শিক্ষার মানোন্নয়ন ও মানবকল্যাণমুখী অর্থনীতি

মুহম্মদ মাহবুব আলী
Published : 7 May 2017, 03:48 AM
Updated : 7 May 2017, 03:48 AM

শিক্ষা জাতীয় উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। শিক্ষার সম্প্রসারণ ও তার মানোন্নয়ন এক কথা নয়।

স্বাধীনতার পূর্বকালে স্বল্পসংখ্যক লোকের শিক্ষার সুযোগ ছিল। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। '৭৫-এর বিয়োগান্তক ঘটনার পর একমুখী শিক্ষাব্যবস্থার বদলে বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়, যার সঙ্গে এদেশের আচার-আচরণ, কৃষি-সংস্কৃতির যেমন মিল নেই, তেমনি কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থার কোনো বালাই নেই। শিক্ষা মাঝখান থেকে হয়ে উঠেছিল একধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যের হাতিয়ার।

গত আট বছরে অবশ্য সরকারের প্রয়াসে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করা যায়নি। অবস্থাটি দাঁড়িয়েছে, তাত্ত্বিকভাবে বললে 'ক্লাসেস অব সিভিলাইজেশান'-এর মতো। সরকারের আন্তরিকতা থাকলেই চলবে না বরং যারা বাস্তবায়ন করবে তাদের মধ্যেও কাজ করার প্রবৃত্তি থাকতে হবে।

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম বলেছিলেন যে, প্রতিষ্ঠানকে কেবল ভালো না বেসে কাজকে ভালোবাসতে। আমাদের দেশের সিংহভাগ লোক অবশ্য কাজকে ততখানি ভালোবাসে যতখানি নিজের সমৃদ্ধি হয়, কিন্তু সমাজ ও দেশের কল্যাণ হয় কি না তা সচরাচর চিন্তাভাবনা করে না।

কয়েকদিন আগে সম্মিলিত নাগরিক সমাজ থেকে তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিজ্ঞান বইগুলো পর্যালোচনা করতে অনুরোধ করা হয়েছিল। বইগুলো পড়তে গিয়ে প্রথমে যেটি স্বগতোক্তি করলাম তা হল: 'ধরণী দ্বিধা হও।'

কোমলমতি বাচ্চাদের জন্যে এ কী ধরনের বই? বইয়ে আলোচনার প্রারম্ভেই প্রশ্ন কোথা থেকে কীভাবে উত্তর দেবে তার কোনো দিক-নির্দেশনা নেই। মনে পড়ে গেল বেশ কয়েক বছর আগে আমার ছেলের ইংলিশ মিডিয়াম একটি স্কুলের অভিজ্ঞতার কথা। ক্লাস নাইনে ঐ স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর দেখল যে, শিক্ষক প্রথমে অংকের প্রশ্নটি দিলেন। তারপর ফল লিখলেন। এরপর বললেন যে, কেউ না বুঝলে যেন ঐ স্কুলের বেসমেন্টে তার কোচিং ক্লাসে গিয়ে প্রশ্নের উত্তর সলভ করে নেয়।

তৃতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণির বিজ্ঞান বইগুলো পড়ার পর একটি ধারণা হল কেন আজকালকার ছাত্রছাত্রীরা বিজ্ঞান পড়তে অনিচ্ছুক। বিষয়টি তাদের মনে বদ্ধপরিকরভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে শৈশবেই। যেহেতু মেট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত বিজ্ঞান বিভাগে পড়েছি, লেটার মার্কসও ছিল, তাই মনে পড়ল শৈশবের কথা।

এ ধরনের বই কীভাবে প্রকাশ পেল তা খতিয়ে দেখা দরকার। 'জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০'-এর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ গ্রন্থ যেখানে শিক্ষাকে মুখস্থ করার উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। গবেষণা করতে গিয়ে দেখলাম সরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলোর দৈন্যদশা। জরাজীর্ণ ভবন, শূন্যপদে পদায়নের ব্যবস্থা নেই, খোলা আকাশে কোথাও কোথাও ক্লাস হয়, বাচ্চাদের স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থায় শেখার কার্যকর কোনো উদ্যোগ স্কুল কর্তৃপক্ষের নেই। অন্য কোনো চাকরি না পেয়ে বুঝি শিক্ষকতা করতে এসেছে।

পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায় যে, সরকার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানদের সরকারি স্কুলে পড়ার নির্দেশ দিয়েছে। এক্ষেত্রে এটি বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না তা দেখা দরকার। আবার প্রায় ২৫ হাজারের মতো প্রাইমারি পর্যায়ে শূন্যপদে শিক্ষক নিয়োগ করা দরকার। কষ্ট করে বিনামূল্যে বই প্রদান করা যেমন সাধুবাদযোগ্য, তেমনি বইয়ের গঠন প্রণালী ও মানস আর চিত্রকল্প অবশ্যই শিশুতোষ হতে হবে।

তথাকথিত পণ্ডিতরা যেসব বই রচনা ও সম্পাদনা করছেন তারা আদৌ বিবেকের কাছে কি প্রশ্ন রেখেছেন: তৃতীয় শ্রেণিতে অর্থাৎ আট বছর বয়সে এ ধরনের পাঠ-পঠন সম্পর্কে সহজে ধারণা পেতাম না বোধহয়। অথবা উচ্চশিক্ষা নিতে নিতে তারাও যে একদা শিশু ছিলেন, বিজ্ঞানশিক্ষা গ্রহণ করেছেন তা ভুলে গেছেন। মাঝখান থেকে তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির বিজ্ঞান বইগুলোর একটি ধারণাই স্পষ্ট হয়: এগুলো পড়ার জন্যে হয় গৃহশিক্ষক অথবা কোচিং লাগবে। অথচ থাইল্যান্ডের মতো একটি দেশে গিয়ে দেখলাম তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে বিজ্ঞানের বই নেই, আছে ল্যাব। সেখানে ছাত্রছাত্রীরা মনের সুখে বিজ্ঞানের জিনিস তৈরি করছে।

আসলে এদেশের অবস্থান হচ্ছে 'যে যায় লঙ্কায়, সে রাবণ হয়।' শিক্ষা যদি কঠিন করা হয়, তবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। তার ফলস্বরূপ এখন উপরের ক্লাসে উঠে শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই বিজ্ঞানের বদলে ব্যবসা-বাণিজ্য নিতে চাচ্ছে।

আমি দীর্ঘ গবেষণা করে দেখেছি যে, অর্থনীতিতে পাস করলে চাকরির অভাব হয় না। কিন্তু যেভাবে উচ্চশিক্ষায় অর্থনীতিকে গাণিতিক অর্থনীতিতে রূপান্তর করা হয়েছে তাতে এখন অনেকেই বিচিত্র এমবিএ পড়ছে। অথচ আবার উন্নত দেশে প্রয়োজনের নিরিখে সিলেবাস হচ্ছে। অর্থনীতিকে গাণিতিক পর্যায় থেকে বের করে এনে মানবকল্যাণমুখী ও সমাজকল্যাণমুখী করার জন্যে সিলেবাস প্রণয়ন করা দরকার।

শিক্ষা হবে জীবনের জন্যে, মুনষ্যত্ববোধ গড়ার জন্যে, পাশাপাশি কর্মমুখী শিক্ষা। কয়দিন আগে জার্নালিজম বিভাগের কয়েকজন আন্ডারগ্রেড স্টুডেন্টকে সৃজনশীল পাঠ ও পঠনের কর্মশালায় অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছি তাদের সৃজনশীলতার 'সৃ' না জানার কারণে। অথচ এরাই তো এসএসসি ও এইচএসসি পর্যায়ে সৃজনশীল প্রশ্নে উত্তর দিচ্ছে বলে গর্ব করে আমরা পত্রিকায় রিপোর্ট দেখি।

আসলে শিক্ষক-শিক্ষিকারা নিজেরা কতটুকু সৃজনশীলতা সম্পর্কে জানেন স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে সেজন্যে একটি টাস্কফোর্স জরুরিভিত্তিতে গঠনের আবেদন থাকল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে। শিক্ষার সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে গুণগত মান বাড়ানোর যে প্রয়াস তা তখনই সফল হবে যখন সঠিক পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রদান ও শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে মাদ্রাসা শিক্ষার অবস্থা ভালো নয়। প্রায় ২৩ লাখ ছাত্রছাত্রী আছে। এদের চাকরির সংস্থান কীভাবে হবে? এদিকে ব্যবসার ক্ষেত্রে মাদ্রাসাও কম যায় না। নূর আলী আলিয়া মাদ্রাসা, বাসিলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেল সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশোনা ও থাকা-খাওয়াসহ প্রতিমাসে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়।

মাদ্রাসা বোর্ডকে যুগোপযোগী শিক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে শিক্ষার গুণগতমান উন্নয়ন এবং মুখস্থ প্রবণতা বাদ দিয়ে সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহনির্ভর, অসাম্প্রদায়িক চেতনাভিত্তিক ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সংবলিত শিক্ষাকে সুন্দর ও শিশুদের উপযোগী করে পরিবেশন করতে হবে। শিক্ষায় ডিজিটালাইজেশানের উদ্যোগ আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে।

উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের জন্যে সরকার 'ন্যাশনাল এডুকেশান ফ্রেমওয়ার্ক' ও 'অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল' গঠন করতে যাচ্ছেন। আমি সাধুবাদ জানাচ্ছি। কেননা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার মানোন্নয়নে এর বিকল্প নেই। পাশাপাশি আবেদন করব র‌্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করার জন্য। চীনে ২০০৩ সালে র‌্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করে তাদের গুণগতমান অনেকখানি উন্নত করতে সক্ষম হয়েছে। ভারতেও সম্প্রতি র‌্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। আসলে র‌্যাংকিংয়ের পক্ষে-বিপক্ষে অনেক বক্তব্য থাকলেও মূলত আটটি উপাদান বেশ কার্যকর: কর্মমুখী শিক্ষা, বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা গ্রহণ, আন্তর্জাতিকীকরণ, ভৌত কাঠামো, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, আবাসন ব্যবস্থা, ছাত্রছাত্রীদের মান উন্নয়ন ও কমিউনিটি সার্ভিসে অংশ নেওয়া এবং গবেষণা।

আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়ন আমাদেরই করতে হবে। ধরে বেঁধে বিদেশ থেকে এনে অথবা উদ্ভট তথ্য দ্বারা শিক্ষার মান উন্নয়ন করা যাবে না। শিক্ষককে তার দায়দায়িত্ব নিয়ে সজাগ থাকতে হবে। শিক্ষা হবে মানুষের প্রাণের উৎস। শিক্ষার সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক গভীর, সেজন্য কর্মমুখী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।

এদেশে মাত্র ১০% কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। অথচ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণের হার হচ্ছে ৪৩%। সম্প্রতি কারিগরি শিক্ষাকে পৃথক করার জন্যে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা যথোপযুক্ত। তবে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মান উন্নয়ন করতে হবে। ছড়িয়ে দিতে হবে কারিগরি শিক্ষা। কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে তাদের ভবিষ্যৎ জীবন হয়ে উঠতে পারে দেশের সেরা সম্পদ। অনেক কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দুরাবস্থার অন্ত নেই। সেগুলো চিহ্নিত করে মান উন্নত করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা সঠিক শিক্ষা এবং বৈশ্বিক মানদণ্ডে ভালো শিক্ষা পেতে পারে। অথচ কারিগরি শিক্ষার মান উন্নত করার জন্য প্রয়োজন দক্ষ ব্যবস্থাপনা।

আমাদের দেশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈতিকতা, দেশপ্রেম ও সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ছাত্রছাত্রীদের বিচ্যুত রাখা হয়। এমনকি স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও নববর্ষ কিছু কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় পালন করা হয় না। বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসও পালন করা হয় না। কেউ কেউ আবার শিক্ষাকে নিয়ে ভোগবাদী সমাজব্যবস্থায় কেবল ব্যবসা করেন না, বরং পুঁজি পাচারে লিপ্ত হন। এ লুম্পেনদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে আরও তৎপর হতে হবে।

ছদ্মবেশী মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা অথচ তলে তলে শত্রুতা করছে দেশ ও জাতির। তাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাদের মাধ্যমে খোঁজখবর নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিমসটেকের আওতায় বাংলাদেশে একটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গঠনের উদ্যোগ শিক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যৌথভাবে গ্রহণ করতে পারেন। এ জন্যে আঞ্চলিক সহযোগিতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ উদ্যোগ প্রয়োজন।