নতুন আইনে বাল্যবিয়ে বাড়বে

নাসিমুন আরা হক
Published : 29 April 2017, 04:56 AM
Updated : 29 April 2017, 04:56 AM

নারী সমাজ ও দেশবাসীর প্রতিবাদ আপত্তি উপেক্ষা করে ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ জাতীয় সংসদে 'বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭' পাস হল। নারী সংগঠন ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অনুরোধ-উপরোধ উপেক্ষা করে রাষ্ট্রপতি ওই আইনে স্বাক্ষরও দিয়ে দিয়েছেন। এর ফলে দেশ একশ বছর পিছিয়ে গেল।

১৯২৯ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায় প্রমুখের নেতৃত্বে এক আন্দোলনের ফলে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনামলে মেয়েদের বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ নির্ধারণ করে একটি আইন পাস করা হয়েছিল। সে সময়ে এই আইন ছিল একটি যুগান্তকারী ইতিবাচক পদক্ষেপ। এটি ছিল ব্রিটিশ আমলের এক অত্যন্ত অগ্রসর আইন। এটি পাস হওয়ার আগে ৮, ১০, ১১ বছর বা তারও কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত। এই আইনের ফলে সেটা বন্ধ হয়।

কিন্তু আজ একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে সেই সময়ের অগ্রসর আইন সংশোধন করে আমরা পেছনের দিকে পা ফেলে অন্ধকার যুগে প্রবেশ করেছি।

কারণ নতুন আইনে লেখা আছে বিশেষ প্রেক্ষাপটে মেয়েটির সর্বোত্তম স্বার্থে বিধিসম্মতভাবে অভিভাবকরা চাইলে আদালতের অনুমতি নিয়ে একটা মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিতে পারবে।

নতুন আইনে মেয়েদের বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ এবং ছেলেদের বিয়ের বয়স সর্বনিম্ন ২১ বছর রাখা হয়েছে। তারপরও 'বিশেষ পরিস্থিতি'র কথা বলে তা শিথিল করার সুযোগও রাখা হয়েছে।

আমাদের দেশে বাল্যবিয়ের হার সবচাইতে বেশি। আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থায় দরিদ্র ও রক্ষণশীল পরিবারের অভিভাবকদের প্রবণতা হচ্ছে কিশোরী হলেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া। তারা একে স্বাভাবিক কর্তব্য বলে মনে করে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এ ধরনের বিয়ে অহরহ ঘটতে দেখা যাচ্ছে। অজ্ঞানতা, অশিক্ষা ও সচেতনতার অভাবেই এমনটা ঘটছে।

আইনে বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স মেয়েদের জন্য ১৮ হওয়া সত্ত্বেও বাল্যবিয়ের হার বাংলাদেশে অত্যন্ত বেশি। এই যখন অবস্থা তখন আইনে বিশেষ প্রেক্ষাপটে ১৮ বছরের আগে বিয়ের সুযোগ রাখা হলে বাল্যবিয়ে যে অনেক বেড়ে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ইউনিসেফের 'The State of the world's Children Report 2015' অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৫ বছরের কম বয়সে ২৯% মেয়ের আর ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয় ৬৬% মেয়ের।

আন্তর্জাতিক আইন ও দেশের আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে যাদের বয়স তারা সবাই শিশু। সেক্ষেত্রে নতুন আইনে বলা হচ্ছে, বিশেষ প্রেক্ষাপটে অভিভাবকদের ইচ্ছায় আদালতের সম্মতি নিয়ে ১৮ বছরের কমবয়সী মেয়ের বিয়ে দেওয়া যাবে এবং তা বাল্যবিয়ে বলে গণ্য হবে না।

প্রশ্ন হচ্ছে, এতে কি বিরাজমান আইনের চরম লঙ্ঘন হচ্ছে না?

'বিশেষ প্রেক্ষাপট' বলতে কী বোঝাবে সে সম্পর্কে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিমন্ত্রী ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, কোনো মেয়ে ধর্ষণের কারণে বা অন্য কারণে গর্ভবতী হয়ে পড়লে তখন মেয়েটিকে ওই লোকটির সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে।

ধর্ষকের সঙ্গে যদি অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরী মেয়েটির বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তা হবে ধর্ষকের জন্য তার অপরাধের শাস্তি নয়, পুরস্কার। আর যে মেয়েটি ধর্ষণ বা প্রতারণার শিকার বা ভিকটিম তার জন্য এই বিয়ে হবে আজীবন কারাদণ্ড। এই মেয়েটিকে সারা জীবন অত্যাচার, ধর্ষণ ও নির্যাতন করার অনুমতি ওই লম্পট বর্বর অপরাধীকে আইনগতভাবে দিয়ে দেওয়া হবে।

একটি কিশোরী মেয়ে বিয়ে বা সন্তান ধারণের জন্য অনুপযুক্ত। একটি মেয়ে যে নিজেই শিশু সে আরেকটি শিশু কীভাবে জন্ম দেবে? চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী, সন্তান ধারণের জন্য যে পূর্ণতা, পুষ্টি তার দেহে প্রয়োজন তা তখনও সে লাভ করে না।

আমাদের দেশে ১৮ বছরের আগে কোনো ব্যক্তি ভোটাধিকার লাভ করে না। যখন একটি ছেলে বা মেয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করার অধিকারী হয় তখনই কোনো বিষয়ে মতামত দেওয়ার অধিকার সে অর্জন করে। ১৮ বছরে সে দেশের একজন নাগরিক, একজন প্রাপ্তবয়স্ক।

১৮-র আগে কোনো বিষয়ে মতামত দেওয়ার অধিকার বা কোনো চুক্তি সই করার অধিকারী সে নয়। বিয়ে একটা চুক্তি। কিন্তু ১৮-র নিচে একজন কীভাবে এই চুক্তিতে সই করবে? কারও মত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নেওয়া হলে তা হবে সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ সম্প্রতি একটি আলোচনা সভায় যথার্থভাবেই এই মত তুলে ধরেছেন।

আমাদের দেশে সাধারণত ছেলেমেয়েরা এসএসসি পাস করে ১৬ এবং এইচএসসি ১৮ বছর বয়সে। মৌলিক শিক্ষা লাভ অন্তত এইচএসসি পর্যন্ত। এর আগে কীভাবে একটি মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া যাবে? সে কি তার প্রাপ্য মৌলিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না? দেশে মাধ্যমিক পর্যন্ত সরকার বিনামূল্যে শিক্ষাদান কর্মসূচি চালু রেখেছে। এই সুযোগ থেকে ওই ছাত্রীদের কেন বঞ্চিত রাখা হবে? এই বিষয়গুলো কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না।

সরকার সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে, নারীর ক্ষমতায়ণ নিশ্চিত করতে ছাত্রীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি চালু করেছে। এর ফলে বিদ্যালয়ে ছাত্রী ভর্তি অনেক বেড়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য বিশ্বব্যাপী সুনাম অর্জন করেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এ জন্য জাতিসংঘে পুরস্কারও গ্রহণ করেছেন।

এই নতুন আইন কি এক্ষেত্রে দেশের সুনাম ও অগ্রযাত্রা চরমভাবে বিঘ্নিত করবে না? অবশ্যই করবে। ভয়ানক বাধাগ্রস্ত হবে নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সব উদ্যোগ। মলিন হবে বাংলাদেশের সুনাম।

পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে স্কুলে ছাত্রী ভর্তি যত বাড়ছে সেইসঙ্গে ছাত্রী ঝরে পড়ার প্রবণতাও রয়েছে। এর কারণ অভিভাবকদের দারিদ্র্য, রক্ষণশীল মনোভাব ও দুর্বৃত্তদের দৌরত্ম্যের কারণে নিরাপত্তাহীনতা।

স্কুল-কলেজে যাওয়া-আসার পথে ছাত্রীরা কখনও কখনও বখাটেদের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। সেক্ষেত্রে সমাধান হচ্ছে, দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন ও তার প্রয়োগ। পরিবারে, স্কুল-কলেজে, পাড়া-মহল্লায় বখাটের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে তাকে অভয় ও নিরাপত্তা দান। সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি করা। মেয়েটির পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়া, তাকে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া এবং সেই লক্ষ আইনের সংশোধন করে সুযোগ করে দেওয়া এই একবিংশ শতাব্দীতে (২০১৭ সালে) কোনো সুন্দর প্রতিকার হতে পারে না। এ যেন মাথাব্যথা দূর করতে মাথা কেটে ফেলা।

আইনটি সংসদে পাশ হওয়ার আগেই সব নারী সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন এটি পাস না করার জন্য অনুরোধ ও দাবি জানিয়েছিল। তাদের আশঙ্কা ছিল, এ আইন পাস হলে ধর্ষক সাজা থেকে রেহাই পাবে, তার সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে হবে; এমনটি হলে এটা হবে একটি গর্হিত অপরাধমূলক কাজ।

বাস্তবে তা-ই হয়েছে। আইন পাস হওয়ার পর প্রথম বিয়েটি হয়েছে কারাগার থেকে একজন ধর্ষককে মুক্তি দিয়ে; ২৫ বছর বয়সী ওই ধর্ষকের সঙ্গে ১৫ বছর বয়সী ধর্ষিতার বিয়ে দেওয়া হয়েছে। হ্যাঁ, আদালতের অনুমতি নিয়ে এবং অভিভাবকদের উপস্থিতিতে। গণমাধ্যমে এ খবর প্রকাশিত হয়েছে।

সত্যি, ধর্ষকদের তো আনন্দিত হওয়ার কথা! কিন্তু আমরা, যারা বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে চাই, দেখতে চাই এদেশের মেয়েরা, নারীরা মানুষের মর্যাদা পাবে। দেশের একজন নাগরিক হিসেবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানসহ সব ক্ষেত্রে সমান সুযোগ অধিকার নিয়ে কর্তব্য পালনে নারী-পুরুষ হাতে হাত রেখে তালে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাবে, তারা আনন্দিত হতে পারছি না।

আমরা উদ্বিগ্ন, এই নতুন আইন দেশের সাম্প্রতিক সব অর্জন, উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা চরমভাবে ব্যাহত করবে। ম্লান করে দেবে বাংলাদেশের গৌরবময় অগ্রযাত্রা। ১৮-র আগে বিয়ে হলে তা হবে 'শিশু বিয়ে'। আরও স্পষ্ট করে যদি বলি, তাহলে এ তো শিশু বিয়ে নয়, এ হচ্ছে 'মেয়ে শিশুর বলিদান'।

প্রায় ৯০ বছর আগে প্রণয়ন করা অগ্রসর আইন এভাবে সংশোধন করে দেশকে অন্ধকার যুগে ঠেলে দেওয়া বিস্ময়কর শুধু নয়, ভয়ঙ্কর।

মাননীয় মন্ত্রী যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, গ্রামে গ্রামে মেয়েরা প্রেম করে গর্ভবতী হয়ে যাচ্ছে তাতে সামাজিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। কারণ এই বক্তব্যের সমর্থনে কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে না। 'মানুষের জন্য' পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, এ হার ১.৫। কাজেই দলে দলে মেয়েরা প্রেমে পড়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে আর গর্ভবতী হয়ে যাচ্ছে– এ কথা সত্য নয়।

সারা দেশে শিক্ষা ও সচেতনতা ছড়িয়ে দিয়ে সব সমস্যার সমাধান হতে পারে। তা না করে এ ধরনের পশ্চাদমুখী, আত্মঘাতী আইন কোনো সমাধান হতে পারে না।

একটি মেয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়লে ও তার সন্তান জন্ম দিলে কী পরিচয়ে বড় হবে?
এ সম্পর্কে ইতোপূর্বে হাইকোর্টের একটি রায় রয়েছে। যে রায়ে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র মাতার পরিচয়েই সন্তান পরীক্ষা দিতে ও স্কুলে ভর্তি হতে পারবে।

কাজেই এ যুক্তিও আইন প্রণয়নের অজুহাত হতে পারে না। কার স্বার্থে এটা করা হল, তা বোধগম্য নয়।

হেফাজতে ইসলাম দাবি করেছিল বটে পঞ্চম শ্রেণির পরে মেয়েদের পড়ার দরকার নেই। আওয়ামী ওলামা লীগ দাবি করেছিল মেয়েদের বিয়ের কোনো বয়স নির্ধারণ না করার জন্য। সেসব দাবিই কি মেনে নেওয়া হল?

কেন আমরা দেশকে অন্ধকার যুগে ঠেলে দিচ্ছি?