বাংলাদেশের মুুক্তিযুদ্ধকে অনেকে অনির্বাচিত কোনো সশস্ত্র রাজনৈতিক শক্তির সশস্ত্র বিপ্লবের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন। আর ওই সব বিপ্লবের নেতার কাজের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কাজ তুলনা করে তারা বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন। কখনও তাঁরা বিচার করেন না, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত স্বাধীন দেশের অভ্যন্তর থেকে বিদেশি হানাদার-শত্রু বিতাড়নের একটি যুদ্ধ। ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের ৯ মাস সময় লেগেছিল ওই শত্রুদের বিতাড়ন করতে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তাদের আমরা বিতাড়ন করতে সক্ষম হই বলেই ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস।
২৬ মার্চ বাংলাদেশের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, ওই ঘোষণাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ভিত্তি ভূমি, অর্থাৎ ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাকে ভিত্তি ধরে ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ ঘোষণাপত্র বা বাংলাদেশের সংবিধানের মাতৃকোষ ঘোষিত হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। এই ঘোষণাপত্রের ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ সংবিধান রচিত হয়। তাই ১৯৭১ সালে ৯ মাস বাংলাদেশে যে যুদ্ধ হয় তা ছিল নিজ স্বাধীন দেশকে হানাদার বাহিনী থেকে মুক্ত করার যুদ্ধ। নির্বাচনের ভেতর দিয়ে আসা একটি স্বাধীন দেশের সব মানুষ এই যুদ্ধ করে।
স্বাধীন বাংলাদেশ নামক যে দেশটি ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে জন্ম নিল, এই দেশ বা রাষ্ট্রটি যে নির্বাচনের ভেতর দিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত তা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বা বাংলাদেশের সংবিধানের মাতৃজনন কোষে স্পষ্ট ভাষায় উল্লিখিত। সবাই জানি, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সারাংশটি এমনই, ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯ ডিসেম্বরের ভেতর অনুষ্ঠিত যে নির্বাচন হয় ওই নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা পাকিস্তানে একটি সরকার গঠন করার জন্য শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু জনগণের হয়ে জনপ্রতিনিধিদের সেই সরকার গঠন করতে দেওয়া হয়নি। বরং তাদের ওপর অবিচারমূলক যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানের সামরিক সরকার ইয়াহিয়া।
এই গণহত্যা শুরু ও যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার পরেই বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত নেতা হিসেবে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। হানাদারদের বিরুদ্ধে সবাইকে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেন। সেটাকেই স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে সব জনপ্রতিনিধি বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে বৈধ ঘোষণা হিসেবে মেনে নেন। আর বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীন দেশের জন্য সরকার গঠন করেন। বঙ্গবন্ধুকে ওই সরকারের প্রধান অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বৈধ সরকার তখন দেশের ওপর ওই ঘোষণাপত্র অনুযায়ী সব আইন প্রণয়ন ও রাজস্ব-সংক্রান্ত সব অধিকার পায়।
অর্থাৎ ২৬ মার্চ যে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষিত হয় ওই রাষ্ট্রটি ১০ এপ্রিল থেকে তাদের সংবিধান ও বৈধ সরকার নিয়ে যাত্রা শুরু করে। রাষ্ট্রটির জন্য তখন পথ চলতে দুুটি মাত্র বাধা থাকে। এক. রাষ্ট্রটির অভ্যন্তরের বেশ কিছু স্থান তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দখল করে রেখেছে। দুই. রাষ্ট্রটির জন্য অন্য রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দরকার।
এই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির জন্য দুটি বিষয় জরুরি ছিল। এক. যারা এই রাষ্ট্র গঠন করেছে তাদের প্রমাণ করতে হবে তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী নয় এবং দুই. রাষ্ট্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে কি না?
কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অন্য একটি গণতান্ত্রিক নতুন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে গেলে প্রথমেই দেখতে হয় যারা নতুন রাষ্ট্র গঠন করেছেন বলে দাবি করছেন, তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী কি না? যদি তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রমাণিত না হয় তাহলে স্বীকৃতি পাওয়ার ৭০ ভাগ শর্ত তারা পূরণ করেন।
বাংলাদেশের এই পাকিস্তানি হানাদার বিতাড়নের যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু যদি পালিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতেন বা আন্ডার গ্রাউন্ডে গিয়ে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের মতো যুদ্ধ পরিচালনা করার চেষ্টা করতেন, তাহলে পাকিস্তানের সামরিক শাসক তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে প্রমাণ করার যথেষ্ট সুযোগ পেত। কিন্তু তাঁর দেশ আক্রান্ত হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধুৃ নিজ বাসভবনে (যা তখন তাঁর অফিস হিসেবেও ব্যবহৃত হত) বসেই স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি তাঁর জনগণকে আক্রমণকারীদের প্রতিহত করার আহ্বান জানান এবং বিশ্ববাসীর কাছে ওই নতুন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি চান।
এই ঘোষণা ও স্বীকৃতি চাওয়ার কাজটি ছিল প্রকাশ্যে এবং নির্বাচিত নেতা হিসেবে। তাই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে তখন তারা একটি স্বাধীন দেশের নির্বাচিত সরকার প্রধানকে গ্রেপ্তার করে। এই গ্রেপ্তারের ভেতর দিয়ে পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ নিজেরাই বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে প্রমাণিত হয়। বঙ্গবন্ধু প্রমাণ করেন, তিনি বা তাঁর দল বিচ্ছিন্নতাবাদী নয়। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যে এভাবে গ্রেপ্তার হওয়ার ভেতর দিয়ে, স্বাধীনতা ঘোষণার পরে এই দেশটির আর বাকি যে বিজয় অর্জন করার ছিল তার ৭০ ভাগ তিনি একাই করলেন। অর্থাৎ তিনি বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণ করলেন, তিনি ও তাঁর দল বিচ্ছিন্নতাবাদী নয়, তাঁরা মূলত নিজস্ব ভূমি থেকে হানাদার মুক্তির জন্য যুদ্ধ করছেন।
গ্রেপ্তার হওয়ার ভেতর দিয়ে যে আন্দোলন, সংগ্রাম বা যুদ্ধ থেকে কোনো নেতা অনুপস্থিত থাকেন না তার প্রমাণ এর আগেও বঙ্গবন্ধু আগরতলা মামলার ভেতর দিয়ে করেছেন। ওই মামলায়ও তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বানানোর চেষ্টা হয়েছিল। জেলখানায় বসেই তিনি তাঁর মানুষের আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান থেকে বঙ্গবন্ধু হিসেবে জেল থেকে বের হয়ে আসেন। পাকিস্তানি জান্তা তাঁকে ও তাঁর সহযোদ্ধাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়। ১৯৭১-এর ৯ মাসেও পাকিস্তানের জেলে যাওয়ার ভেতর দিয়ে তিনি যেমন ৭০ ভাগ যুদ্ধে জিতিয়ে দেন বাঙালিকে, তেমনি জেলে বসেও তিনি আগরতলা মামলার মতো নিজেকে রূপান্তরিত করেন; তাঁর আকৃতি আরও বিশাল হয়।
আগরতলা মামলায় জেলে থেকে শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু হন, আইয়ুবের পতন ঘটে তাঁকে ফাঁসি দিতে গিয়ে। কিন্তু তারপরও পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা জনগণের নেতার শক্তি বুঝতে পারেনি। তারা ১৯৭১ সালে আরও বড় আকৃতির বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। তারা বুঝতে ব্যর্থ হয়, একটি দেশকে অন্য দেশের কারাগারে রাখা যায় না। ইয়াহিয়ার বাহিনী যখন বঙ্গববন্ধুকে গ্রেপ্তার করে সেই সময়ে 'বঙ্গবন্ধু' ও 'বাংলাদেশ' সমার্থক শব্দ। তাই তারা বাংলাদেশকে লায়লাপুর জেলে ভরতে গিয়ে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়।
গণতান্ত্রিক বিশ্ব বলে, নির্বাচিত নেতাকে গ্রেপ্তার করার অধিকার পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের নেই। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের পক্ষ নিলেও তাঁর সিনেটে তিনি বার বার বাধাগ্রস্ত হন পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থনের বিল আনতে। সেদিনের পত্রপত্রিকার খবরগুলো দেখলে আজকের তরুণ প্রজম্ম বুঝতে পারবে, বাংলাদেশের নবগঠিত সরকারকে সেই সময়ে অনেক দেশ প্রকাশ্যে স্বীকার করে বিবৃতি দিতে না পারলেও তারা এটা জোরের সঙ্গে বলে, নির্বাচিত নেতাকে গ্রেপ্তারের পক্ষে তারা কেউ নয়।
এ কথাও সবাই বলেন, একমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানই তাঁর দেশ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী। পাকিস্তানী সামরিক কর্তৃপক্ষ নয়। তাই মুক্তিযুদ্ধে যেমন বজ্রকণ্ঠের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেলে, মাইনে, গ্রেনেডে সবখানে ছিলেন বঙ্গবন্ধু, তেমনি আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রায় এককভাবে লড়াই করেন গ্রেপ্তার হওয়া নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
যে কোনো মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা সংগ্রাম যেমন দেশের মানুষের আত্মত্যাগের মাধ্যমে হয়, তেমনি তার সঙ্গে সহযোদ্ধা হিসেবে দাঁড়ায় গোটা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষ। গোটা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষকে সেদিন বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ানোর নায্যতা দিয়েছিলেন বন্দী স্বাধীন রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জনগণের কূটনীতিতে সেদিন ইয়াহিয়াকে পরাজিত করেছিলেন বন্দী বঙ্গবন্ধু। অর্থাৎ নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্য দিয়ে সরকার গঠন করে, সশস্ত্র পথে হানাদার তাড়ানোর যুদ্ধে সেদিন বঙ্গবন্ধুর ডিপ্লোম্যাসির কাছে হেরে যায় পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ। বিজয়ী হন বঙ্গবন্ধু, রূপান্তরিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে।
পৃথিবীতে বাংলাদেশের এই নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে হানাদার বিতাড়নের মুক্তিযুদ্ধ হওয়ার আগে ঠিক শতভাগ এই ধরনের আর কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ ছাড়া আর যে বিপ্লবগুলো হয়েছিল তা সম্পূর্ণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চরিত্রের বিপরীত। ওই সব বিপ্লবের সঙ্গে মিলিয়ে বাংলাদেশের হানাদার মুক্তির যুদ্ধকে দেখা হয় বলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির বিষয়টি বিশ্লেষণে ভুল হয়। অনেকেই ভুল করে বলেন, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন।