হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন!

মামুন আল মাহতাব
Published : 12 May 2017, 05:23 AM
Updated : 12 May 2017, 05:23 AM

"ইনশাল্লাহ ক্ষমতা পাবে। যে সকল রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আশায় বারবার আন্দোলন ডাকছেন, কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছেন, আল্লাহপাকের কালামের দ্বারা সঠিক তদবীরের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতা পাবার নিশ্চয়তা দেয়া হয় ইনশাল্লাহ। যোগাযোগ ঃ হাফেজ মোঃ হাবিবুর রহমান"

"অবাধ্য সরকারকে সাতদিনে বাধ্য করা হয়। মুফতি খলিল।"

এই বিজ্ঞাপন দুটি সম্প্রতি ফেসবুকে চোখে পড়ল। মুক্তবাজার অর্থনীতির আজকের যুগে যেখানেই সম্ভাবনা, বাণিজ্যও সেখানেই। দোষেরও কিছু নেই তাতে। আর তাই এসব বিজ্ঞাপন নিয়ে ভার্চুয়াল জগতে রঙ্গ-মশকরা আর আলোচনা-সমালোচনা ইত্যাদি যাই চলুক না কেন, এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ঘেঁটে দেখা জরুরি। কেন হাফেজ রহমান বা মুফতী খলিল অপ্রচলিত এই সেক্টরে বাণিজ্যের সম্ভাবনা দেখছেন?

বাণিজ্যের চালিকাশক্তি চাহিদা। চাহিদা পূরণের জন্য যার চাহিদা, তিনি বা তারা যে কোনো পন্থাই অবলম্বন করবেন, এটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রেও সম্ভবত এটাই ঘটেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন। একটানা ক্ষমতায় থাকার এদেশে এটি নতুন রেকর্ড। আর গণতান্ত্রিকভাবে টানা ক্ষমতায় থাকার হিসেবে আগের যে কোনো সরকারের তুলনায় এটি তো যোজন যোজন এগিয়ে।

শুধু বাংলাদেশে কেন, তৃতীয় বিশ্বে তো বটেই, এমনকি পাশ্চাত্যেও টানা তৃতীয় মেয়াদে পুনঃনির্বাচিত হওয়ার উদাহরণ বিরল। সেই বিবেচনায়, আরেকটি নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার জোয়ারে টান পড়বে এটাই প্রত্যাশিত। ২০১৩এর একপেশে নির্বাচনের পর দলটি বিশেষ করে পাশ্চাত্যে কিছুটা ব্যাকফুটে ছিল। আরেকটি নির্বাচন যখন দুয়ারে সমাগত, একটি ইনক্লুসিভ নির্বাচনের জন্য বাইরের চাপ বাড়বে বৈ কমবে না, এমনটাই ছিল প্রত্যাশিত। বাস্তবতা একেবারেই অন্যরকম।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের দ্রুতগামী যান এখন উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে উন্নয়নের মহাসড়কে। আর মানুষকে সুখী রাখতে যা প্রযোজন, সেই দ্রব্যমূল্য আছে কম-বেশি নিয়ন্ত্রণে। চাল-গম-ভুট্টা-ফল-ডিম-মুরগি-মাছ এসব কিছু উৎপাদনে এ দেশ পৃথিবীর সেরা দশের অন্যতম। ১৬ কোটি মানুষের এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই ছোট্ট দেশের এতসব অর্জনের প্রেক্ষাপটে নিয়ন্ত্রিত দ্রব্যমূল্য অপ্রত্যাশিত, কিন্তু অসম্ভব নয়।

গত আট বছরে দেশের মানুষের আয় বেড়েছে। দ্বিগুণ হয়েছে সরকারি চাকুরের বেতন। পরিচিত এক ট্রাভেল এজেন্ট বলছিলেন গত নববর্ষের এক মাসেরও বেশি সময় আগে থেকেই ঢাকা থেকে ব্যাংককগামী নানা এয়ারলাইন্সের সব টিকেট বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। গত বছর ঈদের লম্বা ছুটিতে আমি নিজেও কক্সবাজার যেতে বিমানের টিকেট পাইনি। পরে অবশ্য বুঝেছি ভালোই হয়েছে। সে সময়টায় কক্সবাজারে কয়েক হাজার পর্যটককে গাড়িতে রাত্রিযাপন করতে হয়েছে। কারণ হোটেলগুলোয় তখন ছিল 'ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই' দশা।

মানুষ আসলে ভালো আছে। বেড়েছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। মানুষের হাতে উদ্বৃত্ত আছে, মনে আছে শান্তি। আস্থা আছে নিজেদের অনুপস্থিতিতে বাড়ি-ঘর থাকবে নিরাপদ। আর তাই মানুষ নানা ছুতা-নাতায় ছুটে যায় ব্যাংকক-কক্সবাজার।

এ তো গেল দেশের ভিতরের অবস্থা। বাইরেরটা ভাবুন একবার। ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে যখন তিনি দৃপ্ত পদক্ষেপে গার্ড অব অনার পরিদর্শন করেন, হঠাৎ মনে হয় উনি কি শেখ হাসিনা না অ্যাঙ্গেলা মার্কেল? তাঁর পাশে জুবুথুবু ভঙ্গিতে জন কেরিকে হাটতে দেখে ভূল হয় কে আমাদের প্রধানমন্ত্রী আর কে উনাদের সেক্রেটারি অব স্টেট। এমডিজি অর্জনের সাফল্যে একের পর এক পদক জিতে মা-ছেলে একদিকে যেমন দেশকে গর্বিত করছেন, তেমনি জি-৮ সামিটে তাঁকে দেখে দেশ গর্ব করে।

অন্যদিকে বিএনপিকে দেখুন। একের পর এক ভুলে ভরা রাজনীতির চোরাবালিতে ঘুরপাক খেতে খেতে দলটি যে শেষে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা-ই এখন গবেষণার বিষয়। একসময় যারা ক্ষমতায় যাবে জেনে নির্বাচন করত, তাদের জন্য ২০১৯এর নির্বাচনটা দলীয় নিবন্ধন রক্ষায় নিয়মরক্ষার নির্বাচনে পর্যবসিত হতে চলেছে। কোথায় পশ্চিমারা তাদের নির্বাচনি বৈতরণী পার করাবে, উল্টো কানাডার আদালত তাদের কপালে সন্ত্রাসী সংগঠনের লেবেল সেঁটে দিয়েছে। পদ্মা ব্রিজের মামলা খারিজ হওয়ার পর ফেসবুকে দুয়েকজন মশকরা করে লিখেছিলেন যে, এরপর হয়তো বিএনপির নেতারা বলবেন যে, কানাডার আদালতও শেখ হাসিনার নির্দেশে চলে! অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, সন্ত্রাসী সংগঠনের সার্টিফিকেট পাওয়ার পর প্রতিক্রিযা জানাতে যেয়ে এই কথাগুলোই সাংবাদিকদের বলে বসলেন বিএনপির 'কথার বাক্স' রিজভী সাহেব।

ওদিকে আদালতে চলছে বিএনপি নেত্রীর ইঁদুর-বিড়াল খেলা। একটি মামলা কতভাবে প্রলম্বিত আর ন্যায়বিচার কতটা বিলম্বিত করা যায় তার উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবে এই মামলা। আমি নিশ্চিত, ভবিষ্যতের দুষ্টু উকিলদের জন্য অবশ্যপাঠ্য হবে এটি।

আগুনে পুড়ে সোনা হয় খাঁটি। কিন্তু প্রতীক্ষা আর হিংসার আগুনে বিএনপি হয়েছে কয়লা। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিতে গিয়ে কিংবা সরকারের যা কিছু ভালো তার অন্ধ বিরোধিতায় আর বাৎসরিক আগুন-সন্ত্রাসে সেই কয়লার এতই ময়লা যে, তা ধুয়েও শেষ হবার নয়। ২০১৯এর নির্বাচন তাই সম্ভবত বিএনপির জন্য ক্ষমতায় ফেরার নয়, বরং ভবিষ্যতে কখনও ফেরার আশায়।

এই যখন পরিস্থিতি, ক্ষমতায় যাবার জন্য ঐশী তদবিরের প্রয়োজন তখন পড়তেই পারে। কাজেই হাফেজ রহমান বা মুফতী খলিলরা যে এমনতরো বিজ্ঞাপন দেবেন তাতে অবাক হবারই-বা কী আছে? দুঃখ শুধূ 'লাল সালুর বাংলাদেশ' যখন অধীর আগ্রহে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের প্রত্যাশায় দিন গুনছে আর উদ্বেল হচ্ছে বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে বিএনএস নবযাত্রা ও জয়যাত্রাকে বীরদর্পে এগিয়ে যেতে দেখে, তখন একদল অর্বাচীন রাজনীতিবিদের ততোধিক অর্বাচীন রাজনীতি প্রিয় গণতন্ত্রকে করছে কলঙ্কিত।

পুনশ্চ:

ভারতের একটি জনপ্রিয় দৈনিক সম্প্রতি খবর ছেপেছে নরেন্দ্র মোদীর দরবারে দীক্ষা নিতে বিএনপি নেত্রী সম্প্রতি সেদেশের একজন বিখ্যাত ধর্মগুরুর দ্বারস্থ হয়েছেন। তাই মাইকেলের কাছ থেকে ধার করে বলতে হয়, বঙ্গজননীর ভাণ্ডারে রয়েছে বিবিধ রতন!