বইমেলার বই সম্পাদিত হয়ে আসে না কেন?

রাখাল রাহারাখাল রাহা
Published : 19 Feb 2012, 02:19 PM
Updated : 19 Feb 2012, 02:19 PM

বাংলাদেশে সারা বছর ধরে যত বই প্রকাশিত হয় তার অধিকাংশই অমর একুশের গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হয়। পাঠক সঠিক পরিসংখ্যানটি না জানলেও সহজেই অনুমান করতে পারেন যে এই সংখ্যাটি বিপুল। এই বিপুল সংখ্যক গ্রন্থ প্রকাশকরা কী প্রক্রিয়ায় প্রকাশ করেন এবং কী ভাবেই বা সম্পাদনা করেন (আদৌ করেন কি?) কীভাবেই বা মুদ্রণ ও বাধাইয়ের কাজ সম্পন্ন হয় তা আমাদের বর্তমান প্রযুক্তিগত অবস্থান এবং ক্রমদক্ষতার পরিপ্রেক্ষিতে বুঝা দুষ্কর।

বলা হয় বই মানসিক খাদ্য। আমরা বয়স্করা এবং শিশুরা এই মানসিক খাদ্য গ্রহণের আগে সত্যি সত্যি কি জানার সুযোগ পাচ্ছি খাদ্যটি আসলে কতটা পুষ্টিকর এবং স্বাস্থ্যসম্মত? সঠিক তথ্য, সঠিক ও উপযোগী ভাষা, বিন্যাস সৌকর্ষ্য, ভাষা শৈলী এবং বিষয়ের উপস্থাপন–এসবই সুসম্পাদিত বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দিক।

বইয়ের এই সবগুলো দিক নিয়ে আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। আমি কেবল মোটা দাগে সম্পাদনা বিষয়ে টেকনিক্যাল কয়েকটি দিক তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

একটি তথ্যতালিকা দিয়ে মূল আলোচনায় প্রবেশ করা যেতে পারে। ডবল ডিমাই ১/১৬ আকারের ১০ ফর্মা অর্থাৎ ১৬০ পৃষ্ঠার একটি সাধারণ মানের বই ১০০০ কপি প্রকাশ করতে এদেশের অধিকাংশ প্রকাশক (কখনও কখনও লেখক) খরচের যে হিসেবটি কষেন তা মোটামুটি এরকম :


তালিকার দিকে তাকিয়ে বোঝা যাচ্ছে, যেখানে প্রত্যেকটি বইয়ের উৎপাদন খরচ ৬০ টাকা থেকে ৮৫ টাকা পর্যন্ত, তার মধ্যে পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার খরচ শূন্য। অর্থাৎ বর্তমানে বাংলাদেশের প্রকাশনা-শিল্প এমন স্তরে আছে যে-স্তরে পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা এখনও খরচের কোনো খাত হয়ে ওঠেনি। কিন্তু যেসব দেশ প্রকাশনা-শিল্পে উন্নতিসাধন করেছে সেসব দেশে এটি খরচের সবচেয়ে বড় খাত। কারণ এটা হলো সেই খাত, যে-খাতের উপর নির্ভর করে গ্রন্থ নামক পণ্যটির গ্রহণযোগ্যতা, স্থায়িত্ব, বিক্রি, লেখক-প্রকাশকের সুনাম এবং বৃহত্তর অর্থে সমাজের অগ্রগতি। কিন্তু খরচের সবচেয়ে বড় খাত হলেও এটা এমন একটা খাত যে-খাতে একবার ব্যয় করলে ভবিষ্যতে যতবারই বইটা ছাপানো হোক, আর ব্যয় করার প্রয়োজন হয় না (সংস্করণ করা না হলে)। তথ্যতালিকায় উল্লিখিত বইটির সম্পাদনা বাবদ যদি ১০ হাজার টাকাও ব্যয় ধরা হতো তাহলে বই-প্রতি ১০ টাকা করে অতিরিক্ত খরচ যোগ হতো। ভবিষ্যতে এই বই ১০ হাজার কপি ছাপা হলেও খরচ আর বাড়তো না। তখন বই-প্রতি সম্পাদনা বাবদ খরচ গিয়ে দাঁড়াতো মাত্র ১ টাকায়। কিন্তু খরচের অন্যান্য প্রায় সকল খাতের চরিত্রই এর উল্টো। যত বই ছাপা হবে খাতওয়ারি খরচ তত বাড়বে। শুধু তাই নয়, সময় যত যাবে আগের চেয়ে খরচ আরো বাড়তে থাকবে। বাংলাদেশের লেখক ও প্রকাশকদের পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা এবং খরচের খাতগুলোর তুলনামূলক গুরুত্ব বিশ্লেষণ করতে না পারা বই অসম্পাদিতভাবে প্রকাশ হওয়ায় অন্যতম প্রধান কারণ।

দ্বিতীয়ত, অমর একুশে বইমেলার প্রায় সকল পাণ্ডুলিপি তৈরি হয় মেলার দু-তিন মাস আগে। এবং এই পাণ্ডুলিপির সংখ্যা থাকে পাঁচ হাজারেরও অধিক। এগুলোর পৃষ্ঠাসংখ্যা গড়ে ১০০ ধরলে মোট পৃষ্ঠাসংখ্যা দাঁড়ায় ৫ লাখে। গড়ে প্রতিটি পৃষ্ঠায় ৫০০ শব্দ থাকলে মোট শব্দসংখ্যা হয় ২৫ কোটি। Chicago Manual of Style অনুযায়ী একজন দক্ষ সম্পাদককে ১ লাখ শব্দের একটি পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করতে ১২০ ঘণ্টা নিবিড়ভাবে কাজ করতে হয় (সম্পাদকের মতামতের ভিত্তিতে লেখক যদি পাণ্ডুলিপিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনেন তবে আরো বেশি সময় প্রয়োজন হয়)। এর মধ্যে সম্পাদক ৩ বার পাণ্ডুলিপিটি সম্পাদনা করেন। প্রকৃত শ্রমঘণ্টা ৬ ধরলে এই কাজে তার লাগবে ২০ দিন। সুতরাং আমাদের বইমেলার সব বই যদি এ ধরনের একজন সম্পাদককে সম্পাদনা করতে হয় তাহলে তার প্রয়োজন হবে ৫০ হাজার দিন অর্থাৎ প্রায় ১৩৭ বছর। বাংলাদেশে দক্ষ পাণ্ডুলিপি সম্পাদক যদি ১০০ জনও থাকেন এবং তাঁদের প্রত্যেকে যদি ৫০০ দিন নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করেন তাহলে বইমেলার সব বই সম্পাদিত হয়ে প্রকাশ হওয়া সম্ভব। আর সব বই দুই মাসের মধ্যে সম্পাদনা করতে হলে লাগবে প্রায় ৮৩৩ জন সম্পাদক। এত সম্পাদক দেশে নেই। এত সময়ও লেখক-প্রকাশকের নেই। লেখকের সৃষ্টি-উন্মাদনা ও প্রকাশকের মুনাফা-তাড়নার কাছে সম্পাদনার মতো মানবিক শ্রমও এখানে নিতান্ত অসহায়। বইমেলার বই সম্পাদিত হয়ে না আসার এটা আরেকটা প্রধান কারণ।

তৃতীয় হচ্ছে, সম্পাদনার রয়েছে বহুরকম পর্যায় বা ধাপ। উপরে সম্পাদনার জন্য যে সময়ের হিসাব করা হলো তা শুধুমাত্র সম্পাদনার দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ। এর আগের ধাপে রয়েছে উন্নয়নমূলক সম্পাদনা। এই ধাপে পাণ্ডুলিপিকে উদ্দীষ্ট পাঠক বা ব্যবহারকারীর উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়। এ পর্যায়ে পাণ্ডুলিপির বিষয় ও চরিত্র অনুযায়ী সম্পাদক ও লেখক অনেকসময় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেন। আর এর পরের ধাপে আছে কারিগরী সম্পাদনা। এটা পাণ্ডুলিপির বাক্য, ব্যাকরণ, বানান, যতি, টাইপ, স্পেস ইত্যাদির প্রমিতি নির্ধারণ করে, যার একেবারে শেষে থাকে প্রুফ-রিডিং। সাধারণত উন্নত প্রকাশনা সংস্থাগুলো সম্পাদনার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের কাজ সম্পাদন করে পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করে। প্রথম ধাপ লেখক সম্পন্ন করেন পেশাদার সম্পাদক বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। তিন ধাপ পার হওয়ার পরও অনেক ক্ষেত্রে কাজ শেষ হয় না। প্রবন্ধ বা গবেষণামূলক পাণ্ডুলিপি হলে নির্ঘণ্ট, শব্দসংক্ষেপ, শব্দসংকেত, পরিশিষ্ট, গ্রন্থপঞ্জী, বিস্তারিত সূচী ইত্যাদি বহু রকমের কাজ-কারবার আছে, যেগুলো পৃথকভাবে করতে হয়।

এতসব না-জানার অনেক সুবিধা! বছরখানেক আগে 'সম্পাদনা'-আয়োজিত এক কর্মশালায় প্রত্যন্ত একটি জেলা থেকে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাও শেষ করেনি এমন একজন ত্রিশোর্ধ্ব যুবক অংশগ্রহণ করেছিলেন। কর্মশালা শেষে কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি এখান থেকে আসলে কী পেলেন? তিনি যেটা জবাব দিয়েছিলেন তা হলো বিগত কয়েকটা বইমেলায় তিনি ধারাবাহিকভাবে বাংলাবাজারের বিভিন্ন প্রকাশককে টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করে আসছিলেন। এ মেলায়ও তার প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু কর্মশালায় অংশগ্রহণ করার পর তিনি পরিকল্পনাটি ত্যাগ করেছেন। গল্পটা সেই নাপিতের ফোঁড়া কাটার গল্পের মতো। যখন তাকে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, স্নায়ু-শিরা-ধমনি এসব চেনানো হলো তখন সে আর ফোঁড়ায় ক্ষুর চালাতে পারে না। কোথায় কোন শিরা, কোন ধমনি কেটে যায় সেই ভয়ে। আমাদের প্রকাশক-লেখকদের বোধহয় গল্পটা জানা আছে। এটা হয়তো আরেকটা কারণ।

চতুর্থ হচ্ছে গ্রন্থ-উন্নয়ন, গ্রন্থপ্রসার ও পাঠক বাড়ানোর নামে রাষ্ট্র কর্তৃক দেশের মধ্য থেকে টাকা খরচ করে এবং দেশের বাইরে থেকে ডলার ভাঙিয়ে নিকৃষ্ট মানের গ্রন্থক্রয়। যত উন্নত রাষ্ট্রই হোক, তার সংগ্রহগারগুলোর ধারণক্ষমতা অসীম নয়। আমাদের দেশের অতি স্বল্পায়তনের সেই গুরুত্বপূর্ণ স্থান দীর্ঘদিন ধরে গ্রন্থ-সদৃশ আবর্জনায় ভরানো হচ্ছে। এতে সুবিধা হচ্ছে ভরানোর কাজে যুক্তদের লাভ বেশি হচ্ছে, মানুষ আবর্জনায় ডুবে থাকলে আয়েশে শাসন-শোষণ করা যায়। আর অসুবিধা হচ্ছে আবর্জনা আবর্জনাকেই ডেকে আনছে। গুলিস্তানের জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র তাদের অধিভুক্ত সারাদেশের কয়েক হাজার লাইব্রেরিতে যোগান দেওয়ার জন্য যেসব গ্রন্থ স্তূপ করে রেখেছে সেগুলো, আর শাহবাগের জাতীয় গণগ্রন্থাগার তার শাখাগুলোর জন্য যেসব নতুন বই সংগ্রহ করছে তার নমুনা পর্যবেক্ষণ করলে সহজেই উপলব্ধি করা যাবে, দেশে কেন ভালো বইয়ের পাঠক কমে যাচ্ছে। এ দুটো প্রতিষ্ঠানসহ সরকারের কিছু মন্ত্রণালয় এবং দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উন্নয়ন-বাণিজ্যিক-সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে কিছু ভালো বইয়ের শাক দিয়ে ঢেকে বিবিধ প্রক্রিয়ায় অসংখ্য নিকৃষ্ট বইয়ের মাছ জাতিকে খাইয়ে যাচ্ছে। নিকৃষ্ট গ্রন্থ পাঠ করে পাঠকের রুচি নিকৃষ্ট হচ্ছে, ফলে আরো নিকৃষ্ট গ্রন্থের চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে, যা আরো নিকৃষ্ট গ্রন্থ উৎপাদনে উৎসাহ যোগাচ্ছে। এই নিকৃষ্ট বইয়ের ভিড় আর প্রচারণায় উৎকৃষ্ট বই চোখে পড়ছে কম। ফলে রুচিশীল পাঠক বইবিমুখ হয়ে পড়ছে। এটা একটা দুষ্টচক্র।

এই দুষ্টচক্র ভাঙতে হবে। কারণ দুনিয়ার কোনো দেশেই পাঠক ছিল না। পাঠক সৃষ্টির জন্য এবং বইয়ের মান বাড়ানোর জন্য রাষ্ট্র এবং সমাজের মধ্যে এক ধরনের সচেতন প্রয়াস ছিল। সেই প্রয়াসের ধারাবাহিকতায় শিক্ষা, প্রযুক্তি, অর্থনীতি, রাজনীতিরও ক্রমোন্নয়নে তারা এমন এক অবস্থানে পৌঁছেছে যে, এখন বইপড়া তাদের সামগ্রিক জীবনাচরণের অংশ বলে মনে হয়। সেকারণেই আমরা আজ বলি অমুক অমুক দেশের মানুষ প্রচুর পড়ে। কিন্তু আমরা যেহেতু তার উল্টোস্রোতে চলছি সেজন্য আমাদের প্রয়োজন প্রকাশনা নিয়ন্ত্রণের– ত্রিপাক্ষিক নিয়ন্ত্রণ। প্রথম পক্ষ লেখকের গ্রন্থ-প্রণয়ন নিয়ন্ত্রণ, দ্বিতীয় পক্ষ প্রকাশকের গ্রন্থ-প্রকাশ নিয়ন্ত্রণ এবং তৃতীয় পক্ষ রাষ্ট্র ও তার দেশি-বিদেশি উন্নয়ন-বাণিজ্যিক-সংগঠনের গ্রন্থ-সদৃশ আবর্জনা উৎপাদন ও ক্রয় নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয় পক্ষের একজন অপ-বিকশিত ক্ষেত্রের অপরিণত ব্যবসায়ী এবং আরেকজন দুর্বৃত্ত। তৃতীয় পক্ষের চরিত্রের কারণেই এখানে দ্বিতীয় পক্ষের সুব্যবসায়ী হওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার এবং তার ক্ষেত্রের স্বাভাবিক বিকাশ ঘটাও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সুতরাং প্রথম পক্ষ লেখকেরই এগিয়ে এসে গ্রন্থ-নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। এজন্য তাঁর প্রথম যেটা করা প্রয়োজন তা হচ্ছে গ্রন্থ-পরিকল্পনা করে অধ্যায় বা পরিচ্ছেদ লিখতে বসা। এমন অরাজক দেশের সংবেদনশীল মানুষ হিসাবে তিনি সমাজের বহুবিধ বিষয়ে কলম ধরবেন– সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই বিক্ষিপ্ত সব লেখাকেই মানানসই ফর্মার পুরুত্বে ভরে না দিয়ে সম্পাদনা করে পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত করবেন, এবং প্রকাশককে সেই পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করে প্রকাশ করতে সহযোগিতা করবেন এবং প্রয়োজনে বাধ্য করবেন। এটাই এখন প্রয়োজন।

রাখাল রাহা: প্রধান সম্পাদক, 'সম্পাদনা'