সরকারে একবার রাজাকার একবার মুক্তিযোদ্ধা– এ মিউজিক্যাল চেয়ার খেলা বন্ধ কর

হাসানুল হক ইনু
Published : 6 April 2017, 03:03 PM
Updated : 6 April 2017, 03:03 PM

এক.
দারিদ্র্য-বৈষম্য-দলবাজি-দুর্নীতি বাংলাদেশের বিদ্যমান সমস্যা হলেও বর্তমানে মানুষ-সমাজ-সংস্কৃতি ও দেশ-গণতন্ত্র-অর্থনীতি জঙ্গি সন্ত্রাসের আক্রমণের মুখোমুখি। এসব বিদ্যমান সমস্যা মোকাবেলা-প্রচেষ্টায় জঙ্গি সন্ত্রাস বিপজ্জনক উৎপাত হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। তাই বিদ্যমান সমস্যা মোকাবেলার পাশাপাশি জঙ্গি দমনের যুদ্ধে বিজয় অর্জন করতে হবে। জঙ্গি দমনের যুদ্ধে বিজয় অর্জন করে জঙ্গিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা আজ বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশে জঙ্গি দমনের এ যুদ্ধ একাত্তরের সুমহান মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতা। এ যুদ্ধের এক দিকে আছে মুক্তিযুদ্ধের অর্জন বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতির (গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা) পক্ষের শক্তি, বিপরীত দিকে আছে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত ও পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পুনর্বাসিত-সংগঠিত একাত্তরের পরাজিত শক্তি। এক দিকে আছে ১৪ দল, বিপরীত দিকে আছে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত-জঙ্গির সিন্ডিকেট। জামায়াত-হেফাজত-জঙ্গির সঙ্গে বিএনপির এ গাঁটছড়া, ঐক্য কোনো সাময়িক কৌশল নয়; বাংলাদেশের ইতিহাস প্রমাণ করে যে, এদের ঐক্য আদর্শিক-রাজনৈতিক ঐক্য। একাত্তরের খুনি, পঁচাত্তরের খুনি, ২১ আগস্টের খুনি আর আগুনসন্ত্রাসের ভয়ঙ্কর সব খুনিদের সিন্ডিকেট প্রধান খালেদা জিয়া।

মানুষ-সমাজ-সংস্কৃতি ও দেশ-গণতন্ত্র-অর্থনীতির শত্রু এ সিন্ডিকেট বর্জন-বিচার-বিতাড়ন-নির্মূল না করলে শান্তি ও উন্নয়ন ব্যহত হবে, দারিদ্র্য-বৈষম্য-দলবাজি-দুর্নীতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জয়যাত্রার প্রয়াস ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

দুই.
বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুনি জেনারেল জিয়াউর রহমান একাত্তরে পরাজিত পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে–
১. একাত্তরের খুনি পলাতক জামায়াত-শিবির-রাজাকার-আলবদরদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনে এবং বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুরস্কৃত করেন;
২. পাকিস্তানের পক্ষ নেওয়া যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-শিবির ও নিষিদ্ধ ধর্মান্ধ দলগুলোকে রাজনীতি করার অধিকার দেন;
৩. নিজের দল বিএনপিতে ও সরকারের মন্ত্রিসভায় তাদের ব্যাপকভাবে পুনর্বাসন করেন এবং
৪. পাকিস্তানের 'দ্বিজাতি তত্ত্ব' অনুযায়ী বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রবর্তন করে ও রাজনীতির সাম্প্রদায়িকীকরণ করে বিভেদ-বৈষম্যের নীতি-আদর্শ-কর্মসূচি প্রণয়ন করেন।

পরবর্তীতে ১৯৯১ সাল থেকে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি–
১. যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াতকে সরকারের অংশীদারে পরিণত করে; শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে পরিচালিত যুদ্ধাপরাধ বিচার আন্দোলনের ওপর ধারাবাহিক হামলা পরিচালনা করে;
২. সারা দেশে রাজনৈতিক-প্রশাসনিক উদ্যোগে জঙ্গি দল-উপদল উৎপাদন-পুনরুৎপাদন শুরু করে;
৩. এসব জঙ্গিদের দিয়ে জনগণের ওপর সশস্ত্র হামলা শুরু করে; সারা দেশে একসঙ্গে ৫০০ স্থানে বোমা হামলা করে; থানা-আদালত-অফিস-সিনেমা-মন্দির-চার্চ-জনসভায় হামলা করে; এমনকি তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করে এবং
৪. জঙ্গিরা মিডিয়ার কল্পনা বলে প্রচারণা চালায় আর জঙ্গি সন্ত্রাসের দায় অপরাপর রাজনৈতিক দলের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করে।

এখানেই তাদের অপরাধ থেমে থাকেনি। ২০০৯ সাল থেকে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি–
১. জামায়াত-শিবিরকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য নাশকতা-অন্তর্ঘাত শুরু করে;
২. হেফাজতের জঙ্গি তাণ্ডবে প্রকাশ্য সমর্থন দেয় ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে;
৩. ৯৩ দিনের আগুনযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে শিশু-নারী-শ্রমিকদের জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা শুরু করে;
৪. জঙ্গিদের মাধ্যমে সারা দেশে একের পর এক গুপ্তহত্যা পরিচালনা করতে থাকে;
৫. গুলশান-শোলাকিয়া-কল্যাণপুর-নারায়ণগঞ্জ ও বিভিন্ন স্থানে সরাসরি যুদ্ধে নিহত জঙ্গিদের পক্ষ নেয়, তাদের রক্ষার অপচেষ্ট করে এবং
৬. গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করতে সংবিধান ও নির্বাচন নিয়ে একের পর এক ষড়যন্ত্র পরিচালনা করতে থাকে।

বাংলাদেশের ইতিহাস বলছে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের রাজনৈতিক-প্রশাসনিক-সাংস্কৃতিক পুনর্বাসন করেছে বিএনপি, সশস্ত্র জঙ্গিবাদের বিকাশ ঘটিয়েছে বিএনপি এবং এদের রক্ষার চেষ্টা করছে বিএনপি, এবং বিএনপি জামায়াত-হেফাজত-জঙ্গিদের নিয়ে সিন্ডিকেট গঠন করেছে। এ সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন খালেদা জিয়া।

খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থেকে ও ক্ষমতার বাইরে থেকে উভয় ক্ষেত্রে জঙ্গিদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন– স্বেচ্ছায় তিনি গণতান্ত্রিক শিবিরের বাইরে চলে গেছেন। সজ্ঞানে তিনি নিজে থেকে গণতন্ত্রের ক্লাব ত্যাগ করেছেন। তাই খালেদা জিয়া ও বিএনপি তাদের এ আদর্শিক ও রাজনৈতিক অবস্থান পরিত্যাগ না করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রত্যাবর্তন করলে গণতন্ত্র হুমকির মধ্যে নিপতিত হবে। বাংলাদেশের ইতিহাস সে সাক্ষ্য দেয়।

তিন.
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অন্যতম হল নির্বাচন। কিন্তু বিএনপি জামায়াত-হেফাজত-জঙ্গি সিন্ডিকেট প্রধান খালেদা জিয়ার মূল এজেন্ডা নির্বাচন নয়। তিনি বারবার প্রমাণ করেছেন তাঁর মূল এজেন্ডা অসাংবিধানিক অস্বাভাবিক সরকার। খালেদা জিয়া যেহেতু স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে গণতান্ত্রিক শিবিরের বাইরে চলে গেছেন, সেহেতু তিনি গণতন্ত্রের যোগ্য নন, নির্বাচন প্রক্রিয়ার যোগ্য নন।

বাংলাদেশের সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে হলে চারটি বিষয় 'মানতে হবে'–
১. বাংলাদশের স্বাধীনতার ঘোষণা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান;
২. বাঙালি জাতীয়তাবাদসহ মুক্তিযুদ্ধের অর্জন চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি;
৩. মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লক্ষ শহীদ এবং
৪. ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস।

উল্লিখিত মীমাংসিত বিষয় বিতর্ক করে বা অস্বীকার করে বাংলাদেশের প্রতি কোনো অঙ্গীকার প্রদর্শন করা যায় না। বর্ণিত 'মানতে হবে'র পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চার ধরনের শত্রুকে রাজনৈতিকভাবে 'ছাড়তে হবে'–

১. জামায়াত
২. রাজাকার
৩. যুদ্ধাপরাধ ও
৪. জঙ্গি।

বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলকে বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে এ 'মানতে হবে' ও 'ছাড়তে হবে'র পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। এ পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হতে পারবে না তারা গণতন্ত্রের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারবে না।

বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত-জঙ্গি সিন্ডিকেট এবং এ সিন্ডিকেটের প্রধান খালেদা জিয়াকে যারা গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় রাখতে চান, তাদের প্রতি স্পষ্ট বক্তব্য:

এদের আর কোনোভাবেই জায়েজ করা চলবে না;
মিলমিশের কোনো তত্ত্ব চলবে না;
রাজাকার-জঙ্গিদের সঙ্গে ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারা চলবে না;
তারা ক্ষমতা ও নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে না;
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার শত্রুদের কোনো স্থান গণতন্ত্রে থাকতে পারে না।

এ বিষয়ে 'শূন্য সহিষ্ণু' (জিরো টলারেন্স) নীতি গ্রহণ করতে হবে। আগামী নির্বাচনের আগেই দেশে এ বিষয়ে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করতে হবে। শুধু জঙ্গি নির্মূল করলেই চলবে না, জঙ্গি নির্মূল করে জঙ্গি-সঙ্গিকে পুষে রাখলে তারা আবারও জঙ্গিদের পুনর্বাসন ও সংগঠিত করবে এবং জঙ্গি উৎপাদন-পুনরুৎপাদন করবে। ঠিক যেমনটি অতীতে করেছে।

রাজাকার আর মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে 'মিউজিক্যাল চেয়ার' খেলা চলতে পারে না। ক্ষমতায় একবার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল আর একবার রাজাকারের দল– এ প্রক্রিয়ার চির অবসান ঘটাতে হবে। একাত্তরের পরাজিতদের পুনর্বাসিত-সংগঠিত-সশস্ত্র উত্থানকে চিরতরে নির্বাসন ও নিশ্চিহ্ন করতে হবে। বাংলাদেশে ক্ষমতায় ও ক্ষমতার বাইরে উভয় ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবে কেবল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি।

অতএব বাংলাদেশে জঙ্গি দমন আর দারিদ্র্য-বৈষম্য-দলবাজি-দুর্নীতিসহ বাংলাদেশের বিদ্যমান সমস্যা নিরসন করে শান্তি ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে–

১.ক. শূন্য সহিষ্ণু নীতির ভিত্তিতে সশস্ত্র জঙ্গি নির্মূল অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে;
১.খ. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে;

২. জঙ্গি-সঙ্গি খালেদা এবং বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত-জঙ্গি সিন্ডিকেটের আগুনসন্ত্রাস, গাছ কাটা, রেল-ট্রেন ধ্বংস করা, বোমাবাজি ও গুপ্তহত্যার প্রতি শূন্য সহিষ্ণু নীতির প্রদর্শন করে সব মামলা সক্রিয় করতে হবে, সেগুলোর চার্জশিট দিতে হবে এবং দ্রুত বিচার আদালতে অপরাধীদের বিচার করতে হবে;

৩.ক. স্বাধীনতার ঘোষণা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু, বাঙালি জাতীয়তাবাদসহ মুক্তিযুদ্ধের অর্জন চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি, মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লক্ষ শহীদ ও ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস যারা মানবে না এবং মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শত্রু জামায়াত, রাজাকার, যুদ্ধাপরাধ ও জঙ্গিকে যারা রাজনৈতিকভাবে ছাড়বে না, জাতীয় রাজনীতিতে তাদের অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে, বিতাড়িত করতে হবে। জাতীয় স্মৃতি সৌধ, শহীদ মিনার, শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি সৌধ ও বধ্যভূমিসহ জাতীয় চেতনাসংশ্লিষ্ট সব স্থান ও স্থাপনায় এদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে হবে;

৩.খ. জামায়াতসহ সব সাম্প্রদায়িক দল ও রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।