হেফাজতে ইসলাম আমাদের কী বার্তা দিচ্ছে?

বিজন সরকার
Published : 31 March 2017, 12:38 PM
Updated : 31 March 2017, 12:38 PM

শাপলা চত্বর দেশের রাজনীতিতে একটি 'অশনি সংকেতবাহী' এলাকা। কথিত ১৩ দফার দাবিতে ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলাম শাপলা চত্বরে যে মধ্যযুগীয় তাণ্ডব চালিয়েছিল, সেটির মানসিক আঘাত দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ এখনও ভুলতে পারেনি বলেই অনুমেয়। ৫ মে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের মতো মানবসভ্যতার পরিপন্থী, উগ্রবাদী কর্মকাণ্ড সমকালীন বিশ্বের কোনো গণতান্ত্রিক সমাজেই তেমন একটা দেখা যায় না। হেফাজতে ইসলামের ৫ মে সমাবেশের নামে জঙ্গিপনার মতো দুটি উদাহরণ চোখের সামনে ভাসে– এর একটি ঘটেছিল তালেবান দ্বারা ১৯৯৫ সালে আফগানিস্তানের হেরাতে এবং অন্যটি জঙ্গিদের আদর্শিক অনুপ্রেরণার সংগঠন মুসলিম ব্রাদার্স হুড দ্বারা ২০১৩ সালে মিসরে।

২০১৩ সালের ৫ মে ধর্মান্ধের হিংস্র রূপটি দেশের আপসকামী রাজনীতি যেমনভাবে প্রত্যক্ষ করল, তাতে আপসকামী রাজনীতি আরও আপসকামীতর হয়ে পড়েছে। সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির যেটুকু ভাবমূর্তি এখনও অবশিষ্ট রয়েছে, সেটিতে দেখা দিয়েছে হতাশা ও আতঙ্কের ছাপ।

৫ মের সমাবেশটির চরিত্রে কয়েকটি প্যারামিটার স্পষ্টই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের সামাজিক চিত্র রূপায়িত করে। চিত্রটি ১৯৯৫ সালে সেপ্টেম্বরে ইরান-সীমান্তবর্তী আফগানিস্তানের হেরাত প্রদেশকে তালেবানদের দ্বারা দখলকৃত চিত্রটির একটি কার্বন কপি মাত্র। পার্থক্য এই, তৎকালীন আফগানিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলিতে ও দেশটির সমাজে আরবীয় কালচার ও অতি মাত্রায় রাজনৈতিক ইসলামিকরণের কারণে তৎকালীন আফগান প্রেসিডেন্ট বোরহানউদ্দিন রব্বানি সরকার তালেবানদের সামান্যতম প্রতিরোধ করতে পারেনি। ১৯৯৮ সালের মধ্যেই তালেবান আফগানিস্তানের ৯০ ভাগ এলাকা দখল করে নেয়। আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজে প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িকতার প্রদীপটিতে এখনও আলো জ্বলছে। ফলে বাংলাদেশ ৫ মে একটি তালেবানি শাসনব্যবস্থা থেকে রক্ষা পেয়ে যায়। তবে প্রদীপটি যে অবস্থায় আছে তাতে কতদিন বাংলার তালেবানদের ক্ষমতার মসনদ থেকে দূরে রাখা যাবে, তেমন একটি আশঙ্কা তীব্রতর হচ্ছে।

৫ মের সমাবেশে তিনটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রথমটি হল হেফাজত ইসলামের সাংগঠনিক সক্ষমতা। সমাবেশটিতে লোকসমাগমের পরিমাণ দেশে ইতিহাস সৃষ্টিকারী সমাবেশের মতো। একটি অরাজনৈতিক সংগঠন যেটির জন্মই হয়েছে ৫ মে সমাবেশের তিন বছর আগে সেটির দ্বারা লাখ লাখ মানুষ 'মোবাইলাইজ' করার বিষয়টি সমাজের ভেতরের চিন্তা-চেতনার সংকেতবাহী রূপ মাত্র।

হেফাজতে ইসলাম গঠিত হয়েছিল ২০১০ সালের জানুয়ারির ১৯ তারিখে। হেফাজতে ইসলাম গঠিত হয়েছিলে এমন একটি প্রেক্ষাপটে যখন দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতের রাজনীতি বন্ধের দাবি গণদাবিতে পরিণত হচ্ছিল। বলা যায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু এবং দেশে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি বন্ধের দাবির ঘটনাকে অনুসরণ করেই হেফাজতে ইসলামের জন্ম। বাংলাদেশে জামায়াত-শিবিরের সম্ভাব্য শূন্যতাকে বিবেচনাতে নিয়েই হেফাজতে ইসলামের জন্মের অনুপ্রেরণা।

যদি হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবির প্রতিটি দফা জামায়াতের রাজনীতির উদ্দেশ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যায়, কোথাও কোনো পার্থক্য দেখা যায় না।

হেফাজতে ইসলাম প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে কথা বলে মাঠ গরম করে। সাম্প্রদায়িক ভারত উপমহাদেশের ধর্মীয় উসকানি ও এর ত্বরিত ফলাফলের ইতিহাস হেফাজতে ইসলামের নীতি-নির্ধারকেরা ভালো করেই জানেন। যেখানে অন্য ধর্মের মানুষদের ছোট করে দেখা কিংবা তাদের প্রতি বিরাগভাজনপূর্ণ মানসিকতা ধর্মীয় পুণ্যের প্যারামিটারে এগিয়ে রাখা হয়, সেখানে ধর্মনিরপেক্ষ যে কোনো অনুষঙ্গের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বিনা পরিশ্রমে ও অর্থে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করা যায়।

হেফাজতে ইসলামের নীতি-নির্ধারকেরা জানেন যে, খণ্ডিত ভারতের পেছনে বাংলার দুটি বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাই বেশি রসদ জুগিয়েছে: একটি কলকাতার ময়দান এবং অন্যটি আমাদের নোয়াখালীর ধর্মীয় দাঙ্গা। প্রসঙ্গত, কলকাতার দাঙ্গার স্থান বাংলা সাহিত্যে থাকলেও নোয়াখালীর দাঙ্গায় যে প্রায় অর্ধ লক্ষ মানুষ হতাহত হয়েছে সেটি বাংলা সাহিত্যের কোথাও স্থান পায়নি।

২০১১ সালে হেফাজতে ইসলাম নারীনীতির বিরুদ্ধেও মাঠে নামে। সরকার কর্তৃক যে সিদ্ধান্তটি দেশের সমাজব্যবস্থার উদার চিত্রটি উজ্জ্বল করেছে, হেফাজতে ইসলাম সেখানেই বিরোধিতা করেছে। এমতাবস্থায় কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক এই সংগঠনটি প্রগতিশীলতার বিরোধী সব শক্তির সমর্থন খুব সহজেই আদায় করে নেয়।

সংগঠনটির ৫ মে সমাবেশের আরেকটি চরিত্র ছিল মধ্যযুগীয় তাণ্ডবের চিত্রটি। যে ধ্বংসযজ্ঞ দিনব্যাপী চালিয়েছিল, সেটি স্বাধীন বাংলাদেশ এর আগে কখনও প্রত্যক্ষ করেনি। একটি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় যে কোনো সংগঠন তার দাবিদাওয়া জানাতেই পারে। হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় মানানসই কি না, সেটি একেবারেই ভিন্ন বিতর্ক। তবে তাদের দাবি পেশ করা এবং বাস্তবায়নের জন্য গণতান্ত্রিক নিয়মনীতি মেনেই সরকারকে চাপ দেওয়া অধিকার তাদের অবশ্যই রয়েছে।

তবে তারা ৫ মে সমাবেশের নামে যে জঙ্গি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছিল এবং পুরো জাতিকে আতঙ্কের মধ্যে রেখে তাদের দাবি আদায় করতে চেয়েছিল, পদ্ধতিটি ছিল হেরাত প্রদেশে তালেবানের আন্দোলনের মতোই। একটি কট্টর ধর্মীয় মানসিক কাঠামোকে মননে ধারণ করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিশ্বাস স্থাপন যে সম্ভব নয়, আজকের বিশ্বে এটি প্রমাণিত। এমতাবস্থায়, সুবিধামতো সময়ে ও সুযোগে তাদের দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য কোনো গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ধার হেফাজতে ইসলাম ধার ধারবে না বলেই মনে হয়। ৫ মে সমাবেশের পর হেফাজতে ইসলাম যতবারই মাঠে নামতে চেয়েছে, সরকার এবং পুরো জাতিকে প্রত্যক্ষভাবেই ৫ মে সমাবেশের কথা স্মরণ করিয়ে হুমকি দিয়েছে, এখনও দিচ্ছে।

বিবিসি বাংলার এক অনুষ্ঠানে হেফাজতে ইসলামের উচ্চপর্যায়ের এক নেতাকে আবারও প্রচ্ছন্ন হুমকি দিতে শোনা গেছে। তারা ৫ মের ধ্বংসযজ্ঞকে তাদের দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য 'ট্রেডমার্ক' হিসেবে ব্যবহার করছে। মানে দাবি মেনে নাও, না হলে আমরা আবারও শাপলা চত্বরে আসব, সব গাছ কেটে ফেলব, ভাস্কর্য ভাঙব, ব্যাংকে আগুন দেব ও বৈদ্যুতিক খুঁটি ফেলে দিয়ে ভূতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি করব।

হেফাজতে ইসলামের ৫ মে সমাবেশের বড় তাৎপর্যপূর্ণ চরিত্র হল ক্ষমতার রাজনীতি। হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের পেছনে মূল নিউক্লিয়াস ছিল কথিত নাস্তিক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করা। হেফাজতে ইসলাম ধর্ম অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহিতার বিচারের জন্য জাতীয় সংসদে ব্লাসফেমি আইন চায়; একই সঙ্গে রাষ্ট্রে সৃষ্টিকর্তার আইনের বাস্তবায়ন চায়। নাস্তিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করলেও স্বঘোষিত নাস্তিক ফরহাদ মজহারকে তাদের আন্দোলনের 'থিং ট্যাংক' হিসেবে মেনে নেয়।

নারী সমাজকে ঘরবন্দি করে রাখার দাবি জানালেও এরশাদের মতো একজন মানুষের হাতে হেফাজতে ইসলামের শসা ও পানি খেতে ইমানে লাগেনি! কাজী জাফরের মতো একজন দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদকে মঞ্চে নিয়ে ইমানি আন্দোলনের শ্লোগান দিতে হেফাজতে ইসলামের ঈমান নষ্ট হয়নি। ধর্মীয় শিক্ষক হয়ে সন্ধ্যা ৬টায় শাপলা চত্বর থেকে চলে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঢাকায় ঢুকে খালেদা জিয়ার আহ্বানে সারা রাত রাষ্ট্রের সম্পদ ধ্বংস করতে হেফাজতে ইসলামের ইমানে বাধেনি।

হেফাজতে ইসলাম মৌলিক ও আদর্শিক কাঠামোর বিবেচনায় একটি অরাজনৈতিক মুখোশে একটি মধ্যযুগীয় রাজনৈতিক শক্তি। এমনকি হেফাজতে ইসলাম দেশের এত এত জঙ্গি হামলার পরও মুখে কলপ দিয়েছিল; জামায়াতের দেশব্যাপী জঙ্গি কর্মকাণ্ডেও হেফাজতে ইসলামকে নির্লিপ্ত থাকতে দেখা গেছে। গুলশান হামলার পর পুলিশ প্রধান হেফাজতে ইসলামের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পর হেফাজতে ইসলামকে অনেকটা অনিচ্ছায় নিন্দা জানিয়ে একটি বিবৃতি দিতে দেখা গেছে। দেশের জঙ্গি হামলা এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলার বিষয়ে হেফাজতে ইসলামের নেতাদের প্রশ্ন করা হলে নেতারা যে ন্যারেটিভস লাইনের সমান্তরালে গিয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে উত্তর দেন, সেটি উগ্রবাদের প্রতি একধরনের কৌশলগত সমর্থন মাত্র। জন্মের পর থেকে হেফাজতে ইসলাম একটি অরাজনৈতিক 'রিজার্ভ ফোর্স' হিসেবে মুখোশ পরে থাকলেও সেটি আমাদের ভালনারেবল রাজনীতিতে যে কোনো সময় সামনে চলে আসতে পারে।

পরিবর্তনশীল বিশ্ব রাজনীতি, বিশেষ করে ধর্মীয় উগ্রতার বিপক্ষে যে ভূরাজনীতি এখন দেখা যাচ্ছে, সেটির কারণে কিছুটা হয়তো হেফাজতে ইসলামের ক্ষমতার রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় ভাটা পড়েছে। ৫ মের পর হেফাজতের ইসলামের নেতা বাবু নাগরীকে জিজ্ঞাসাবাদে যে তথ্য পাওয়া যায়, সেটিতে হেফাজতে ইসলামের রাজনৈতিক ক্ষমতার খোয়াবটি প্রকাশ হয়ে পড়ে। বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতায় গেলে হেফাজতে ইসলামের কে কে মন্ত্রিত্ব পাবে, কিংবা হেফাজতে ইসলাম একা সরকার গঠন করলে বাবু নাগরী প্রধানমন্ত্রী হবেন কি না, তা দেশের জাতীয় দৈনিকগুলিতেই দেখা গিয়েছিল। ফলে হেফাজতে ইসলাম একটি অরাজনৈতিক সংগঠন– এটি শতভাগ মিথ্যা। বলা যায়, হেফাজতে ইসলাম ইমানি আন্দোলনের আড়ালে নিজেদের রাজনৈতিক খোয়াবের পিছনে দৌড়াচ্ছে।

ক্ষমতার রাজনীতির কারণেই কেবল হেফাজতে ইসলাম দেশের শিল্প-সাহিত্যের অনুষঙ্গেও একধরনের প্রভাব বিস্তার করছে। একুশের বইমেলা ও বাংলা একাডেমিতে এই সংগঠনটির প্রভাব যে দেশের ইনক্লিউসিভ সমাজের অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে, সেটি দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়। পাঠ্যপুস্তকেও হেফাজতে ইসলামের চিন্তা-চেতনার প্রভাব পড়েছে। হেফাজতে ইসলামের পরামর্শে একটি বিশেষ ধর্মের কারণে যখন কোনো লেখকের লেখা পাঠ্যবই থেকে বাদ দেওয়া হয়, তখন আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে, আমরা কতটা হেফাজতি ভয়ে তটস্থ। সেই তটস্থ হয়ে যাওয়ার কারণেই কবি নজরুলের কবিতায় 'শশ্মান' শব্দটি 'গোরস্থান' হয়ে যায়; ছোট ছোট শিশুরা ওড়না ওড়ায়; ছাগল গাছে ওঠে।

ইসলাম বৈচিত্র্যপূর্ণ, সুন্দর, সমৃ্রধ ও মানবিক বিশ্বাস। ফলে ইসলামের কৃষ্টি-কালচার সভ্যতার পরিপূর্ণতার জন্যই অপরিহার্য। তার মানে এই নয় যে, আমাদের 'শশ্মান' শব্দটির জায়গায় 'গোরস্থান' বসিয়ে ইসলামকে কৃত্রিম পদ্ধতিতে প্রাধ্যন্য দিতে হবে।

পাঠ্যপুস্তকে যা ঘটেছে সেটি কেবল হেফাজতে ইসলামের আশা-আকাঙ্ক্ষা নয়। মোটা দাগে এটি জামায়াত থেকে শুরু করে নিষিদ্ধ সংগঠন হিজবুত তাহরির ও আনসারউল্লাহ বাংলা-টিমসহ অন্যান্য সব কট্টর ধর্মীয় গোষ্ঠীর আদর্শ। সন্দেহ নেই যে, পাঠ্যপুস্তকে হেফাজতে ইসলামের হস্তক্ষেপ দেশের উগ্রবাদী চিন্তাচেতনা কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছে। নির্মোহ বিচার্যে হেফাজতে ইসলামেরও কোনো ধরনের জয় হয়নি; কেবল পরাজয় হয়েছে দেশের ক্ষয়িষ্ণু ও অপুষ্টিতে আক্রান্ত প্রগতিশীলতার। দেশের অসাম্প্রদায়িক মলিন চেহারাটা আরও মলিনতর হয়েছে। আতঙ্কিত মানুষগুলির মুখমণ্ডলের আতঙ্কের ছাপ আরও পুরু হয়েছে।

পাঠ্যপুস্তকের আত্নঘাতী সফলতার পর হেফাজতে ইসলামের দৃষ্টি সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ন্যায়পরায়ণতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত 'গ্রিক দেবী' থেমিসের ভাস্কর্যটির দিকে। হেফাজতে ইসলাম দাবি তুলছে এই ভাস্কর্য অপসারণ করার; কারণ হিসেবে হেফাজতে ইসলাম উল্লেখ করেছে– এতে নাকি ধর্মীয় অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং কয়েকটি অনলাইন পোর্টালের খবরে দেখা গেল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হেফাজতে ইসলাম ঘোষণা দিয়েছে যে, এই মূর্তি অপসারণ না করলে দেশের সব মূর্তি ভেঙে ফেলা হবে। দেশে বসবাসকারী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। প্রয়োজনে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে।

অথচ আইনশাস্ত্রের গোড়াপত্তন ঘটে সেই রোমানদের শাসন আমলেই। কেবল গোড়াপত্তন নয়, রোমানদের আমলেই আইনশাস্ত্রের প্রভূত উন্নয়ন ঘটে। গ্রিক মিথের দেবী থেমিস সেই থেকেই আইনশাস্ত্রে ন্যায়পরায়ণতার প্রতীক হিসেবে মূল্যায়িত হয়ে আসছে।

অধিকন্তু, এটি এমন কোনো মূর্তি নয় যে, মানুষ পরকালের জন্য তার সামনে প্রার্থনা করে। হেফাজতের ইসলাম নেতাদের হয়তো জানা নেই থেমিসের এই মূর্তি মিসর, ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্কসহ বহু মুসলিমপ্রধান দেশে রয়েছে। তাছাড়া মুসলিমের বিশ্বের প্রতিটি দেশেই রয়েছে শত শত বছর আগের নান্দনিক সব ভাস্কর্য।

সেই সব ভাস্কর্য একটি সমাজের অতীত চিত্র ধারণ করে, যা দেখে আমরা সেই সমাজের জীবনপ্রবাহের নানা দিক বুঝতে পারি। আমরা বর্তমান সভ্যতার সঙ্গে অতীত সভ্যতার একটি তুলনামূলক চিত্র পাই। ফলে জ্ঞাননির্ভর সেই সব ভাস্কর্য কিভাবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয় সেটি বোঝা খুবই দুরূহ। যদি ভাস্কর্য দেখেই আমাদের ধর্মীয় অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে, সেই অনুভূতি জাতির জন্য আতঙ্কের; দেশকে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেনের পথে যাওয়ার সহায়ক অনুভূতি। এই অনুভূতি যতই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যখন তখন আঘাতপ্রাপ্ত হবে, জাতির ভবিষ্যৎ ততই অন্ধকারের দিকে ধাবিত হবে।

হেফাজতে ইসলামের নেতাদের একটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা করতে হবে। বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের জন্য একসময় সারা বিশ্ব মুসলিম বিশ্বের দেশগুলির দিকে তাকিয়ে থাকত। আজ যেমন আমরা স্ট্যানফোর্ড, এমআইটি ও হার্ভার্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি, ঠিক এমন একটা সময় ছিল সারা বিশ্বের জ্ঞানপিপাসী মানুষদের স্বপ্নের দেশ ছিল ইরাক, ইরান ও সিরিয়ার মতো মুসলিম বিশ্বের দেশগুলি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে হেফাজতে ইসলামের ট্রেড মার্কা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত পেতে পেতে সেই ইরাক ও সিরিয়ার মানুষগুলি এখন অন্য দেশে আশ্রয়ের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিচ্ছে, সাগরে ডুবে মারা যাচ্ছে।

আধুনিক সভ্যতা আজ বহুদূর এগিয়ে গেছে। ইচ্ছে করলেই এটিকে থামিয়ে রাখা যাবে না। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের বাজারি শ্লোগান তুলে মানববসতি এই গ্রহের নির্দিষ্ট কোনো জাতিগোষ্ঠী কিংবা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে ধর্মীয় উন্মাদনায় হয়তো নিমজ্জিত করা যাবে, তবে এই গ্রহে অন্যান্য জ্ঞানপিপাসী ও বিজ্ঞানমনস্ক জাতিগোষ্ঠীদের দাবিয়ে রাখা যাবে না। একবিংশ শতাব্দীতে এসে হেফাজতে ইসলাম আমাদের জঙ্গলে নিয়ে গেলেও জ্ঞানপিপাসী ও বিজ্ঞানমনস্ক জাতিগোষ্ঠী ঠিকই মঙ্গলে যাবে।

এমতাবস্থায় একটি প্রশ্নই বারবার মনে ফিরে আসে। প্রশ্নটি হল 'হেফাজতে ইসলাম আমাদেরকে কী বার্তা দিচ্ছে?'