বাংলাদেশের রাজনীতি: অসম্ভব অস্থির পর্যায়ে চতুর্থ শক্তির সন্ধানে

Published : 15 Feb 2012, 08:57 AM
Updated : 15 Feb 2012, 08:57 AM

বাংলাদেশের রাজনীতির তিনটি পর্যায় আছে। অস্থির, ভীষণ অস্থির এবং অসম্ভব অস্থির। এই মুহূর্তে দেশ মধ্য পর্যায় রয়েছে মনে হয়। পূর্বেও এই স্থানে ছিলো এবং অসম্ভব অস্থির পর্যায়ের দিকে বেশ ভেবে চিন্তে আগাচ্ছে। আমাদের রাজনীতিতে সংঘাতের কোন বিকল্প পন্থা না থাকার কারণে সংঘর্ষের মাধ্যমে সমাধান খোঁজার চেষ্টা করা হয়। দেশের রাজনৈতিক শক্তি বা দল সমূহের ওপরে দোষ দেওয়া হলেও সম্ভবত আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো অনেকটা এর জন্য দায়ি। এই পর্যায়ে প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় শক্তি ক্ষমতায় আসবে সেই নিয়ে কথা শুরু হয়েছে। কে আসবে ক্ষমতায় ? প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শক্তি ?

কয়েক দিন আগে আর্মির একটি অংশ ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে যদিও তাদেরকে খুব একটা সফল গোষ্ঠী মনে হয়নি। যারা এর সাথে জড়িত তারাও খুব একটা উচ্চ পদস্থ ছিলনা; তাদেরকে আর্মির খুচড়া অংশ বলা যায়। এর তথাকথিত নেতা ইসরাক কারও কারও পরিচিত কিন্তু কেউ তাকে সিরিয়াসলি নেয়না বা নেযনি। জিয়ার আমলে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সদস্য ছাড়া কিছু করেছে বলে কারও জানা নেই। অবশ্য খালেদ মোশাররফের ওপর নির্মিত 'Khaled's War' ছবিতে তিনি সেক্টর টু যোদ্ধা হিসেবে বক্তব্য রাখেন। ষড়যন্ত্রে তার আগ্রহের কথা জানা যায়। কিন্তু যে কেউ ষড়যন্ত্র করতে পারে। এটা কার্ও শক্তির প্রমাণ নয়।

সেনাবাহিনীর একটি বিচ্ছিন্ন অংশ ক্ষমতা গ্রহণ করলেও ধরে রাখতে পারে না বাংলাদেশে। তার প্রমাণ ফারুক-রশীদ গ্রুপ, শাফায়েত জামিল খালেদ গ্রুপ এবং তাহের গ্রুপের স্বল্পকালীন ক্ষমতা দখল। জিয়া ও এরশাদ গোটা সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে ক্ষমতায় আসে।

তবে রাজনীতিতে চরমপন্থীদের অবস্থান এবং আর্মি কর্তৃক ক্ষমতা গ্রহণের সম্ভাবনা চলমান দুশ্চিন্তার প্রমান দেয়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনটি প্রধান শক্তি/দল রয়েছে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে সক্ষম এবং এরা যায়। এরা হলো আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও আর্মি। এই বাস্তবতার ভিত্তিতে আজকের রাজনীতি নির্মিত। সামরিক ও বেসামরিক শক্তির মধ্যে পার্থক্য বা দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে অনেক সময় রাজনীতি দেখা হয় কিন্তু আমাদের দেশে এই পার্থক্যের কোন বাস্তবতা বা ভিত্তি নেই। এই তিন দলের মধ্যে শাসন প্রক্রিয়া ও শাসন পদ্ধতির্ও কোন বিশেষ তফাৎ নেই। কোন সরকারই জবাবদিহিমূলক বা নীতিগতভাবে গণতন্ত্রী নয়। সামরিক "সরকার"ও মাঝে মধ্যেই নির্বাচন দেয় এবং তাতে অংশগ্রহণ করে "বেসামরিক" দলসমূহ ক্ষমতায় আসে। সামরিক বা বেসামরিক কোন দলের অধীনে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছে এমন প্রমান পাওয়া দুষ্কর।

বেসামরিক দলগুলো সংকট সৃষ্টি না করলে সামরিক দলের ক্ষমতায় আসার সুযোগ হয় না। সেটা ১৯৭৫ সালের একদলীয় শাসন হোক অথবা ২০০৭ সালের বিএনপির সিইসি নিয়োগ নিয়ে জটিলতা এবং পরবর্তি খুন-খারাপী হোক। কিন্তু শেষের দফা বা ১/১১-এর সময় ক্ষমতা গ্রহণ যেটার মধ্যে সামরিক বেসামরিক মিলমিশ ছিল সেটা একটি পরিবর্তনের ইংগিত বহন করে। এর মধ্যে প্রধান বিষয় হচ্ছে এই তিন সামরিক বেসামরিক দলের কারও পক্ষে একক ক্ষমতা গ্রহণ ও ধরে রাখা সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একসাথে আর্মির চেয়ে সবল যার প্রমাণ ফকরু-মইন শাসনকাল যখন আর্মি কোনঠাসা হয়ে পড়ে এই দুই দলের যৌথ চাপের মুখে। অর্থাৎ কেবল এই তিন দলের মধ্যে দুই দল একত্রিত হলে ক্ষমতা গ্রহণ ও দেশ চালানো সম্ভব । গত ইনিংন্সে বিএনপি এই অংক থেকে নানাবিধ কারণে বাদ যায়। কিন্তু ক্ষমতার সমীকরনটি প্রতিষ্ঠিত বলে মনে হচ্ছে।

এই অবস্থায় আর্মির ক্ষমতা গ্রহণের কোন কারণ বা সুযোগ আছে বলে মনে হয়না। সরাসরি ক্ষমতায় গিয়ে শাসন চালাবার ঝামেলা না করে যদি সুবিধা পাওয়া যায়, তাহলে আর্মি ক্ষমতায় গিয়ে দেশ চালাবার ঝুট ঝামেলা কেন পোহাবে? যেটা আছে সেটা হলো চরমপন্থীদের নিয়ে দুশ্চিন্তা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের উপস্থিতি ছোট বা বড় হোক, কেবল থ্রেট হিসেবেই কাজ করে না, তারা ক্ষমতাবানদের টিকে থাকায় সহায়ক হয়।

আওয়ামী লীগের প্রথম দফায় চরম বামপন্থীদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী অভিযান পরিচালিত হয়। BNP আমলে এটা চলে জাসদ-প্রসূত গণবাহিনীর বিরুদ্ধে। ২০০৮ সালের পরে সেই চরমপন্থী স্থান দখল করে নিয়েছে চরমপন্থী ইসলামী সংগঠন সমূহ। প্রকৃত অর্থে এই সব শক্তিসমূহ কতটা শক্তিশালী সেটাও পরিমাপ করা দরকার। হোক আর না হোক রাষ্ট্রে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার 'মোটা-তাজাকরণ' প্রকল্প এতে লাভবান হয়। এটা ইতিহাসের বাস্তবতা।

বাংলাদেশে কোন চরমপন্থী ইসলামপন্থী দল যার সংগঠণ ক্ষমতায় আসার সুযোগ বা বাস্তবতা আছে কিনা সেটাও দেখা দরকার। আওয়ামীপন্থীরা মনে করেন BNP ইসলামপন্থীদের সাথে হাত মেলাবেন। অর্থাৎ একটা আদর্শগত স্থান রয়েছে তাদের। মনে হয় তারা BNPকে যে মহত্ত আরোপ করেছে সেটা বেজায়গায় পড়েছে। কারণ মনে হয় এই দলের কোনো আদর্শ নাই, ক্ষমতা দখল ছাড়া। ইসলামপন্থীদের সাথে কেন তারা ক্ষমতা ভাগাভাগি করবে?

ভারতের ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান খুবই সুবিধাজনক যে-কোন বাংলাদেশী সরকারের জন্য। যেহেতু ভারত ইসলামপন্থী সরকার কোনদিনই মানবে না তাই তারা, যে-কোন ধরণের এর সহয়তা দিতে প্রস্তুত তাদের বিরুদ্ধে।

মালদ্বীপে তারা এক কাঠি এগিয়ে গিয়ে প্রেসিডেন্ট নাসিদকে সরাতে সহয়াতা করে কারণ তার চরমপন্থী-বিরোধী অবস্থান, সেই শক্তিদেরকেই সবল করছিল যেটা ভারতের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাড়ায়। ভারত বাংলাদেশে চায় একটি মধ্যপন্থী এবং চরমপন্থী-বিরোধী সরকার, কোন বিশেষ দলের সরকার নয়। যে সেটা দিতে পারবে সেই ক্ষমতায় টিকতে পারবে বাংলাদেশে। সেটা আওয়ামীলীগ, বিএনপি বা আর্মি যেই হোক।

অতএব, তৃতীয় শক্তি নয়, চতুর্থ শক্তির সন্ধান বা সনাক্তকরণ দরকার। মনে হয় সেটা হচ্ছে জনগন। এই জনগন ক্ষমতায় বসাতে পারে কিন্তু নিজে ক্ষমতায় যেতে পারে না। নির্বাচনের মাধ্যমে যে দলকে তারা ক্ষমতায় বসায় সে দল তাদের স্বার্থ রক্ষা করে না। আন্দোলন করে এক দলকে নামায়, আরেক দলকে বসায় কিন্তু সেই দল একই কাজ করে।

সম্ভবত সারাক্ষণ তারা ক্ষমতাহীনতায় ভোগে বলেই নির্বাচনের একদিনের বাদশাহীর আনন্দে তারা এত আগ্রহী, গণঅভূত্থানের মাতাল আনন্দে এত নেশাগ্রস্থ। যদি জনগণ খতিয়ে দেখতো তাহলে এই ক্ষমতা দখলের দুই পন্থার প্রতি এতটা আগ্রহ নাও থাকতে পারতো তাদের।

যেখানে এই ত্রিদলীয় সমঝোতার মধ্যে সবকিছু ঘুরছে, সেখানে দলসমূহ কিছু না দিতে পারলেও মানুষ তাদের সমর্থন করছে। তা হলে সেখানে রাজনীতির প্রধান সমস্যা দলসমূহ বা তাদের ব্যর্থতা নয়, জনগণের সকল কিছু মেনে নেওয়ার প্রবণতা। দল সফল বা ব্যর্থ হোক ক্ষমতায় যাওয়ার পথে তাদের কোন বাধা নেই। এই সমস্যা কোন দল সমাধান করতে পারবে বলে মনে হয় না। জনগনই পারে কিন্তু তারা করতে চায় কিনা বোঝা যায় না।

তবে এমন তো হতে পারে যে আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কোন মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু আমাদের চোখে পড়ছে না এমনতো হতে পারে। যে কারণে রাজনীতি একাধিক আনন্দ দানের প্রক্রিযায় পরিণত হয়েছে এবং কোন আর্থ সামাজিক উন্নতি জনগন রাষ্ট্রের কাছে সন্ধান করে না আর।

এই সংকটের সমাধান আছে কি?

আফসান চৌধুরী : নির্বাহী সম্পাদক, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম