যদি জাপান পারে, আমরা কেন নয়?

সাজ্জাদুল হাসান
Published : 11 April 2017, 04:19 AM
Updated : 11 April 2017, 04:19 AM

সত্তরের দশকের শুরু থেকে পশ্চিমা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসমূহ বিশেষ করে উৎপাদন খাত জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ব্যাপক প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। ধীরে ধীরে এবং অনেকটা নিশ্চিতভাবেই জাপানি পণ্যসমূহ বাজারের দখল নিতে থাকে। তাদের সাফল্যের এ অগ্রযাত্রা ঈর্ষণীয়ভাবে অব্যাহত রাখে এবং কিছুদিনের মধ্যেই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে সক্ষম হয়। জাপানের অর্থনীতির এই অভাবনীয় উন্নতির শুরুটা হয় পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে। সমগ্র বিশ্ববাসী হতবাক! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত ও  ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি দেশ কী করে এত দ্রুত নিজেদের ব্যর্থতার গ্লানি পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্রে দীক্ষিত হল?

পশ্চিমা থিংকট্যাংক কিছুটা বিচলিত, কেননা বাজারের উপর জাপানি পণ্যের সুস্পষ্ট আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল। সেই সময়ে 'এনবিসি টেলিভিশন'-এ কর্মরত রিপোর্টার লয়েড অ্যালেন ডোবিনস জাপানের এই বিস্ময়কর উন্নতির রহস্য উন্মোচনে সচেষ্ট হলেন। তিনি তাঁর গবেষণার অংশ হিসেবে সশরীরে জাপান গেলেন। ব্যাপক অনুসন্ধানের পরে তিনি যা আবিষ্কার করলেন তা ছিল আরও বিস্ময়কর! জাপানের এই অভাবনীয় অগ্রযাত্রার বীজ বপন করেছেন একজন আমেরিকান– উইলিয়াম এডওয়ার্ড ডেমিং!

১৯৮০ সালে 'এনবিসি টেলিভিশন' যখন রিপোর্টার লয়েড অ্যালেন কর্তৃক তৈরি প্রতিবেদনটি ('If Japan can, why can't we?') প্রচার করে, কেবলমাত্র তখন এই তথ্য সবার গোচরীভূত হয়। কে এই ডেমিং?

যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া অঙ্গরাজ্যের সিউক্স শহরে ডক্টর উইলিয়াম এডওয়ার্ড ডেমিংয়ের জন্ম হয় ১৯০০ সালে। ১৯২১ সালে তিনি উয়োমিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তড়িৎ প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৫ সালে স্নাতকোত্তর এবং ১৯২৮ সালে বিখ্যাত ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগে একজন গাণিতিক পদার্থবিদ (Mathematical Physicist) হিসেবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ডেমিং মার্কিন সমীক্ষা ব্যুরোতে পরিসংখ্যান বিষয়ক পরামর্শক (Statistical Consultant) হিসেবে কাজ করেন। তিনি সুদীর্ঘ কাল (১৯৪৬- ১৯৯৩) নিউ ইউর্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ব্যাবসা প্রশাসন ফ্যাকাল্টিতে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ড. ডেমিং বিভিন্ন সময়ে বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহে পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেছেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে মিত্র বাহিনী (Allied Force) জাপানের পুনর্গঠনে সহায়তা প্রদানের অংশ হিসেবে একটি সমীক্ষা করার পরিকল্পনা করে। মার্কিন সেনাবাহিনীর অনুরোধে ড. ডেমিং এই সমীক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব নিতে সম্মত হন। জাপানে তাঁর অবস্থানকালে স্থানীয় বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলীদের ইউনিয়নের আমন্ত্রণে তাদের সদস্যদের সংখ্যাতাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণের (Statistical Control) উপর প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। ১৯৫০ সালের জুন থেকে অগাস্ট– এই তিন মাসে শত শত জাপানি প্রকৌশলী, ব্যাবস্থাপক ও বিভিন্ন পেশাজীবী পরিসংখ্যান প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ (Statistical Process Control – SPC) এবং মান নিয়ন্ত্রণ (Quality Control) পদ্ধতির উপর প্রশিক্ষণ লাভ করেন।

ওইসব প্রশিক্ষণের মূল বক্তব্য কী ছিল, যা পরবর্তীতে জাপানের অর্থনৈতিক উন্নতিতে অসামান্য অবদান রাখে?

ড. ডেমিং বারংবার একটি বিষয়ের উপর জোর দেন: পণ্যের গুণগত মানবৃদ্ধি উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে সাহায্য করে এবং সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পায় উৎপাদনশীলতা, যা ব্যাবসায়ীক সমৃদ্ধির জন্য একান্ত প্রয়োজন।

পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ডেমিং একটি যুগান্তকারী তত্ত্বের অবতারণা করেন। তাঁর সেই তত্ত্বের চারটি প্রধান বিষয়: পদ্ধতিগত চিন্তা (system thinking), তারতম্য (variation), জ্ঞান তত্ত্ব (theory of knowledge) এবং মনস্তত্ত্ব (psychology)।

পদ্ধতিগত চিন্তা বলতে সমগ্র প্রক্রিয়াগত বিষয়কে বোঝানো হয় যেখানে সরবরাহকারী, উৎপাদনকারী এবং ভোক্তা সবার ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক প্রক্রিয়ায় কিছুটা তারতম্য হয়। এই তারতম্য যতটা সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা যায় পণ্যের মান বজায় রাখার জন্য তা ততটাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

যে কোনো পণ্য বা প্রক্রিয়ার উন্নতিকল্পে জ্ঞানের কোনো বিকল্প নেই। শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হলে নিত্যনতুন গবেষণার উপর দিতে হবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। ডেমিংয়ের মতে, পরিকল্পনা (plan), বাস্তবায়ন (do), চর্চা (study) ও ক্রিয়া (act)– এই চক্র সামগ্রিক জ্ঞানবৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। যে কোনো প্রতিষ্ঠানের সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করে সেই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়সমূহ বিশেষ করে তাদের প্রণোদনা, উৎসাহ ও উদ্দীপনার উপর।

উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জাপানি উদ্যোক্তা ড. ডেমিংয়ের তত্ত্বের সফল প্রয়োগ করেন। ফলে অর্জন করেন অভাবনীয় সাফল্য। তাদের সফলতার মূল মন্ত্র ছিল পণ্যের গুণগত মান ও উৎপাদনশীলতা, যার ফলে তারা সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্পন্ন পণ্য ভোক্তার হাতে তুলে দিতে সক্ষম হন। সৃষ্টি হয় নতুন এক বাজার যা তাদের নিয়ে যায় উত্তরোত্তর সফলতার দিকে।

জাপানের এই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মতো এক উদীয়মান অর্থনীতির জন্য হতে পারে ভীষণ কার্যকরী। আমরা সবাই অবগত আছি, বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশের আশু উন্নয়নের ব্যাপারে বেশ আশাবাদী। গোল্ডম্যান স্যাকস এবং অর্থনীতিবিদ জিম ও'নেইল কর্তৃক পরিচালিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় প্রকাশ: একবিংশ শতাব্দীর বৃহৎ ১১টি অর্থনীতির একটি হবে বাংলাদেশ।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রভাবশালী অনলাইন সংবাদমাধ্যম 'বিজনেস ইনসাইডার' এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে 'এশিয়া মহাদেশের বাঘ' হিসেবে অভিহিত করেছে।

অবারিত এই সম্ভাবনা বাস্তবে পরিণত করতে গেলে এখন থেকেই নিতে হবে সঠিক উদ্যোগ। বিশেষজ্ঞদের মতে, রপ্তানিমুখী উৎপাদন খাত হবে আমাদের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির নিয়ামক। সেক্ষেত্রে পণ্যের মান আর উৎপাদনশীলতা হবে সাফল্যের চাবিকাঠি।

ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়াসহ আফ্রিকা মহাদেশের মিসর, কেনিয়া কিংবা নাইজেরিয়ার মতো বিভিন্ন দেশ হবে আমাদের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমাদের যাত্রাপথ কুসুমাস্তীর্ণ হবে না, বরং আমাদের তৈরি হতে হবে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের জন্যে। এ লড়াই হবে সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহের। আমাদের সামগ্রিক উৎপাদন প্রক্রিয়া এই চিন্তা সামনে রেখে ঢেলে সাজাতে হবে।

ড. ডেমিং যে তত্ত্ব আজ থেকে ৬৭ বছর আগে জাপানিদের শিখিয়েছিলেন, আজ এতদিন পরেও তা আমাদের জন্য একইভাবে প্রযোজ্য।

যদি জাপান পারে তাহলে নিশ্চয়ই আমরা পারব। লাখো শহীদের রক্তের ঋণ পরিশোধের লক্ষ্যে স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমরা সবাই আজ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।