তামাক সেবন করিয়ে নারীকে মারো: নারীবাদকে সম্বল করে তামাক কোম্পানির কৌশল

ফরিদা আখতার
Published : 30 May 2010, 01:02 PM
Updated : 30 May 2010, 01:02 PM

পুরুষের তুলনায় নারী ধূমপায়ীর সংখ্যা অনেক কম, এই তথ্য নিয়ে কেউ কোনো বিতর্ক করবেন না, জানি। তামাকের অন্যান্য ধরনের ব্যবহারও নারীদের মধ্যে কম-বেশি আছে। ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, এমনকি মৃত্যুর প্রধান কারণ, সেই কথা নিয়ে ধূমপায়ীরাও বিপক্ষে যুক্তি দেবেন না। তারা সিগারেটের গায়ে এই বাক্য লেখা দেখেও পয়সা দিয়ে কিনে জোরে টান দিচ্ছেন, সেখানে বলার আর কিছু থাকে না। দীর্ঘ দিন ধরে ধূমপানের বিরুদ্ধে যারা কাজ করছেন তাঁরা জানেন তামাক কোম্পানির কৌশল দিনে দিনে কত বদলায় এবং কীভাবে তারা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিনা বিচারে ঢুকে পড়েছে। তবে বিষয়টি এত দিন সব বয়সী পুরুষদের মধ্যেই ছিল, নারীর কথা তেমনভাবে কখনো আসে নি।

এবার ৩১ মে, বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস, ২০১০ পালন করার জন্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নারীর ওপর তামাকের ক্ষতিকর প্রভাবকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের কারণে নারী নিজে ধূমপায়ী বা ব্যবহারকারী হলে ক্ষতি তো হচ্ছেই, কিন্তু সে যদি নিজে ব্যবহারকারী নাও হয়, তাহলেও তার রক্ষা নাই। বাবা, চাচা, মামা, স্বামী, পুত্রসহ পরিবারের পুরুষ সদস্যদের ধূমপান স্ত্রী, কন্যা, মাসহ পরিবারের নারীদের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। শুধু তাই নয়, নারীর সাথে ঘরের শিশুটিও বাদ যায় না। আর অফিসে পুরুষ সহকর্মী সিগারেট ধরালে নারীদের কষ্ট কম হয় না। তবে আজকাল, এর বিরুদ্ধে নারীরা সোচ্চার হয়ে উঠেছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নারীদের মধ্যে ধূমপান ও নানা ধরনের তামাক সেবন বেড়ে যাচ্ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এই তথ্য বিভিন্ন গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে। বর্তমানে ১০০ কোটি ধূমপায়ীর মধ্যে শতকরা ২০ ভাগ, বা প্রায় ২০ কোটি, নারী। এই সংখ্যা ভয়াবহ । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরও উদ্বিগ্ন হয়েছে এই কারণে যে তামাক কোম্পানি পুরুষদের পর নারীর দিকেই নজর দিয়েছে, তাদের ব্যবসার ভবিষ্যৎ বিবেচনা করে। কারণ তাদের ক্রেতাদের একটি বড় অংশ খুব তাড়াতাড়ি অকাল মৃত্যুর শিকার হবে, তা হলে নতুন ক্রেতা তৈরি না করলে তামাক কোম্পানির ব্যবসার ক্ষতি হবে। তাই নারীদের প্রতি নজর পড়েছে। এতদিন নারী ছিল পুরুষ ধূমপায়ীর সাথী, সিগারেটের বিজ্ঞাপনে নারীর হাতে সিগারেট নয়, পুরুষ ধূমপায়ীর ভোগের বস্তু ছিল। এতেও নারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ধূমপায়ীর সাথী হিসেবে ধোঁয়ার ক্ষতিকর প্রভাব তার শরীরেও গেছে।

"
স্বামীকে পাকঘরের চুলা থেকে বিড়ি ধরাতে গিয়েও অভ্যাস হয়েছে, এমন ঘটনাও শোনা যায়। কিন্তু ঢাকা শহরে নারীবাদের হাওয়া লেগে পুরুষের সমকক্ষতা অর্জনের জন্য সিগারেট হাতে তুলে নিয়েছেন এমন নারীর সংখ্যাও কম নয়। প্রত্যেকের ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে নারী অধিকারের নামে কোম্পানির ক্ষতিকর পণ্যের ভোক্তা হয়ে আমাদের কী লাভ?… পুরুষরা বুদ্ধ্বিজীবী, কবি, লেখক, বিজ্ঞানী কিংবা হতাশ হলে চেইন স্মোকার হন, আর নারীকে স্বাধীন হতে হলে সিগারেট ধরাতে হবে?

"

জানা গেছে তামাক কোম্পানিগুলো প্রধানত ব্যবসা করতে চায় অল্পবয়সী মেয়েদের তামাক সেবনে আগ্রহী করার মাধ্যমে। সেভাবে তাদের বিজ্ঞাপন সাজানো হয়। যদিও বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ তবুও কোম্পানি নানাভাবে প্রচার করছে। প্রায় ১৫১টি দেশের তথ্য নিয়ে দেখা গেছে বয়ঃসন্ধি কালের ছেলে এবং মেয়েদের মধ্যে ধূমপানের সংখ্যা বেড়েছে। শতকরা ১২% ছেলে এবং ৭% মেয়েরা ধূমপান করছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনেক দেরিতে এই বিষয়টি লক্ষ্য করেছে। তামাক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদন, ব্যবহার, ক্রয়, বিক্রয় ও বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ প্রণয়ন করেছে। এই আইনে নারীদের রক্ষা করার কোনো নির্দিষ্ট বিধান নাই।

শুধু ধূমপান ও তামাক সেবন নয়, নারীরা তামাক উৎপাদনের কারণেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। উবিনীগের গবেষণায় দেখা যায়, তামাক চাষ করতে ব্যাপকভাবে কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। এর ফলে নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। গর্ভবতী মহিলাদের বাচ্চা নষ্ট হয়ে যায়, কিংবা বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হয়। এ ছাড়াও নারীদের অনেক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা যায়। তামাকের পাতা পোড়াতে গিয়ে ৬০ থেকে ৭২ ঘণ্টা একনাগাড়ে না ঘুমিয়ে থাকতে হয়। এর ফলে শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা যায়।

তামাক চাষের কারণে খাদ্য ফসলের চাষ কম হচ্ছে। তামাক চাষীর ঘরে নগদ টাকা থাকলেও খাদ্যের অভাব ঘটছে। গরিব মানুষ এমনিতেই খাদ্য ঘাটতিতে ভোগে, তামাকের কারণে তার ভয়ানক পুষ্টির ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। তামাক চাষের এলাকায় নারীদের মধ্যে মানসিক অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। পরিবারে শান্তি নাই, চিকিৎসা করতে গিয়ে তামাক চাষ করে যা আয় হয়, তার সবই খরচ হয়ে যায়। কাজেই আর্থিক কষ্টেও তাদের পড়তে হয়।

অর্থনৈতিক মানদণ্ডে তামাক কোম্পানি সরকারকে এক হাজার কোটি টাকা ভ্যাট দিচ্ছে, এটাই তাদের কাছে বেশি জরুরি। তাই নারীদের ক্ষতি নিয়ে ভাববার সময় সরকারের নেই।

আমি একই সাথে বলতে চাই নারীবাদের সাথে ধূমপানের সম্পর্ক নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে। পশ্চিমা দেশ বিশেষ করে আমেরিকায় সিগারেট কোম্পানির বিজ্ঞাপন ও প্রভাবে নারীর হাতে সিগারেট উঠেছে প্রায় ৮০ বছর আগে। এর আগে খোদ আমেরিকায় নারীর সিগারেট খাওয়া ভাল চোখে দেখা হতো না। সিগারেট ফোঁকে এমন নারীকে হাল্কা চরিত্রের মনে করা হতো। পুরুষ ধূমপায়ীরাও মহিলাদের সিগারেট খাওয়া পছন্দ করতো না। তারা মনে করতো মেয়েরা ঠিক মতো সিগারেট ধরতেও জানে না আর মুখ থেকে ধোঁয়া বের করতে গিয়ে এলোমেলো করে ফেলে। এটা পুরুষের দক্ষতা। এমন পরিস্থিতিতে ১৯২৮ সালে তামাক কোম্পানি নারীস্বাধীনতার আন্দোলনের সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগালো। এডওয়ার্ড বার্নেস (Edward Bernays, যাকে আধুনিক জনসংযোগের জনক হিসেবে গণ্য করা হয়), নারীদের সিগারেট খাওয়ার জন্য সহযোগিতায় এগিয়ে এলেন। তখন নারীদের ভোটের অধিকারের আন্দোলন চলছে, নারী তার ব্যক্তি অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এই সময় তার স্বাধীন ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে হলে সিগারেট তার হাতে জ্বলতে হবে। তামাক কোম্পানি বুঝেছিল নারী মানব জাতির অর্ধেক, তাদের বাদ দিয়ে কোনো ব্যবসা হবে না। এই সময় ফিলিপ মরিস (Philip Morris) এর বিজ্ঞাপন–সিনেমার বিখ্যাত নায়িকার হাতে সিগারেট, আর বক্তব্য "Believe in yourself", আধুনিক নারীদের মনে স্থান করে নিতে পেরেছে। নারীদের জন্য বিশেষ ধরনের সিগারেট তৈরি করা হলো, এখন প্রায় ২০% মার্কিন নারী ধূমপায়ী। এই পরিসংখ্যানের সাথে এই তথ্যও দেয়া দরকার যে আমেরিকায় বছরে ১ লক্ষ ৭০ হাজার নারী ধূমপানের কারণে নানা রোগে ভুগে মৃত্যুবরণ করে। বিশ্বব্যাপী নারীরা নানা ধরনের প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন, তার মধ্যে ধূমপায়ীর সংখ্যাই বেশি।

আমেরিকায় নারীর ধূমপানে পুরুষদের বিরোধিতার সুযোগটি তামাক কোম্পানি নিতে ছাড়ে নি। নারীরা সংগঠিত হয়ে সিগারেট ধরিয়ে "torches of freedom" বা "মুক্তির মশাল" নামে মিছিল করে ১৯২৯ সালে। সিগারেট নারী-মুক্তির প্রতীক। অন্যদিকে, তামাক কোম্পানি এটাও খুব ভাল করে জানে নারীবাদ বা নারী মুক্তির কথা বললেই ব্যবসা হবে না। তাই বলা হলো, সিগারেট খেলে নারীর শরীর স্লীম (বা রোগা?) থাকবে। নারীর সৌন্দর্যের লক্ষণ শরীর পাতলা থাকা। মনে হয় স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নারীদের ওপর তামাক কোম্পানি আস্থা রাখতে পারে নি, তাই সৌন্দর্যের দোহাই দেয়া জরুরি মনে করেছে। নারীদের জন্য সিগারেট বাজারজাত করতে হলে স্বাধীনতার প্রতীক যথেষ্ট নয়, তাকে সৌন্দর্যের কথা বলতে হবে। ১৯৬৮ সালে নারীবাদের আন্দোলন একটু থেমে ছিল, এই সময় নারীদের জন্য Virginia Slims নামক সিগারেট বাজারজাত করা হোল। তামাক কোম্পানি একের পর এক নারীদের জন্য ফাঁদ পাততে থাকে।

বাংলাদেশে গ্রামে যারা বিড়ি সিগারেট খায় তারা নারীবাদ নিয়ে কথা বলে না। স্বামীকে পাকঘরের চুলা থেকে বিড়ি ধরাতে গিয়েও অভ্যাস হয়েছে, এমন ঘটনাও শোনা যায়। কিন্তু ঢাকা শহরে নারীবাদের হাওয়া লেগে পুরুষের সমকক্ষতা অর্জনের জন্য সিগারেট হাতে তুলে নিয়েছেন এমন নারীর সংখ্যাও কম নয়। প্রত্যেকের ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে নারী অধিকারের নামে কোম্পানির ক্ষতিকর পণ্যের ভোক্তা হয়ে আমাদের কী লাভ?

পুরুষরা বুদ্ধ্বিজীবী, কবি, লেখক, বিজ্ঞানী কিংবা হতাশ হলে চেইন স্মোকার হন, আর নারীকে স্বাধীন হতে হলে সিগারেট ধরাতে হবে? এমন ফাঁদে পা দিয়ে নারীরা নিজেদের আর ক্ষতি করবেন না আশা করছি।