ভাষা নিয়ে বাড়াবাড়ি কি শেষ পর্যন্ত ভাষা-পুলিশের জন্ম দেবে?

Published : 22 Feb 2012, 05:44 PM
Updated : 22 Feb 2012, 05:44 PM

আমাদের ভাষার মাসে মানুষের ভাষাপ্রীতি ভীষণ বেড়ে যায় এবং অনেক ক্ষেত্রে সেটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায়। মানুষ একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে কীভাবে ভাষার প্রতি আনুগত্য দেখানো যায়, ভাষাদ্রোহীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। যখন কোনো নেতৃস্থানীয় মানুষ বলে যে, কেবল একই উচ্চারণে, একই প্রমিত বাংলায় সবাইকে কথা বলতে হবে, তখন কেউ চায় আর না চায় 'মৌলবাদী' ভাবনার ছায়া তাতে পড়ে। এই বাড়াবাড়ি এক দিন ভাষ-ফ্যাসিবাদে পরিণত হয় কিনা সেটা নিয়ে এখন চিন্তা হয়। যে কোনো উগ্র জাতীয়তাবাদ– সেটা, ভাষা, ধর্ম, জাতি– এ ধরনের যে কোনো ভিত্তির উপর যখন দাঁড়ায়, তখন তা চরম পর্যায়ে ফ্যাসিবাদে পরিণত হয়।

এই দুশ্চিন্তা আরও সবল হয়েছে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের খুবই সফল একটি সম্পাদকীয় দেখে যেখানে ভাষা 'দূষণ'কে 'নদী-দূষণের' মতো বিধ্বংসী বলা হয়েছে। আদালত এই লেখাটি গোচরে আনেন এবং সরকারের ওপর কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন কেন যেসব প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমে এই ধরনের 'কলুষিত' ভাষা ব্যবহার করা হয় সে সব নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে না। যারা এটা করছে তাদের লাইসেন্স কেন বাতিল করা হবে না সেটিরও কারণ দেখাতে বলা হয়েছে। আদালত আরও বলেছেন যে, এই 'দূষণ' ঠেকাতে এবং 'প্রমিত বাংলা ভাষা' নির্ধারণ করতে একটি বিশেষ কমিটি নিয়োগ করা হোক। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংস্কৃতি, সমাজ ও বিদ্যার জগৎ থেকে বিষয়টি আদালত, আইন এবং গুরুদের হাতে অর্পণের ব্যবস্থা করা হল।

ভাষার মতো কোনো সামাজিক সম্পত্তি হাতছাড়া করার প্রক্রিয়া অন্য কোনোভাবে শুরু করা যায় বলে জানা নেই।

মনজুর ভাই তাঁর লেখায় তিনটি উদাহরণ দিয়েছেন যেগুলো তাঁর কাছে দূষণ বলে মনে হয়েছে। এক ব্যক্তি গণমাধ্যমে তার বক্তব্য জানাবার জন্য ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে কথা বলেন। একজন ছাত্রী সেই একই কাজ করেন। তার জ্ঞানও ভাষার ক্ষেত্রে ছিল 'দূষিত'। শেষটি হচ্ছে এফএম রেডিওর ভাষা নিয়ে।

ক্ষমা চেয়ে নিয়ে লিখছি, যে তিনটি উদাহরণের মধ্যে কোনোটি আমার 'দূষণ' বলে মনে হয়নি। পছন্দ না হতে পারে ভাষা কিন্তু এটাকে দূষণের মতো দণ্ডযোগ্য অপরাধ বলে মনে হয়নি। মানুষ তার বক্তব্য বোঝাবার জন্য যে কোনো ভাষা বা একাধিক ভাষা প্রযোগের অধিকার রাখে। কানে শুনতে কারও কারও খারাপ লাগলেও এটা বেআইনি হতে পারে না। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে এটা এখন প্রচলিত পন্থা– কিছু মনে করবেন না, এটা তার অধিকারও বটে।

মেয়েটি যে শুদ্ধ ও সঠিকভাবে কথা বলতে পারেনি সেটা তার সংস্কৃতি ও শিক্ষার সীমাবদ্ধতার কারণে। এটাকে ভাষার 'দূষণ' বলাটাও কীভাবে যুক্তিযুক্ত হয় আমি বুঝিনি। শেষমেষ, এফএম রেডিওর উদাহরণ বা বক্তব্য একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ এই দোআঁশলা ভাষায় পৃথিবীর সকল এফএম রেডিও একইভাবে কথা বলে। এটা তাদের 'মাতৃভাষা'।

পৃথিবী 'দূষণ', 'দূষণ' বলে আহাজারি করে না এটা নিয়ে। অনেকের অস্বস্তি বা বিরক্তি থাকতে পারে কিন্তু তাকে 'দূষণ' বলাটা অন্যদের অধিকার খর্ব করার সমান হয়ে যায়। পছন্দের ভাষা ও তরিকায় কথা বলাটা প্রত্যেকের মৌলিক অধিকার এবং বিশ্বের সকল দেশে তা স্বীকৃত। যারা আমাদের থেকে আলাদাভাবে জীবনযাপন করে, অন্য ভাষায় কথা বলে, ভিন্ন ধরনের পোশাক পরে, তাদেরকে 'দূষণকারী' বলা মানে নিজেদের ছাড়া অন্যকে সম্মান না করার মানসিকতা। এই অবস্থান মানবাধিকারবিরোধী।

'দূষণ' শব্দটি ধর্মীয় ভাবনায় ভরা। বস্তুতপক্ষে শব্দটি প্রায় সকল সময় মৌলবাদকে উচু করার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। এই দূষণ ও পবিত্র বিষয়টি যে কোনো কৃষিভিত্তিক নারীকেন্দ্রিক সংস্কৃতিতে প্রবল হয়ে থাকে। মনে হয় আমাদের ভাবনাতে এই প্রাচীন ঐতিহ্য এখনও যথেষ্ট বিদ্যমান।

একটি নদী প্রকৃতির সৃষ্টি আর ভাষা সমাজ ও মানুষের সৃষ্টি। দুটোকে একই সমান্তরালে রাখা সমস্যা-উদ্রেককারী এবং রূপকটিও তাই ভ্রান্ত। এর ফলে ভাষা 'ধর্মীয়' বস্তুতে পরিণত হয়েছে এবং সেটা রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়েছে আদালত ও তাদের নির্দেশিত পণ্ডিতগণ। এই পদ্ধতিও গণতন্ত্রবিরোধী।

'ভাষা-দূষণ' বিষয়টির মধ্যে 'বর্ণবাদ' বা 'ভাষাবাদ' জড়িত। ইংরেজ আমলে ইংরেজি ভাষা জানাই ছিল ওপরে ওঠার সিঁড়ি। যে যত শুদ্ধ 'ইংরেজি' জানত সে ততটা ইংরেজ-ঘনিষ্ঠ হতে পারত। নিম্নস্তরের দেশীয়রা যারা 'অশুদ্ধ' ভাষা ব্যবহার করত তারাই ব্রাত্যজনের পরিচয় ধারণ করত।

গত বছরে লন্ডনের লুট-দাঙ্গার সঙ্গে বেশিরভাগ বিত্তহীন, কম শিক্ষিত কালো মানুষজন জড়িত ছিল। এদের অনেকেই আবার ক্যারিবিয়ান এলাকার যারা কিনা দাসদের বংশধর। এদের গালি দিতে গিয়ে অনেকেই বলেন যে, এই সব বর্বর মানুষ যারা অশুদ্ধ জ্যামাইকান-ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলেন– এরা একটা নতুন ভাষায় কথা বলেন যার বড় সূত্র র‌্যাপ সঙ্গীত, সেটা এফএম রেডিওর মাধ্যমে প্রচারিত হয়, এটা ইংরেজি নয়।

দোষাভী প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে আমরা শিখতাম এই ভাষা ব্যবহারের বিভিন্নতা। নিচু, মধ্য এবং উঁচু স্তর সব ভাষাতেই থাকে এবং তার প্রয়োগের বিভিন্নতাও আছে। ভাষা জানার বিষয়টি কেবলমাত্র বোঝা ও বোঝানোর বিষয়। সেখানে আইনের কোনো ভূমিকা নেই, গুরুজনদের পাণ্ডিত্য নেই, কেবল মানুষের যোগাযোগ পদ্ধতি ও ব্যবহার রয়েছে। বিবিধ ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটাই আর্ন্তজাতিক বিবেচনা।

এই ভাষার মাসে গণমাধ্যমে যে বিষয়টি মনিষীদের বক্তব্যে উঠে আসে সেটা হচ্ছে, ভাষা একটি একক স্থির বিষয়। ভাষাভিত্তিক শুদ্ধতার প্রতি আনুগত্য দেখানোর আগ্রহ এই ভাষা সমাজে পূর্বে দেখা যায়নি। সবাই বলছেন যে, সর্বস্তরে বাংলা চালু করতে হবে কিন্তু সেটা কী? কেউ কি বাধা দিচ্ছে তাতে? তার মানে কি এই যে, কেবল একইভাবে এক উচ্চারণে, কথা বলা হলে এই শুদ্ধতার বাস্তবায়ন হবে? একটি সমাজে যখন কেবল একটিমাত্র শুদ্ধ অস্তিত্ব আছে বলে মনে করা হয়, তখন তাকে একচ্ছত্রবাদী সমাজ বলা হয়।

প্রাক্তন সমাজতান্ত্রিক সমাজে ছিল ও বর্তমান ইসলামি আরবি কিছু দেশে এই ধরনের ব্যবস্থা এখনও চালু আছে।

এই 'একমাত্র' পদ্ধতি, এই একক পন্থার প্রতি আমাদের আগ্রহ আছে বলে মনে হয়। বহুবিধ ব্যবস্থা বা মত বা ভাষা প্রযোগ আমাদের অস্বস্তির কারণ হয়। আমরা একদলীয় ব্যবস্থা স্থাপন করতে পারি কিন্তু বহুবিধ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারি না। কেন পারি না তার কারণ বোধহয় আমরা এক পরিমণ্ডলে কেবল একটি বাস্তবতা সবার ওপর চাপিয়ে দিতে চাই। আমাদের জন্য বহুবিধতা যে সংকট সৃষ্টি করে তার সমাধান আমাদের ভাবনায় নেই। তাই আমরা চাই, সবাই একইভাবে বলবে, একইভাবে 'শুদ্ধ' থাকবে, যাতে দূষণ ও পবিত্রতার মাধ্যমে যে আচরণ বিধি-ব্যবস্থা সৃষ্টি হয় সেটা টিকে যাবে, যাতে ভাষা 'ধর্মীয়' গণ্ডির মধ্যে থাকে যেখানে বিতর্ক ও বিবিধতার ব্যবস্থা নেই।

বিষয়টা জটিল হয়েছে আদালতের জড়িয়ে পড়ার কারণে। এখন যে গণ্ডিতে এটা চলে গেছে সেটা আর ভাষার বিষয় নেই। এখন যারা বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করবে তারা সেই আদালত দ্বারা নির্দেশিত পণ্ডিতবর্গ, আইন প্রযোগকারী সংস্থা এবং শেষাবধি যারা তদারকি করবেন তারা সেই আমলাকুল। সমাজের পরিসর থেকে এটা চলে গেছে সরকারি অফিসের পরিসরে।

স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, এই প্রক্রিয়ার কি কোনো গন্তব্য আছে? স্বাভাবিক কারণেই আঞ্চলিকতা প্রভাবিত বাংলা সেই যুক্তিতে 'দূষিত' বাংলা এবং একই নিরিখে বর্জনের দাবি রাখে। এফএম রেডিওর ভাষা, বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলা বা সেই ভাষা পত্রিকায় ছাপা বন্ধ করা যাবে। জীবনের সকল ক্ষেত্রে আড়ি পাতা যাবে 'ভ্রান্ত ও দূষিত' ভাষা প্রয়োগের অপরাধ শনাক্ত করার জন্য।

জর্জ অরওয়েল তাঁর ১৯৮৪ উপন্যাসে 'চিন্তার পুলিশের' কথা বলেছিলেন যাদের কাজ ছিল অগ্রহণযোগ্য চিন্তার অপরাধের জন্য মানুষকে গ্রেপ্তার করা। আমরা শেষাবধি 'ভাষা-পুলিশ' প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র প্রস্তুত করলাম কিনা দেখা যাক।