নাগরিক সাংবাদিকতা, দায়িত্বশীলতা

তৌফিক ইমরোজ খালিদী
Published : 16 Feb 2012, 03:41 PM
Updated : 16 Feb 2012, 03:41 PM

এক বছর আগে আমরা যখন আমাদের বাংলা ব্লগ নতুন করে শুরু করেছিলাম তখন ঠিক করে নিয়েছিলাম, এই ব্লগ অন্য আর পাঁচটি ব্লগের মত হবেনা। এখানে ব্লগাররা শুধুই তাদের মতামত দেবেন না, শুধুই অন্য কোন ঘটনা, কোন বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাবেন না; তারা তথ্যও দেবেন। তারাও একধরণের সাংবাদিকতা করবেন।

সাংবাদিকতা নিয়ে কথা বলতে গেলে, একটা কথা প্রায়ই বলা হয়, কমেন্ট ইজ চিপ, ইনফরমেশন ইজ এক্সপেনসিভ । অর্থাৎ, মন্তব্য করাটা সহজ, কিন্তু তথ্য যোগাড় করা কিংবা তথ্য দেয়াটা কঠিন কাজ। প্রযুক্তির কল্যাণে, তথ্য পরিবেশনের কাজটা অনেক সহজ হয়েছে। কিন্তু তথ্য যোগাড়ের যে কাজটি, তথ্য যাচাই বাছাই করার যে কাজটি, সেটি আমার ধারণা একটু কঠিন কাজ। কেননা, সেখানে দায়িত্বশীলতার প্রশ্ন এসে যায়, সেখানে সতর্ক হবার প্রয়োজন আছে।

এখানে দায়িত্বশীল হতে হবে দু'পক্ষকেই — যারা নাগরিক সাংবাদিক হিসেবে তথ্য দেবেন এবং সেইসাথে যারা (moderators) এ প্রান্ত থেকে আরেক জোড়া চোখ দিয়ে তা যাচাই করে দেখবেন। একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, দায়িত্বশীল আচরণ করতে ব্যর্থ হলে মাশুল গুনতে হবে সবাইকে। আইন বা বিধিবিধানের বিষয়টি তখনই সামনে আসে যখন স্বাধীনতার অপব্যবহার হয়। স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতা হয়। আমাদের সতর্ক থাকবার প্রয়োজন আছে। ইন্টারনেটে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অসতর্কতার পরিণতিতে সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক মূল্য দিতে হতে পারে। বেশি দূর যেতে হবে না, বাংলাদেশের গত ৪০ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই দেখা যাবে বিভিন্ন সময়ে কিভাবে গণবিরোধী কাজে কিংবা আইনের শাসনবিরোধী কাজে গণমাধ্যমকে ব্যবহার করা হয়েছে। আমাদের সমস্যা হচ্ছে, আমরা ইতিহাস থেকে শিখি না, শিখতে চাই না।

এদেশের রাজনীতিকরা বারবার ভুল করেছেন এবং চরম মাশুল দিয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি মাশুল দিয়েছেন এদেশের মানুষ — গণতন্ত্রহীন পরিবেশে, আইনের শাসনহীন রাষ্ট্রে জনগণ যন্ত্রণা ভোগ করেছে। রাজনীতিকরা অন্য অনেক বিষয়ের মত গণমাধ্যম ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে চরম দায়িত্বহীনতা এবং অযোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। এতে সমাজের ক্ষতি হয়েছে, অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে, রাজনৈতিক ব্যবস্থার ক্ষতি হয়েছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষতি হয়েছে।

তবে রাজনীতি কিংবা রাজনৈতিক ব্যবস্থার কোন বিকল্প এখনো আধুনিক সমাজ দেয়নি। যখনই অন্য কোন শক্তি এই রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করেছে কিংবা করবার চেষ্টা করেছে তখনই সসস্যা হয়েছে। দেশ, সমাজ পিছিয়ে গেছে। আইনের-শাসন-ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলবার জন্য, কিংবা যেটুকু আছে তাকে আরো শক্তিশালী করবার জন্য রাজনীতির পাটাতনটা আরো শক্ত হবার প্রয়োজন আছে। বিষয়টি না বুঝলে বাংলাদেশকে আরো মাশুল দিতে হবে, যেমনটা দিয়েছে এবং দিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান। তবে, স্বীকার করতে হবে, এদেশে যা কিছু উন্নতি হয়েছে তা রাজনীতিকদের কারণেই হয়েছে। আবার, এদেশের দুর্দশার সব দায়ও রাজনীতিকদের নিতে হবে।

অব্যবস্থাপনার কারণে, কিংবা সিদ্ধান্তগ্রহণকারীদের অযোগ্যতা-অদূরদর্শিতার কারণে গণমাধ্যমে একটা অরাজক পরিস্থিতি বিরাজমান। এর দায় পুরোটাই রাজনীতিকদের। তারা তাৎক্ষণিক লাভটা দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পরে অনেক ক্ষেত্রে আফসোস করেছেন। সুযোগ পেয়েও শেখার বা শোধরাবার চেষ্টা করেননি।

এটা স্পষ্ট, ইতোমধ্যে অরাজক পরিস্থিতির সুবিধাভোগীরা সংখ্যায় অন্তত মূলধারার সংবাদকর্মীদের ছাড়িয়ে গেছেন। সততা এবং অঙ্গীকার নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের মধ্যে একটা হতাশা আছে বলে মনে হয়।

এটা এক ক্রান্তিকাল। দ্রুত বিবর্তিত হচ্ছে প্রচার মাধ্যম। প্রযুক্তি পাল্টে দিয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার চেহারা। মেলানো হচ্ছে রাজনীতির পুরোনো কিছু হিসেব-নিকেশ। সম্পাদকীয় ব্যবস্থাপনায়, সর্বোপরি গণমাধ্যম ব্যবস্থাপনায়, দায়িত্বশীল আচরণ যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি প্রয়োজন বোধহয় এখন।

কাজেই জাতিবৈরিতা, ধর্মীয় বিদ্বেষ ও মানহানিকর বক্তব্য ইত্যাদি বিষয়ে সতর্ক থাকবার প্রয়োজন শুধু আইনি নয়, প্রয়োজন সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক। আইন প্রসঙ্গে একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। যে বিশাল ইন্টারনেট সমাজ গড়ে উঠেছে, তার মধ্যে যে সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে, তার বিস্তৃতি, গভীরতা এবং প্রভাব কিন্তু অনেকাংশে 'বাস্তব' সমাজের চেয়ে অনেক বেশি। গণমাধ্যম সম্পর্কিত পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলেই সেটা বোঝা যায়। এদেশে দু'কোটি ইন্টারনেট সংযোগ আছে, প্রায় ২৪ লাখ ফেইসবুক ব্যবহারকারী আছেন। অন্যদিকে সবগুলো কাগজের প্রচারসংখ্যা আসলে ১২ লাখের বেশি নয়। বিভিন্ন জরিপের ফলাফল দেখলেই বোঝা যায়, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সংবাদ, চলতি ঘটনার অনুষ্ঠান কিংবা জনমত পাল্টে দেবার মত অনুষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত দর্শকসংখ্যা, এই মুহূর্তেই বাংলাদেশের ইন্টারনেট জনসংখ্যার সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সীমার কাছে কিছুই নয়।

কাজেই সতর্ক হবার প্রয়োজনটা আরো বেশি। আসলে পুরোনো মাধ্যমের চেয়ে এই নতুন মাধ্যমের শক্তি  আরো বেশি। যেমন ধরুন, মানহানির প্রশ্নে যে আইনটা প্রয়োগ করা হয় পুরোনো মাধ্যমে তা কিন্তু এই নতুন মাধ্যমেও প্রয়োগযোগ্য। ভয়টা হলো, রাষ্ট্রপরিচালনাকারীদের একটা বড় অংশ এসব বিষয়ে যথেষ্ট শিক্ষিত নন, যথেষ্ট সংবেদনশীল নন। আইনের ভুল, বিব্রতকর এবং ক্ষতিকর প্রয়োগ হলে মাশুল দিতে হবে সবাইকে। সতর্কতাটাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হয়। সামাজিক উন্নয়নের সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকা সমাজেও বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক চলছে। আমাদের দেশেও বিতর্কটা হচ্ছে, মূলত নতুন মাধ্যমে। ভালো দিকটা হলো এই বিতর্কেও পুরোভাগে রয়েছে নতুন মাধ্যম।

ফিরে আসি নাগরিক সাংবাদিকতা প্রসঙ্গে। বাংলাদেশকে বলা হয়, সাংবাদিকতার স্বর্গরাজ্য। বিশেষ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার। দুর্নীতি আর বিভিন্ন  রকম দুর্বৃত্তায়নের এ দেশে চারিদিকেই শুধু খবরযোগ্য ঘটনা। নাগরিক সাংবাদিকরা এ সুযোগটা নেবে না কেনো? তবে সুযোগ গ্রহণের পাশাপাশি দায়িত্ববানও হতে হবে তাদের। না হলে গণমাধ্যমের প্রতি আস্থাহীনতার সংকট আরো প্রকট হতে পারে।

[লেখাটি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বাংলা ব্লগ bdnews24 ব্লগের বছরপূর্তি অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তৃতার সারাংশ।]