মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি কি এই ভুল করবেন?

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 16 April 2017, 04:46 AM
Updated : 16 April 2017, 04:46 AM

বাংলা নববর্ষ পালন নিয়ে কত উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগ। একদিকে মানুষের অসীম আগ্রহ আরেকদিকে দেশের অন্ধকার শক্তির আস্ফালন। বিগত কয়েক বছর ধরে উৎকণ্ঠার কিছু যৌক্তিক কারণও ঘটেছে বৈকি।

গেলবার মঙ্গল শোভাযাত্রার ভেতর ঢুকে পড়া একশ্রেণির ইতর মা-বোনদের সঙ্গে যে অপমানজনক আচরণের চেষ্টা করেছিল, এখন মনে হচ্ছে সেটাও হয়তো ছিল পরিকল্পিত। এরা কারা তা সরকারের অজানা নয়। দেশের বাহিনীগুলোও ভালো করেই জানে এসব দুষ্কৃতি কারা। কিন্তু কী তাদের ভাগ্যে ঘটেছে, কোথায় তারা আজ, আমরা আর কিছুই জানি না। এই আমাদের জাতীয় চরিত্র। যে কোনো ঘটনায় আমরা প্রথমে হামলে পড়লেও কদিন পর সব ভুলে যাই। অথবা ভুলে যাওয়ার আয়োজনগুলো কিংবা নীল নকশায় ভুলিয়ে দেওয়া হয়। এটা তেমন কোনো ঘটনার মতো চাপা পড়ে গেলেও বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখ পড়েছে তোপের মুখে। একবার ভুভুজেলা পরেরবার মুখোশ, এরপর হয়তো মানুষকেই আসতে দেওয়া হবে না। হয়তো বলা হতে পারে: 'মুখোশগুলোই হেঁটে যাবে মানুষের প্রয়োজন নেই।'

অথচ মানুষ অকুতোভয়। বাঙালি এক অনন্ত সম্ভাবনার জাতি। তারা ভাঙে কিন্তু মচকায় না। এবারও তারা তাই করেছে। ঘরের শত্রু বিভীষণের জ্বালায়, তাদের হুংকারে অতিষ্ঠ হওয়ার পরও এই জাতি নিজের জাতিসত্তা ও উৎসবের প্রতি নিবেদিত। তারা খুব ভালো জানে: 'ধর্ম যার যার উৎসব সবার'।

এই স্লোগান সামনে রেখে ধর্ম ও রাজনীতির বাইরে একমাত্র সর্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ তারা বরণ করে নিয়েছে। যে রাজনীতি নারীকে 'তেঁতুল' মনে করে যার চোখে ভাস্কর্য হল 'মূর্তি' এবং যারা এদেশের প্রগতিকে মনে করে সমাজের অধঃপতন তাদের চোখরাঙানি তুচ্ছ করে এবার নারী-পুরুষ সবাই নেমে এসেছিল রাস্তায়।

শুধু তাই নয়, প্রচণ্ড দাবদাহ পাশ কাটিয়ে রাজপথে বা আয়োজনে-অনুষ্ঠানে আসা বাংলাদেশের মানুষের এই নাড়ির স্পন্দন আওয়ামী লীগ ধরতে পারেনি। পারলে পহেলা বৈশাখের আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হেফাজতকে খাতির করে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য সরানোর কথা বলতেন না। তাঁর এই ঘোষণা যে কতটা অপমানজনক এবং হতাশার সেটা হয়তো তিনি নিজেই টের পাননি। কারণ রাজনীতি যখন অচল ও অন্ধ হয়ে যায় যখন তার পথ প্রায় রুদ্ধ হওয়ার পথে তখন আসলে দৃষ্টিময়ী-দৃষ্টিমানও চোখে দেখেন না। হয়তো প্রধানমন্ত্রীও এখন তাই কুয়াশায় আছেন।

সম্প্রতি তিনি ভারত সফর করে ফিরেছেন। তাঁর এই ভারত সফর যে উত্তেজনা ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, মনে হয়, তিনি ইসরায়েল সফরে গেলেও তেমনটা হত না। ভারত একাত্তরের বন্ধু হলেও এখন আর সে জায়গায় নেই দুদেশের সম্পর্ক। ইতোমধ্যে অনেক পানি গড়িয়েছে গঙ্গা-পদ্মায়। সে পানি এসে ঠেকেছে তিস্তায়। বলা ভালো– একদিকে জল, আরেকদিক পানিশূন্য।

সে রাজনীতি শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে ফেলেছে ঘোর বিপদে। মাঝখানে মমতার নামে দাঁড়িয়ে থাকা মমতাহীন রমনীর খেলায় দুদেশের সম্পর্ক যখন গোলমেলে তখন শেখ হাসিনার সফরের যাবতীয় অর্জন প্রায় শূন্য। সাধারণ মানুষ যা বোঝে তা খুব স্পষ্ট আর মোটা দাগের। তা ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত বিরোধিতার যে মাজেজা সেটার কুফলভোগী আওয়ামী লীগ। বিএনপি এর উল্টোদিকে। কিন্তু এর সমাধান কি হেফাজতকে হাত করায়? না তাদের কথামতো দু-চারটি ভুল সিদ্বান্ত নিলেই তারা সুড়সুড় করে আওয়ামী নৌকায় ঢুকে পড়বে? অথচ নিজের ভোটব্যাংক আর প্রগতিশীলতার কথা না ভেবে প্রধানমন্ত্রীর এই কৌশল বা পন্থা অবলম্বন আসলে কিসের ইঙ্গিতবাহী?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি অামাদের বিশ্বাস ও অাস্থার প্রতীক। কে না জানে আপনি বঙ্গবন্ধু কন্যা। এই পরিচয়টি শাসন-ক্ষমতার চাইতে অনেক বড়। কারণ তিনি অামাদের যে দেশটি দিয়ে গেছেন সেটি ছিল কূপমণ্ডুকের হাতে। পাকিদের উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও হীনতার কবল থেকে অামাদের মুক্ত করার নেতা তিনি। তাঁর কন্যা বলে অাপনার ওপর প্রগতির যে ভরসা সেটা এবার 'টাল' খেয়েছে মাননীয়া।

এদেশে অন্ধদের রাজনীতি নতুন কিছু নয়। জামায়াতের মতো মৌলবাদী, ক্যাডারভিত্তিক দলকে সাইজ করেছেন অাপনি। মানবতাবিরোধী রাজাকার যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে ঝোলানো অাপনি কেন হেফাজতের জালে অাটকা পড়বেন? এই হেফাজতের উত্থান কি খুব বেশি দিনের ঘটনা? এদের বাড়বাড়ন্ত হওয়ার কারণ যদি শাপলা চত্বরের ঘটনা হয়তো, সেটিও অাপনি সামাল দিয়েছেন। কিন্তু তখন থেকে এরা লাই পেতে পেতে এখন মাথায় উঠেছে।

শোনা যায় যতবার তারা ক্ষেপে ততবার রেলের জমি, টাকা বা উপঢৌকন দিয়ে বশ করা হয়। এবার তারা পৌঁছে গেছে গণভবনে। গণভবনে তারা যেতেই পারেন। তাদের অাদর্শ বা নীতি তাদের মতো। কিন্তু মুশকিল হল তারা যখন তাদের মনগড়া কাহিনি ও খায়েশের নামে বাংলাদেশকে অন্ধকূপে ফেলতে চায় তখন কি করে সরকার তাতে সায় দেয়?

কোর্টের বাইরে থাকা মূর্তিটি অাসলে ভাস্কর্য। সেটি অাপনি ভালোই বোঝেন। এর সুরত অাদল বা মান নিয়ে কথা থাকতেই পারে। কিন্তু হেফাজতের এজেন্ডা ভিন্ন। তাদের উদ্দেশ্য বলার দরকার পড়ে না। তারা যখন গণভবনে গিয়ে এ অাশ্বাস পায় যে এটি সরানো হবে এবং তা অাপনারও অপছন্দের, নৌকা কিন্তু দুলে ওঠে। কারণ নৌকার মাঝি-মাল্লারা এদেশের সাধারণ ও মুক্তমনের মানুষ।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অাপনি অবগত অাছেন এখন দলের চেয়ে অাপনার ইমেজ বড় ও কার্যকর। আপনি না বললে বা না চাইলে অনেক দরকারি কাজও হয় না। সেখানে অন্ধকার থেকে অালোয় ফেরার জায়গাটা অাপনার হাতে বন্ধ হয়ে গেলে ক্ষমতা থাকলেও ভবিষ্যৎ হাতে থাকবে না। এটা সবাই জানে এই শক্তি বা অপস্রোত নৌকা ডোবানো ছাড়া কোনো কাজে অাসবে না।

একটা গল্প মনে করিয়ে দিই মাননীয়া। এক সাপ অার এক ব্যাঙে দারুণ বন্ধুতা। তাই ব্যাঙ চাইত না সাপটির কিছু হোক। বারবার তাকে বলত, "ভাই অাঁকাবাঁকা চলিস না। সোজা চললেই ভালো থাকবি।"

সাপ হাসত অার বলত, "অামি বিষধর। কেউ অামার কিছু করতে পারবে না। তুই বরং সামলে থাক।"

ব্যাঙ দুদিনের জন্য বেড়াতে গিয়ে ফিরে এসে সাপকে পায় না। খুঁজতে খুঁজতে দেখে সটান সোজা হয়ে শুয়ে অাছে। ব্যাঙ মনে মনে ভাবলো, বাহ এইতো সুমতি হয়েছে। কাছে গিয়ে কথা বলে নেড়েচেড়ে দেখে সাপটা মরে সোজা হয়ে গেছে। তখন সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, "জীবনে সোজা হলি না মরার পর সোজা হয়ে কি লাভ রে শয়তান!"

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাপ কখনও সোজা হয় না। অাপনি যতই ছাড় দিন ওরা ছোবল মারবেই। যে অাপনি 'অানন্দলোকে মঙ্গলালোকে' গান, তাঁকে ওরা কখনও ছেড়ে কথা বলবে না। অাপনি ভুল করলে দেশ ও জাতির কী হবে, সেটা নিশ্চয়ই অাপনি জানেন। অামরা অাপনার মুখ চেয়ে অাছি।

আহমদ ছফার সেই লাইনগুলো মনে করছি:

"আওয়ামী লীগ জিতলে শুধু আওয়ামী লীগ জিতবে। আর তারা হারলে সমগ্র দেশ ও জাতি হেরে যায়।"

প্রধানমন্ত্রী আপনি নিশ্চয়ই এমন ভুল করবেন না। করলে এদেশের ভবিষ্যৎ কবে কখন কিভাবে হারিয়ে যাবে কেউই বলতে পারে না।