আগে চাই ভালো সমর্থক

সৌরিন দত্ত
Published : 7 April 2017, 05:46 AM
Updated : 7 April 2017, 05:46 AM

এ দেশের ক্রিকেটের সোনালী সময়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে মাশরাফির অধিনায়কত্ব। উইকেট নেওয়ার পর মাশরাফির সঙ্গে তাসকিনের মনোরম সেই উদযাপন কিংবা 'ম্যান অব দ্য ম্যাচ' হওয়ার পর মুস্তাফিজের সঙ্গে অ্যাংকরের কথা বলতে মাশরাফীর দোভাষীর কাজ করা দেখে শুধু এক অধিনায়কের দায়িত্ববান রূপটিই চোখে পড়ে না, মনের চোখে ধরা পড়ে মাশরাফির ভেতর লুকিয়ে থাকা এক বিশাল মনের মানুষকে যিনি পরম মমতায় আগলে রেখেছে পুরো দলকে।

সেই মাশরাফির অবসরের ঘোষণায় তাঁর গুণমুগ্ধ দেশবাসী যে ব্যথিত তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু একশ্রেণির সমর্থক যেভাবে তাঁর অবসরের কারণ হিসেবে বিসিবির কর্মকর্তাদের গালি দিয়ে যাচ্ছেন এবং তাদের মদদদাতা কিছু তথাকথিত সাংবাদিক তাঁকে আরও উসকে দিয়ে যাচ্ছেন তা সভ্যতার এবং শালীনতার সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে।

পায়ে ব্রেস পড়ে এবং প্রশংসনীয়ভাবে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে খেলে যাওয়া মাশরাফির বয়স এখন ৩৩ বছর। টি-২০ খেলোয়াড় হিসেবে মাশরাফির পরিসংখ্যানও এমন আহামরি না। তার ইঞ্জুরির যা অবস্থা তাতে ২০১৮ সালের টি-২০ বিশ্বকাপে মাশরাফির খেলার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত। খেললেও তৃতীয় স্পেশালিস্ট পেসারের দায়িত্ব মাশরাফি কতটুকু সামলাতে পারবে তাও বিবেচ্য।

অন্যদিকে ২০১৮ সালের টি-২০ বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ মোট টি-২০ খেলবে চারটি। নতুন অধিনায়ককে দায়িত্ব দিয়েই আমরা নিশ্চয়ই আশা করব না তিনি যাদুর কাঠির ছোঁয়ায় দলকে নিজের মতো করে নেবেন। কিছুটা সময় তো নতুন অধিনায়কের লাগবেই। এবং একটি বড়মাপের টুর্নামেন্টের জন্য দলকে ভালোভাবে বুঝতে একজন অধিনায়কের জন্য চারটি ম্যাচ মোটেই বেশি নয়। কাজেই নিজের হোক বা বোর্ডের সিদ্ধান্তে হোক মাশরাফির অবসরের সিদ্ধান্ত খুবই সময়োপযোগী। দুর্ভাগ্য, কিছু লোক তা বুঝছে না।

ভারতের স্পিন-সর্বস্ব বোলিং আক্রমণে প্রথম জেনুইন পেসার কপিল দেব। ফয়সলাবাদে আন্তর্জাতিক কেরিয়ার শুরু করা কপিল প্রথম দেখিয়েছিলেন একজন ভারতীয় বোলারও বাউন্সার দিয়ে ব্যাটসম্যানের হেলমেটে আঘাত হানতে পারে। গতি আর নিজস্ব ট্রেডমার্ক আউট সুইংগারে ভারতের নিষ্প্রাণ ম্যাড়ম্যাড়ে পিচেও কপিল ছিলেন দলের বোলিং আক্রমণের মূল অস্ত্র। 'হরিয়ানা হারিকেন' কপিল যখন কেরিয়ারের শেষ দিকে স্যার রিচার্ড হেডলির সর্বোচ্চ উইকেট শিকারের রেকর্ড ভাঙার জন্য চেষ্টা করছিলেন, তখন তিনি মোটেও দলের অপরিহার্য খেলোয়াড় নন। জীবনের শেষদিকে বোলার কপিলের চাইতে ব্যাটসম্যান কপিল পরিচয়টাই বড় হয়ে উঠেছিল। কপিলের রেকর্ড ভাঙার পেছনে ছুটতে গিয়ে নতুন বল হাতে পাননি উদীয়মান পেসার জাভাগল শ্রীনাথ।

প্রথম প্রকৃত ভারতীয় ফাস্ট বোলার, ভারতীয় সমর্থকদের 'নয়নমনি' কপিলের অবসর মোটেই তাঁর কেরিয়ারের মতো বর্ণাঢ্য ছিল না। খ্যাতির মধ্যগগনে থেকে অবসর নেওয়া ক্রিকেটাররা চিরকাল তাদের ভক্তদের হৃদয়ে বিরাজ করেন। ইমরান খান, জহির আব্বাস, ভিভ রিচার্ডস, ইয়ান বোথাম কিংবা অরবিন্দ ডি সিলভা সে পথেরই পথিক।

সারা জীবন যার ধীরগতির ব্যাটিংয়ের অপবাদ ছিল সেই গাভাস্কারও অবসর নেওয়ার আগের ম্যাচে ৮৮ বলে ১০৩ রান করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর ক্ষমতা। অবসর টেস্টেও স্টিভ ওয়াহ দলের পক্ষে সর্বোচ্চ রান করে ম্যাচ বাঁচিয়েছিলেন।

আধুনিক ক্রিকেটে যে কোনো দলই কোনো দুর্বল স্থান রাখতে পারে না। চার বোলার ভালো বল করলেও একজনের পাঁচ ওভারে ৬০ রান দলকে ম্যাচ থেকে ছিটকে দেয়।মনে পড়ে একসময় জিএম নওশের প্রিন্স একাই বাংলাদেশের পেস আক্রমণ টেনে নিয়ে যেতেন। একদিকে প্রিন্সের দুর্দান্ত গতির অসাধারণ বলগুলো কোনোমতে সামাল দিয়ে অপর বোলারের উপর চড়াও হতেন প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানরা।

এখন আমাদের দিন পাল্টেছে। এখন কোনোমতে মুস্তাফিজকে সামলানো গেলে আসে তাসকিন। বল একটু পুরনো হলেই সাকিব, মিরাজ। সাইডলাইনে বসে সোহাগ গাজি, রুবেল। বাংলাদেশের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ অধিনায়ক মাথা উঁচু করেই ব্যাট-প্যাড তুলে রাখবেন। অবসরের পরেও অনেক কাজ মাশরাফির; তাঁকে ছুটে বেড়াতে হবে দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে। প্রেরণা দিতে হবে দেশের কোণায় কোণায় লুকিয়ে থাকা প্রতিভাগুলোকে, মাশরাফি যে আমাদের আগামী প্রজন্মের কাছে রোল মডেল।

খালেদ মাহমুদ সুজনের শেষ ম্যাচ দেখার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিল। সেই ম্যাচে সুজন বল হাতে নিলেই দর্শকরা তাঁকে দুঁয়ো দিত। মনোজ প্রভাকর জীবনের শেষ ওয়ানডেতে পেস বলে মার খেয়ে স্পিন বল করেও দর্শকের ঠাট্টা থেকে বাঁচতে পারেনি। আজ যারা মাশরাফিকে অবসরের ঘোষণা তুলে নিতে বলছেন তারা হয়তো 'graceful exit' শব্দবন্ধের সঙ্গে পরিচিত নন।

অবশ্য এ দেশের ক্রীড়া সাংবাদিকতার যা অবস্থা তাতে এটা আশাও করা যায় না! কয়েকজন স্পোর্টস রিপোর্টার বাদ দিলে অনেকের যা ক্রিকেট নলেজ তা দিয়ে খেলা দেখা যায়, কিন্তু রিপোর্টিং করা যায় না। এ দেশের সম্ভবত সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত বাংলা দৈনিকের ক্রীড়া সাংবাদিক ইনিংস পরাজয়কে হাস্যকরভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন কয়েক বছর আগে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভেসে যাচ্ছে বিসিবি সভাপতি এবং কর্মকর্তাদের প্রতি গালিগালাজে। বিসিবি এ দেশে ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক হলেও সর্বোচ্চ সংস্থা নয়। এর উপরে আছে এনএসসি, তার উপরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। কিন্তু এ দেশের সম্ভবত সবচেয়ে দক্ষ, সুশৃংখল এবং সৌভাগ্যময় প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি বিসিবি। বিসিবির কয়েকজন পরিচালককে খুব কাছ থেকে আমি দেখেছি। উনারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল এবং ক্রিকেট নিয়ে উনাদের ভিশন সুদূরপ্রসারী। অনেকেই সাবেক ক্রিকেটার। সাবের হোসেন, সিনা ইবনে জামালী, মুস্তফা কামাল কিংবা নাজমুল আহসানরা এ দেশের ক্রিকেটকে শুধু দিয়ে গেছেন, অন্তত ক্রিকেট বোর্ড থেকে কিছু নেননি।

মাহবুব আনামের মতো বড় মাপের মেধাবী সংগঠক একটি বোর্ডের জন্য অমূল্য সম্পদ। একজন টেন্ডুলকার একা দলকে কখনও টানতে পারেন, কখনও পারেন না। কিন্তু মাহবুব আনামরা পর্দার আড়াল থেকে ১৬ কোটি মানুষের স্বপ্নকে টেনে নিয়ে বেড়ান। একই দেশে একই মায়ের পেটে জন্মে আমরা এমনি এমনি ফুটবল হকি বাস্কেটবলে আন্তর্জাতিক মানে নেই কিন্তু, কিন্তু ক্রিকেটে বিশ্বের সেরা দলগুলোকে হারিয়ে দিই। এর পেছনে বোর্ডেরই অবদান। আমাদের চেয়ে ভালো ক্রিকেট লিগেসি নিয়েও একটি দক্ষ বোর্ডের অভাবে এই মুহূর্তে জিম্বাবুয়ে আমাদের নিচে।

এবারের শ্রীলংকা সফরে ডাম্বুলায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। আম্পায়াররা গ্রাউন্ডসের প্রায় সবার সঙ্গে কথা বলে আউট ফিল্ড অবজার্ভ করার পর দুই দল আর সব অফিসিয়ালদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রপার ইন্সপেকশন শেষে ম্যাচই বাতিল করে দেন। খেলা শুরু করার জন্য যেই সোয়া ঘণ্টার মতো সময় হাতে ছিল, তার মধ্যে মাঠকে খেলার উপযোগী করা যেত না বলেই শেষ মেষ ম্যাচই বাতিল।

ঠিক বছর খানেক আগে ঢাকায় এশিয়া কাপ ফাইনাল। টাইগাররা খেলবে ইন্ডিয়ার সঙ্গে। খেলা টসে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে প্রবল কালবৈশাখী শুরু হল। মাঠের ভেতরে কাগজ আর বোর্ডের ব্র্যান্ডিং তছনছ। পুরানো স্কোরবোর্ডের এক পাশ উড়ে গেছে। ২৫ মিনিটের তুফানের পর ঝুম বৃষ্টি। থামছেই না সেই বৃষ্টি। কিন্তু মিনিট ৪০ পরে একদম ভিন্ন চিত্র। ব্যাট হাতে তামিম-সৌম্য ঢুকছে। আশিষ নেহরা নতুন বল নিয়ে প্রস্তুত। চল্লিশ হাজার লোকের গর্জনে গ্যালারি সরগরম। জমজমাট ফাইনাল খেলা হল। ঘণ্টাখানেক আগেই এই মাঠেই কী হচ্ছিল তার চিহ্ন মাত্র রইল না। এমন স্টেডিয়াম শুধু 'শেরে বাংলা'ই নয়। এতটা না হলেও বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম আর রংপুর ক্রিকেট গার্ডেনেও একই ব্যবস্থা আছে যেখানে আজ পর্যন্ত টেস্ট খেলা হয়নি।

স্টেডিয়ামগুলোর ভেতরে ওয়াই-ফাই রিসেপ্টর আছে মিডিয়া আর স্কোরারদের জন্য। আমাদের সেকেন্ড ডিভিশন খেলাগুলোরও অনলাইন স্কোরিং হয়, যেখানে শ্রীলঙ্কা তো বটেই, এমনকি সিডনি বা মেলবোর্নের মূল মাঠ MCG আর SCG-এর বাইরে ছোটখাটো মাঠগুলোতে এই সুবিধা নেই।

ক্রিকেট উন্নয়নে জনগণের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু ক্রিকেটের সব উন্নয়নই ট্যাক্স পেয়ারের টাকায় হয় না। টুর্নামেন্ট মানি, স্পন্সর আর বিভিন্ন স্বত্ব বিক্রী করে তা অর্জিত হয়। এমন অনেক স্বত্ব বা স্পন্সর কোটি টাকায় বিক্রি হয় যেগুলো আমাদের দেশের কোনো কোম্পানি থেকেই আসে না। দক্ষ এবং যোগ্য লোকেরা বিসিবিতে আছেন বলেই এগুলো সম্ভব হয়েছে।

দল নির্বাচন করেন সিলেক্টররা। আর মানুষ গালি দেয় বিসিবি সভাপতিকে। নাজমুল আহসান পাপন যদি আওয়ামী লীগের এমপি না হতেন তবে উনার কপালে হয়তো গালি একটু কম জুটত! আর ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ না থাকলে কেউ কেউ বলতে পারত না বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে হেরেছে। হায়রে আমজনতা!

ক্রিকেটকে আবেগ দিয়ে ভালোবেসেছিলেন বলেই মুস্তফা কামাল সাহেব বলতে পেরেছিলেন আইসিসি মানে ইন্ডিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল। তোয়াক্কা করেননি আইসিসিতে পরবর্তী পদের। এই ভালোবাসা হৃদয় উৎসারী স্বতঃস্ফুর্ত, এই আবেগ বুকে নিয়েই তিনি বিসিবি সভাপতির চেয়ারে বসেছিলেন। মন্ত্রী মুস্তফা কামাল, রাজনীতিবিদ মুস্তফা কামাল বিসিবি সভাপতি ছিলেন না। বিসিবি সভাপতি ছিলেন এক ক্রিকেটপাগল আবেগী, ক্রিকেট উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিব্ধ মুস্তফা কামাল।

একসময় বাংলাদেশের ক্রিকেটের সূতিকাগার ছিল চট্টগ্রাম। শাহেদ আজগর, ওয়াহেদ আজগর বা ইউসুফ গনি চৌধুরীর মতো সংগঠকরা ছিলেন বলেই নিয়মিত টুর্নামেন্ট হত। আর তারই ফলে উঠে এসেছিলেন নান্নু, নোবেল, শহীদ, মাসুম, আকরাম খানরা। আমরা প্রতিষ্ঠিত, প্রমাণিত যোগ্য লোকদের বিসিবিতে পেয়েছি। উনারা যোগ্য সন্মান না পেলে আখেরে আমাদেরই ক্ষতি।

আমরা ক্রিকেট টিম খারাপ খেললেই যে ভাষায় সংশ্লিষ্টদের গালিগালাজ করি তা প্রকৃতই বর্বরোচিত। আর সংশ্লিষ্টদের কোনোভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়াতে পারলে তো কথাই নেই। কয়েক বছর আগে সাকিবের ঘটনা কিংবা ফেসবুকে মুশফিকুর রহিমের মা-বাবাকে গালি দেওয়া প্রমাণ করে ভালো সমর্থক হতে আমাদের এখনও বাকি।

একটি ভালো টিম পেতে হলে সমর্থকদেরও ভালো হতে হবে। আর তাতে ক্রীড়া সাংবাদিকদের একটা বড় দায়িত্ব আছে।