৃত্যু, অভাব-অনটন, মর্যাদাহানি, অসহায়ত্ব, হতাশা, ভয়-ভীতি ইত্যাদি।

বোধগম্য কারণে আমাদের দেশে মেয়েরা বিষণ্ণতায় বেশি আক্রান্ত হয়, বিশেষ করে বিবাহিত নারীরা। কারণ অধিকাংশ মেয়ে কর্তৃত্ব-নিয়ন্ত্রণ, ভয়, নিপীড়ন, লাঞ্ছনার মধ্যে বড় হয়, বসবাস করে। উপরন্তু 'মানিয়ে নেওয়ার' নামে শিশুকাল থেকে মেয়েদের বঞ্চনা ও মানসিক যন্ত্রণা গোপন ও দমন করার দীক্ষা দেওয়া হয়।

কেউ কেউ হয়তো মানিয়ে নিতে পারে এবং টিকে থাকে। কিন্তু সবার অনুভূতি ও ধারণ ক্ষমতা এক নয়। ফলে অনেকের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনে জমাট বাঁধা মনোকষ্ট, বিপর্যস্ত অবস্থা একসময় বিষণ্ণতায় রূপ নেয়।

যখন একজন ব্যক্তি নিজের অসহায়ত্ব অতিক্রম করার কোনো উপায় খুঁজে পায় না তখন সে হতাশ হয়ে পড়ে। দুই সপ্তাহের অধিক সময় ক্রমাগত হতাশাগ্রস্ততায় মানুষ বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়। যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা না করলে এই বিষাদগ্রস্ততা জীবনকে তিলে তিলে নিঃশেষ করতে থাকে এবং একসময় মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় রূপ নেয়। মিডিয়ার মাধ্যমে মাঝেমধ্যেই এর করুণ পরিণতি জানা যায়, যেমন: আত্মহত্যা অথবা সন্তান হত্যার মতো বেদনাদায়ক ঘটনা।

দুঃখজনকভাবে সারা বিশ্বেই বিষণ্ণতা ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব বা স্টিগমা (Stigma) বিদ্যমান। কিন্তু আমাদের দেশে এর উপস্থিতি কখনও কখনও ভয়ানক নির্মম। নারী, পুরুষ, শ্রেণি/সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সবাই এর শিকার। সব ক্ষেত্রেই মানসিক ব্যাধিকে 'সহ্য করার', লুকানোর দীক্ষা দেওয়া হয়।

নারীর কথা উপরে উল্লেখ করেছি। আমাদের সমাজে পুরুষকে কঠোর মানসিকতায় দেখতে অভ্যস্ত এবং সেভাবেই তাদের লালন-পালন করা হয়। যেমন: বাচ্চা ছেলেকেও শেখানো হয় 'ছেলেদের কাঁদতে নেই', 'মেয়েদের মতো কান্না ছেলেদের মানায় না' ইত্যাদি। ফলে অধিকাংশ সময় ছেলেরা মানসিক কষ্ট প্রকাশ করা দুর্বলতা মনে করে তা দমন করে। তাছাড়া, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শিক্ষিত, সামাজিক অবস্থানে অধিষ্ঠিত কারো মনোকষ্ট তুচ্ছ করে দেখার প্রচলন বিদ্যমান। যেমন: 'এত আবেগী হওয়া তোমাকে মানায় না', 'ঢং করছ', 'পাগলামি রাখ' ইত্যাদি।

ভুক্তভোগীর অনুভূতি তাচ্ছিল্য করা, হাসি-তামাশা, কটূক্তি করার প্রবণতা যেন সাধারণ ব্যাপার। এসব কারণে অনেকে নিজের মানসিক ব্যাধি বুঝতে পারলেও তা প্রকাশ করেন না, নিরাময়ের জন্য সঠিক ব্যবস্থা নেন না। প্রকৃতপক্ষে আবেগ-অনুভূতির কোনো লিঙ্গ, জাত-পাত, শ্রেণি নেই। এর সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ হচ্ছে চিত্র নায়িকা অপু বিশ্বাসের আবেগময় টিভি সাক্ষাৎকার।

স্বজনদের বিশেষ মনোযোগ, মানসিক সমর্থন গর্ভকালীন অবস্থায় প্রত্যেক নারীর জন্য জরুরি। কিন্তু অপু তার গর্ভকালীন সময়ে স্বামীকে পাশে পাননি বরং অবহেলা পেয়েছেন। তিনি পুরো সময় মাতৃত্বের চাপ একা সামলেছেন, অধিকন্তু বিষয়টিকে গোপন রাখতে বাধ্য হয়ে সামাজিক চাপ সামলেছেন। নিজের পেশাজীবনের সঙ্গে আপস করেছেন, আত্মত্যাগ করেছেন। সঙ্গত কারণেই তিনি মানসিক কষ্টে জর্জরিত ও বিপর্যস্ত ছিলেন।

অপুর মর্মবেদনা সেই টিভি সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট, যেখানে তিনি তাঁর আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে অপারগ ছিলেন। ইচ্ছা করলেও দীর্ঘদিনের চাপা মনোকষ্ট অনেক সময় নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। প্রসঙ্গক্রমে কান্না হচ্ছে মানসিক কষ্ট প্রকাশ এবং প্রশমনের একটা স্বাস্থ্যকর পদ্ধতি। পরবর্তীতে অপু উল্লেখ করেছেন ওই সাক্ষাৎকারের পর, ঘটনা পরম্পরায় তিনি কতটা উদ্বেগমুক্ত ও স্বস্তি অনুভব করেছেন।

তবে অনেকেই অপুর মতো নিজের আবেগ প্রকাশ করতে পারে না। প্রচলিত নেতিবাচক ধারণা, 'পাছে লোকে কিছু বলে'র ভয়ে, দ্বিধায় অনেকে মানসিক ক্ষত বয়ে বেড়ায়। এছাড়া অনেক ভুক্তভোগী তাদের বিপর্যস্ত অবস্থা এবং ভেতরের গভীর ক্ষত লুকিয়ে রাখার জন্য বেশি বেশি ভালো থাকার ভান করে। যার ফলে অন্যরা তাদের অস্বাভাবিকতা অনুধাবন করতে পারে না। এ ধরনের বিষণ্ণতাকে Psychiatry and human behaviour and medicine এর ক্লিনিক্যাল অধ্যাপক Carol Landau 'উচ্চ ক্রিয়াশীল বিষন্নতা' (high-functioning depression) হিসেবে অবিহিত করেছেন।

হাই ফাংশনিং বিষণ্ণতার যথাযথ উদাহরণ হচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত শিক্ষক আকতার জাহান এবং প্রয়াত মাহবুবুল হক শাকিল। এ দুজনের ক্ষেত্রেই, তাদের অন্তঃক্ষরণ বাইরে থেকে কেউ অনুমান করতে পারেনি। বিশেষ করে শাকিল, তাঁর বিভিন্ন লেখায় স্পষ্ট যে তিনি কোনো কারণে বিপর্যস্ত ও বিষণ্ণ ছিলেন। কিন্তু তাঁর প্রকৃত অবস্থা লুকায়ে রাখতে পেশাগত ব্যস্ততার পাশাপাশি তিনি বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে যেন একটু বেশি সময় কাটাতেন। অন্যদিকে অধিকাংশের অগোচরে নিজের বিষণ্ণতা লাঘবে একটি বিপদজনক পদ্ধতি: অতিরিক্ত মদ্যপানের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। এই দুজনের মানসিক ব্যাধি শেষ পর্যন্ত তাঁদের আত্মহননের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে তুলনা করা হয় সমুদ্রে ভাসমান বরফখণ্ড বা হিমশৈলের (ice berg) সঙ্গে। আমরা ভাসমান অংশটাই কেবল দেখতে পাই, কিন্তু পানির নিচে বরফখণ্ডটা কত বড় এবং গভীরে প্রথিত তা অনুমান করা যায় না। একইভাবে কোনো ব্যক্তির মনোজগতে প্রকৃতপক্ষে কী হচ্ছে, তা অনুধাবন করা কঠিন। তাই কারো আবেগ-অনুভূতি, বিমর্ষ অবস্থা তুচ্ছ করে দেখা মানে সেই ব্যক্তিকে সাহায্য না করা। অথচ একজন বিপর্যস্ত, বিষণ্ণ মানুষের সবচেয়ে প্রয়োজন সহানুভূতি ও সহযোগিতা।

শারীরিক অসুস্থতায় ও মানসিক ব্যাধিতে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, বরং সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক ব্যাধিকে সম গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচনা করা জরুরি। তবে প্রতিরোধ সবসময়ই উত্তম।

আত্মভালবাসা মানে নিজের সঠিক যত্ন, যেমন: সময়মতো সঠিক আহার, ঘুম ও শারীরিক ক্রিয়া মানসিক ব্যাধি থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে। এছাড়া, নিজের পছন্দের কাজ করা, নতুন কিছু করা, প্রতিদিন মুক্ত বাতাসে হাঁটাচলা, সহমর্মী বন্ধু তৈরি করা, বিশ্বস্ত আত্মীয়/বন্ধুর সঙ্গে মানসিক অবস্থা শেয়ার করা, সঠিক সাহায্য সন্ধান করা, নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মানুষ থেকে দূরে থাকা ইত্যাদি।

মানসিক ব্যাধির কারণ বা ট্রিগার (trigger) চিহ্নিত করা, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া এবং টিকে থাকার কৌশল রপ্ত করা। এক্ষেত্রে সংবেদনশীল স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের সহমর্মিতা ও সহযোগিতামূলক ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।