ইংরেজি-হিন্দির আগ্রাসন ঠেকাতে চাই কার্যকর ভাষানীতি

রেজাউল করিম ফকির
Published : 9 May 2017, 02:10 AM
Updated : 9 May 2017, 02:10 AM

বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতির অন্যতম হল বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্টভাবে বিবৃত রয়েছে যে, বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা হল বাংলা। এরকম একটি প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের প্রধান ভাষা হওয়া উচিত বাংলা।

আপাতদৃষ্টিতে বাংলা হল বাংলাদেশের ভাষা। কারণ বাংলা ভাষা বলা, লেখা ও ব্যবহারে কোনো বাধা নেই। স্বাধীনভাবে বাংলা ভাষা বলা, লেখা ও ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু অন্য ভাষা বলা, লেখা ও ব্যবহারেরও সমান সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশে যে কোনো ভাষা যথেচ্ছ ব্যবহারের এই সুযোগে বেশ কয়েকটি বিদেশি ভাষা যথেচ্ছ ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যেসব বিদেশী ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে তা হল যথাক্রমে ইংরেজি ও হিন্দি। এই বিদেশি ভাষাগুলো বাংলা ভাষার তুলনায় মর্যাদা ও কার্যকারিতায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে বাংলা ছাড়াও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার উপস্থিতি থাকায় এমনিতেই বাংলাদেশকে অনেকে বহু ভাষাভাষী দেশ বলে আখ্যায়িত করছেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলা ভাষার চেয়ে কার্যকারিতায় ইংরেজি ও হিন্দিকে প্রাধান্য দেওয়ার পাঁয়তারা। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা সব মিলে প্রায় ৫০ হলেও সব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীই জনসংখ্যায় বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর চেয়ে নগণ্য। যে কারণে বাংলাদেশের ভাষা পরিস্থিতিতে এসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার প্রভাব একেবারেই নেই, বরং এসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা বাংলা ভাষা দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। কিন্তু ইংরেজি ও হিন্দি ভাষা দেশের ভাষা পরিস্থিতি প্রভাবিত করছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদা ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে।

ইংরেজি ভাষা বাংলা ভাষার তুলনায় মর্যাদা ও কার্যকারিতায় সবচেয়ে বেশি প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। কারণ এই ভাষার পেছনের শক্তি হল নব্য ধনিক শ্রেণি। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গতি আসায় মফস্বল শহর থেকে শুরু করে রাজধানী ঢাকা শহর পর্যন্ত সর্বত্র নব্য ধনিক শ্রেণির বিস্তৃতি ঘটেছে। দেশে গণতান্ত্রিক ব্যাবস্থার ত্রুটির কারণে দেশে মুষ্টিমেয়তন্ত্র বা কতিপয়তন্ত্রের উত্থান ঘটেছে। ফলে এ নব্য ধনিক শ্রেণিটি দেশের রাজনীতির নিয়ামক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

এই শ্রেণিটি ইংরেজি ভাষার সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক। এই শ্রেণিভুক্ত লোকেরা আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামিসহ যে দলের অনুসারীই হোক না কেন, তারা সবাই বাংলাদেশে ইংরেজি প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে সমানভাবে সচেষ্ট। কাজেই ইংরেজি ভাবধারার এ রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণির আওতায় দেশে কতিপয়তন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করেছে। এ ধনিক শ্রেণিটি রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত থেকে দেশে ইংরেজি ভাষা প্রতিষ্ঠিত করার কাজটি চালিয়ে যাচ্ছে। দেশে গত কয়েক দশক ধরে ব্যক্তি মালিকানায় যেসব বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার প্রায় সবগুলোই ইংরেজি মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। দেশের কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক ইত্যাদির দাপ্তরিক কাজকর্ম ইংরেজিতে সম্পন্ন হচ্ছে। দেশে বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত সব বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।

যদিও সাংবিধানিক নিয়ম রক্ষার স্বার্থে সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের দাপ্তরিক কাজকর্ম বাংলা ভাষার মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে, এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ইংরেজি ভাবধারার অভিজাত শ্রেণি। তারা সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু উন্নয়ন করে বেসরকারি খাত। তারা সারা দেশের সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালায়, কিন্তু এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে তারা তাদের নিজেদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য পাঠায় না। তারা সরকারি হাসপাতাল চালায়, কিন্তু তারা এসব বাংলা মাধ্যমে পরিচালিত হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্যসেবা নেয় না। কাজেই অভিজাত শ্রেণির কল্যাণে দেশের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ইংরেরজিতে পরিচালিত হচ্ছে। এভাবে দাপ্তরিক কার্যকারিতায় ইংরেজি পর্যায়ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে।

ইংরেজি ভাষার পরে বাংলাদেশে যে বিদেশি ভাষা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা হল আরবি। আরবি ভাষা 'ধর্মীয় ভাষা'। এটি ইংরেজি ভাষার তুলনায় প্রায় আটশ বছর আগে এদেশে ধর্মীয় ভাষা হিসেবে প্রবর্তিত হয়েছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হওয়ায় ধর্মীয় ভাষা হিসেবে আরবি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি রয়েছে। এই ভাষাটি ধর্মীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার পেছনের শক্তি হল এদেশের আলেম ও উলামা সমাজ। তারা বাংলাদেশে একটি প্রভাবশালী শ্রেণি। কিন্তু তারা রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে নেই। কাজেই তারা কেবল ধর্ম বা ধর্মীয় শিক্ষার কাজেই আরবি ভাষা ব্যবহার করে থাকেন। ফলে আরবি ভাষা বাংলা ভাষার কোনো প্রত্যক্ষ ক্ষতি বয়ে আনছে না। এ ভাষাটি দ্বারা ইংরেজি ভাষার মতো করে বাংলা ভাষার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। কাজেই আরবি ভাষা বাংলাদেশের প্রত্যেক মুসলমান লালন করলেও, এটি বাংলা ভাষা সর্বস্তরে চালুর ক্ষেত্রে কোনো অন্তরায় হিসেবে দাঁড়াচ্ছে না।

তৃতীয় যে বিদেশি ভাষাটি বাংলাদেশে বহূল ব্যবহৃত হচ্ছে সেটি হল হিন্দি ভাষা। হিন্দি ভাষার পেছনে যে শক্তিটি কার্যকার তা হল ভারতের হিন্দি বিস্তৃতির সাম্রাজ্যবাদী নীতি। বাংলাদেশের মানুষ হিন্দি মাধ্যমে প্রচারিত অনুষ্ঠানে আসক্ত। বাংলাদেশে হিন্দি ভাষায় প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে যেমন রয়েছে শিশুদের জন্য কার্টুনের মতো অনুষ্ঠান, তেমনি বড়দের জন্য রয়েছে সিনেমা, নৃত্যকলা ও ম্যাগাজিনের মতো বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান। কাজেই হিন্দি ভাষা বাংলাদেশে বিনোদনের বিকল্প ভাষা মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হিন্দি ভাষা বাংলা ভাষার বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণ হল বাংলা ভাষার সঙ্গে হিন্দি ভাষার সাদৃশ্য আর হিন্দির রঙিন সংস্কৃতির প্রতি বাংলাদেশের মানুষের অন্ধ আকর্ষণ। এ ভাষাটি বিনোদনের বিকল্প মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ায় বিনোদন জগতে বাংলার কার্যকারিতা হ্রাস পাচ্ছে।

ইংরেজি, আরবি ও হিন্দি এই তিনটি বিদেশি ভাষার মধ্যে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষা বাংলা ভাষার কার্যকারিতার স্থান দখল করে নিচ্ছে। তার মধ্যে ইংরেজি ভাষা বাংলা ভাষা ব্যবহারের কার্যকর স্থানগুলো সবচেয়ে বেশি দখল করে নিচ্ছে। এভাবে বাংলা ভাষার তুলনায় ইংরেজি ভাষা মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছে।

শুরুতেই যেমনটা বলেছিলাম, বাংলা ভাষা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হল বাঙালি জাতীয়তাবাদ। সে হিসেবে বাংলা ভাষা ইংরেজি ভাষার তুলনায় সমাজের সর্বস্তরে কার্যকারিতা লাভের কথা। কিন্তু বাস্তবে ইংরেজি ভাবধারা সম্পন্ন অভিজাত শ্রেণির কল্যাণে ইংরেজি ভাষা সমাজের প্রায় সবক্ষেত্রেই কার্যকারিতা পেতে যাচ্ছে। বাংলা ভাষা এখন কেবল কার্যকারভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে সাধারণ মানুষের কথ্যভাষা হিসেবে।

এ প্রেক্ষাপটে আপাতদৃষ্টিতে এমনও মনে হতে পারে যে, বাংলাদেশের ভাষানীতি হল সরকারি পর্যায়ে ইংরেজি ভাষা প্রতিষ্ঠিত করা। কিন্তু আদতে বাংলাদেশে কোনো ভাষানীতিই নেই। কিন্তু দেশে ভাষানীতি না থাকলেও বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ রয়েছে। তাই বাংলা ভাষাকে মর্যাদা দান ও কার্যকারিতা প্রদানের পক্ষে যথেষ্ঠ।

উপরন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে তো বাংলা ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি রয়েছেই। তা সত্ত্বেও কেন ইংরেজি ভাষা বাংলা ভাষাকে ছাপিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সে প্রশ্ন ওঠে। বাংলাদেশে ইংরেজি ভাষা প্রতিষ্ঠায় যারা ওকালতি করেন, তারা এর পক্ষে কয়েকটি যুক্তি তুলে ধরেন। এগুলো হল:

ক) ইংরেজি হল ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার;
খ) ইংরেজি হল আন্তর্জাতিক ভাষা;
গ) ইংরেজি হল বিশ্বের জ্ঞান ভাণ্ডারে প্রবেশের মাধ্যম এবং
ঘ) ইংরেজি হলো বিশ্বের চাকরির বাজারে প্রবেশের মাধ্যম।

কিন্তু একটু পর্যলোচনা করলে দেখা যাবে যে, এসব যুক্তি ইংরেজি ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরলেও, বাংলাদেশের দাপ্তরিক কাজ পরিচালনায় ইংরেজি ভাষা প্রতিষ্ঠার কোনো যুক্তি উপস্থাপনা করে না।

কাজেই ইংরেজি ভাষা কর্তৃক বাংলা ভাষার মর্যাদা ও কার্যকারিতার যে দখল চলছে তার মোকাবিলায় এখন প্রয়োজন একটি ভাষানীতি। এ প্রেক্ষাপটে শুরুতেই স্পষ্ট করে নিচ্ছি যে ভাষানীতি বলতে কী বোঝায়।

আসলে ভাষানীতি হল কতকগুলো কার্যপ্রণালী যার সাহায্যে কোনো রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ সে রাষ্ট্রের ভাষা সম্পর্কে তিনটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই তিনটি বিষয় হল:

১) জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ভাষাকে (বা ভাষাসমূহ) অন্যান্য অপেক্ষাকৃত অগুরুত্বপূর্ণ দেশীয় বা উপজাতীয় ভাষার চেয়ে অধিক মর্যাদা আরোপ ও কার্যকারিতা প্রদান;
২) সেই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ভাষাকে বিভিন্ন উপাদানে সমৃদ্ধ করে পরিপুষ্টি সাধন এবং ৩) সেই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ভাষাকে শিক্ষাব্যবস্থা বা প্রশাসনের মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রচলন।

কিন্তু পূর্বেই বলা হয়েছে যে বাংলাদেশের কোনো ভাষানীতি নেই। ভাষানীতি যে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্য একটি প্রয়োজনীয় নীতি সে সম্পর্কে দেশের বুদ্ধিজীবী ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে কোনো ধারণা নেই। অথচ জাতীয় উন্নয়নে অন্যান্য রাষ্ট্রীয় নীতির চেয়ে ভাষানীতি কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় নীতি যেমন: অর্থনীতি, শিল্পনীতি ও শিক্ষানীতি ইত্যাদি বাস্তবায়নের কারণে যেমন যথাক্রমে দেশের অর্থনীতি, শিল্প-কারখানা ও শিক্ষার উন্নয়ন ঘটে, তেমনিভাবে ভাষানীতি বাস্তবায়নের ফলে সেদেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংশ্রয়ে শৃঙ্খলার উন্নয়ন ঘটে। যত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রতিষ্ঠান তত বেশি বাংলা ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে সেসব জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার হচ্ছে বেশি।

এ অবস্থা কয়েক দশক ধরে চলতে থাকলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইত্যাদি বিভিন্ন সংশ্রয়ে শৃঙ্খলার অবনতি ঘটবে। সেজন্য বাংলাদেশে ইংরেজি ও হিন্দিসহ বিভিন্ন বিদেশি ভাষার আগ্রাসন মোকাবেলায় একটি ভাষানীতি প্রণয়ন করা প্রয়োজন, যেন তার অনুসরণে বাংলাকে ইংরেজি, হিন্দি ইত্যাদি ভাষার তুলনায় মর্যাদা ও কার্যকারিতায় প্রতিষ্ঠিত করা যায়।