পরিবারতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র নাকি গণতন্ত্র?

মহিবুল ইজদানী খান
Published : 6 May 2017, 05:34 AM
Updated : 6 May 2017, 05:34 AM

দীর্ঘদিন ধরে সুইডেনের মূলধারার রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার কারণে বাংলাদেশের রাজনীতি আমার কাছে এখন আর 'রাজনীতি' মনে হয় না! রাজনীতিতে গণতন্ত্র অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ বিষয় হলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে আদৌ কি কোনো গণতন্ত্র আছে?

আমার তো মনে হয়, এখানে আছে শুধু তোষামোদি, চাটুকারিতা, রাজনীতির নামে বাণিজ্য, মাস্তানি ও একনায়কতন্ত্র। নিজ নিজ দলে গণতন্ত্র না এনে 'গণতন্ত্র', 'গণতন্ত্র' বলে সবাই চিৎকার করছে। রাজনৈতিক দল বিরোধী অবস্থানে থাকলে সরকারকে বলে স্বৈরাচার, অগণতান্ত্রিক– আর ক্ষমতায় গেলে তারা নিজেরাই হয়ে যায় অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচার।

এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি বাংলাদেশে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এ ধরনের রাজনীতির ভবিষ্যত কখনও ইতিবাচক হতে পারে না। অন্যদিকে বাংলাদেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এখন পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ লক্ষণীয় নয়। ভবিষ্যতে দলগুলোর মধ্যে আদৌ গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে উঠবে কি না তাতেও সন্দেহ রয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে এখন তৃণমূল পর্যায়ে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক কাঠামোর আওতায় পুনর্গঠন করা উচিত। দলের গঠনতন্ত্র শক্তিশালী করার লক্ষ্যে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে। ওয়ান-ইলেভেনে সেনাবাহিনী-সমর্থিত ফখরুদ্দিন আহমেদের অস্থায়ী সরকার ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে একটা পরিবর্তন নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছিলেন যা সর্বস্তরে প্রশংসিত হয়েছিল। এই সময় রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতান্ত্রিক নিয়মের আওতায় নিয়ে আসার নির্দেশ পর্যন্ত করা হয়েছিল। যদিও অনেক রাজনৈতিক দল ও নেতাদের তা পছন্দ হয়নি। তবে সরকারের এ ধরনের প্রস্তাবের প্রতি দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের সমর্থন ছিল যথেষ্ট।

প্রথমদিকে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের স্ব স্ব গঠনতন্ত্রে কিছু কিছু পরিবর্তনে এগিয়ে আনলেও সরকার পরিবর্তনের পর তার আর কোনো উন্নতি লক্ষ্য করা যায়নি। দলগুলো আবার সেই একনায়কতন্ত্রেই ফিরে গেছে। ক্ষমতা এখানে কেন্দ্রভিত্তিক জালে আটকে রাখা হয়েছে; একক নির্দেশেই চলছে দল দলের তৎপরতা।

ফখরুদ্দিন আহমেদের অস্থায়ী সরকার বিদেশে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর শাখা বিলুপ্ত করে দলের গঠনতন্ত্র তৈরি করার নির্দেশ প্রদান করে। বিভিন্ন দলের গঠনতন্ত্রে বিদেশে দলের শাখা খোলার ব্যাপারে সম্ভবত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। বর্তমানে নতুন কিছু উল্লেখ করা হয়েছে কি না তা আমার জানা নেই। তবে দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীদের বিদেশ সফরের সময় তাদের স্ব স্ব রাজনৌতিক দলের সংবর্ধনা নিতে দেখা যায়। দলের নেতানেত্রীরা বিদেশ ভ্রমণে এলে এসব শাখা আয়োজন করে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান যেখানে দলের নাম ব্যবহার না করে বলা হয় 'নাগরিক সংবর্ধনা'।

বর্তমানে বলতে গেলে প্রতিটি দেশেই রয়েছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের শাখা। ঠিক দেশের মতোই এখানেও রয়েছে বিভক্তি, দলাদলি আর মারামারি। তবে জামায়াত-শিবিরের মধ্যে এ ধরনের বিভক্তি, মারামারি বা দলাদলি লক্ষ্য করা যায় না। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এবং তাদের অঙ্গসংগঠনগুলোর মধ্যেই যত সমস্যা।

দেশে বলুন আর বিদেশেই, দলের ভেতরে গণতন্ত্র না থাকার কারণেই মূলত সৃষ্টি হয়েছে এ ধরনের দ্বন্দ্ব। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থা এখন এমন যে, বঙ্গবন্ধু পরিবার ও জিয়া পরিবার থেকে পরবর্তী নেতৃত্ব না এলে দল দুটির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে ওঠার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আর এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে দল দুটির ভেতরে অবস্থানরত চাটুকারি ও তোষামোদকারি নেতারা।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো চলছে একক নেতৃত্ব ও নেতাকেন্দ্রিক ব্যবস্থায়। দলে গণতন্ত্র থাকলে নেতানেত্রীদের কর্মীদের কাছে জবাবদিহিতার দ্বার উন্মুক্ত হত। অন্যদিকে, দল একক নেতৃত্ব কিংবা পারিবারিক নেতৃত্বের উপর নির্ভরশীল না থেকে হয়ে উঠবে কর্মীনির্ভর। ফলে কর্মীরা প্রকাশ্যে নেতানেত্রীদের সাংগঠনিক কাজকর্মের সমালোচনা করার সুযোগ পাবে। দলের নেতানেত্রীদের জন্য তখন আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে নিজেদের ভুল শুদ্ধ করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।

এই আত্মশুদ্ধি, আত্মসমালোচনা ও আত্মসংযমের কথা বলেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ যদি প্রশ্ন করি, জাতির পিতার এই গণতান্ত্রিক আদর্শ কি এখন তাঁর প্রাণপ্রিয় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগে আছে? কী উত্তর দেবেন তখন আওয়ামী লীগ নেতারা? কী উত্তর দেবেন জাতির জনকের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের?

এদিকে সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রাণ হারালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপিতেও নেমে আসে বিভক্তি; দলটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। পরবর্তীতে দল টিকিয়ে রাখার জন্য বেগম খালেদা জিয়াকে সামনে নিয়ে আসা হয়। রাজনীতিতে তাঁর পূর্বঅভিজ্ঞতা না থাকলেও ঐ সময় দল টিকিয়ে রাখতে হলে তাঁকে ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না বলে দলের নেতৃত্ব মনে করে। সেখানে এখন মা ও ছেলের রাজনৈতিক পদ আরও পাকাপোক্ত করা হয়েছে। একমাত্র সন্তান তারেক রহমান অপেক্ষা করে আছেন মায়ের অবর্তমানে দলের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য।

বিএনপিতে দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্বরত ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবকে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিকভাবে ভারমুক্ত করা হয়েছে। জানি না বিএনপির গঠনতন্ত্রে কোনো কাউন্সিল অধিবেশন করার নিয়ম আছে কি না। যদি থেকে থাকে তাহলে এভাবে দলের নেতৃত্বে কেন নিযুক্ত করা হয়? যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে অযথা অর্থের অপচয় না করে ঘরে বসে কমিটি তৈরি করে মিডিয়ায় প্রকাশ করলেই তো হয়ে যায়!

দলে এমন কেউ কি আছেন যিনি এ ধরনের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবেন? না, কারও সেই সাহস নেই। কারণ অতীতের মতো আর কেউ সংস্কারপন্থী হয়ে রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়তে চান না। সুতরাং বেগম খালেদা জিয়া যা বলবেন সেটাই হল দলের গঠনতন্ত্র, গণতন্ত্র ও আদর্শ। তিনি কখনও ভুল করতে পারেন না। তিনি আমাদের নেত্রী। তাঁর ছেলে তারেক রহমান আমাদের ভবিষ্যত নেতা। বিএনপি চলবে খালেদা-তারেকের নেতৃত্বে। এখানে প্রতিদ্বন্দ্বী বলে কোনো কথা নেই। এই হল বিএনপির রাজনীতির হালচাল।

এই রাজনীতি পুঁজি করেই বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যুগ যুগ ধরে চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁর একক নেতৃত্ব। অথচ বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান তাঁর পরিবারকে সবসময় রাজনীতির বাইরে রেখেছিলেন। আজ সেই দলের অবস্থান কোথায়? কী উত্তর দেবেন জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও তাঁর দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর?

এখানে এককভাবে শুধু বিএনপিকে দায়ী করা ঠিক হবে না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেও বিরাজ করছে একই অবস্থা। এখানেও চলছে অগণতান্ত্রিক পথে একক নেতৃত্ব। ফলে তৃণমূলের আদর্শবান, সৎ ও পরীক্ষিত নেতারা নেতৃত্বে আসতে পারছেন না। অথচ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সময় দলের এমন অবস্থা ছিল না।

আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়েছে। নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়েছে। সারাদেশে একটি শক্তিশালী ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অবস্থান ছিল শক্ত। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু একসময় দলের সভাপতির পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন। এই সময় কামরুজ্জামান হয়েছিলেন সভাপতি। আওয়ামী লীগে বঙ্গবন্ধু এমন অনেক গণতান্ত্রিক উদাহরণ রেখে গেছেন। অথচ এই লীগে কয়েক যুগ ধরে দলীয় প্রধানের পদে পরিবর্তন হয়নি।

বর্তমানে একদিকে দল অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রিত্ব দুটোই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে সামাল দিতে হচ্ছে। তিনি চাইলে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিয়ে দলীয় সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। কিংবা বঙ্গবন্ধুর মতো দলের সভাপতির পদ ছেড়ে দিয়ে শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে পারেন। তাহলে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ পরিচালনায় তিনি আরও বেশি সময় দেওয়ার সুযোগ পাবেন।

প্রতিবেশি দেশ ভারতে সোনিয়া গান্ধী তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি দলের সভানেত্রী থেকে মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। সমালোচকদের মতে, বিএনপির মতোই বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগও এখন পরিবারতন্ত্রের জালে আটক পড়েছে। শেখ হাসিনার পরে একই পরিবার থেকেই আসবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব, কিন্তু কেন বঙ্গবন্ধুকন্যা কি পারেন না দলকে পরিবারতন্ত্র থেকে মুক্ত করতে?

দলে নেতারা চিরদিন থাকবেন না, কিন্তু দল যদি তার আদর্শ সামনে রেখে স্থায়ীভাবে টিকে থাকতে চায় তাহলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবে। বঙ্গবন্ধু তাঁর অবর্তমানে আওয়ামী লীগে নেতৃত্ব সৃষ্টি করেছিলেন। সেই নেতৃত্বই মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। তাঁকে হত্যা করার পর দলের ভেতরে থাকা বিশ্বাসঘাতক চতুর মোশতাক সেই নেতাদের হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতাশূন্য করে ধ্বংস করার চেষ্টা করে। এই সময় একদিকে 'মিজান আওয়ামী লীগ', 'গাজী আওয়ামী লীগ', 'জহুরা তাজউদ্দীন ও মালেক উকিল আওয়ামী লীগ' আর অন্যদিকে আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে 'বাকশাল' গঠনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়।

খন্দকার মোশতাক তখন নিজেও আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন 'ডেমোক্রেটিক লীগ'। এমন এক পরিস্থিতিতে রাজনীতিতে আগমন ঘটে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার। তবে তিনি ছাত্রজীবনে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তাছাড়া তাঁর আগমন ছিল বঙ্গবন্ধুর মতো এক মহান রাজনৈতিক পরিবার থেকে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র এখন কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বর্ধিত হয়েছে। ফলে তৃণমূল রাজনীতিতে হতাশা দিন দিন বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না। পরিবারতন্ত্র কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত স্থায়ীভাবে আস্তানা গেড়ে বসবে। রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রকে শুধু হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করবে। ক্ষমতায় থাকলে স্বৈরাচারী মনোভাব আর ক্ষমতার বাইরে অবস্থান করলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।

সম্প্রতি এক সভায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল আলমগীর বলেছেন:

"বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক দল। আমরা গণতন্ত্রে বিশেষ করি। আমরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি।"

এখন যদি তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, দীর্ঘদিন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব থাকার পর আপনি কি গণতান্ত্রিক নিয়মে ভারমুক্ত মহাসচিব হয়েছেন, না আপনার দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার একক নির্দেশে নিযুক্ত হয়েছেন? কী উত্তর দেবেন তিনি? যিনি নিজেই দলে নির্বাচিত নন, তিনি কী করে আবার বলেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কথা!

এ ধরনের নেতারা আন্দোলনের নামে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির করার কারণে ঝরে পড়ে অনেক সাধারণ মানুষের প্রাণ! গত কয়েক যুগ ধরে এ ধরনের আন্দোলনে যারা প্রাণ দিয়েছেন, জানি না তাদের তালিকায় কজন নেতা কিংবা নেতানেত্রীদের সন্তানের নাম রয়েছে। এভাবেই দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে বাংলাদেশের রাজনীতি।

দলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রাথমিকভাবে সদস্য ফি নবায়নের বিষয়টি কার্যকর করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। বর্তমান আইটি যুগে খুব সহজেই সদস্যদের তালিকা রেজিস্ট্রেশন ও ফি পরিশোধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এভাবে প্রতি বছর বার্ষিক ফি জমা দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করা হলে বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর বাৎসরিক আয় কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে একবার ভেবে দেখুন।

নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সদস্য ফি জমা দেওয়া না হলে নিয়ম অনুযায়ী ব্যক্তিকে দলের প্রাথমিক সদস্য থাকার যোগ্যতা হারাতে হবে। জেলা-উপজেলায় বাৎসরিক সম্মেলনকালে শুধুমাত্র ফি পরিশোধকারী সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হবেন জেলার আগামী নেতৃত্ব। পরবর্তীতে জেলা শাখার ডেলিগেটরা দলের জাতীয় কাউন্সিলে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্বাচিত করবেন।

অন্যদিকে এই জেলা ডেলিগেটদের স্ব স্ব জেলার সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হতে হবে। প্রতিটি জেলার ডেলিগেটদের সংখ্যা নির্ধারিত হবে জেলার সীমানা কিংবা জনসংখ্যা অনুসারে নয়, হবে জেলা শাখার সদস্য সংখ্যার উপর নির্ভর করে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর বেলায় এই নিয়ম আছে বলে আমার মনে হয় না। যদি গঠনতন্ত্রে লিখিতভাবে থেকেও থাকে তবে বাস্তবে তার কার্যকারিতা দেশে-বিদেশে কোথাও দেখা যায়নি। প্রতি বছর নিয়ম অনুসারে দলের সদস্য ফি পরিশোধ না করে নেতাকর্মীরা কী করে দল করেন, নেতা হন, এমপি হন, এমনকি মন্ত্রী পর্যন্ত হন, তা আমার কাছে অবাক লাগে। এ কী করে সম্ভব?

বাংলাদেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল সম্মেলনের পূর্বে কি কখনও যাচাই করে দেখেছে কারা দলের সদস্য ফি পরিশোধ করেছেন? কখনও কি যাচাই করে দেখেছে কারা দলের গঠনতন্ত্র অনুসারে সদস্য? নাকি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে একবার সদস্য ফি জমা দিলেই তাকে আজীবন সদস্য হিসেবে ধরে নেওয়া হয়? বিষয়টি আমার কাছে পরিষ্কার নয়।

কোনো কোনো দলে সদস্য ফি পরিশোধের নিয়ম থাকলেও থাকতে পারে। তবে কেন্দ্রীয় নেতানেত্রী থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত কেউ এই ফি পরিশোধ করেন কি না, তাতে সন্দেহ রয়েছে। প্রাথমিকভাবে কেউ কেউ হয়তো একবার সদস্য ফি দিলেও দিয়ে থাকতে পারেন। তবে প্রতি বছর এই ফি আর কেউ নবায়ন করেন না বলেই আমার মনে হয়। আবার অনেকে কোনো ধরনের ফি না দিয়েই নেতানেত্রীদের হাতে ফুলের তোড়া তুলে দিয়ে দলে যোগদান করে অল্প সময়ের মধ্যে নেতৃত্ব পেয়ে যান। তাছাড়া আজ পর্যন্ত কখনও শোনা যায়নি আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ বাংলাদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল তাদের দলের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রকাশ্যে কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

দলে গণতন্ত্র থাকলে জেলা-উপজেলা ও বিদেশের কমিটিগুলোর কোনো স্বীকৃতি ও বিভক্তির প্রশ্ন আসত না। নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হত না। দলকে কোনো পরিবারের উপর নির্ভরশীল হতে হত না। কর্মীদের দলীয় নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার সুযোগ আসত। দলীয় কর্মীদের সরাসরি সমর্থনে সৃষ্টি হত নতুন নতুন নেতৃত্ব। তা না করে এখানে ক্ষমতা অগণতান্ত্রিকভাবে কেন্দ্রের হাতে আঁকড়ে ধরে রাখা হয়েছে। সৃষ্টি করা হয়েছে 'স্বীকৃতি' নামের এক ক্ষমতার খেলা। কেন্দ্রের এই নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক খেলার কারণেই মূলত সৃষ্টি হয়েছে একই দলে একের অধিক কমিটি ও নেতৃত্ব। কখনও কখনও আবার দলের ভেতরে নেতৃত্ব নিয়ে হয় মারামারি, খুনাখুনি।

ইউরোপের আওয়ামী লীগ দেখার জন্য দীর্ঘদিন ধরে যে দুজন ব্যক্তির উপর দায়িত্ব (নির্বাচিত নন) দেওয়া হয়েছে তারা এখন দুই মেরুকরণে অবস্থান করছেন। ফলে ইউরোপের প্রতিটি দেশেই আওয়ামী লীগের একের অধিক শাখা রয়েছে। সম্প্রতি প্যারিস বাংলাদেশ দূতাবাসের অভ্যন্তরে দলের দুই গ্রুপের মধ্যে চেয়ার ছোঁড়াছুড়ি করে সংঘর্ষ পর্যন্ত হয়েছে।

অগণতান্ত্রিক নিয়মে দল পরিচালনা করার কারণেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে মূলত সৃষ্টি হয়েছে এ ধরনের অরাজকতা। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্লাটফর্মে দেশে-বিদেশে দলের নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার কোনো সুযোগ নেই। আর এ কারণেই দেশে-বিদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিভক্তি; অনেক সময় এই বিভক্তি সৃষ্টি করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুই নারী নেতৃত্বের আগমন হঠাৎ করে হলেও তাঁরা দুজনই পরবর্তীতে তাদের স্ব স্ব অবস্থান দলে পাকাপোক্ত করতে সামর্থ হন। ক্ষমতার রাজনীতির স্বাদ দুজনই গ্রহণ করেছেন। দুজনই এখনও দলের ভেতরে তাদের একক নেতৃত্ব শক্তভাবে ধরে রেখেছেন।

আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা মনে করে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। ঠিক তেমনি বিএনপির সমর্থকেরাও মনে করে বেগম খালেদা জিয়ার বিকল্প নেই। তাহলে বিকল্পহীন এ দুই বৃহৎ রাজনৈতিক দলের ভবিষ্যৎ কী? পরিবারতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, নাকি গণতন্ত্র?

যেদিন বড় দুই রাজনৈতিক দল একক নেতৃত্ব থেকে সরে এসে প্রকৃত গণতান্ত্রিক নিয়মে দলকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে একমাত্র সেদিনই আসবে দেশে গণতন্ত্র, সরকারে গণতন্ত্র। তা না হলে ক্ষমতায় যাওয়া আর ক্ষমতায় গিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য সব অগণতান্ত্রিক নিয়মের জাল থেকে বাংলাদেশ আর কোনোদিন বেরিয়ে আসতে পারবে না।

সুইডেনসহ ইউরোপের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব গণতান্ত্রিক নিয়মের মাধ্যমে নির্বাচিত করা হয়। পশ্চিমা বিশ্বে প্রতিটি দেশেই রয়েছে একটি গণতান্ত্রিক সিস্টেম। এসব সিস্টেমে দলের মনোয়ন কমিটির রাখা প্রস্তাবের উপর উপস্থিত সদস্যদের সমর্থন নিয়ে নির্বাচিত হয় দলের নেতৃত্ব। তবে কখনও কখনও মনোয়ন কমিটির প্রস্তাবের বিরুদ্ধেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়ে থাকে। এসময় স্ব স্ব প্রতিদ্বন্দ্বীর পক্ষে একটি নির্দিষ্ট সময় কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়। তবে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীর বিপক্ষে এখানে বক্তব্য রাখার সুযোগ নেই।

পরবর্তীতে শুরু হয় নির্বাচন। উপস্থিত ডেলিগেটদের সরাসরি নির্বাচনে কমিটি নির্বাচিত হয়। দলের গঠনতন্ত্রের বাইরে যদি কোনো নেতাকর্মী কিছু করে একমাত্র তাহলেই তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা যেতে পারে।
নেতানেত্রীর কার্যকলাপের সমালোচনা করা সদস্যদের নৈতিক অধিকার। এজন্য সংস্কারপন্থী কিংবা অন্য কোনো দোষ দিয়ে কাউকে দল থেকে বহিষ্কার করা যায় না। দলের গঠনতন্ত্র মেনে চললে তাকে কেউ দল থেকে বহিষ্কার করতে পারে না। কোনো নেতানেত্রীর ক্ষমতা নেই কোনো কর্মী বা নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করার। দলীয় প্রধান সব সিদ্ধান্তের মালিক হতে পারেন না। সিদ্ধান্তের মালিক কর্মীরা। একেই বলে গণতন্ত্র।

পারবে কি বাংলাদেশ এ পথে এগিয়ে যেতে?

পারিবারিক রাজনীতি বিশ্বের অনেক দেশেই আছে। বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। তবে শুধু পরিবার থেকে আসছে বলেই যাকে-তাকে উড়ে এসে জুড়ে বসতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তাকে আসতে হবে রাজনৈতিক যোগ্যতার মাপকাঠিতে। একটি গণতান্ত্রিক সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে। শুধুমাত্র পারিবারিক কারণের উপর নির্ভর করে নয়।

বাংলাদেশের আশেপাশের অনেক দেশেই পরিবারতন্ত্রের রাজনীতি রয়েছে। তবে সেই পরিবারতন্ত্র যোগ্যতার ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক পদে আসছে। বাংলাদেশের মতো পরিবারের নাম বহন করে নয়। সুতরাং সরাসরি পরিবারতন্ত্রের সমালোচনা করাটা হয়তো ঠিক হবে না। এখানে দলে গণতান্ত্রিক সিস্টেম চালু করার উপর জোর দেওয়া উচিত। তাহলে দলীয় কর্মীরা সহজেই দলের নেতৃত্বে পরিবর্তন নিয়ে আসার সুযোগ পাবে। দলে গণতন্ত্র ফিরে এলে এমনিতেই পরিবারতন্ত্রের অবসান হতে বাধ্য।