কাশেম বিন আবু বাকার, পশ্চিমা গণমাধ্যম এবং ইসলামি জনপরিমণ্ডল

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 11 May 2017, 02:06 AM
Updated : 11 May 2017, 02:06 AM

গত শতাব্দীর সত্তর দশকের শেষ সময় থেকে 'সাহিত্য চর্চাকারী' কাশেম বিন আবু বাকার হঠাৎ বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাশাপাশি বিভিন্ন গণমাধ্যমের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছেন। নানাজন নানা দৃষ্টিকোণ থেকে আবুবাকারের মূল্যায়ন করছেন। এ মূল্যায়নে বাদ পড়ছে না কোনো বিষয়ই; আবুবাকারের লেখার সাহিত্যিক, নন্দনতাত্ত্বিক বিচার যেমন চলছে, তেমনি এর সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মতাত্ত্বিক দিক নিয়েও চলছে তুমুল আলোচনা।

কিন্তু প্রশ্ন হল, যিনি এত দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন তিনি কেন এতদিন পর হঠাৎ করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলেন, তাও কিনা লেখা ছেড়ে দেওয়ার দুবছর পর।

আবু বাকার যে ধারায় লেখেন ওই ধারায় তিনিই একমাত্র লেখক নন, বা তিনিই প্রথম এ ধারার লেখা শুরু করেননি। আবু বাকার ছাড়াও এ ধারার আরও অনেক লেখক রয়েছেন, যারা এক বিশেষ পাঠকগোষ্ঠীর কাছে বেশ জনপ্রিয়। তাহলে সবাইকে বাদ দিয়ে শুধু তাঁকে নিয়ে আলোচনা কেন?

এ আলোচনার মূল কারণটা হল 'এএফপি', 'ডেইলি মেইল'সহ পাশ্চাত্যের কিছু গণমাধ্যমে আবু বাকারকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ।

উপনিবেশিক শাসন চলে গেলেও আমাদের ভালো-মন্দ সবকিছু যে আমরা এখনও পাশ্চাত্যের চোখে দেখতে অভ্যস্ত, আবু বাকারের গল্প আমাদের আরেকবার নতুন করে তা মনে করিয়ে দিল। আমাদের এ মনোজাগতিক উপনিবেশিকতা পাশ্চাত্যের সংবাদমাধ্যমগুলো খুব ভালো বোঝে। তাই তারা তাদের সুবিধা অনুযায়ী কখনও কাউকে বানায় নায়ক, আর কাউকে খলনায়ক। আর আমরাও সে অনুযায়ী কখনও হাততালি দেই আর কখনও কারও মুখে চুনকালি মাখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

দেশের ভূমি স্বাধীন হলেও আমাদের মনের ভূমিতে এখনও পড়ানো রয়েছে উপনিবেশবাদের সেই পুরানো শিকল। ফলে আমাদের নিজেদের চেহারাও আমরা সেভাবেই দেখি, পাশ্চাত্য আমাদের যেভাবে দেখায়। নিজেদের চেহারা নিজেদের আয়নায় দেখতে পারবার যে অক্ষমতা একেই অনেক মনীষী অভিহিত করেছেন 'মনোজাগতিক উপনিবেশিকতা' হিসেবে।

জাপান ছাড়া পাশ্চাত্যের বাইরের সব দেশ নিয়ে পাশ্চাত্যের প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে যেসব সংবাদ পরিবেশিত হয় সেগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে সিংহভাগ রিপোর্টেই এসব দেশকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এসব নেতিবাচক রিপোর্ট অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে নেওয়া হয়।

পাশ্চাত্যের মিডিয়াগুলো আপাত স্বাধীন মনে হলেও কিছু ব্যতিক্রম বাদে এরা মূলত বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বা পরিচালিত। এসব প্রতিষ্ঠান আবার সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। ফলে সাধারণত কোনো মিডিয়া পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রসমূহের যে চিন্তাধারা তার বাইরে কোনো সংবাদ বা সম্পাদকীয় পরিবেশন করে না।

পশ্চিমা মিডিয়া এবং চিন্তাবিদদের প্রবণতা হল পাশ্চাত্যের যা কিছু অর্জন তাকে ইউনিভার্সেল বা বৈশ্বিক বলা; অন্যদিকে প্রাচ্যের মহৎ অর্জনসমূহ গণ্ডিবদ্ধ করে প্রচার করা বা জনমানসে এ ধরনের ধারণা তুলে ধরা। ফলে পাশ্চাত্যের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি যার অনেক কিছুর মাঝেই সুস্পষ্ট খ্রিস্ট ধর্মীয় প্রভাব রয়েছে, তাকে প্রচার করা হয় বৈশ্বিক ও অসাম্প্রদায়িক হিসেবে। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যসহ যেসব দেশে মুসলিম জনগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেসব দেশের শিল্প-সাহিত্যকে ধর্মীয় পরিভাষা দিয়ে গণ্ডিবদ্ধ করবার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। ফলে পাশ্চাত্যের কোনো শিল্পীর চিত্রকলা যখন শুধুই চিত্রকলা– মধ্যপ্রাচ্যের কোনো শিল্পীর কাজ তখন 'ইসলামিক আর্ট'।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা। সেখানে প্রেসিডেন্ট, বিচারকবৃন্দসহ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সবাই বাইবেলে হাত রেখে শপথ নিতে হয়। মার্কিন জনগণ যে ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন সেটি এখানে ডলারের প্রতিটি নোটে লেখা রয়েছে। শুধুমাত্র খ্রিস্টীয় ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষেই এ দেশে সরকারি ছুটি থাকে; অন্য ধর্মাবলম্বী এমনকি ইহুদিদের ধর্মীয় উৎসবেও এদেশে কোনো সরকারি ছুটি নেই। বড়দিনের সময় এদেশে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস, হোটেল এমনকি অনেক রাস্তাও 'ক্রিসমাস ট্রি' দিয়ে সাজানো হয়।

দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করেও খ্রিস্ট ধর্ম বাদে অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় প্রতীক পাবলিক প্লেসে আমার চোখে পড়েনি। ছোট-বড় সব হোটেল ও মোটেলের প্রতিটি কক্ষে এদেশে বিছানার পাশে সাইড টেবিলে রাখা আছে বাইবেল। এসব সত্ত্বেও পাশ্চাত্যের মিডিয়া ও মূলধারার বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র 'সেক্যুলার' রাষ্ট্র।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যদি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে তুলনা করি তাহলে আমরা দেখি যে, এখানে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে কোনো পর্যায়ের নির্বাচিত প্রতিনিধি বা বিচারকবৃন্দ কোরান শরিফে হাত রেখে শপথ গ্রহণ করেন না। এদেশের বেশিরভাগ জনগণ যে আল্লাহতে বিশ্বাস করেন সেটি টাকার উপর লিখে রাষ্ট্র বোঝাতে চেষ্টা করে না। মুসলিম জনগোষ্ঠী ব্যতীত হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসবেও সরকারি ছুটি থাকে। ব্যাপক না হলেও ইসলাম ধর্মাবলম্বী ব্যতীত অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় প্রতীকও কখনও কখনও রাস্তায় বা পাবলিক প্লেসে চোখে পড়ে। ছোট-বড় কোনো হোটেল-মোটেলের শয়নকক্ষে এখানে কোরান শরিফ রাখা নেই। যদিও কয়েকটি তারকাখচিত হোটেল উপনিবেশিক দাসসুলভ মানসিকতা দেখিয়ে অনেকটা মাছিমারা কেরানির মতো পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ করে তাদের শয়নকক্ষসমূহে রেখেছে বাইবেল।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কিছু বিরল ব্যতিক্রম বাদে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এলিট হিসেবে যারা পরিচিত, সে অংশটি মনোজগতে উপনিবেশিক দাস মনোবৃত্তি দ্বারা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। এ মনোবৃত্তির একটি নগ্ন বহিঃপ্রকাশ হল তারকাখচিত হোটেল এবং এসব এলিটদের ক্লাবসমূহে বাংলাদেশের শ্রেণি-ধর্মনির্বিশেষে সবাই যে পোশাক পরিধান করেন, অর্থাৎ লুঙ্গি পরে প্রবেশে সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশিক প্রভুদের আলোকে নিষেধাজ্ঞা জারি রাখা। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার, ভুটান বা শ্রীলঙ্কার সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এলিটবৃন্দ সেদেশের জাতীয় পোশাক লুঙ্গি, সারং (শ্রীলঙ্কান পুরুষদের লুঙ্গির মতো এক ধরনের পোশাক) বা ঘো (ভুটানের পুরুষদের জাতীয় পোশাক) পরে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে খুব স্বাছন্দে চলাফেরা করেন।

বাংলাদেশে সব ধর্মাবলম্বী সরকারি ছুটি ভোগ করেন এ তথ্য যখন আমি মার্কিন কলিগ বা বন্ধুদের উল্লেখ করি তাদের মাঝে বিস্ময়ের প্রথম যে প্রতিক্রিয়া শুনতে পাই তা হল: একটি আইডিয়াল সেক্যুলার রাষ্ট্রে তাই হওয়া উচিৎ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশেষ ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য থাকলেও পশ্চিমে তা সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। অপরদিকে বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ইংলিশ ভার্সন অনুযায়ী সেক্যুলারিজম অন্তর্ভুক্ত করা হলেও সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এখনও অন্তর্ভুক্ত থাকার ফলে পশ্চিমা গণমাধ্যম বাংলাদেশকে সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠিত। যদিও সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী একইসঙ্গে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম পালনের অধিকার নিশ্চিত করেছে। অর্থাৎ পশ্চিমা গণমাধ্যমের কাছে একই যাত্রায় দুই রাষ্ট্রের জন্য দুই ফল। ধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা সত্ত্বেও মার্কিন রাষ্ট্র তাদের কাছে 'সেক্যুলার'; অপরদিকে বাংলাদেশ সংবিধানে কিছু ধর্মীয় চিহ্ন থাকার ফলে 'মডারেট' মুসলিম দেশ।

আবার মুশকিল হল, পশ্চিমা জগতের বাইরে কোনো রাষ্ট্র যদি পুরোপুরি সেক্যুলার হয়, যেমন কামাল আতাতুর্কের তুরস্ক, তখন সেই পশ্চিমা গণমাধ্যম ও বুদ্ধজীবীরা বলতে শুরু করেন: শতভাগ সেক্যুলার রাষ্ট্রে মুসলমানসহ অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অধিকার রক্ষিত হয় না। অর্থাৎ উপনিবেশিক শাসন হারিয়ে ফেলার পর পাশ্চাত্যের গণমাধ্যম ও একাডেমিক ডিসকোর্স যে কাজ করছে তা হল, পাশ্চাত্যের বিভিন্ন থিংক ট্যাংক বা চিন্তক গোষ্ঠীর মাধ্যমে প্রাচ্যের উপরে বুদ্ধিবৃত্তিক উপনিবেশ কায়েম রাখা।

কাজটা তাদের জন্য সহজ হয় আরও এ কারণে যে, বাংলাদেশের মতো যেসব দেশ দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে, সেসব দেশে কিছু ব্যতিক্রম বাদে বুদ্ধিজীবী সমাজ ও সিভিল সোসাইটি বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার জন্য পাশ্চাত্যের উপর নির্ভরশীল। এ নির্ভরতা তাদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা রহিত করে তাদের মধ্যে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক বৈকল্যের জন্ম দিয়েছে। যার জন্য পাশ্চাত্য যা বলে বা যা দেখায় এর বাইরে তারা বলতে বা দেখতে অক্ষম। ফলে আমাদের দেশে বুদ্ধিজীবী ও চিন্তকগোষ্ঠীর মাঝে পাশ্চাত্যের চিন্তাধারার অনুরণন দেখা যায়।

পাশ্চাত্যের উপরে মনস্তাত্ত্বিক এ নির্ভরতার কারণে ডান-বাম ধারার সেক্যুলার হিসেবে পরিচয় দানকারী বুদ্ধিজীবীরা তো বটেই, এমনকি যারা নিজেদের ইসলামিক ধারার পরিচয় দিতে পছন্দ করেন, তারাও পাশ্চাত্যের স্বীকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকেন। পাশ্চাত্যের মিডিয়া, প্রতিষ্ঠান বা সরকার যখন আমাদের দেশের কাউকে স্বীকৃতি প্রদান করে বা কাউকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে তখন আমাদের মতো উপনিবেশিকত্তোর দেশগুলোতে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি হয়। পাশ্চাত্যের মিডিয়া বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও সাধারণত সেসব ব্যক্তিকেই সামনে নিয়ে আসে যারা তাদের নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

বাংলাদেশকে নানা সময়ে কিছুটা হলেও ধর্মনিরপেক্ষ (সেক্যুলার নয়) রাষ্ট্রের চরিত্র দেওয়ার চেষ্টা যখন বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার করে আসছে, তখন একজন অখ্যাত লেখক আবু বাকারকে তুলে আনবার মাধ্যমে পশ্চিমা মিডিয়ার একই সঙ্গে দুই উদ্দেশ্য সাধিত হল। একদিকে পশ্চিমা দুনিয়ার সাধারণ জনগণের সামনে বাংলাদেশের সাহিত্যের মান কোথায় সেটি যেমন দেখানো সম্ভব হল, পাশাপাশি এ বিষয় তুলে ধরা গেল যে, তৃণমূল পর্যায়ের সাধারণ জনগণ ইসলামি চেতনা দ্বারা পরিচালিত বলে ইসলামি ভাবধারা প্রভাবিত সাহিত্য তাদের কাছে জনপ্রিয়।

আর যেহেতু পশ্চিমা মিডিয়া থেকে বলা হয়েছে আবু বাকার বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক, মনোজগতে উপনিবেশিক মানসিকতা আমাদের বিশ্বাস করাতে শুরু করেছে: আবু বাকার অবশ্যই জনপ্রিয় লেখক, তিনি আমাদের কাছে যতই অখ্যাত হন না কেন। আমরা এটা মনে করতে শুরু করেছি, শহরে আমরা তাঁর নাম না শুনলেও গ্রামাঞ্চলে তিনি জনপ্রিয়।

এভাবে যারা শহরে বসবাস করেন তারা বোঝাতে চাইছেন যে, শহরে যারা বসাবাস করেন বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে তারা গ্রামে বসবাসকারী মানুষের চেয়ে উন্নততর যেহেতু তারা আবু বাকারের নামই শোনেননি। অর্থাৎ তারা আবু বাকারের মতো 'নিম্নমার্গের সাহিত্যিকের' সাহিত্যকর্ম পড়া তো দূরে থাক, তাঁর নাম না জানলেও পশ্চিমা মিডিয়া যেহেতু বলেছে, সেহেতু গ্রামাঞ্চলের জনগণের বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যতা দেখিয়ে হলেও বিশ্বাস করতে হবে যে, আবু বাকার বাংলাদেশের জনপ্রিয় লেখক। যদিও অনেকের ভাষ্যমতে: তিনি বড়জোর 'বটতলার সাহিত্যিক'।

একটি অপ্রাসঙ্গিক কথা না বললেই নয়: শুধু বাংলাদেশে নয়, আমেরিকাতেও 'বটতলার সাহিত্যিকদের' লেখা অধিক জনপ্রিয়। কে সাহিত্যিক আর কে 'বটতলার সাহিত্যিক' তা বিচারের ভার একান্তই পাঠকের। বিজ্ঞানের মতো সাহিত্যে এমন কোনো সূচক নেই যা দিয়ে এ বিভাজন পরিমাপ করা যায়।

বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ জনপ্রিয়তা কিন্তু তাঁর সাহিত্যকর্ম দিয়ে পাননি, বরং যেসব লেখা আদৌ সাহিত্য পদবাচ্য কি না বলে সমালোচকদের প্রশ্ন রয়েছে, সেসব লেখাই তাঁকে জনপ্রিয় করেছে। আর জনপ্রিয়তাই তাঁর ভালো কাজগুলো পড়তে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে।

প্রসঙ্গত উল্লখযোগ্য যে, বাংলাদেশের কোনো প্রথিতযশা সাহিত্যিক, যাদের সাহিত্যকর্ম কালোত্তীর্ণ হবে বলে মনে করা হয়, তাঁরা কেউ জনপ্রিয় ছিলেন না। শওকত ওসমান, শওকত আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক, কায়েস আহমেদ এমনকি সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকও অন্তত হুমায়ূন আহমেদ যে অর্থে জনপ্রিয় ছিলেন সে অর্থে ছিলেন না।

চলচ্চিত্র অভিনেতা-অভিনেত্রী বা রাজনীতিবিদদের মতো একজন সাহিত্যিক জনপ্রিয়তা অর্জনের লক্ষ্য মাথায় রেখে সাহিত্য সৃষ্টি করেন না। তাঁর লক্ষ্য থাকে সমকালীন বাস্তবতা বা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তাঁর সাহিত্যকর্মে ফুটিয়ে তোলা। তাঁর সাহিত্যকর্ম একজন পাঠক বুঝতে পারলেন কী পারলেন না তার দায়ভাগ একজন সাহিত্যিকের নয়, একান্তই পাঠকের।

চেখভ, দস্তয়েভস্কি, হেমিংওয়ে বা স্টাইনবেকের লেখা যদি আমরা না বুঝতে পারি, তার দায়ভার সম্পূর্ণভাবে আমাদের। আমাদের বোঝার উপযোগী করেই লেখককে লিখতে হবে, এ দায়ভার নিয়ে যদি লেখক লেখেন তাহলে আর যা-ই হোক সাহিত্য সৃষ্টি হবে না। আবু বাকারকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর অনেকেই লেখকদেরকে তাঁর পথে হাঁটার উপদেশ দিচ্ছেন।

কিন্তু কী লিখেছেন আবু বাকার? তাঁর মতো 'সাহিত্যিকদের' লেখার তথাকথিত জনপ্রিয়তা বোঝার জন্য অনেকেই কিছু গবেষণা উদ্ধৃত করে বলতে চাইছেন যে, বাংলাদেশে একটি ইসলামি বা ইসলামপন্থী জনপরিমণ্ডল ব্যবস্থা (Public Sphere) তৈরির প্রক্রিয়া গত কয়েক দশক ধরে ক্রমে জোরদার হচ্ছে এবং কাশেম বিন আবু বাকার সে ধারার প্রতিনিধিত্ব করেন। বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশের জনপরিমণ্ডল ব্যবস্থা সবসময় ইসলামি ছিল।

তবে অনেক গবেষক সাম্প্রতিক সময়ে সমাজে সৌদি প্রভাবে ওয়াহাবি ইসলামের প্রভাববৃদ্ধির বিষয়টি মাথায় রেখে জনপরিমণ্ডল ব্যবস্থা ইসলামি হয়ে উঠছে বলে মনে করেন। বাংলায় ওয়াহাবি ইসলামও নতুন বিষয় নয়। ব্রিটিশ আমলে বংলায় ওয়াহাবি ইসলাম এসেছিল এবং উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এ ইসলামের অনুসারীদের অনেকে শক্ত ভূমিকা পালন করেছিলেন। বাংলাদেশের জনগণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ওয়াহাবি ব্যাখ্যার আলোকে ইসলাম পালন করছেন দীর্ঘদিন ধরে।

বাংলাদেশের যে অর্থে জনপরিমণ্ডল ইসলামি সে অর্থে মার্কিন জনপরিমণ্ডল ব্যবস্থাও খ্রিস্টীয়। অর্থাৎ বাংলাদেশের জনগণ তার পরিচয় ও কিছু পরিভাষা বা রেটোরিকে সবসময় ইসলামি, কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপক চর্চার দিক থেকে কখনও ইসলামি হয়ে ওঠেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বেশিরভাগ জনগণ দৈনন্দিন জীবনে খ্রিস্টীয় পরিভাষা ব্যবহার করতে অভ্যস্ত। এখানেও চার্চে সাপ্তাহিক প্রার্থনার দিবস মাথায় রেখে রবিবার ছুটি থাকে, যাতে কাজের জন্য লোকজনের চার্চে যেতে সমস্যা না হয়।

বাংলা অঞ্চলের জনগোষ্ঠী কখনও 'সেক্যুলার' ছিল না, বিশেষ ঐতিহাসিক রাজনৈতিক প্রয়োজনে এদেশের জনপরিমণ্ডল ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে, যার ভুল ইংরেজি অনুবাদ করা হয়েছে 'সেক্যুলার' হিসেবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তৎকালীন পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত এক ধরনের সেক্যুলার সমাজ গঠনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের সামাজিক-ঐতিহাসিক বাস্তবতায় এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া একটি অর্বাচীন চিন্তা ছাড়া আর কিছু নয়।

'সেক্যুলার' তো নয়ই, বাংলাদেশের সমাজ 'ধর্মনিরপেক্ষ'ও নয়, তবে এক ধরনের ধর্মীয় সহিষ্ণুতা সমাজে বিদ্যমান রয়েছে; যদিও জাতীয়, আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী থেকে পাড়া-মহল্লার তুচ্ছ ঘটনা এ সহিষ্ণুতা অসহিষ্ণুতায় রূপ দিতে বিন্দুমাত্র সময় লাগে না।

বাংলাদেশ নিয়ে আরেকটি যে মিথ তৈরি করা হয়েছে তা হল, বাংলাদেশ অসাম্প্রয়দায়িক। কিন্তু এ অঞ্চলের মানুষ সবসময় তার ধর্মীয় সম্প্রদায়গত পরিচয় নিয়ে বসবাস করে আসছে। দেশের দুটি প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়, হিন্দু ও মুসলমান ঐতিহাসিকভাবে দীর্ঘদিন ধরে পাশাপাশি বাস করলেও নিজেদের মধ্যকার সন্দেহ, অবিশ্বাস, দ্বন্দ্ব দূর করতে পারেনি। একে অন্যের সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েও তারা যেমন দূর করতে পারেনি নিজেদের মধ্যকার সূক্ষ্ম সাংস্কৃতিক বিভাজন তেমনি দূর হয়নি কিছু পরিভাষা ব্যবহারের পার্থক্য।

এ বিভাজন আর পার্থক্য চাপা দেওয়ার জন্য গড়ে তোলা হয়েছে "বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ"এর মিথ। বাস্তবতা হল, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ক্রমাগত চলে আসা 'নীরব সাম্প্রদায়িকতা' এ জনপদের বৈশিষ্ট্য যার পরিণতি বিপুল হারে হিন্দু সম্প্রদায়ের দেশত্যাগ। তারা এখন মোট জনসংখ্যার মাত্র সাত শতাংশে পরিণত হয়েছেন।

আবু বাকারের 'সাহিত্যকর্ম' এ বিভাজন এবং সাম্প্রদায়িক স্বাতন্ত্র্য মাথায় রেখেই রচিত হয়েছে। জীবনাচরণে নয়, জনপরিমণ্ডল ব্যবস্থা যেখানে শুধু পরিভাষা ও রেটোরিকে ইসলামিক, আবু বাকারও সেখানে শুধু ধর্মীয় পরিভাষা ঠিক রেখে নরনারীর সম্পর্কের এমন বিষয়গুলোর বর্ণনা উৎসাহিত করেছেন, যা শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে কোনো মাজহাব কর্তৃক অনুমোদিত নয়।

বাংলাদেশের ইসলামি জনপরিমণ্ডল ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য এ জায়গাতেই যে, যেখানে শুধুমাত্র ইসলামি পরিভাষা ব্যবহার করেই বা 'হালাল' তকমা লাগিয়ে নিয়ে ইসলাম অনুমোদন করে না এমন যে কোনো কাজ করা বা বলা সম্ভব। আবু বাকারসহ অনেকেই এ বিষয়টা বুঝতে পেরেছেন বলে ধর্মীয় পরিভাষা ব্যবহার করে যৌনতার বর্ণনায় তথাকথিত সাহিত্য রচনায় উৎসাহিত হয়েছেন, যা আবার একটি বিশেষ পাঠকগোষ্ঠী তৈরি করেছে।

ভারতীয় উপনিবেশে যখন ইংরেজি শিক্ষা শুরু হয় তখন এ শিক্ষা ব্যবস্থার ফল সম্পর্কে ব্রিটিশ ঐতিহাসিক লর্ড ম্যাকলে যে মন্তব্য করেছিলেন তার সারমর্ম হল: এ শিক্ষায় যারা শিক্ষিত হবেন তারা দোভাষীর কাজ করবেন। তারা গাত্রবর্ণে ভারতীয় হলেও মননে হবেন ব্রিটিশ। অর্থাৎ ব্রিটিশদের চোখে তারা পৃথিবী দেখবেন।

দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসনের ফলে আমাদের দেশে শুধু ইংরেজিশিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সমাজ নয়, মাদ্রাসাশিক্ষিত আলেম সমাজসহ আমরা যারা সাধারণ জনমানুষ, আমাদের মনোজগতে পাশ্চাত্যের দৃষ্টিতে বিশ্ব বুঝবার মনস্তত্ত্ব তৈরি হয়েছে। এ থেকে আমরা যতক্ষণ বেরুতে না পারব, ততক্ষণ পাশ্চাত্য তার নিজের প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে অথবা নিছক হাস্যরস তৈরির মাধ্যমে একটি জাতিকে ছোট করার জন্য যতবার কাউকে তুলে আনবে, ততবারই আমরা আলোড়িত হতে থাকব।

[পাদটিকা: যারা কাশেম বিন আবু বাকারের 'সাহিত্যকর্মের' সঙ্গে পরিচিত নন তাদের জন্য তাঁর প্রকাশিত কিছু বইয়ের একটি তালিকা দেওয়া হল, বইয়ের শিরোনাম তিনি কোন ধরনের সাহিত্য রচনা করেন তা বুঝতে সাহায্য করবে।

'ফুটন্ত গোলাপ', 'একটি ভ্রমর পাঁচটি ফুল', 'বিলম্বিত বাসর', 'বাসর রাত', 'সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে', 'বিদায় বেলায়', 'প্রেম যেন এক সোনার হরিণ', 'স্বপ্নে দেখা সেই মেয়েটি', 'মনের মতো মন', 'কালো মেয়ে', 'অবশেষে মিলন', 'কেউ ভোলে কেউ ভোলে না', 'ধনীর দুলালী', 'তোমারই জন্য', 'হৃদয়ে আঁকা ছবি' ইত্যাদি।]