প্রীতিলতাকে ‘রোল মডেল’ কবে ভাবা হবে?

জাহান-ই-গুলশান
Published : 5 May 2017, 09:03 AM
Updated : 5 May 2017, 09:03 AM

ঠিক কতটুকু বয়সে প্রীতিলতার নাম প্রথম জেনেছিলাম সে দিনক্ষণের ঠিক হিসাব আজ করতে পারি না। তবে এটুকু খুব মনে আছে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বীরত্বগাথা প্রথম জেনে যেমন আলোড়িত হয়েছিলাম, আজও সেই আলোড়ন একই রকম।

তবে স্কুলের কোনো পাঠ্যবই থেকে তাঁকে জানতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে প্রথম প্রীতিলতার ছবি দেখি। ছোট চুলের শাড়ি পরা প্রীতিলতার নিরীহ ছবিটা দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম খুব। এমন কোমল মুখের মানুষ কি করে ছদ্মবেশে ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ করেন!

সেই ঘোর নিয়েই প্রীতিলতার মতো চুলের ছাঁট দিয়ে ফেললাম। যেন আমিই প্রীতিলতা! মনে পড়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা শেষে প্রীতিলতা হলে গিয়েছিলাম। চেয়েছিলাম, ভর্তি হলে যেন প্রীতিলতার ছাত্রী হই। তাহলে অহংকার করে বলতে পারব: "আমি প্রীতিলতায় থাকি।"

কোনো না কোনোভাবে প্রীতিলতার নামটা যেন আমার সঙ্গে থাকে সেটা খুব চাইতাম।

আজ ৫ মে আমার, আমাদের প্রীতিলতার জন্মদিন। ১৯১১ সালের এদিন তিনি জন্মেছিলেন প্রতিভাদেবী আর জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদারের ঘরে। চট্টগ্রামের পটিয়া থানার ধলাঘাটে। ছয় ভাইবোনের একজন প্রীতিলতাকে পরিবারের সবাই 'রাণী' নামে ডাকত।

পড়ালেখা শুরু ড. খাস্তখীর বালিকা বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ১৯২৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে ঢাকার ইডেন কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩০ সালে আইএ পরীক্ষায় তিনি সম্মিলিতভবে পঞ্চম এবং মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করেন। এরপর বৃত্তি নিয়ে কোলকাতার বেথুন কলেজে পড়তে যান। ১৯৩২ সালে ডিসটিংশন নিয়ে বিএ পাস করেন। সেসময় ব্রিটিশ সরকার আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেওয়ায় তাঁর অনার্সের রেজাল্ট স্থগিত রাখা হয়। পরে ২০১২ সালে তাঁকে মরণোত্তর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেওয়া হয়।

এ তো গেল প্রীতিলতার আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা। কিন্তু তিনি কেবল পাঠ্যবই পড়ুয়া শিক্ষার্থী ছিলেন না। ক্লাস টেনে পড়ার সময় কাজিন পূর্ণেন্দু দস্তিদারের রেখে যাওয়া 'বিপ্লবী কানাইলাল', 'ক্ষুদিরাম', 'বাঘা যতীন' বা দেশের কথা লুকিয়ে পড়তেন। আর স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক তাঁর প্রিয় ঊষাদির কাছে পাওয়া 'ঝাঁসীর রাণী' বই পড়ে নিজেকে লক্ষ্মী বাঈয়ের মতো ভাবতেন। আরও একজন– যিনি পরবর্তীতে সহযোদ্ধা ছিলেন– সেই কল্পনা দত্তও ছিলেন তাঁর ভাবনার সঙ্গি। একই স্কুলে পড়তেন দুজনই। তাদের সেসব ভাবনার কথা লিখেছেন কল্পনা দত্ত:

"কোনো কোনো সময় আমরা স্বপ্ন দেখতাম বড় বিজ্ঞানী হব। সেসময় ঝাঁসির রানি আমাদের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে। নিজেদের আমরা অকুতোভয় বীর হিসেবে দেখতে শুরু করলাম।"

এভাবে একেবারে কিশোর বয়সে প্রীতিলতা, কল্পনা দত্তরা ঝাঁসির রানিকে তাদের 'রোল মডেল' হিসেবে ভাবতে শুরু করেন। যে ভাবনাটা দীপালী সঙ্ঘের মতো সংগঠনে যুক্ত হতে তাদের অনুপ্রাণিত করেছিল। এমনকি পরিস্থিতির কারণে সেসময় যুব সম্মেলন, চট্টগ্রাম জেলা সম্মেলন আয়োজন করা হলেও নারী সম্মেলনের করার কোনো প্রস্তুতি ছিল না সূর্যসেনদের।

তবে সংগ্রামে নারীদের অংশগ্রহণের কারণে ও পূর্ণেন্দু দস্তিদারের প্রস্তাবে লতিকা বোসের সভাপতিত্বে প্রথমারের মতো নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতাও যোগ দেন। দিনে দিনে বিপ্লবী জীবনের নানা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, ছদ্মবেশ, কঠোর পরিশ্রম, প্রতিকূল সামাজিক পরিবেশ– কোনো কিছু তোয়াক্কা না করে প্রীতিলতারা ভারতবর্ষের স্বাধীনতার লড়াইয়ে সক্রিয় থাকেন।

কলেজে অবসরে বাঁশি বাজানো বা স্কুলের ছুটিতে নাটক লেখা, প্রীতিলতা দেশের শত্রু ইংরেজদের বিরুদ্ধে নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করেন সেই স্কুলেই। প্রীতিলতার জীবনের এটুকু জেনে প্রশ্ন জাগে, আজ আমাদের স্কুলে স্কুলে থাকা কিশোর বয়সী শিক্ষার্থীরা কিসের জন্য নিজেকে তৈরি করে? ভবিষ্যত জীবনের কী ছবি তারা আঁকে। সামাজিকমাধ্যমের এ কালে সমাজের কোন কোন বিষয় নাড়া দেয় তাদের? যেগুলো দূর করার জন্য মনে মনে জোর তাগাদা থাকে তাদের?

কে তাদের 'রোল মডেল'? বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজি ছবির কোনো নায়ক বা নায়িকা?

প্রীতিলতাদের জীবন, সূর্যসেনদের জীবন, জীবনের প্রতিটি ঘটনার চেয়ে রোমাঞ্চকর কি কোনো মুভি হতে পারে? তবে বাস্তবের নায়ক সূর্যসেন, প্রীতিলতারা আমাদের কিশোরদের 'রোল মডেল' নন কেন? কেন আজ কিশোর বয়সী কোনো মেয়ে প্রীতিলতার মতো সাহসী হতে চায় না?

ক্যাটরিনাদের যতটা চেনাই আমরা, তার কতটুকু প্রকৃত বীর বিপ্লবী প্রীতিলতাদের চেনাতে, জানাতে চেষ্টা করি? প্রীতিলতার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী হল আর পাহাড়তলীতে অযত্নে থাকা আবক্ষ ভাস্কর্য, ধলাঘাটে স্মৃতি স্মারক– এসবের বাইরে বড় আকারে খুব বেশি কিছু করার খবর তেমন জানা যায় না। এমনকি সেই ঐতিহাসিক ইউরোপীয় ক্লাবটিও স্মৃতি জাদুঘর নয়, বরং সরকারি অফিস।

প্রীতিলতার জন্মদিন উপযাপনের, তাঁর আত্মত্যাগের কথা জানানোর জন্য বিশেষ আয়োজনও চোখে পড়ে না। কেবল প্রগতিশীল কয়েকটি নারী বা ছাত্র সংগঠনকেই দেখি প্রীতিলতাকে আজকের দিনে স্মরণ করতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরাও বন্ধুরা যেমন করতাম।

একদিকে আমরা হাহাকার করছি, তরুণরা মাদক, জঙ্গিবাদে ঝুঁকছে বলে। অন্যদিকে এ মাটির প্রকৃত বীরদের আড়াল রাখছি তরুণদের কাছ থেকে। পুঁজির আগ্রাসনের এ কালে মুনাফা যখন মননে, নিপাট ব্যক্তি হয়ে ওঠার লক্ষ্যটাই যখন তরুণদের সামনে, তখন প্রীতিলতাদের সামষ্টিক ভাবনা থেকে যোজন যোজন দূরেই থাকে কিশোর-তরুণরা।

দেশের শিক্ষিত মানুষদের বড় অংশই জানেন, ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর প্রীতিলতা ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণে নেতৃত্ব দেন। সফল অপারেশনের পর সঙ্গীরা নিরাপদে বেরিয়ে গেলে ধরা পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে মাত্র ২২ বছরে 'সায়ানাইড' খেয়ে দেশের জন্য আত্মাহুতি দেন তিনি।

জানতে ইচ্ছা করে এখনকার কতজন মা-বাবা, অভিভাবক বা শিক্ষক নিজেদের মেয়েদের "প্রীতিলতা হও" বলে আর্শীবাদ করেন?

অনেকে বলবেন প্রীতিলতাদের সেকাল নেই। ইংরেজ, পাকিস্তান আমল গিয়ে আজ স্বাধীন বাংলাদেশ। ঠিক, বিদেশি শত্রু দৃশ্যমান নেই। কিন্তু প্রীতিলতারা যে আত্মমর্যাদাশীল স্বাধীন জাতির আকাঙ্খা করেছিলেন, ইউরোপীয় ক্লাবে কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধের মতো অপমানের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন তার কতখানি পূরণ হয়েছে? সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির কালে স্বনির্ভর অর্থনীতি, রাজনীতি বা সংস্কৃতি কতখানি চর্চা করতে পারছে স্বাধীন বাংলাদেশ?

বিপ্লবী প্রীতিলতার আত্মত্যাগ পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিতে মেয়েদের ভূমিকা 'ছোট' করে দেখার প্রচলিত ধারণাতেও বড় আঘাত হেনেছে নিঃসন্দেহে। একইসঙ্গে তিনি মেয়েদের অন্য এক মর্যাদাপূর্ণ জীবনের রূপকারও বটে।

'পদ্মরাগ' উপন্যাসে রোকেয়া সাহসের সঙ্গে যে উচ্চারণ করেছিলেন:

"…কেবল সংসার জীবনই নারী জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়।"

প্রীতিলতার বীরোচিত আত্মত্যাগ যেন রোকেয়ার চিন্তনেরই বাস্তবায়ন।

আজকের দিনে বিশ্ব ইতিহাসের অনন্য মহানায়ক কার্ল মার্ক্সসেরও জন্মদিন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। তিনি দুনিয়া বদলানোর লক্ষ্যে কাজ করার আহবান জানিয়েছিলেন। আমাদের তরুণরা নিজেদের জন্য সমতার এক বাংলাদেশ গড়তে গড়তে দুনিয়া বদলানোর লড়াইয়ে সামিল হবে, সমষ্টির স্বার্থে প্রীতিলতাদের আত্মত্যাগ থেকে শিক্ষা নেবে, প্রীতিলতার জন্মদিনে সেই প্রত্যাশা করছি।