বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ

Published : 20 Feb 2012, 05:31 PM
Updated : 20 Feb 2012, 05:31 PM

বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার দাবি থেকে আমরা পিছিয়ে আসিনি তো ?
গত বছর যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র পার হয়ে একুশের বইমেলায় এসেছেন তারা আসা-যাওয়ার পথে কেন্দ্রের কাছে মাইক্রোফোনে ভরাট কন্ঠের আবেদন শুনেছেন : বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা ঘোষণা করতে হবে। বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা ঘোষণা করার দাবিতে পাঁচ কোটি মানুষের স্বাক্ষর নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিবসহ বিশ্বের সব দেশের সরকার-প্রধানকে একটি আবেদন পাঠানো হবে। গণদাবির ইতিহাসে এটাই হবে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষের স্বাক্ষরিত দাবি।

বাংলা ভাষার স্বার্থে এটি নিশ্বয়ই একটি শুভ উদ্যোগ। এতোদিনে নিশ্চয়ই পাঁচ কোটি মানুষের স্বাক্ষরে সমৃদ্ধ আবেদনটি জাতিসংঘে পৌঁছেছে এবং জাতিসংঘের আমলারা পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দিয়ে নথি চালাচালি করছেন।
১৯৮০ সালে আরবিকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার পর ৩২ বছর অতিবাহিত হতে চলেছে। এর আগে ১৯৭৩-এ চীনা এবং ১৯৬৮-এ রুশ ১৯৪৮-এ স্পেনিশ এবং শুরু থেকেই ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চ দাপ্তরিক ভাষা।

পাঁচ কোটি মানুষের গণদাবিকে স্বাগত জানিয়ে একটিই সংশয় প্রকাশ করা হয়েছিল– জাতিসংঘে সপ্তম দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলা চালু হয়ে গেলে বিভিন্ন সময়, বিশেষ করে সাধারণ অধিবেশনে যোগদানকারীকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলকে সহজে বোঝার স্বার্থে এই বাংলা না আবার ইংরেজি কিংবা হিন্দিতে অনুবাদ করে দিতে হয়।

রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই দাবি জানিয়ে আমরা সাফল্য অর্জন করেছি। বাংলাকে সসম্মানে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিয়েছি, ভাষা আন্দোলনের বিস্ফোরণই শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা আন্দোলনে পরিণত হয়। দেশও স্বাধীন হয়। বাংলা সাংবিধানিকভাবেই বাংলাভাষা, এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় নথিতে ও পত্রে বাংলা ব্যবহারে বাধ্যতা সৃষ্টিকারী আইনও প্রণয়ন করা হয়।

অতি সম্প্রতি বিকৃত বাংলা ব্যবহার রোধে বিজ্ঞ উচ্চ আদালত অনুগ্রহ করে রুল জারি করেছে। বিকৃত বাংলা ব্যবহার শাস্তিযোগ্য অপরাধ বিবেচিত হতে যাচ্ছে।

যা কিছু ঘটছে তাত্ত্বিকভাবে সবই বাংলার পক্ষে। বাংলাদেশের সুবিধার শেষ নেই। একশত পঞ্চাশ মিলিয়নের সবাই চাইবেন বাংলা হোক বৈশ্বিক পর্যায়ে দাপ্তরিক ভাষা। এ সুবিধে ভারতের নেই। হিন্দির জন্য দাবি জানালে এক যোগে প্রতিবাদ জানাবে উর্দু, গুজরাটি ও বাংলা ভাষাভাষী সকলেই। পাকিস্তান উর্দুর জন্য দাবি জানালে সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাব বসে থাকবে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে পাঞ্জাবির দাবিও উপেক্ষা করা যাবে না। পূর্ব পাঞ্জাবেরও প্রায় সবাই এসে পাঞ্জাবিকে ভোট দেবে।
সপ্তম দাপ্তরিক ভাষা হবার দাবিদার পুর্তুগিজ, এসপারেন্তো, হিন্দি ও উর্দু। ভাষা-শহীদের দেশ হিসেবে ধরা যাক বাংলাদেশ বিশ্ব সমর্থনই পেল। ধরা যাক বাংলাও আরাধ্য-স্থানে পৌঁছে গেল। আশংকাটা তার পরপরই– ভাষা শিক্ষার যে হাল আগামী প্রজন্মের বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের অনেক সদস্যই যে বাংলা ভালো বুঝবেন না এটা ধরে নেওয়া তেমন অসঙ্গত হবে না। সুতরাং বাঙ্গালিদের বোঝাতে ইংরেজি বা হিন্দি অনুবাদক লাগতেই পারে।

আমার এই অনুমান একেবারে ভিত্তিহীন নয়। পৃথিবীর যে কোন ভাষার বিকাশ ঘটেছে মধ্যবিত্তের হাতে ; আবার মধ্যবিত্তের উপেক্ষা ও অনীহা সে ভাষার মৃত্যুও ডেকে এনেছে।

নতুন সহস্রাবব্দে বিগত দশ-এগারো বছরের কথা ধরা যাক:
১. আপনার সন্তান আমার সন্তান কোন স্কুলে ভর্তি হয়েছে ?
২. আমাদের সন্তানরা কি ঠিকভাবে বাংলা বলতে ও পড়তে পারছে ? প্রথম প্রশ্নটির সাধারণ উত্তর : ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে।
দ্বিতীয় প্রশ্নটির সাধারণ উত্তর : ওরা আসলে ইংরেজিতেই বেশি 'কমফোর্ট ফিল' করে।
দ্বিতীয় প্রশ্নটির আরও একটি উত্তর : ওরা হিন্দিতেও বেশ ভালো। কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই রয়েছে।
এই পরিবর্তিত অবস্থাটির জন্য সন্তানদের দোষারোপ করা অর্থহীন। কোন স্কুলে ভর্তি হবে, কোন বই পড়বে শৈশবের এই সিদ্ধান্তগুলো তাদের নিজেদের নেওয়া নয়। কাজটা আমরাই করেছি।

নিজেদের কাজের সমর্থনে পর্যাপ্ত যুক্তি আমাদেরও আছে। যুক্তিগুলো যথেষ্ট যুক্তিসম্মতও। ইংরেজি জানা প্রার্থী চাকরিতে ও পদোন্নতিতে অগ্রাধিকার পান। আরবি জানা প্রার্থীদের ধর্মালয়সহ আরও নানান জায়গায় শিক্ষকতারও নিশ্চিত কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে। ডেইলি স্টার পত্রিকায় একটি চাকরির বিজ্ঞাপনে হিন্দি না জানা প্রার্থীর আবেদন করার যে প্রয়োজন নেই সেটা সচক্ষে দেখেছি। কিন্তু ভালো বাংলা জানা প্রার্থীর অগ্রাধিকার রয়েছে এমন কোন চাকরির বিজ্ঞাপন গত চল্লিশ বছরেও চোখে পড়েনি, কিংবা ভালো বাংলা জানা প্রার্থী পদোন্নতিতে অগ্রাধিকার পেয়েয়েন তাও শুনিনি।

মানি বা নাই মানি জীবনের প্রায় সকল কর্মকাণ্ডের চালিকাশক্তি অর্থ উপার্জনের সক্ষমতা। বাংলা ভাষা অর্থ উপার্জনে কোন ভাবেই সহায়তা করছে না তা নয়, অর্থ উপার্জনের যে সব আরোপিত এবং অব্যক্ত পূর্বশত তার একটিও বাংলা-বান্ধব নয়। এমনিতেই ইংরেজি এগিয়ে ছিল, সেই সাথে যোগ হলো বিশ্বায়নের তোড়। বিশ্বায়নের ভাষাগত অবস্থাটি হচ্ছে। 'Englishing the World'- ইংরেজিই হবে বিশ্বের ভাষা। সন্তানের মঙ্গলাকামী বাবা-মা সন্তানের রুটি-রুজি নিশ্চিত করতে ইংরেজিকেই যে বেছে নেবেন তাই স্বাভাবিক।

বাংলাকে গুরুত্বপূর্ণ এবং আকর্ষণীয় করে তোলার প্রশ্নে আমাদের সকলেরই ব্যর্থতা রয়েছে। আমরা বাংলাকে অর্থকরী ভাষায় পরিণত করতে পারিনি। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনের পর গত ষাট বছরে বাংলাতে কোন মূল্য সংযোজন করতে পারিনি। ভাষার জন্য মাতমই আর উৎসবই হোক ফেব্রুয়ারি পেরিয়ে গেলে আমরা পুরনো অবস্থানে ফিরে আসি। ইংরেজির নান্দীপাঠ করি, হিন্দি গানের কলি আওরাই, আরবি দোয়া পাঠ করি।

আর্থিক গুরুত্বের জন্যই ইংরেজিতে আত্মনিবেদন করছি।

শতবর্ষেরও অধিককাল আগে ইংরেজির সামাজিক গুরুত্ব কম ছিল না, কিন্তু সেই ইংরেজি জানা মানুষগুলো বাংলার জন্যও অকাতর কাজ করে গেছেন। ১৩১৩ বঙ্গাব্দে বামাবোধিনী পত্রিকা লিখেছে:
"কেবল ইংরাজীতে বক্তৃতা প্রবন্ধ ও প্রত্রাদি লেখা দেশীয় শিক্ষিত শ্রেণীর ব্যাধিস্বরূপ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল এবং সাধারণে তাহারই সমাদর করিত। এখন সুরেন্দ্র, নরেন্দ, ভূপেন্দ্র প্রভৃতি মহাশয় মাতৃভাষায় বক্তৃতা করিতেছেন এবং সর্ব্ব সাধারণে তৎশ্রবনে অধিকতর প্রীত ও উৎসাহিত হইতেছেন। এই সঙ্গে সর্ব্ববিধায় জাতীয়ভাবে উৎকর্ষ সাধিত হইতেছে।"

সেই উৎকর্ষের ধারা আবার পাল্টে গেছে। কিন্তু ইংরেজি ভাষাটিও ভালো করে না শেখায় শুদ্ধ ইংরেজিতে বক্তৃতা, প্রবন্ধ ও পত্রাদি ইত্যাদি লিখতেও পারছেন না।

বাংলা ভাষার অবস্থা বর্ণনার জন্য একটি সূচকই যথেষ্ট: ১৫০ থেকে ১৬০ মিলিয়ন বাংলাভাষী মানুষের দেশের বাংলা পত্রিকার সর্বমোট প্রকৃত প্রচার সংখ্যা এখনও ১ মিলিয়ন ডিঙ্গিয়েছে কিনা সন্দেহ রয়েই গেছে।

সব মিলিয়ে আগামী দিনে বাংলা ভাষার যে ভবিষ্যৎ দেখা যাচ্ছে তা মোটেও আলোকিত নয়।

এক সময়ে প্রতাপশালী-ভাষা ইডিশের অন্যতম কথাসাহিত্যিক আইজাক বসেভিস সিঙ্গার উপন্যাস লিখতেন। তাঁর সন্তান ও সন্তানের সন্তানদের তা পড়তে হবে ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে। কারণ তখন ইডিশ জানতেন এমন মানুষের সংখ্যা আঙ্গুলে গোনা যেত। শহর ও গ্রামের দরিদ্র মানুষকে বাংলা নিয়েই পড়ে থাকতে হবে কিন্তু বাংলা সংবাদপত্র এবং বাংলা গল্প- উপন্যাস-কবিতা পড়ার মত কার্যকরী বাংলা জ্ঞান থাকতে কিনা সেটিই প্রশ্ন।

নিবন্ধটির মূল সুর হতাশাব্যঞ্জক। হোক। লিখতে হলে আমি তো আর বাংলা থেকে সরে আসতে পারছি না, উপায়ও নেই। পাঠক যতই হ্রাস পাক, জানি, বাংলাতেই লিখে যাবো।

আন্দালিব রাশদী: কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক।