অটিজম সচেতনতা দিবস ও প্রতিবন্ধী মানুষের ক্ষমতায়ন

সাবরিনা সুলতানাসাবরিনা সুলতানা
Published : 2 April 2017, 05:25 AM
Updated : 2 April 2017, 05:25 AM

আমাদের কণ্ঠস্বর কেবলই রুদ্ধ করে রাখা হয়। আমাদের চিৎকারে কানে তুলো গুজে রাখে পরিবার তথা সমাজ। অথচ আমাদের বর্জন করা সামগ্রিকভাবেই সমাজের জন্য ক্ষতিকারক। তবু এই সত্য জেনেও আমাদের দিব্যি অস্বীকার করে চলতে চায় সমাজ।

যদিও 'আমাদের ছাড়া, আমাদের জন্য কোন বিষয়ে কিছু নয়'– এই মূল স্লোগানে প্রতিবন্ধী মানুষকে মানববৈচিত্র্যের অংশ হিসেবে মেনে নেওয়া; ব্যক্তির মর্যাদা, স্বীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা ও ব্যক্তি স্বাধীনতা, বৈষম্যহীনতা এবং পূর্ণ-কার্যকর সামাজিক অংশগ্রহণ ও অন্তর্ভুক্তি ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় প্রণীত হয়েছে জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার সনদ (সিআরপিডি)। অন্যদিকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) অঙ্গীকার 'নো ওয়ান লেফট বিহাইন্ড' বা 'কাউকে বাদ রেখে নয়'।

কিন্তু এখনও সমাজ ব্যবস্থাপনা চলছে এসব ধারণার সম্পূর্ণ বিপক্ষে। সমাজের সব ক্ষেত্রে সব ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা নেতৃত্ব চর্চা এবং সম-অংশগ্রহণের পরিবেশ সৃষ্টির উদ্যোগ নেই। এই হারে প্রতিবন্ধী মানুষদের প্রতি নেতিবাচক আচরণ প্রক্রিয়া চলতে থাকলে সিআরপিডি বাস্তবায়নসহ এসডিজির লক্ষ পূরণে অসমর্থ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি থেকে যাবে।

১.
সরকার আন্তরিকতার সঙ্গেই প্রতিবন্ধী মানুষের উন্নয়নে নানা কর্মকাণ্ডের উদ্যোগ নেয়। ২০০৮ সালে জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার সনদ (সিআরপিডি) স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু। এরপর সিআরপিডির আলোকে 'প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩' এবং 'নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন ২০১৩' প্রণয়ন করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। বেশ কিছু আন্তর্জাতিক দলিল ও অঙ্গীকারে প্রতিবন্ধী মানুষের সব ক্ষেত্রে সম-অংশগ্রহণ অর্থাৎ শিক্ষা, কর্মসংস্থান, খাদ্য, পানি, সামাজিক নিরাপত্তা, গণপরিবহনসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রবেশগম্যতা এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা হবে ইত্যাদি বেশকিছু লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার যা বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ।

বিগত বছরে এসডিজি নিয়ে সমাজের সর্বস্তরেই মাতামাতি দেখা গেছে। প্রতিবন্ধী মানুষদের নিয়ে কর্মরত সরকারি ও বেসরকারি কর্তাব্যক্তিরাও আলোচনা সভা-বক্তৃতায় পিছিয়ে নেই। গেল বছর ৩ ডিসেম্বর 'টেকসই সমাজ গড়ি, ১৭ লক্ষ্য অর্জন করি'– এই প্রতিপাদ্যে 'আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি দিবস ২০১৬' উদযাপিত হয়েছে। 'স্বকীয়তা ও আত্মপ্রত্যয়ের পথে'– এই প্রতিপাদ্যে পালিত এ বছরের বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবসের নানা অনুষ্ঠানেও এর ব্যত্যয় ঘটবে না বলে ধারণা করি।

কিন্তু মুদ্রার অন্য পিঠে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিনিধিত্ব অস্বীকার করেই 'প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩' বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত হয়ে যায় সেই আইনের জাতীয় সমন্বয় কমিটি এবং জাতীয় নির্বাহী কমিটি। জেলা পর্যায়ের কমিটিগুলোতেও নীতি নির্ধারণের সিদ্ধান্তে বেসরকারি প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিবন্ধী নারী ও পুরুষের প্রতিনিধিত্ব বিপুল পরিমাণে নিশ্চিত হয়েছে, এমনটিও শোনা যায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিবন্ধী মানুষের মতামত গ্রহণের তোয়াক্কা না করেই একই আইনের আওতায় জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন। এমনকি এ বিষয়ে সরকারের সব মন্ত্রণালয়কে অন্তর্ভুক্ত করে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বিষয়ক ফোকাল কর্মকর্তাদের মতামত গ্রহণেরও কোনো উদ্যোগ আমাদের নজরে আসেনি।

সারা দেশের প্রতিবন্ধী জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত দায়িত্বপ্রাপ্ত একমাত্র মন্ত্রণালয় সমাজকল্যাণ– সামাজিক নিরাপত্তা ও জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের গুরুদায়িত্ব যার ওপর অর্পিত– সেই মন্ত্রণালয়ের জন্য জনগণের সব অধিকার ও সুরক্ষা বাস্তবায়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনা কঠিন বৈকি!

বাংলাদেশে অটিজম বিষয়ে কাজ করে বিশ্বজুড়ে প্রশংসা কুড়িয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। বিগত অটিজম দিবসের জাতিসংঘের দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে তিনি তাঁর বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতায় অটিজম ব্যক্তিদের বিভিন্ন অধিকার সুরক্ষায় ১৪টি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠনের কথা উল্লেখ করেন। নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ।

কিন্তু একদিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কন্যা জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অটিজম ব্যক্তিদের উন্নয়নে মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বিত কার্যক্রম বিষয়ে বলছেন, অপরদিকে একই সময়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এককভাবে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়টি সত্যিই দুঃখজনক। যদিও অটিজম বিষয়ক এই ১৪টি মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। অন্যদিকে দেশের সব ধরনের প্রতিবন্ধী জনগণের উন্নয়ন ও অধিকার সুরক্ষায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে কর্মসূচি গ্রহণের পদক্ষেপও নেই।

'রুলস অব বিজনেজ'-এর সংকট যতক্ষণ না কাটবে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্যোগ গ্রহণের সম্ভাবনা স্তিমিতই থেকে যাবে। বিস্ময়কর ব্যাপার হল 'নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন ২০১৩'-এর কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের পূর্বে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল তা-ও মেনে চলা হয়নি প্রতিবন্ধী মানুষের এই মূল আইনের (প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩) জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (খসড়া) প্রণয়ন করার ক্ষেত্রে।

ট্রাস্ট আইনের কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের আগে সারা দেশের বিভিন্ন জেলার অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণ আলোচনা-পরামর্শ এবং কর্মশালা আয়োজনের মাধ্যমে মতামত নিয়েই এই কর্মপরিকল্পনা প্রণীত হয়েছে বলে আমরা জানি। কিন্তু মূল আইনের কর্মপরিকল্পনায় তৃণমূলের বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনের মতামত গ্রহণমূলক কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি প্রতিবন্ধী মানুষদের নিয়ে কর্মরত বেসরকারি সংস্থাগুলোসহ সংশ্লিষ্টদের।

জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়নের সময়কার কথা অনেকের মনে থাকবে। সেই সময় এ দেশের নারীরা কি অভিযোগ এনেছিলেন, যেনতেন প্রক্রিয়ায় গুটিকয়েক সরকারি আমলা এবং নারীদের নিয়ে কর্মরত বেসরকারি সংগঠন মিলে নারী নীতিমালা বিষয়ক সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন? নারীর বা নারী সংগঠনের মতামত উপেক্ষা করে এই নীতিমালা প্রণীত হয়েছে বলেও আমরা শুনিনি। এমনকি নারী নীতিমালা প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধী নারীদের মতামত গ্রহণ করা হয়নি– এই অভিযোগ করার সুযোগও নেই। সবার কাছে অগ্রহণযোগ্য বা স্বল্প কয়েকজনের মতামতের ভিত্তিতে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা প্রণীত হয়েছে– এমনটাও আমাদের জানা নেই।

তবে কেন প্রতিবন্ধী মানুষের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সরকাররি বা বেসরকারি নীতি নির্ধারণী মহল প্রতিবন্ধী মানুষ ও তাদের প্রতিনিধিত্বকারী ডিপিও সংগঠন এবং অভিভাবক সংগঠনকে সম্পৃক্ত করতে এতটা কার্পণ্য করেন! তাছাড়া সারা দেশের সব ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য প্রণীত এই মূল আইনটি নিশ্চয় শুধুই রাজধানী-কেন্দ্রিক মানুষের জন্য নয়। কিন্তু তবু তৃণমূলের প্রতিবন্ধী মানুষ এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনসমূহের অংশগ্রহণ ও মতামত প্রদানের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার কেন নেই– এ প্রশ্ন এসেই যায়।

আজকের দিনে 'নারীর প্রতিনিধিত্ব পুরুষ করছে' সমাজের কাছে এই ভাবনা হাস্যকর। সরকারি-বেসরকারি নারী অধিকার বিষয়ক নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কমিটিগুলোতে 'নারীর পক্ষে পুরুষ প্রতিনিধিত্ব করছে' এমনটা দেখে আমরা অভ্যস্ত নই। এমনকি কোনো নারীও তা মেনে নেবেন না। কিন্তু প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিনিধিত্ব অ-প্রতিবন্ধী মানুষেরা করছে– একে খুব স্বাভাবিকভাবেই নেওয়া হয়। এমনকি প্রতিবন্ধী মানুষের মধ্যেও বাদ-প্রতিবাদ দেখা যায় না।

আমরা অনেকে বিবেচনায় রাখি না যে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দলিল এ বিষয়ে বেশ শক্তিশালী। যেমন: সিআরপিডি, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, ইনচিয়ন কৌশল ইত্যাদি আন্তর্জাতিক দলিলপত্রে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্ব এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বিষয়ক জাতীয় সমন্বয় প্রক্রিয়ার সদস্যদের মধ্যে সব ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষসহ প্রতিবন্ধী নারীদেরও আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার বিষয়েও গুরুত্বরোপ করা হয়েছে।

কিন্তু প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার বিষয়ক কমিটিগুলোতে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিনিধিত্বের দাবির প্রশ্নে সরকারি কর্মকর্তারা কেবলই বিস্মিত হতে জানেন। প্রতিবন্ধী মানুষেরা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে, বিশেষত জাতীয় পর্যায়ের কমিটিতে প্রতিনিধিত্ব করবে এ যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের বস্তু।

২.
অধিকার আদায় ও ক্ষমতা অর্জনের লড়াই অতটা সহজ নয়। একসময়ের নারী আন্দোলনের পটভূমি তা-ই মনে করিয়ে দেয়। কয়েক দশক আগেও কৈশোরে বাবার অধিকারে কাটিয়ে নারীর বাকি জীবন পার হত স্বামীর দয়ায়। শিক্ষা, বিনোদন সব অধিকারেই পুরুষের সিদ্ধান্তই শেষ কথা। পরনির্ভরশীলতায় অসহনীয় হয়ে ওঠা নারী স্বাধিকারের লড়াইয়ে সোচ্চার হতে না পারার যন্ত্রণাকে ছাপিয়ে ধীরে ধীরে দুঃসাহসী হতে শুরু করল। একে অপরের সঙ্গে সুখ-দুঃখ বিনিময় চলছিল। ভাববিনিময় প্রক্রিয়ার এক পর্যায়ে নিজেদের সংগঠিত করে রাস্তায় নামার তাগিদ অনুধাবন করল তারা। এভাবেই সমাজ তথা পুরুষের শৃঙ্খল ভেঙে নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় এগিয়ে আসার শুরু।

একতাবদ্ধ নারীর শক্তিশালী কণ্ঠস্বরে সমাজ সাধুবাদ জানাতে বাধ্য হল। নারীদের ক্ষমতায়িত করার জন্য সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে। স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের সফলতাও লাভ করে নারীরা। আজ নারীর জন্য রয়েছে স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বতন্ত্র অধিদফতর। মহিলা বিষয়ক অধিদফতর সারা দেশের নারী সংগঠনগুলোকে সম্পৃক্ত করে নারীদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিসহ নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নে দারুণভাবে কাজ করছে।

প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য সরকারের তেমনই উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত হল স্বতন্ত্র অধিদফতর। জাতিসংঘ সনদ সিআরপিডির ধারা ৩৩ অনুযায়ী প্রতিবন্ধী মানুষের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে সমন্বয়কারী সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উন্নয়ন অধিদফতর। সিআরপিডি অনুসমর্থনকারী বিভিন্ন দেশ, যেমন ভারত সরকারও ২০১২ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ক্ষমতায়ন অধিদফতর চালু করেছে।

একই অঙ্গীকার রক্ষায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১০ সালের বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবসে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিদফতর গঠনে ঘোষণা দিলে তা বাস্তবায়নে সরকারি প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয়। এ সময় সিদ্ধান্ত হয় জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনকে অধিদফতরে রূপান্তর করা হবে। এই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উন্নয়ন অধিদফতরের ফলক উন্মোচন করেন। কিন্তু দীর্ঘ সাত বছরের এই প্রক্রিয়া আজও আলোর মুখ দেখেনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এমন আন্তরিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নের প্রধান বাধা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কর্মরত বেসরকারি এনজিও নেতৃবৃন্দের বিরোধীতা এবং আমাদের প্রতিবন্ধী মানুষের অসচেতনতা।

৩.
যুগে যুগে পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা গেছে, প্রতিবন্ধী মানুষের নেতৃত্বে তাদের অধিকার অর্জনের আন্দোলনে সফলতা এসেছে। উন্নত দেশগুলোর রাষ্ট্রযন্ত্র বাধ্য হয়েছে প্রতিবন্ধী মানুষের কাছে মাথা নোয়াতে। নিশ্চিত হয়েছে প্রতিবন্ধী মানুষের শিক্ষা, চাকরি, যাতায়াত তথা সর্বত্র প্রবেশের অধিকার। দয়াদাক্ষিণ্য, সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত হওয়ার ভয়ে অথবা ক্ষমতাসীনদের সামনে তাদের প্রতিবাদী কণ্ঠ চুপসে যায়নি। সমাজে সমমর্যাদা ও নাগরিক অধিকারের দাবিতে ক্ষমতাসীনদের পরোয়া না করে রাজপথে সোচ্চার হয়েছে তারা।

অথচ আমরা এখনও ভাবতেই পারি না প্রতিবন্ধী মানুষের নেতৃত্ব, প্রতিনিধিত্ব তথা সিদ্ধান্ত গ্রহণের চর্চা বিষয়ে। আর তাই আমাদের দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উন্নয়ন অধিদফতর বাস্তবায়নে সরকারপ্রধানের অঙ্গীকার ধূলোয় গড়ায় বছরের পর বছর ধরে। বাস্তবায়িত হয় না জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার সনদসহ (সিআরপিডি) অন্যান্য আন্তর্জাতিক সনদ, ঘোষণা ও দেশীয় নীতিমালা।

২০০১ সালের কল্যাণ আইনের নীতি সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলোতে যখন শ খানেক সাধারণ মানুষের ভিড়ে মাত্র দু-তিনজন প্রতিবন্ধী মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করতে দেখা যায়, তখনো আমরা চুপ থাকি। দীর্ঘ ১৫ বছর পর বর্তমানের বাস্তবতায় অধিকার আইনের ছায়াতলে এসে আমরা দেখি, এই আইনের জাতীয় কমিটিও একই পথে হাঁটছে। তখনও আমরা চুপ থাকি। সরকারি ও বেসরকারি সব সিদ্ধান্ত গ্রহণমূলক প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠন থেকে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা কখনও থাকে না। এবং এ বিষয়ে আশ্চর্য রকমের নীরব ভূমিকায় প্রতিবন্ধী মানুষদের নিয়ে কর্মরত সাধারণ মানুষ তথা এনজিও নেতৃবৃন্দ।

কল্যাণের জায়গা থেকে বেরিয়ে আমরা অধিকারের পথে হাঁটছি ঠিকই, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিজের ইচ্ছা, স্বাধীনচেতনা ও আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দিয়ে। ক্রীতদাসের মতো মেনে নিয়ে এবং মানিয়ে চলাতেই আমরা স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছি। নতুবা শেকল ভেঙে নতুনকে স্বাগত জানাতে আমাদের এত দ্বিধা কিসের! সমাজের চোখে 'অযোগ্য-অথর্ব' প্রতিবন্ধী মানুষ আমরা এহেন স্বাভাবিক ভাবনার মূলে আঘাত করার বিষয়ে কেন ভাবতে পারি না এখনও!