লায়লা সামাদ একজন প্রথাভাঙা মানুষ। বৈরী সমাজের সব প্রতিকূলতা ভেঙে তিনি নিজে শিক্ষিত, রাজনীতি ও সমাজ সচেতন হয়েছেন, তেমনি তাঁর চারপাশের মানুষকেও এগিয়ে নিতে চেষ্টা করেছেন। তাদের মধ্যে বীজ বুনতে চেয়েছেন নৈতিকতা, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধের।
মনে পড়ে তাঁর মগবাজারের একতলা বাড়ির নিখুঁতভাবে সাজানো ড্রয়িংরুম। শিক্ষা, সংস্কৃতি, রুচি ও আভিজাত্য যার পরতে পরতে জড়ানো সাদা থান শাড়ি, হাতকাটা ব্লাউজ, কপালে বড় টিপ, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার সঙ্গে মায়া জড়ানো হাসির অপূর্বচ্ছটা। স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব ও অতি আধুনিক এই মানুষটিই কথাবার্তা-আচার-আচরণে ছিলেন একেবারেই শিশুর মতো সহজ ও সরল।
গুজরাট থেকে আনা মশলা দিয়ে নিজ হাতে তৈরি করা আলুরদম, লুচি প্লেটে তুলে দিতে দিতে তাঁর সময়ের কথা অনর্গল বলে যাচ্ছিলেন। আলুরদমের সেই মশলার গন্ধে সারা বাড়ি মৌ মৌ করছিল। তাঁর সঙ্গে আমার বেশ কয়েকবার দেখা ও সময় কাটানোর দুর্লভ অভিজ্ঞতা রয়েছে; রয়েছে কিছু দুঃখের আবার কিছু মধুর মজার স্মৃতিও। কিন্তু সেদিনের সেই মুখরোচক আলুরদম, আন্তরিকতা ও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা আনন্দঘন সময় আমার স্মৃতিতে শুধু উজ্জ্বল নয়, প্রেরণার উৎস হয়ে আছে।
সেই পঞ্চাশের দশকে লায়লা সামাদ শুধু সাহিত্য ও সাংবাদিকতা নয়, রাজনীতি, সমাজকল্যাণ, মঞ্চনাটক, প্রচ্ছদশিল্প, মডেলিং, বিনোদন পত্রিকা প্রকাশসহ বহু সৃজনশীল কাজের অগ্রভাগে ছিলেন। এ ক্ষেত্রে তিনি যে পুরোধা ব্যক্তিত্ব তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিংবদন্তিসম এই মানুষটি জগদ্দল পাথর সরিয়ে যে পথ তৈরি করেছিলেন, সেই পথ ধরেই আমরা এখনও এগিয়ে চলছি। একজন নারী যখন চিন্তা চেতনার স্বতন্ত্র জগত গড়তে আসেন তখন তিনি যে দুঃসাহসী, এ কথা নিঃসন্দেহে আমরা বলতে পারি।
তাঁকে দেখে মনে হয়েছে তাঁর বয়স বেড়েছে, কিন্তু বয়স তাঁকে স্থবিরত্ব দেয়নি; বরং বয়স তাকে নতুন ইমাজিনেশন দিয়েছে। তাঁর সাংবাদিক ও সাহিত্য জীবনে এই ইমাজিনেশনকে আবার নতুন করে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাও দিয়েছে, যা পরবর্তী সময়ে আমার সৃজনীশক্তিকেও নাড়া দিয়েছিল। লায়লা সামাদ তাঁর পুরো জীবনের কর্মকাণ্ডের মধ্যে দাঁড়িয়ে পরম বাস্তবতার মধ্য দিয়ে খুঁজেছেন বিন্দু বিন্দু আলো, এগিয়েছেন প্রত্যাশিত গন্তব্যের দিকে।
লায়লা সামাদের জন্ম কলকাতায় ১৯২৮ সালের ৩ এপ্রিল। লায়লার পিতা আমিনুল হক ১৯০৭ সালে আলিগড় ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন; ১৯১১ সাল পর্যন্ত সেখানে পড়াশোনা করেন। পরবর্তী সময়ে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের হোম ডিপার্টামেন্টে রেজিস্টার হিসেবে যোগ দেন। তিনিই ছিলেন হোম ডিপার্টমেন্টে প্রথম মুসলমান রেজিস্টার। লায়লার মা তৎকালীন জলপাইগুড়ির চন্দনবাড়ির বিখ্যাত টি ফ্যামিলির মেয়ে। নাম তাহসিনা খাতুন। শুনেছি সেই সময়ে তিনি খুব ভালো পিয়ানো বাজাতেন। লায়লা সামাদ ১৯৪২ সালে কলকাতার সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং লেডি বেব্রোন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ নারী বন্ধুদের মধ্যে আছেন বেগম সম্পাদিকা প্রয়াত নূরজাহান বেগম, কুলসুম বেগম এবং হুসনা বানু খানম।
অত্যন্ত মেধাবী লায়লা সামাদের লেখা অল্প বয়সেই পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। স্কুল জীবন থেকেই লায়লা সামাদ ভালো বক্তৃতা দিতে পারতেন। দিনাজপুরে বিখ্যাত নাজিমউদ্দিন হলে কয়েকটি সভায় বাবার সঙ্গে তিনিও বক্তব্য রেখেছিলেন। সমাজ বিশ্লেষকরা মনে করেন, লায়লা সামাদ সেই প্রতিভাধরদের একজন, যারা তাদের সময়ের আগেই জন্মগ্রহণ করেন। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় Ahead of times। গ্রহণ, ধারণ ও স্বীকার করার মতো সমাজ সৃষ্টি হওয়ার আগেই তাঁর জন্ম হয়েছিল। যে অভিজাত বনেদি পরিবারে তাঁর জন্ম, সে সমাজ তাঁকে শেকল পরাতে পারেনি। বিয়ে করেছিলেন সেই অন্ধকার সময়ের এক আলোকিত মানুষ, নিবেদিতপ্রাণ কমিউনিস্ট নেতা মির্জা আব্দুস সামাদকে। রাজনৈতিক কারণে তখন মির্জা সামাদকে ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় থাকতে হত। ১৯৫৭ সালে লায়লা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হন। সেই পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন এবং 'বংশীধর জার্নাল স্বর্ণপদক' লাভ করেন। তিনিই পথম মুসলমান নারী যিনি এই পদক পান। ১৯৬০ সালে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল সরোজিনী নাইডুর হাত থেকে তিনি এই পদক আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেন। পদকপ্রাপ্তির এই খবর তখন আনন্দবাজার ও স্টেটসম্যান পত্রিকায় গুরুত্বসহকারে ছাপা হয়েছিল।
কলকাতা থেকে পরবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় এসে তিনি সাংবাদিকতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন। বেগম, পূর্বদেশ, সংবাদ, চিত্রালী ইত্যাদি পত্রিকায় কাজ করার পর তিনি ১৯৭০ সালে চিত্রিতা নামের এক অসামান্য সুস্থ বিনোদন পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক হয়েছিলেন। তাঁর নিজের প্রেস কথাকলি থেকে এই পত্রিকা প্রকাশিত হত। এই পত্রিকার প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে তিনি লিখেছিলেন:
"এভাবে-অনুভব এবং অনুধাবন মানুষের অন্তরলোকে যে আনন্দের সুপ্রাচীন সমুদ্রকে অহরহ উদ্বেলিত করে আমাদের লক্ষ্য সেই সুস্থ নির্মল এবং প্রাণবন্ত আনন্দকে সবার জন্য পরিবেশন করা। তাই বাংলাদেশে যারা সুস্থভাবে সংগ্রাম করেন- তারা সবাই আমাদের এই আনন্দলোক আবিষ্কারের অভিযাত্রায় সহযাত্রী।"
১৯৫২ সালে লায়লা সামাদ ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। যুইফুল রায়ের সঙ্গে কাজ শুরু করেন। নিবেদিতা নাগের সঙ্গে দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগাতেন। লায়লা সামাদ আত্মরক্ষা সমিতির একজন দক্ষ সক্রিয় সংগঠক ছিলেন। ১৯৭০ সালে তিনি দৈনিক সংবাদ পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছেন। তিনিই আমাদের দেশের, প্রথম নারী রিপোর্টার, তাঁর সময়ে যা ছিল অকল্পনীয়। তাঁর মেধা ও সাহসের কাছে সেই দাম্ভিক সময় পর্যুদস্ত হয়েছিল। তিনি ১৯৫০ সালে বেগম পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসেবে সাংবাদিক জীবন শুরু করেন। অনন্যা নামের মাসিক প্রত্রিকা সম্পাদনা ছাড়াও তিনি এ সময়ে কান্তি ও জার্নাল নামে দুটি পত্রিকার সহ-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সাপ্তাহিক চিত্রালীর নারী বিভাগ তমিশ্রা, দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার শিশু বিভাগ চাঁদের হাট দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করেছেন।
লায়লা সামাদ নানা ধরনের ব্যস্ততার মধ্যেও লিখেছেন অজস্র। তাঁর লিখিত বইয়ের সংখ্যা ১২, যার ছয়টিই অনুপম গল্পগ্রন্থ। শিশুদের নিয়ে তাঁর একটা অন্তহীন ভাবনার জগৎ ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, যে সম্ভাবনাময় জগতের স্বপ্ন তিনি দেখছেন তা সৃষ্টি করতে হবে শিশুদের অন্তর্লোকে। তাই তিনি মায়েদের জন্য সুলিখিত ভাষায় লিখেছিলেন 'আপনার শিশুকে জানুন' শিরোনামের বইটি।
সেই অন্ধ সময়ে মঞ্চনাটকেও অভিনয় করেছেন তিনি। ঢাকায় তুলসী লাহিড়ীর 'ছেঁড়া তার'-এ অভিনয় করে তিনি স্বর্ণপদক লাভ করেন। পঞ্চাশের দশকে বেগম পত্রিকার প্রচ্ছদে মডেল হয়েছেন। নিজ যুক্তিতে যখন যে কাজটি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন, সেই কাজটি করতে তিনি দ্বিধা করেননি। কোনো বাধাকে তিনি বাধা মনে করেননি।
স্বামী মির্জা সামাদের সঙ্গে তিনি সক্রিয়ভাবে বাম রাজনীতি করেছেন। তাঁর গৃহশিক্ষক মোখলেসুর রহমান ছিলেন কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদের একজন সহযোগী। লায়লার জীবনে ও এই শিক্ষকের রাজনৈতিক প্রভাব পড়ে। তিনি জলপাইগুড়ির পাড়ায় পাড়ায় পার্টির কাজ করতেন। স্বাধীনতা পিপলস ওয়ার পত্রিকা বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিক্রি করতেন। সবচেয়ে বেশি চাঁদা তোলার জন্য পার্টি তাঁকে পুরস্কৃত করেছিল। এভাবেই রক্ষণশীল মুসলমান পরিবারের এই মেয়েটি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। আফ্রো-এশীয় লেখক সংঘের একমাত্র নারী প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ১৯৭৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের লেখক সম্মেলনে যোগ দেন। ১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র এবং ১৯৮২ সালে দিল্লিতে আফ্রো-এশীয় লেখক সম্মেলনে অংশ নেন তিনি। ১৯৮৫ সালে চেক সরকারের আমন্ত্রণে কবি সুফিয়া কামাল ও লায়লা সামাদ চেকোশ্লাভাকিয়া সফর করেন।
ছোটগল্প লেখায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি 'বাংলা একাডেমি', 'লেখিকা সংঘ পুরস্কার', 'নূরুন্নেসা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনী', 'হাসান হাফিজুর রহমান স্বর্ণপদক' ও 'সুফী মোতাহার হোসেন পদক' পেয়েছিলেন। ইস্কাটন লেডিজ ক্লাব নারী সাহিত্যিকদের পুরস্কৃত করার জন্য 'লায়লা সামাদ সাহিত্য পুরস্কার'-এর প্রবর্তন করেছে। বিজনেস অ্যান্ড প্রফেশনাল উমেন্স ক্লাব, বেগম ক্লাব, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদে যুক্ত থেকে বহু উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন।
সংস্কৃতি জগতে সব বাধার বিরুদ্ধে ছিল তাঁর নিরন্তর সংগ্রাম। সব চেয়ে বড় কথা, সব ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে এ ক্ষেত্রে অন্য নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। আজকের সংস্কৃতি নারী কর্মীদের সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর এই অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি দিতেই হবে। তাঁর প্রগতিশীল সামাজিক-রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের যথার্থ মূল্যায়ন হওয়া দরকার। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের পুনঃপ্রকাশ, বাজারজাতকরণের সঠিক ব্যবস্থা এবং তাঁর কর্মকাণ্ডকে বাঁচিয়ে রাখতে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি, গবেষণা করার উদ্যোগ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন।
নারী ও সাহিত্য সংগঠনগুলো তাদের এই অগ্রদূতকে ভুলে গেলে, যথাযথ মর্যাদা না দিলে, সেই ব্যর্থতার দায়ভার তাদেরই বহন করতে হবে। লায়লা সামদের চরিত্রের মধ্যে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার যে উদাহরণ আছে, টানাপড়েনের অজস্র অভিজ্ঞতার মধ্যে স্তব্ধ সমাজকে ভেঙে-গুঁড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা আছে, তাকে আমাদের উপলব্ধির মধ্যে নিতে হবে।
তাঁর লেখা পড়ে মনে হয়েছে মানুষ যখন স্বপ্ন দেখে তখন সে জিনিয়াস, নির্ভীক এবং শুদ্ধ। তিনি বলেছেন: স্বপ্ন যা কদাচিৎ বাস্তব হয়ে ওঠে, তা-ই একান্তভাবে মানুষের পবিত্র ভালোবাসার ফসল। এই স্বপ্নের মধ্য দিয়ে ভেতরের মানুষটিও দেখা যায়। একটা স্বপ্নের সঙ্গে আরেকটা স্বপ্নের যোগসূত্র খুঁজে নেওয়া যায়। তাই আমরা যারা লেখালেখি ও সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত, তারা সেখান থেকে প্রেরণা ও শক্তি নিতে পারি। এই মহিয়সী নারী ১৯৮৯ সালের ৯ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।
৩ এপ্রিল তাঁর জন্মদিন। গভীর শ্রদ্ধায় তাঁকে স্মরণ করছি।