ভাস্কর্য কেন সরাতে হবে?

আকতার হোসেন
Published : 16 Nov 2011, 06:54 AM
Updated : 17 April 2017, 03:02 PM

সুপ্রিম কোর্টের চত্বর থেকে 'লেডি জাস্টিস' নামে খ্যাত গ্রিক দেবী থেমিসের ভাস্কর্য সরিয়ে নিতে দাবি করে আসছে হেফাজতে ইসলামসহ কিছু ইসলামি সংগঠন। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জাপান, ব্রাজিল, ইতালি, জার্মানি, কানাডা, ইরান, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আদালত প্রাঙ্গন, ডাকটিকেট কিংবা মুদ্রায় 'লেডি জাস্টিসের' ভাস্কর্য রয়েছে। সেটা মনে করেই হয়তো কারও মাথায় এল বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের চত্বরে কেন 'লেডি জাস্টিসের' ভাস্কর্য স্থাপন করা হবে না। সেই থেকেই হয়তো শুরু এবং ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে লেডি জাস্টিসের বাংলা ভার্সন স্থাপন করা হয়। যার উদ্বোধন করেছিলেন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি।

যদিও ভাস্কর্য নির্মাতা মৃণাল হক বলেছেন, এই ভাস্কর্য কোনো গ্রিক দেবীর মূর্তি নয়, বরং ন্যায়বিচারকের ভূমিকায় বাঙালি নারীর অবয়ব। তাই এই ভাস্কর্য সরিয়ে নিলে 'আত্মসমর্পণ' করা হবে।

ভাস্কর্য নির্মাতা তাঁর বক্তব্য দিয়েছেন অথচ বিভিন্ন লোক এখনও বলছে, লেডি জাস্টিসকেই বাঙালি করার প্রচেষ্টায় শাড়ি পরিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে। অনেকের মতে, ভাস্কর্যটি বাংলার শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। শাড়ি পরালেই যে বাঙালি হয় না সেটা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের দিকে তাকালেই দেখা যায়। ইন্দিরা গান্ধী, সোনিয়া গান্ধী কি বাঙালি?

সবচেয়ে বড় কথা, বাঙালি নারীর হাতে গ্রিক বা আরব দেশের তরবারি তুলে দিয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। তরবারি, সে যে কাজের প্রতীকই হোক না কেন, বাঙালি নারীর হাতে বেমানান। ইতিহাস খুললে কোনো বিপ্লবী বাঙালি নারীর হাতে তলোয়ারের ছবি পাওয়া যাবে না।

ভাস্কর্য স্থাপিত হবার পর থেকে বিরোধী পক্ষ হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে হিংস্র হয়ে উঠেছে। তারা বলছে, ৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশের প্রধান আদালতে এমন ভাস্কর্য থাকতে পারে না। অতএব, এটা সরিয়ে নিতে হবে। মূলত দুটি কারণ দেখিয়েছে ওরা। প্রথমত, সংখ্যাগুরু মুসলমান দেশের প্রধান বিচারালয়ে কেন মূর্তি থাকবে? দ্বিতীয়ত, জাতীয় ঈদগাহের পাশে এমন ভাস্কর্য মেনে নেওয়া যায় না।

উল্লেখ্য যে, ভাস্কর্যকে কখনও মূর্তি বলে উল্লেখ করা হচ্ছে, আবার ক্ষণে ক্ষণে সেটা বদলিয়ে ভাস্কর্য হয়ে যাচ্ছে। আশা করি যারা মূর্তি ও ভাস্কর্য নিয়ে মতামত দিচ্ছেন তারা এই দুটির মধ্যে পার্থক্য জানেন। বিষয়বস্তু সংক্ষিপ্ত করতে তাই এ নিয়ে আলোচনা করব না।

উপরের যুক্তিতে যদি সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে ভাস্কর্যটি সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে কোথায় যাবে? সংখ্যাগুরু মুসলমানের দেশ বলে বাংলাদেশ বিবেচ্য হলে সেই বাংলাদেশ তো সর্বত্র। পার্ক? সেখানে কি মুসলমান যায় না। চারুকলা ইন্সটিটিউটের ভেতর কোথাও রেখে দিবে? চারুকলা ইন্সটিটিউটের পাশে কি মসজিদ নেই বা চারুকলার ছাত্রছাত্রীরা কি মুসলমান নয়? কতটুকু দূর হলে ভাস্কর্য তার প্রভাব হারায়?

অন্যদিকে জাতীয় ঈদগাহের পাশে গ্রিক দেবতার ভাস্কর্য মেনে নেওয়া না গেলে জাতীয় ঈদগাহের পাশে লর্ড কার্জনের নামে এত বড় একটি দালান রয়েছে, এই অমুসলিম নাম কি ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে কোনো অসুবিধা সৃষ্টি করবে না?

এভাবেই এগুচ্ছে নানান প্রশ্ন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্প্রতি বক্তব্যে ফুটে উঠেছে গ্রিক দেবতার ভাস্কর্য বাংলাদেশের জন্য কতটুকু প্রযোজ্য। যে স্থানে ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছে সেখানে কয়েক মাস আগেও এটি ছিল না। বহুযুগ ধরে গ্রিক দেবতার ভাস্কর্য যেখানে অনুপস্থিত ছিল সেখানে কি ন্যায়বিচার হয়নি? হঠাৎ কেন সেখানে একে বসানো হল? ন্যায়বিচারের মানদণ্ড হিসেবে সুপ্রিম কোর্টে তো 'দাঁড়িপাল্লা' রয়েছে, আবার ভাস্কর্যের কী প্রয়োজন?

তিনি বলেছেন, এটা সরানোর জন্য প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলবেন। প্রশ্ন হল, ভাস্কর্য কেন সরাতে হবে? ইরানের মতো একটি মুসলিম দেশের আদালতেও লেডি জাস্টিসের ভাস্কর্য রয়েছে। এছাড়া সৌদি আরবসহ বিভিন্ন মুসলিম-অধ্যুষিত দেশে মানব ও প্রানিদের প্রচুর ভাস্কর্য রয়েছে। বাংলাদেশ একটি ভাস্কর্য নিয়ে এত উত্তাল কেন?

পাকিস্তান আমলে আমরা যখন সিনেমা দেখতাম– বিশেষ করে মোহাম্মদ আলী, ওয়াহিদ মুরাদের সিনেমা– তখন আদালতের দৃশ্যে দেখা যেত কালো কাপড়ে চোখ বাঁধা লেডি জাস্টিসের ভাস্কর্য। তখন হেফাজতে ইসলাম ছিল না বলে হয়তো কেউ প্রশ্ন তুলেনি। কিন্তু আমরা এখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাকিস্তান আমলের চেয়েও অনেক বেশি মুসলমান হয়ে যাচ্ছি। ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে কোনো কার্যক্রম নেই, অথচ ইসলামি ধর্মীয় ভাবনা প্রসারে চলছে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ। সম্প্রতি স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে সংযোজিত বিষয়াদি এবং রাস্তাঘাটে চলাফেরা করলেই এ কথার সত্যতা বুঝতে অসুবিধা হয় না।

প্রধানমন্ত্রী যখন উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি একটা সুরাহা করবেন বলে মনে হচ্ছে। এক পক্ষ আপাতত খুশি হলেও হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে লেডি জাস্টিসের ভাস্কর্যই শুধু নয়, অন্য যে কোনো ভাস্কর্য সরিয়ে নিলে বা ভেঙে ফেললে যে নৈতিক প্রশ্ন এসে উপস্থিত হবে তা হল, রাষ্ট্র কি অনির্বাচিত একটি বিশেষ গোষ্ঠীর হাতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষমতায়ন করছে?

আপোষকামিতা আর সমঝোতা এক কথা নয়। কাজেই গ্রিক ভাস্কর্য এখন উপলক্ষ মাত্র। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বাস্তবায়নে হেফাজতে ইসলামসহ মৌলবাদী দল ও গোষ্ঠীর রয়েছে বিরাট তালিকা। এরা হয়তো এরপর দেশের সব মূর্তি এবং ভাস্কর্যের দিকে ইঙ্গিত করবে। ভোটের আগে পাতের ভাত জোগাড় করতে আমরা কি শুধু আপোষ করতেই থাকব?

বাংলাদেশ উন্নতি করছে ঠিকই এবং সেই উন্নতি অতীতের সব সরকারের চাইতে বর্তমান সরকারের আমলেই বেশি দেখা যাচ্ছে। তবে মনে রাখতে হবে, উন্নয়ন বলতে শুধু অবকাঠামো ও পরিসংখ্যানের সূচক নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলে হবে না। প্রকৃত উন্নয়ন আসবে মানুষের ভাবনা-চিন্তা ও শিক্ষা (পাশের হার নয়) থেকে। কেননা চেতনা হল সমস্ত শক্তির স্থায়ী ঠিকানা। ভূমিকম্প এসে যদি অট্টালিকা গুঁড়িয়ে দেয় তাহলে উন্নয়নের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ মননের শক্তি কোনো আঘাতে ভাঙে না। আমাদের প্রয়োজন সেই শক্তির দিকে নজর দেওয়া।

মনে পড়ছে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর দীর্ঘদিন ঢাকাবাসীকে কার্ফুর মধ্যে থাকতে হয়েছিল। সেই সময় ঢাকার জিপিওর পাশেও একটা ভাস্কর্য গড়ে উঠছিল। নগরবাসী আশা করেছিল যে কোনো দিন সেটা উন্মুক্ত করা হবে। কিন্তু একদিন কার্ফুর মধ্যে, মানে রাতের আঁধারে প্রকাণ্ড সেই ভাস্কর্য কারা যেন গোড়া থেকে কেটে নিয়ে গেল। যেটা কাটতে বা সরাতে বিরাট যন্ত্রপাতি এবং বড় বড় যানবাহনের প্রয়োজন হবার কথা। এদিকে কার্ফু চলাকালীন জনগণ বাইরে যেতে পারে না। কাজেই বোঝা গেল কী হল এবং কেমন করে রাষ্ট্রীয় সহায়তায় সেই ভাস্কর্য হারিয়ে গেল।

তারপর তো অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। চোখের সামনে বলাকা এবং লালন ভাস্কর্য হারিয়ে গেল। তাই ভয় হয়, কখন হাতুড়ির আঘাত লাগে 'অপরাজেয় বাংলা'সহ বাংলা ভাষা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গড়ে ওঠা শহীদ মিনার ও ভাস্কর্যগুলোর উপর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে অবস্থিত 'অপরাজেয় বাংলা' কিংবা শহীদ মিনারের গায়ে হাত দিলে বাংলাদেশে যে একটা গৃহযুদ্ধ বেঁধে যাবে তাতে সন্দেহ নেই। সরকার যেভাবে মৌলবাদীদের কাছে নতজানু হচ্ছে তাতে অনেকে ভরসা হারিয়ে ফেলেছে। মৌলবাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা কতদিন টিকে থাকে সেটাই দেখার বিষয়। প্রশ্নগুলো বর্তমান সরকারের একনিষ্ঠ কর্মীদের মুখেই শোনা যাচ্ছে।

ভাস্কর্য বলা হলেও হেফাজতের আসল দৃষ্টি মূর্তির দিকে। তাই মাঝে মাঝে ভাস্কর্য হয়ে যাচ্ছে মূর্তি। খুব জানতে ইচ্ছে করে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মূর্তি কেন গাত্রদাহ হয়ে উঠেছে? মূর্তিপূজা বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মগোষ্ঠীর অধিকার। যে কোনো মূর্তি ভাঙা মানেই সংবিধান লঙ্ঘন থেকে শুরু করে একের পর এক অবিচার করা। কোনো উচ্চমাপের মুসলমান ধর্মীয় নেতার পক্ষে এটা মেনে নেওয়া ঠিক হবে না। অথচ ধর্মীয় নেতারাই আজ প্রশ্নবিদ্ধ।

আফগানিস্তানের বৌদ্ধ মূর্তি কামান দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে কী শান্তি ও সৌহার্দ্য পাওয়া গেছে কেউ কি তার হিসাব দিতে পারবে? নিজেদের মধ্যে হানাহানি করার আগের দিনগুলোতে সেই বৌদ্ধ মূর্তি আফগানিস্তানে কারও চক্ষুশূল হয়ে ওঠেনি। এমন কথাও শোনা যায়নি যে, একজন মুসলমান বিরাট আকৃতির মূর্তির জন্য ধর্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল। তাই মূর্তি ভাঙার কুফলও বিবেচনা করে দেখতে হবে। মনে রাখতে হবে, যদি কারও ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করা হয় তবে অন্যজনও সেই আঘাত করতে পারে। নিজ দেশে না হলে পরদেশে।

প্রসঙ্গক্রমে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে যে, হযরত মোহাম্মদ (সা:)সহ ইসলাম ধর্মের আদি অনুসারীরা মূর্তির মধ্যেই ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছিলেন। হযরত মোহাম্মদ (সা:) কাবা ঘরে যেতেন যেখানে ছিল অনেক মূর্তি। সুখে-দুঃখে তখন কাবাই ছিল সেই অঞ্চলের লোকজনের একমাত্র ভরসার স্থান। অথচ বাল্যকালে তিনি কোনো মূর্তি ভাঙার চেষ্টা করেছিলেন বলে শোনা যায় না।

আরবের মুসলিম ইতিহাস পড়লে দেখা যায়, কাবা ঘরকে একাধিকবার পুনর্গঠন করতে হয়েছিল। একবার কাবা মেরামতের পর 'কালো পাথর' উঠিয়ে কে সেটাকে নির্ধারিত স্থানে পুনঃস্থাপন করবে এই নিয়ে যখন মুল গোত্রের নেতারা একমত হতে পারছিল না এবং প্রায় সংঘাত পর্যায়ে চলে এসেছিল তখন বলা হল, পরবর্তী যে ব্যক্তি কাবা ঘরে প্রবেশ করবে আমরা তার পরামর্শ মেনে নিব। সেই পরবর্তী ব্যক্তিটি হলেন তখনকার মোহাম্মদ (সা:)। তিনি বিচক্ষণতা দিয়ে বললেন, কালো পাথরটি একটি চাদরের মাঝখানে রাখা হোক এবং চার গোত্র প্রধান সেটা বহন করে নিয়ে যাক। এভাবেই তিনি সমস্যার সমাধান করে দিলেন।

তখন কি তিনি কাবার মূর্তিগুলো দেখে মুখ ফিরেয়ে নিয়েছিলেন কিংবা দাবি করেছিলেন যে, আমি সমাধান দিব, তোমরা যদি একটি মূর্তি ভেঙে ফেল?

ইসলাম আবির্ভাবের পরের কথা হল, হিজরতের পর মদিনাতে গিয়ে হযরত মোহাম্মদ (সা:) 'মসজিতুল নবী' স্থাপন করেন। যেখানে ইহুদি-খ্রিস্টান ও পৌত্তলিক পূজকসহ সকলের প্রবেশের অধিকার ছিল এবং একই স্থানে মুসলমানেরা নামাজ পড়তেন। এই মসজিদে বসেই বিভিন্ন ঘটনা ও দ্বন্দ্বের বিচার-মীমাংসা করতেন নবী (সা:)। এটাই ছিল তাঁর দপ্তর। অন্য ধর্মে বিশ্বাসীদের নিজদের মধ্যে মীমাংসায় পৌঁছে দিতে তিনি সেই ধর্ম বা গোত্রের বিচক্ষণ ব্যক্তিদের মতামতও নিতেন।

এছাড়া সেই মদিনা মসজিদে বসে তিনিসহ অন্যান্য মুসলমানেরা জেরুজালেমে অবস্থিত বায়তুল মোকাদ্দাস মুখি হয়ে নামাজ পড়তেন। এরপর যখন তাঁর উপর নির্দেশ এল, (সূরা ২ / ১৪২-১৪৪) তিনি কেবলা ঘুরিয়ে মক্কায় অবস্থিত কাবা ঘরের দিকে মুখ করে নামাজ পড়তে শুরু করলেন। বাস্তবতা হল, তখনো কিন্তু কাবা ঘরের মধ্যে চন্দ্র দেবতা হুবালসহ ৩৬০টি মূর্তি ছিল। মূর্তি থাকা অবস্থায় কেবলা কাবামুখী হয়েছিল এবং মক্কা বিজয়ের আগ পর্যন্ত প্রায় আট বছরেরও অধিক সময় মূর্তিসহ কাবামুখী হয়ে নামাজ পড়েছেন নবীর নেতৃত্বে সে সময়কার মুমিনেরা।

স্বভাবতই মনে হতে পারে, মূর্তির অবস্থান কাবাতে থাকলেও মনের চিন্তা ছিল আল্লাহ কিংবা আল্লাহর পবিত্র ঘর কাবার প্রতি। এখানেই প্রশ্ন এসে যায়, আজ কেন মূর্তি দেখে আমদের ধর্মীয় ইমান ও বিশ্বাস স্থির থাকতে পারে না। কীসের এত ভয়?

বিদেশে প্রায় প্রতিটি হাসপাতালে একটা নির্জন কক্ষ বা প্রেয়ার রুম থাকে। হাসপাতালের বিছানায় পড়ে থাকা আপনজনের রোগ মুক্তির জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে যে যার ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে প্রার্থনা করে। তাই সেই নির্জন কক্ষে বিভিন্ন ধর্মের মূর্তিসহ জায়নামাজও বিছানো থাকে। একই কক্ষে মূর্তি পাশে রেখে নামাজ আদায়ের দৃশ্য নতুন কিছু নয়। ঈদ এলেই দেখা যায় ভারতের কিছু কিছু মন্দির মুসলমানদের জামাতের জন্য খুলে দেওয়া হয়। তখন কিন্তু মূর্তিগুলো মন্দিরের ভেতরেই থাকে। কোনো আড়াল কিংবা ঢেকে রাখাও হয় না। কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখলে পূজার মূর্তিগুলো ক্ষমতাহীন হয়ে যাবে এমনটা কিছু কিছু মুসলমান বিশ্বাস করলেও একজন হিন্দু সেটা বিশ্বাস করবে না।

আমরা জানি হযরত মোহাম্মদ (সা:) ইসলাম ধর্ম প্রচারের প্রথমদিকে নানা অত্যাচার জুলুম সহ্য করেছেন। যারা তাঁর পক্ষ নিয়েছিল তাদের সামাজিক বয়কট থেকে শুরু করে শারীরিক নির্যাতনসহ ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। অনেককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া মক্কাবাসী একের পর এক যুদ্ধ করেছে মুসলমানদের সঙ্গে। কিন্তু মক্কা বিজয়ের পর হযরত মোহাম্মদ (সা:) প্রতিশোধ না নিয়ে অমুসলিমদের অভয় দিয়েছিলেন যে, তাদের ভয় নেই। রক্তপানের দেশে এই শান্তির বাণী আজও বিশ্বের সর্বত্র প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখা হয়।

এর আগে হযরত মোহাম্মদ (সা:) একবার হজ্জ করার উদ্দেশ্য নিয়ে মক্কা অভিমুখে রওনা হন। কিন্তু কুরাইশদের বাধার কারণে হজ্জ না করে মদিনাতে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। ফিরে যাবার আগে 'হুদাইবিয়ার সন্ধি' নামে মক্কাবাসীদের সঙ্ড়ে একটি সন্ধি করেছিলেন তিনি। সেই সন্ধি মোতাবেক পরের বছর তিন দিন মক্কায় অবস্থান করে মুসলমানেরা হজ পালন করেছিল। তখনও ৩৬০টা মূর্তি ছিল কাবা ঘরে।

এরপর দশ হাজার লোকের বিরাট দল নিয়ে তিনি মক্কা অভিমুখে যাত্রা করে বিনা বাধায় মক্কা জয় করে নেন। এবারই তিনি কাবাতে স্থাপিত সবগুলো মূর্তি ভেঙে ফেলেন। জানা মতে, মক্কা বিজয়ের পর কাবার মূর্তি ভাঙার জন্য কোনো অহি আসেনি। সেটা যদি সত্যি হয় তাহলে প্রশ্ন জাগে, ছোটখাট বিষয়সহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সমূহ সমাধানের জন্য যখন আল্লাহ আয়াত নাজেল করতেন, কাবা ঘরের মূর্তি ভাঙা-সংক্রান্ত তাৎক্ষণিক কোনো আয়াত তিনি পাঠালেন না কেন? অতএব বলা যেতে পারে যে, হযরত মোহাম্মদ (সা:) নিজ সিদ্ধান্তেই এই কাজ করেছিলেন।

ইসলাম ধর্মের কট্টর বিশ্বাসীদের বলব, যেহেতু পৃথিবীর সব লোককে কোনো উপায়েই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করতে পারবেন না, সেহেতু সকলকে ভালোবাসা দিয়ে জয় করতে চেষ্টা করুন। কোরান হাদিস অন্যকে ধ্বংস করতে বলেনি। পবিত্র কোরানে বলা হয়েছে: (সূরা ২ আয়াত ২৮৫) মুসলমানরাও সবাই বিশ্বাস রাখে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর গ্রন্থসমূহের প্রতি এবং তাঁর পয়গম্বরগণের প্রতি। তারা বলে আমরা তাঁর পয়গম্বরদের মধ্যে কোনো তারতম্য করি না।

সূরা ২২ আয়াত ১৭– যারা মুসলমান, যারা ইহুদি, সাবেয়ী, খ্রিস্টান, অগ্নিপূজক এবং যারা মুশরেক, কেয়ামতের দিন আল্লাহ অবশ্যই তাদের মধ্যে ফায়সালা করে দেবেন। সব কিছুই আল্লার দৃষ্টির সামনে।

কাবা ঘরের মূর্তি মক্কা বিজয়ের পর ভাঙা হলেও পৃথিবীর সব মূর্তি ভাঙতে বলেননি হযরত মোহাম্মদ (সা:)। তাহলে আজ পৃথিবীতে এত মূর্তি থাকত না। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর 'দৈনিক পাকিস্তান' পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় 'দৈনিক পাকিস্তান' কেটে তার নিচে লিখা হয়েছিল 'দৈনিক বাংলা'। ১৯৭১-৭২ সালের প্রথমদিকে দলিল দস্তাবেজে যেখানে দেশের নাম পাকিস্তান লেখা থাকত সেই স্থানে রাবার স্ট্যাম্পে বাংলাদেশ ঠুকে দেওয়া হত।

বিপ্লবের পর নতুন শাসনের গোড়াপত্তনের সময় পূর্ববর্তী শাসন ক্ষমতা থেকে সরে আসা একটি রাজনৈতিক প্রথা। কাবাতেও তাই হয়েছিল, সেটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, মুসলমানদের সারা জীবন শুধু মূর্তি ভেঙে যেতে হবে। অতএব চিন্তা-ভাবনা করে নির্দেশনা দিতে হবে কী করে সহঅবস্থান করা যায় এবং অন্য ধর্মের বিশ্বাসীরা যেন মনে না করে যে, তাদের অপমান ও অসম্মান করা হচ্ছে।

মোট কথা কারও ধর্মবিশ্বাসে আঘাত না করা। ভুলে যেতে হবে যুদ্ধজয়ের জন্য যেসব যুদ্ধ কৌশল বলা আছে (সূরা ২ আয়াত ১৯১, সূরা ৮ আয়াত ১২) সেগুলো শান্তিপূর্ণ অবস্থানে প্রচার না করার এবং যুদ্ধে অবস্থানরত হুমক না দেওয়া।

যুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষও করেছে। অ্যামব্যুশ করা, অতর্কিত আক্রমণ, সঠিক লক্ষ্যে তাক করাসহ নানা কৌশল শেখানো হয়েছিল যুদ্ধজয়ের জন্য। কিন্তু যুদ্ধ শেষ তো সব শেষ। এখন সেই যুদ্ধকালীন সময়ের একটি কৌশল ব্যবহারও আইনের চোখে অপরাধ।

অনেকে হয়তো পবিত্র কোরান থেকে উদ্ধৃতি দিবেন। যেমন ধরুন সূরা ২১ (৫৮), সূরা ২২ (৩০) সূরা ১৪ (৩৫)। কিন্তু খণ্ড খণ্ড অংশ উল্লেখ না করে মূর্তি ভাঙা-সংক্রান্ত যে আয়াতগুলো আছে সেগুলো ভালো করে পড়লে বোঝা যাবে যে, সেগুলো অন্য গোত্র, অন্য পরিস্থিতি উল্লেখ করে বলা হয়েছে। একটা জিনিস ভুলে গেলে চলবে না যে, কোরানের কিছু বাণী উপদেশ, আবার কিছু বাণী উপমা। সূরা ৩ আয়াত ৭– তিনিই আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন। তাতে কিছু আয়াত রয়েছে সুস্পষ্ট, সেগুলোই কিতাবের আসল অংশ। আর অন্যগুলো রূপক।

সূরা ১৪ (২৪) তুমি কি লক্ষ্য কর না, আল্লাহ তা'আলা কেমন উপমা বর্ণনা করেছেন।

সূরা ১৪ (২৫) আল্লাহ মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেন যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে।

কাজেই যত্রতত্র কোরানের বাণীর ভুল ব্যাখ্যা সমস্যা দূর করার বদলে নতুন সমস্যা ডেকে আনতে পারে। যেমন সূরা ১৪ (৩২); তিনিই আল্লাহ, যিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃজন করেছেন এবং আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে অতঃপর তা দ্বারা তোমাদের জন্য ফলের রিজিক উৎপন্ন করেছেন এবং নৌকাকে তোমাদের আজ্ঞাবহ করেছেন..। এই শেষের অংশটুকু যেখানে বলা হচ্ছে নৌকাকে তোমাদের আজ্ঞাবহ করেছেন.. এই আয়াত যদি নির্বাচনী প্রচারে লাগিয়ে ভুল ব্যাখ্যা করতে থাকে তখন কি বিভ্রান্তি ছড়াবে না?

ইসলাম ধর্মের অন্যতম দীক্ষা হল 'লা শারিক আল্লাহ' মানে আল্লাহর কোনো শরিক নাই বা অন্য কেউ আল্লাহ সমকক্ষ নয়। একাধিকবার পবিত্র কোরান শরিফে এই কথাটা বলা হয়েছে। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলতে চাই বিশ্বাস অটুট থাকলে কোনো কিছু আল্লাহর সমতুল্য মনে করা উচিৎ নয়। অন্য কেউ আল্লাহর সমতায় অবস্থান করছে মেনে নিলে সে আর মুসলমান থাকে না।

যে যার বিশ্বাস নিয়ে থাকুক না কেন, বৈরিতার কী প্রয়োজন? আর ভাঙাভাঙির দরকারটা কী? তবু যদি সুপ্রিম কোর্ট চত্বরের ভাস্কর্যটি মূর্তি মনে করে সরিয়ে নেওয়া হয় বা ভেঙে ফেলা হয় তাতে রাজনৈতিক কৌশলগত লাভক্ষতি বিচার করা ছাড়া ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে লাভক্ষতির সম্ভাবনা প্রশ্নবিদ্ধ থেকেই যাবে। মনে রাখতে হবে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে তুলতে কাঁটা ভেঙে শরীরের ভেতর ঢুকে গেলে সেপটিক হবার আশঙ্কা থাকে।

অন্য একটি খবর হল, মূর্তির নামে কিন্তু ইতোমধ্যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তুলে নেবার দাবি করা হচ্ছে। এই যাত্রায় রক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। তিনি পারলে বঙ্গবন্ধুর কন্যা পারবেন না কেন? বঙ্গবন্ধুর কন্যা বাংলাদেশ থেকে ভাস্কর্য সরিয়ে নেবার পক্ষে দাঁড়ালে ভারতে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যও সরে যেতে পারে এবং বাংলাদেশে শুরু হবে নতজানুতার যুগ। অতঃপর লেখা থাকবে সেইসব নাম যিনি এগিয়ে এসেছিলেন অথবা এগিয়ে আসেননি মঙ্গলের জন্য।

দাঁড়িপাল্লা থেকে বাটখাড়া উঠিয়ে নিলে হেলে-দুলে ওঠে ন্যায়নীতি। ক্ষমতায় থেকেও শক্তি হারিয়ে ফেললে জন্ম নেবে অপশক্তি। অতএব শক্ত হতে হবে। শক্ত হোন।