উচিত শিক্ষা-১ : মূর্খদের কেন ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে?

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 14 May 2017, 03:10 AM
Updated : 14 May 2017, 03:10 AM

শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সরকার– শিক্ষার তিন অংশীদার। একজন অভিভাবক কেন তার সন্তানকে শিক্ষিত করে তুলতে চান? শিক্ষার্থীই-বা কোন 'আশার ছলনে ভুলি' শিক্ষিত হওয়ার জন্যে আদাজল খেয়ে লাগে? সরকারই-বা কেন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নাগরিকদের শিক্ষার ব্যবস্থা করে? উচিত বা উপযুক্ত শিক্ষা বলতেই-বা কী বোঝায়?

যখন থেকে মনের ভাব প্রকাশ বা ধারণ করার জন্যে লিপি ব্যবহারের সূচনা হয়েছে, সেই সুমের বা মিসরে, তখন থেকেই লিখতে ও পড়তে জানা, অর্থাৎ শিক্ষিত লোকদের একটা চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। যেহেতু অন্য কর্মজীবীদের তুলনায় কলমজীবীদের পারিশ্রমিক সাধারণত বেশি, সেহেতু 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে' এই চিরন্তন আকুতি থেকে পিতামাতারা সর্বযুগেই বহু ত্যাগ স্বীকার করে সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে চেয়েছেন।

এ তো গেল ব্যষ্টিক অর্থনীতির দিক, সামষ্টিক অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখি তবে আধুনিক রাষ্ট্র অনেকটা নিজের স্বার্থেই জনগণের জন্যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করে আসছে। কারণ রাষ্ট্রের সার্বিক অগ্রগতির জন্যে শিক্ষিত নাগরিক অপরিহার্য। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ একটি বাজারের প্রয়োজন। ধরা যাক দুটি প্রতিবেশি রাষ্ট্র– একটিতে সব নাগরিক অশিক্ষিত এবং অন্যটিতে সবাই উচ্চশিক্ষিত– এ দুই রাষ্ট্রের বাজারের প্রকৃতি এক হবে না। প্রথম রাষ্ট্রের তুলনায় দ্বিতীয় রাষ্ট্রের বাজার অনেক বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ হবে। একজন অশিক্ষিত লোকের যা যা প্রয়োজন– যেমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদি– তার প্রায় সবকিছুই একজন শিক্ষিত লোকের প্রয়োজনের তালিকায় আছে। কিন্তু একজন শিক্ষিত লোকের এমন অনেক কিছুই প্রয়োজন হয়– যেমন বই, কলম বা কম্পিউটার– যাতে অশিক্ষিত লোকের তেমন প্রয়োজন নেই।

মহাভারতের বনপর্বে বকরূপী যক্ষ যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করেছিল: "সুখী কে?"

যুধিষ্ঠির উত্তর দিয়েছিলেন: "অঋণী, অপ্রবাসী এবং দিনান্তে শাকান্নভোজী মানুষ সুখী।"

নিজের বাজারের আয় থেকেই যদি কোনো রাষ্ট্রের সব নাগরিকের গ্রাসাচ্ছাদন ভালো রকম চলে যায়, তবে সেই রাষ্ট্রের নাগরিকদের মা-বাবা-স্ত্রী-সন্তান ছেড়ে বহু বিচিত্র ঝুঁকি নিয়ে প্রতিকূল পরিবেশে গিয়ে অন্য জাতির গোলামি করতে হয় না। কিন্তু বাংলাদেশের জনসংখ্যা এতটাই ক্রমবর্ধমান এবং বাংলাদেশের বাজার এখনও এতটাই অনুন্নত যে, বাঙালির সামনে আরও অনেক দশক ধরে অন্য দেশে গিয়ে গতর ও মস্তিষ্ক খাটানোর বিকল্প নেই।

কৃষি কিংবা শিল্পের উন্নয়নের অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের সর্বাধিক দৃষ্টি দিতে হবে মানবসম্পদ উন্নয়নের দিকে, যেহেতু এই সম্পদটি প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশি আছে আমাদের। মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশ দর্শনীয় উন্নতি করেছে বা নিদেনপক্ষে করার কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার কথা ভাবছে, এমনটা বলা যাবে না। বাঙালি শ্রমিকেরা শ্রীলঙ্কা, ভারত বা ফিলিপাইনের শ্রমিকদের তুলনায় কম বেতন পায়, কারণ তারা অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত। উপযুক্ত প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করা গেলে বাংলাদেশের জনসংখ্যা জনসম্পদে রূপান্তরিত হতে পারে। এই জনসম্পদ প্রথমত, বর্তমানের চেয়ে বহুগুণ বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে, এবং দ্বিতীয়ত, অভ্যন্তরীণ বাজারের বিস্তৃতি ও উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদে অন্য যে কোনো খাতে বিনিয়োগের চেয়ে ফলদায়ী হবে– রাজনৈতিক অর্থনীতিতে আগ্রহীমাত্রেই এই দাবির সঙ্গে একমত হবেন।

বাংলাদেশ সরকার ২০১৬-১৭ বাজেটের সর্বোচ্চ অংশ (১৫.৬%) শিক্ষা খাতের জন্যে বরাদ্দ করেছে (জনপ্রশাসন: ১৩.৯%, যোগাযোগ: ১১%, প্রতিরক্ষা: ৬.৫%,স্বাস্থ্য: ৫.৩%)। এই বরাদ্দ পাশ্চাত্যের অনেক দেশের (যুক্তরাষ্ট্র ২%, কানাডা ৩%, জাপান ও ফ্রান্স ৪%) চেয়ে চার থেকে আটগুণ বেশি এবং দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ (ভারত ১৩% এবং পাকিস্তান ১৪%)। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ অর্থের প্রায় অর্ধভাগ প্রাথমিক শিক্ষাখাতে ব্যয়িত হচ্ছে। আন্তর্জালে সহজলভ্য বিভিন্ন দেশের বাজেটের পাইচার্টের তুলনা থেকে এ তথ্যগুলো উঠে এসেছে। কাজীর গরু যদি শুধু হিসাবে থাকে এবং হিসাবেও যদি ভুল থাকে, তবে আমি নিরুপায়!

সরকার শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দিতে সক্ষম হচ্ছে। নারীশিক্ষায় দর্শনীয় অগ্রগতি হয়েছে। পরীক্ষাগুলো ঠিক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবু আজ প্রশ্নফাঁস, কাল কোনো পরীক্ষা কেন্দ্রে নকলবাজির মহোৎসব, পরশু পরীক্ষায় উত্তর বলে দেওয়া, তরশু হেফাজতের দাবি মানতে গিয়ে সিলেবাসের গায়ে (সুকুমার রায়ের ভাষায়) 'টকটক গন্ধ'– শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশে অভিযোগ এবং ইস্যু অন্তহীন।

দেশে এবং বিদেশে বাঙালি জনগোষ্ঠীর একটি অংশ আশঙ্কা করে, বাংলাদেশে লেখাপড়ার ১২টা বেজে গেছে। তাদের অভিযোগ: শিক্ষার উন্নয়নের দাবির পুরোটাই মূলত এবং কার্যত চমৎকার এক চক্ষুসাফাই, তলে তলে কোম্পানিকা যাবতীয় মাল দরিয়ামে ঢালা হচ্ছে। নচিকেতা যেমনটা গেয়েছেন:

"রাজা দেয় প্রতিশ্রুতি হ্যান কারেগা, ত্যান করেগা; করেগা কচু, আসলে ব্যাটা পকেট ভারেগা!"

বাংলাদেশে কাগজে-কলমে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক। উচ্চশিক্ষাও এদেশে প্রায় বিনামূল্যেই পাওয়া যায়। কিছুদিন আগে অর্থমন্ত্রী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি বাড়ানোর কথা বলেছেন। ফেল কড়ি মাখ তেল! উচিত শিক্ষা কি অবৈতনিক হওয়া উচিত নয়? ইওরোপের একাধিক জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পিতামাতার আয় অনুসারে শিক্ষার্থীর ফি নির্ধারিত হয়।

শিক্ষা বা চিকিৎসা, রাষ্ট্রের যে কোনো সুবিধা নেওয়ার জন্যে টিন নম্বর বাধ্যতামূলক করার কথা ভাবা যেতে পারে। সরকারি কোনো বিদ্যায়তনে ভর্তি হওয়ার সময় পিতামাতার আয় দেখে জানা যাবে, শিক্ষার্থীকে কোনো বেতন দিতে হবে কি না। তবে টিন নম্বর থাকলেই বছরে ছয় হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে, আয় থাকুক বা না থাকুক, এরকম হাস্যকর নিয়ম বাতিল করলে ভালো হয়। ঘরের চালেই যার টিন লাগানোর ক্ষমতা নেই, সেই অভিভাবকের উপরে টিন নম্বর চাপিয়ে কী হবে!

সরকারি সুবিধা তারই পাওয়া উচিত, যার আসলেই সেই সুবিধার প্রয়োজন আছে, কিন্তু ক্রয়ের ক্ষমতা নেই। তেলা মাথায় তেল দিলে জনগণের অর্থের অপচয় হবে।

শিক্ষার তিনটি ধাপ: প্রাথমিক, (নিম্ন ও উচ্চ) মাধ্যমিক ও উত্তর-মাধ্যমিক (স্নাতক ও স্নাতকোত্তর) বা উচ্চশিক্ষা। শিক্ষার আটপৌরে বাংলা প্রতিশব্দ: 'লেখাপড়া' বা 'পড়ালেখা'। ইংরেজিতে বলে, 'থ্রি আরস' (Rs): রিডিং, রাইটিং এবং অ্যরিথম্যাটিক।

ন্যূনতম প্রাথমিক শিক্ষার অধিকারী বলে দাবি করতে হলে একজন মানুষকে অবশ্যই লিখতে ও পড়তে জানতে হবে এবং যোগ-বিয়োগ-গুন-ভাগসহ কমবেশি গণিতও জানতে হবে। মাধ্যমিক এবং/বা স্নাতক ডিগ্রির অধিকারী কোনো ব্যক্তি যৌক্তিক বিশ্লেষণশক্তির অধিকারী হওয়া বাঞ্ছনীয়। শিক্ষাদান যদি ঠিকঠাক পরিচালিত হয়, তবে কারও পক্ষে একজন স্নাতককে সাত-পাঁচ-চৌদ্দ বোঝাতে পারার কথা নয়। মাধ্যমিক বা উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তির মধ্যে স্বাধীনভাবে জ্ঞান অর্জনের আগ্রহ ও ক্ষমতা থাকাও অপরিহার্য। এসব দক্ষতা কমবেশি আছে কি না বিচার করেই শিক্ষার্থীকে ডিগ্রি দেওয়া উচিত।

"লিখে দিলাম কলাপাতে, ঘুড়ে মরগে পথে পথে!"

কোনো ডিগ্রির যেন এই করুণ পরিণতি না হয়।

লেখাপড়া যেহেতু ভাষানির্ভর এবং যে কোনো রাষ্ট্রে যেহেতু একাধিক ভাষাভাষী লোক থাকে, সেহেতু রাষ্ট্রকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, কোন ভাষাটি শিক্ষার মাধ্যম হবে। মাতৃভাষা শিক্ষার মাধ্যম হলে সবচেয়ে ভালো হয়– এতে দ্বিমত নেই। কিন্তু সব নাগরিককে তার মাতৃভাষায় লেখাপড়া শেখার সুযোগ দেওয়ার মতো আর্থিক ও ব্যবস্থাপনাগত সক্ষমতা বেশিরভাগ রাষ্ট্রেরই থাকে না।

বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসীর মাতৃভাষা বাংলা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা। রাষ্ট্রভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করতে যে কোনো সরকার বাধ্য। রাষ্ট্রভাষা যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মাতৃভাষা হয়ে থাকে, তবে রাষ্ট্রের শিক্ষার খরচ অনেকটাই কমে যায়। কিন্তু এটাও ঠিক যে, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলার তুলনায় ইংরেজির গুরুত্ব বেশি। কিন্তু বাংলাদেশের সব শিক্ষার্থীকে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার সাধ্য বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নেই। উচিতই মেলে না, আবার মিষ্টান্ন!

সুতরাং যে কোনো বিচারে বাংলা ছাড়া আর কোনো ভাষাই বাংলাদেশে শিক্ষার প্রধান মাধ্যম হতে পারে না। তবে জনসংখ্যার ভিত্তিতে বাংলাদেশের অন্যান্য মাতৃভাষাগুলোতেও লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে (এবং বর্তমান সরকার তা যথাসাধ্য করছেও), যদি এই কাজের জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক ও ব্যবস্থাপনাগত সঙ্গতি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের থাকে।

বাংলাদেশের অনেক শিক্ষায়তনে শিক্ষার মাধ্যম বাংলা নয়। অনেক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে একটি বাংলা শব্দ উচ্চারণ করলেও নাকি শাস্তি পেতে হয়! বেসরকারি মাদ্রাসা ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল– এ দুই ধরনের বিদ্যালয়ের মধ্যে মিল রয়েছে। দুটোর কোনোটির সঙ্গেই দেশীয় বাঙালি সংস্কৃতির তেমন যোগ নেই। দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই জাতীয় সংগীত না গাওয়ানো, জাতীয় পতাকা উত্তোলন না করা, জাতীয় পাঠ্যক্রম অনুসরণ না করার অভিযোগ রয়েছে। এ দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়েই নিজভূমে পরবাসী এবং জঙ্গি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

দুই ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরাই তাদের খদ্দের অর্থাৎ শিক্ষার্থী ও তাদের বাবা-মাকে স্বর্গে নেওয়ার লোভ দেখায়। ইংলিশ মিডিয়ামের স্বর্গ হচ্ছে 'ইংল্যান্ড' এবং তার প্রাক্তন উপনিবেশগুলো, যেখানে জীবদ্দশাতেই যাওয়া যায় ভাগ্য ভালো হলে। মাদ্রাসার নির্দেশিত স্বর্গ 'পরলোক'। তবে কিছু ইংলিশ মিডিয়াম মাদ্রাসা বা ধর্মভিত্তিক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল রয়েছে, যেখানে ভর্তি হতে পারলে 'গাছেরটা খাওয়া এবং তলারটা কুড়ানো', অর্থাৎ দুই স্বর্গেরই টিকেট পাওয়া অসম্ভব নয়!

কেউ সওয়াল করতে পারেন, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল এবং বেসরকারি মাদ্রাসাগুলো যেহেতু রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা বা অর্থায়নে চলে না, সেহেতু এই প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে কোন ভাষা ব্যবহার করবে সেটা রাষ্ট্র কেন ঠিক করে দেবে? এর জবাবে আমরা দুটি কারণ দেখাব।

প্রথমত, রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ততক্ষণ পর্যন্ত বরদাস্ত করা হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত সেই স্বাধীনতা রাষ্ট্রের ক্ষতি না করছে। যেহেতু বাংলা ও ইংরেজি ভাষার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব সমান নয়, সেহেতু এ দুটি ভাষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব অবশ্যই বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বিভক্তি ও বৈষম্য সৃষ্টি করার সম্ভাবনা থাকবে। যে কোনো ধরনের বিভক্তি ও বৈষম্য সমাজ ও রাষ্ট্রের অগ্রগতি ব্যাহত করে। কারও কুড়াল কেনার সঙ্গতি আছে বলেই রাষ্ট্র তাকে কুড়াল কিনতে দিতে পারে না। রাষ্ট্র যদি নিশ্চিত জানে যে, অন্যের বা নিজের পায়ে মারার উদ্দেশ্যেই দেশি ও বিদেশি উদ্যোগে সে কুড়াল জোগাড় করা হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, মধ্যযুগের ইওরোপে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার সূচনাপর্ব (১১০০-১৫০০ খ্রিস্টাব্দ) থেকেই ডিগ্রি দেওয়ার অধিকার রাষ্ট্রের উপর অর্পিত হয়েছে। রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ব্যতীত কোনো ডিগ্রিরই গ্রহণযোগ্যতা থাকে না, থাকা উচিতও নয়। রাষ্ট্র যদি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ডিগ্রিকে স্বীকৃতি দেয় অথবা রাষ্ট্রের সীমানার ভেতরে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ডিগ্রি দেওয়ার অনুমতিও দেয়, তবে সেই প্রতিষ্ঠান কী পড়াচ্ছে, কোন ভাষায় পড়াচ্ছে এ সবগুলো বিষয়ে খবরদারি করার অধিকার রাষ্ট্রের রয়েছে এবং রাষ্ট্রের হয়ে রাজা বা সরকার এই অধিকার প্রয়োগ করে আসছে সেই মধ্যযুগ থেকে।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সমাপনী পরীক্ষা পাস করা শিক্ষার্থীরা কি গ্রহণযোগ্য বাংলা ও ইংরেজি লিখতে পারে? ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা কি ইংরেজি ঠিকমতো বলতে ও লিখতে পারে? মাদ্রাসা থেকে পাশ করা ছাত্রেরা কি আরবি ও উর্দু শুদ্ধভাবে বলতে ও লিখতে পারে?

পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে নিশ্চিত করা যেতে পারে, কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী বাংলায় ও ইংরেজিতে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না, এতে সম্ভবত কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন না। যে কোনো একটি ভাষা শ পাঁচেক ঘণ্টা শিখেই তাতে মনের ভাব প্রকাশ করা সম্ভব। উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ইংরেজি শেখে কমপক্ষে এক হাজার ঘণ্টা। বাংলা শেখে কমপক্ষে তার পাঁচগুণ বেশি সময় ধরে। শিক্ষার্থীরা যদি বাচনে ও লিখনে এই ভাষাগুলোতে (অন্ততপক্ষে বাংলায়) মনের ভাব প্রকাশ করতে না পারে তবে স্বীকার করতেই হবে যে, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় 'ফাঁকির শুভঙ্কর' চলছে।

লেখা ও পড়াই যদি না শিখল তবে বেশুমার 'জিপিএ-পঞ্চ' প্রসবে কী ফায়দা? উপরে ফিটফাট, ভিতরে সদরঘাট! ঠিকমতো লিখতে পড়তে না জানা একেক জন লেফাফা-দুরস্ত কিশোরের শিক্ষার পেছনে বিনিয়োগকৃত ১২টি বছর আর পরিবার ও রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ অর্থ অপচয় হবার দায় কে নেবে?

কানাডার কুইবেকের ফরাসি স্কুলে বিভিন্ন বিষয়ে লিখতে শেখানো হয় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। এই কাজেই সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করা হয়। ছাত্রেরা ফরাসি বা ইংরেজি ব্যাকরণে দুর্বল থাকলেও ফরাসি বা ইংরেজি কমবেশি শুদ্ধভাবে লিখতে পারে। বাংলাদেশে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক– প্রতিটি ক্লাসে বাংলা ব্যাকরণের মোড়কে সংস্কৃত ব্যাকরণের পুনরাবৃত্তি করাতে গিয়ে যে সময় বেহুদা নষ্ট হয়, সেটা লিখতে শেখানোর কাজে ব্যবহার করা যেত। ছাত্ররা লিখতে জানে না, কারণ আমরা তাদের লিখতে শেখাই না। লিখতে শুধু কেন, শিক্ষার্থীদের আমরা যুক্তিসম্মতভাবে, গুছিয়ে কথা বলতেও শেখাই না। এই দোষ প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে যায়। কারণ রোগই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়।

বাংলাদেশে বাংলা ও ইংরেজি রচনা মুখস্থ করার বই আছে, কিন্তু মনের ভাব প্রকাশ করে লিখতে শেখানোর কোনো বই নেই। এর মানে হচ্ছে বাংলাদেশে শিক্ষাবিষয়ক নীতিনির্ধারকেরা চান– বহু যুগ যাবৎ চেয়ে আসছেন– শিক্ষার্থীরা রচনা মুখস্থ করুক। ছাত্রাবস্থায় ইংরেজি-বাংলা রচনা, বড় প্রশ্ন, ছোট প্রশ্ন, ব্যাখ্যা, ভাবসম্প্রসারণ, ভাবসংক্ষেপ, পত্ররচনা– সবকিছু আমরা নোটবই থেকে ঝাড়া মুখস্থ করতাম। মূল বই পারতপক্ষে পড়তাম না।

শিক্ষকেরা আমাদের নিজের কথা নিজের মতো করে বলতে-লিখতে শেখাতেন না। নিজে থেকেও যে লেখা যায়– এমন 'সৃষ্টিছাড়া' কথা কোনো শিক্ষক কখনও আমাদের বলেননি। একবার আমি দশ পঙক্তির এক কবিতার সারসংক্ষেপ দুই লাইনে লিখেছিলাম বলে শিক্ষক আমার পিঠে বেতের বাড়ি দিয়ে বলেছিলেন: কেন আমি নোটবই থেকে দেখে আরও বড় করে লিখিনি।

পাঠদানের এই 'তোতাপাখি পদ্ধতি' এখন আমূল পরিবর্তন হয়েছে শুনলে খুশি হতাম।

শিক্ষার মাধ্যম নির্বিশেষে বাংলাদেশের যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর শিক্ষার্থীকে রাষ্ট্রভাষা বাংলায় লিখতে ও পড়তে শেখানোর বাধ্যবাধকতা আরোপ করার বিকল্প নেই। বাংলাদেশে শৈশব ও কৈশোর অতিক্রান্ত হয়েছে এমন যে নাগরিক বাংলা ভাষায় গ্রহণযোগ্যভাবে লিখতে ও পড়তে জানে না, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দৃষ্টিকোণ থেকে সে অশিক্ষিত বা মূর্খ বলে বিবেচিত হওয়া উচিত।

মূর্খদের কেন ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে? কিছু আকাট মূর্খের ডিগ্রির স্বীকৃতিই-বা কেন দেওয়া হচ্ছে? পৃথিবীর কোনো উন্নত দেশে কি রাষ্ট্রভাষায় লিখতে-পড়তে না শিখে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপনী ডিগ্রি পাওয়া যায়?

এই প্রসঙ্গে কিছু জ্ঞানপাপী কুযুক্তি দেয়: উন্নত দেশগুলো এমন অনেক কিছু করতে পারে, যা উন্নয়নশীল বাংলাদেশ পারে না। উন্নত দেশগুলো কি উন্নত হওয়ার কারণে মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে পারছে, নাকি মাতৃভাষাকে শতাধিক বৎসর যাবৎ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে শতভাগ নাগরিক সমভাবে শিক্ষিত হওয়াতে সেই দেশগুলো উন্নত হয়েছে?

প্রতিটি পরীক্ষা হবে এক একটি ছাঁকুনি যা গলে শিক্ষিত অনায়াসে বের হয়ে যাবে, কিন্তু মূর্খ ততক্ষণ পর্যন্ত আটকে থাকতে বাধ্য হবে যতক্ষণ পর্যন্ত সে শিক্ষিত না হচ্ছে। গুনাহগার ও নেকদিল উভয়ে যদি হেসে-খেলে পুলসিরাত পার হয়ে যায়, তবে তো শেষ বিচারের দিনেও ধুন্ধুমার লেগে যেতে পারে!

এমন কোনো শিক্ষাপদ্ধতি ও পরীক্ষা পদ্ধতি উদ্ভাবন করা কি সম্ভব, যাতে করে অপরিহার্যভাবে রাষ্ট্রভাষা বাংলা (এবং সম্ভব হলে ইংরেজি) পড়তে ও লিখতে না শিখে কোনো শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিক পাস করতে না পারে?

শিক্ষিত ব্যক্তিরাই ডিগ্রি পাবে, মূর্খরা নয়– সৃজনশীল পদ্ধতি কি এই নিশ্চয়তা দিতে পারবে? মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক ডিগ্রি দেওয়ার আগে প্রত্যাশিত দক্ষতা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। যেনতেন প্রকারে পাসের হার বাড়ানো আখেরে দেশ ও জনগণের জন্যে মঙ্গলজনক হবে না।

কাজীর গরু হিসাবে নয়, গোয়ালে থাকতে হবে।