দেয়ালচিত্রে পোড়া মবিল: সময়ের বক্রাঘাত

Published : 16 April 2017, 05:38 PM
Updated : 16 April 2017, 05:38 PM

গত বৃহস্পতিবার (৩০ চৈত্র ১৪২৩) প্রায় সবগুলো দৈনিক পত্রিকায় ছবিসহ চট্টগ্রাম নগরের বাদশা মিয়া সড়কের দেয়ালে চারুকলা শিক্ষার্থীর আঁকা বাংলার লোকজ সংস্কৃতির চিত্রে দুর্বৃত্তরা (!) যে পোড়া মবিলের আবরণ দিয়েছে তার খবর মুদ্রিত হয়েছে। অনেক সংবাদ প্রতিবেদক একে রাজনীতির 'অশনি সংকেত' বলে উল্লেখ করেছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই কুৎসিত ঘটনাকে 'সময়ের বক্রাঘাত' বলে অভিহিত করতে চাই।

ওই দেয়ালচিত্রটি আঁকা হয়েছিল বাংলা নববর্ষ ১৪২৪ বরণ করার উদ্দেশ্যে। পরিহাস বা বক্রাঘাতের বিষয়টি আছে ইতিহাসে। বাংলাবর্ষ গণনা বা বঙ্গাব্দ গণনারীতি উদ্ভাবিত হয় সৌর ও চান্দ্রবর্ষ গণনার সংমিশ্রণে, যদিও বাংলা বর্ষপঞ্জিকে সৌর বর্ষপঞ্জি রূপেই চিহ্নিত করা হয়। আসলে আলাউদ্দীন হুসেন শাহ, যিনি তদানীন্তন বাংলার সুলতান ছিলেন পঞ্চদশ শতকের প্রথমার্ধে ইসলামি চান্দ্রবর্ষের (হিজরি) সঙ্গে বাংলাদেশে প্রচলিত সৌর বর্ষপঞ্জির সংযুক্তিতে বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রস্তুত করেন। অর্থাৎ সর্ব অর্থে এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ বর্ষপঞ্জি।

কিন্তু এই বর্ষপঞ্জি প্রথম বাস্তবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে মুঘল বাদশাহ আকবরে শাসনামলে পঞ্চদশ শতকের শেষ ভাগ থেকে ষষ্ঠদশ শতকের প্রথমার্ধে। অবশ্য আকবর এই বর্ষপঞ্জিতে একাধিক সংস্কার, রদবদল ও আধুনিকায়ন করেই পঞ্জিটি প্রবর্তন করেন। আসলে এই বর্ষপঞ্জি প্রবর্তনের পেছনে জমির খাজনা আদায়ের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায় ইসলামি বর্ষপঞ্জির সঙ্গে বাংলার ফসল কাটার সময়ের মিল ছিল না। ফলে কৃষকরা অসময়ে খাজনা দিতে বড়ই কষ্ট পেত। তার থেকে পরিত্রাণ দেওয়ার জন্য মহতী আকবর বাংলার কৃষকদের জন্যে বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী খাজনা আদায়ের প্রচলন করেন। একেই সম্ভবত বলা যায় যোগ্য কূটনীতি ও রাষ্ট্রপরিচালন প্রজ্ঞা। ঠিক এ কারণেই আকবর ইতিহাস বিশেষণে ভূষিত হয়েছেন, 'আকবর দ্য গ্রেট' হিসেবে।

কিন্তু উপরোক্ত ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহ কমবেশি সবারই জানা। আর এই জানা বিষয়টির ভেতরই লুকিয়ে আছে পরিহাসটি। বাংলা বর্ষপঞ্জি কোনো বিধর্মী বা ইসলামবিরোধী শাসকের মস্তিষ্কপ্রসূত বিষয় নয়। এর উদ্ভাবক এবং প্রবর্তক উভয়ই মুসলমান।

শুধু তা-ই নয়, ইতিহাস সাক্ষী, তাদের শাসনামলেও বাংলার গ্রামে-গঞ্জে পহেলা বৈশাখে মুখোশ পরিহিত জনগণ ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্রসহ শোভাযাত্রা করেছে, যার ধারাবাহিকতা এই একবিংশ শতকেও লক্ষণীয়। আমার যুক্তি হল– যে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রকৌশলী হলেন দুই মুসলিম শাসক তাদেরই বিরুদ্ধাচারণ নব্যমুসলিম সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারা কি সময়ের বক্রাঘাত বা পরিহাস নয়?

অনেকেই বলবেন আলাউদ্দীন হুসেন শাহ এবং আকবর নিজেদের শাসন ক্ষমতা দৃঢ় করার জন্যে এমন ধর্মনিরপেক্ষতার আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং তারা প্রকৃত মুসলিম ছিলেন না। জানি না প্রকৃত মুসলিম হওয়া অর্থ কী, কিন্তু এ কথা তো সত্য রাষ্ট্র পরিচালনায় ইসলাম ধর্মেও অপরাপর ধর্মাবলম্বীদের স্থান অস্বীকার করা হয় না। দ্বিতীয়ত ধর্মীয় মৌলবাদের বিচারে ও সংজ্ঞায় বর্তমান বিশ্বে সে অর্থে কোনো মুসলিম রাষ্ট্রের অস্তিত্বও নেই, এবং সম্ভবও নয়। তথাকথিত আরব মুসলিম দেশগুলো, ইরান এবং শরিয়া আইন দ্বারা পরিচালিত খোদ পাকিস্তানেও নিজ-নিজ জাতিগোষ্ঠীর অনেক প্রচলিত সাংস্কৃতিক ও লোকজ অনুষ্ঠানমালা প্রচলিত। যেমন, ইরানের নওরোজ অনেকটাই বাংলাদেশের নববর্ষের আদলেই পালিত হয়।

আকবরের ফতুল্লাহ সিরাজি এসব বিষয়গুলো বাস্তবে অনুধাবন করেই মুসলিম চান্দ্রবর্ষ এবং এই ব-দ্বীপের সৌরবর্ষের সংমিশ্রণে যে বর্ষপঞ্জি উদ্ভাবন করেন তার ভেতর ইসলামি বর্ষপঞ্জির মূল্যবোধ এবং সংস্কৃত মাসের নাম সংযুক্ত হয়েছে সুদৃঢ়ভাবে, বলতে কী, ইংরেজি গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির চেয়েও বাংলা বর্ষপঞ্জি আধুনিক ও ধর্মনিরপেক্ষ।

পরিহাস বিষয়ে আমার দ্বিতীয় বক্তব্যটি জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বর্তমান পাঠ্যক্রম বিষয়ে। আমরা যারা ষাটের দশকে একটি সার্বভৌম দেশের জন্য আন্দোলন করেছি এবং পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ করেছি তখনকার সুস্পষ্ট মূল্যবোধ, জাতি-চেতনা, সাতন্ত্র্যবোধের অফুরন্ত চর্চা হয়েছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল জীবনানন্দ শরৎচন্দ্র এবং এমন অনেক মহতী সাহিত্যিকদের রচনাসমগ্র পাঠ করে। আমার ভয় হয় যে প্রজন্ম এদের রচনাবলী পাঠ না করে ভবিষ্যতে এদেশের হাল ধরবে তারা এক দুর্বলতম প্রজন্ম হতে বাধ্য। আজ যে ভুল বিশ্বাস প্রতিপালন করে আগামী প্রজন্ম গড়ে তোলার প্রচেষ্টা হচ্ছে তা এই বাঙালি জাতির জন্যে ভয়াবহ হয়ে উঠবে, তারই আগাম সংকেত দেয়ালচিত্রে কালো মবিল।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমি সারা বিশ্বের সবচেয়ে সাহসী মানুষের একজন মনে করি। এর বোধহয় সবচেয়ে বড় কারণ তাঁর পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খোলা রাজনৈতিক চেতনাবোধের স্পর্শ। ওই মানুষটি তাঁর বক্তৃতায়-আলোচনায়-ঘরোয়া বৈঠকে যাদের রচনা থেকে বারংবার উদ্বৃতি দিতেন তাঁরা হলেন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং বাংলার এমন অগণিত কবি-লেখক।

আমি বিশ্বাস করতে চাই না তাঁরই সাহসী কন্যা এমন এক প্রজন্মের তত্ত্বাবধায়ক হোন যারা তাদের ঐতিহ্যবাহী সাহিত্য-সংস্কৃতির মানুষদের বিস্মৃত হবে এর চেয়ে বড় পরিহাসের ঘটনা তাহলে এই বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি ঘটবে না।

আমরা সবাই চাই আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং বর্তমানে বাংলা নববর্ষ যেন কোনোক্রমেই মসিনিন্দিত না হয়, অন্যথায় পুরো বাঙালি জাতিই মিস-আক্রান্ত হয়ে মানবসমাজ থেকে আড়াল হয়ে পড়বে।