মধুর ক্যান্টিনে এরশাদের জন্মদিন পালন: ভুলে কি যাচ্ছি প্রতিবাদের ইতিহাস?

নাদির জুনাইদ
Published : 22 March 2017, 05:21 PM
Updated : 22 March 2017, 05:21 PM

২১ মার্চ সকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রথম পাতায় চোখ বুলাতেই ডান দিকে স্পটলাইট অংশে খবরটি (http://bangla.bdnews24.com/politics/article1306615.bdnews) চোখে পড়ল। রাজনৈতিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে সচেতন ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদী আন্দোলন যে স্থান থেকে সংহত হয়েছে বার বার, স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে ঝাঁঝাঁলো স্লোগানে বিভিন্ন সময়ে প্রকম্পিত হয়েছে যে প্রাঙ্গন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ঐতিহ্যবাহী মধুর ক্যান্টিনে দেশের সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জন্মদিন কেক কেটে উদযাপন করেছে এরশাদের অনুসারী জাতীয় ছাত্র সমাজ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ এম আমজাদ জানিয়েছেন, এই ছাত্র সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯০ সাল থেকে নিষিদ্ধ। তারা ক্যাম্পাসে কোনো কর্মসূচির অনুমতি পাবে না এবং কর্মসূচি পালন করতেও পারবে না। কিন্তু দেখা গেল জাতীয় ছাত্র সমাজ অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা সেই সেনাশাসকের ছবি টাঙ্গিয়ে জন্মদিন উদযাপন করল মধুর ক্যান্টিনেই যে স্থান শুধুই একটি ক্যান্টিন নয়, তা রাজনৈতিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের একটি প্রতীক।

১৯৯০ সালের অক্টোবর মাস থেকে স্বৈরশাসনবিরোধী যে তুমুল গণআন্দোলন শুরু হয়, এবং যার ফলশ্রুতিতে দুই মাস পরেই এরশাদ ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন, সেই আন্দোলন সফল করতে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা ছিল সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য নামে সমবেত হওয়া সব ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের। ইসলামী ছাত্র শিবিরকে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যে নেওয়া হয়নি যা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চক্রের প্রতি সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের কঠোর মনোভাব স্পষ্ট করেছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতৃত্বে তীব্রতর হয়েছিল ১৯৯০এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন যা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে, আর তার মাধ্যমেই এরশাদের নয় বছরের শাসনের অবসান ঘটেছিল। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদের অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এরশাদবিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী ছাত্ররা সমবেত হয়েছে মধুর ক্যান্টিনে, অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সব স্থান তেমন একটি স্থানে এই ২০১৭ সালে সাবেক স্বৈরশাসকের জন্মদিন উদযাপন করা কি হঠাৎ ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা? নাকি তা নির্দেশ করে এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অগ্রসর জায়গাতেও গৌরবময় রাজনৈতিক আন্দোলন, রাজনৈতিক প্রতিবাদের ইতিহাস ভুলে যাচ্ছে বর্তমান প্রজন্মের মানুষরা?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে সক্রিয় ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতারা বলেছেন যখন এরশাদের জন্মদিন উদযাপন করা হচ্ছিলো তখন তারা কেউ মধুর ক্যান্টিনে উপস্থিত ছিলেন না। হয়তো তারা উপস্থিত থাকলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ ছাত্রসংগঠনটি জন্মদিন উদযাপনের সুযোগ পেত না। আবার এমনটিও তো হতে পারে জাতীয় ছাত্রসমাজের সদস্যরা চিন্তা করেছে বর্তমান ভোগবাদী সময়ে বিস্মৃতি আর ইতিহাসবিমুখ মনোভাবই বেশি। আর আদর্শিকতার পরিবর্তে আত্মস্বার্থের প্রতি আগ্রহই এখন প্রবল। তাই স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছাত্রদের সভা আর স্লোগানে মুখর থেকেছে যে মধুর ক্যান্টিন সেখানেই তারা এরশাদের শাসন অবসানের ২৭ বছর পর তার জন্মদিন পালনের পরিকল্পনা করতে দ্বিধা করেনি।

ইতিহাস ভুলে যাওয়া কি সমাজের জন্য কোনো মঙ্গল নিয়ে আসতে পারে? চিন্তাশীল মানুষমাত্রই অনুধাবন করবেন ইতিহাস মনে রাখার গুরুত্ব অপরিসীম। ইতিহাস ভুলে গেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে নূর হোসেন, রাউফুন বসুনিয়ার যে ভাস্কর্য এবং ডা. মিলনের স্মৃতিস্তম্ভ আছে তা অক্ষয় কোনো স্মৃতির প্রতীক হওয়ার পরিবর্তে কেবলই জড়বস্তু হয়ে থাকবে এই প্রজন্মের তরুণদের জন্য। কেন এই মানুষদের অকালে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল আর কেনই-বা তরুণ আওয়ামী লীগ কর্মী নূর হোসেন খালি গায়ে বুকে পিঠে 'স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক' স্লোগান লিখে রাজপথে নেমে এসেছিলেন কোন স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ জানাতে তাও জানবে না নতুন প্রজন্ম।

বর্তমান সময়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেনটাইন ডে উদযাপনের চাকচিক্যে বাংলাদেশের তরুণদের জানাই হবে না ১৯৮৩ সালের এই দিন ছিল 'স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস' যেদিন গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিল অজস্র ছাত্র আর তারপর রাজপথে শুরু হয়েছিল হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর অংশগ্রহণে সরকারবিরোধী সাহসী মিছিল। মিছিলকারীদের উপর সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিবর্ষণে সেদিন প্রাণ হারিয়েছিলেন জাফর, জয়নাল, আইয়ুব, কাঞ্চন, দীপালি সাহা প্রমুখ। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সরকারবিরোধী মিছিলে পুলিশের ট্রাক তুলে দেওয়া হলে অত্যন্ত করুণ মৃত্যু হয়েছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দুই নেতা সেলিম আর দেলোয়ারের।

এই শহীদদের তো আমরা ভুলে যেতে পারি না। যদি ভুলে যাই তাহলে অন্যায় আর নির্মমতা কী এবং কেন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়া জরুরি তা অনুধাবন করতেও তো আমরা ব্যর্থ হব। এই বিস্মৃতির মাধ্যমে নিরাপদ থাকবে না আমাদের বর্তমান আর ভবিষ্যৎ। তেমনি আমাদের মনে রাখতে হবে এরশাদের শাসনকালে সরকারি হস্তক্ষেপের কারণে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২৭১ দিন বন্ধ ছিল।

[মোহাম্মদ হাননান, পৃষ্ঠা- ৭৫]

ছাত্রদের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন যেন জোরালো রূপ লাভ না করে এজন্য প্রায়ই সরকার কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হত। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে তাই তৈরি হয় ভয়াবহ সেশন জ্যাম যার ক্ষতিকর প্রভাব-পরবর্তী অনেক বছর ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বহন করতে হয়েছে। নষ্ট হয়েছে তাদের শিক্ষাজীবনের মূল্যবান বছর।

১৯৯০ সালের অক্টোবর মাসে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছিল। এমনকি যে কোনো সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার অধিকার সম্পর্কে একটি অধ্যাদেশ ১৫ অক্টোবর জারি করা হয়। দেশের সচেতন মানুষরা এই অধ্যাদেশের তীব্র বিরোধিতা করেন।

[মোহাম্মদ হাননান, পৃষ্ঠা- ১৬৯]

এই অধ্যাদেশ উপেক্ষা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র, কর্মচারীরা ১১ নভেম্বর খুলে দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ক্রমেই পূর্ণতা পায় এবং ফলশ্রুতিতে এরশাদ ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।

প্রবল গণআন্দোলনের কারণে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সময়ে তার সামরিক সচিব ছিলেন মেজর জেনারেল মনজুর রশীদ খান। তাঁর বর্ণনা থেকে জানা যায়, ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরের শুরুতে সেনা সদর দপ্তরে অফিসাররা মতপ্রকাশ করেছিলেন প্রেসিডেন্ট এরশাদের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে যে আন্দোলন চলছে তা থামানোর জন্য বা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সেনাবাহিনীকে যেন আর কোনোভাবেই ব্যবহার করা না হয়।

[মনজুর রশীদ খান, পৃষ্ঠা- ২২২-২২৩]

অর্থাৎ এরশাদের পক্ষে থেকে সেনাবাহিনী সেই সময় দেশবাসীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চায়নি। বাংলাদেশের দুই সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া আর জেনারেল এরশাদ সম্পর্কে মনজুর রশীদ খান লিখেছেন:

১৯৭৫এর ১৫ আগস্টের পর থেকে দুই সেনাবাহিনী প্রধানের ক্ষমতার রাজনীতি আমি লক্ষ করে আসছি। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী ছিল তাদের স্প্রিংবোর্ড স্বরূপ। জেনারেল জিয়াউর রহমানই এই কাজটা প্রথম শুরু করেন। তিনি সে সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে সামরিক ও বেসামরিক নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে প্রতিরক্ষা বাহিনীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও জনশক্তি ব্যবহার করে বেসামরিক প্রশাসন ও রাজনীতিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। সেনাপ্রধান হিসেবে পুরো সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক আজ্ঞানুবর্তিতা ও আনুগত্যের সুযোগ নিয়ে প্রথমে ক্ষমতা দখল, তারপর ক্ষমতা সুসংহত করা এবং সবশেষে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য উল্লিখিত দুজনই প্রতিরক্ষা বাহিনীকে যথেচ্ছ ব্যবহার করেন। উভয়ই নিজেদের ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সামরিক বাহিনীকে তুষ্ট রাখতে তাদের নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে জেনারেল এরশাদই কয়েক ধাপ এগিয়ে। এর ফলে সব বাহিনীর সদস্যই দেশের রাজনীতিসচেতন জনগণের সমালোচনা ও বিদ্বেষের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন।

[ঐ, পৃষ্ঠা ২২৪-২২৫]

নির্বাচিত সরকার উৎখাতের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সময় জেনারেল এরশাদ সেনাবাহিনীর সমর্থন পেলেও ১৯৯০এর গণআন্দোলনের উত্তাল সময়ে সামরিক বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আর এরশাদের পক্ষে থাকেননি। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি মদদে অস্ত্রধারী মাস্তানদের ঢুকিয়ে দিয়েও 'এরশাদ হটাও' আন্দোলন বন্ধ করা যায়নি।

২৫ নভেম্বর থেকে অস্ত্রধারী যুবকরা বার বার সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের মিছিলে গুলিবর্ষণ করে। অস্ত্রের জোরে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু হাজার হাজার সাধারণ ছাত্র তখন সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের সাথে যুক্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মল চত্বর, কলাভবন এলাকা, টিএসসি, বাংলা একাডেমি, দোয়েল চত্বর প্রভৃতি স্থান পরিণত হয়েছিল রণক্ষেত্রে। অজস্র ছাত্রের স্বতঃস্ফূর্ত এবং সাহসী প্রতিরোধের মুখে অস্ত্রধারী যুবকরা পালাতে বাধ্য হয়। কিন্তু তাদের গুলিবর্ষণের সময়ই ২৭ নভেম্বর নিহত হন ডা. শামসুল আলম খান মিলন।

ডা. মিলনের মৃত্যু এরশাদবিরোধী বিক্ষোভের আগুন আরও বাড়িয়ে তোলে। সেদিনই দেশে জরুরি আইন ঘোষণা করা হয়। কিন্তু জরুরি আইন, কারফিউ উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতা মিছিল নিয়ে রাজপথে নেমে আসে বারবার। শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা, আইনজীবী, ডাক্তাররা সরকারের অধীনে কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেন।

[মোহাম্মদ হাননান, পৃষ্ঠা- ২০০-২০৫; বেবী মওদুদ, পৃষ্ঠা- ৯৩-৯৪]

আর কদিন পরই পতন ঘটে স্বৈরাচারী সরকারের। সফল হয় ১৯৯০এর গণআন্দোলন।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। কেন তাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত করা হয়েছে তার ব্যাখ্যা ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা দিতে পারবেন। এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নির্দেশ করে নাকি করে না তার যুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণও সচেতন মানুষদের পক্ষে করা সম্ভব। কিন্তু তিনি এখন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হলেও আমাদের অতীত ভুলে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশে বার বার জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছিল।

১৯৯০এ এরশাদের বিরুদ্ধে গণমানুষের প্রতিবাদী জাগরণ 'স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন' হিসেবে পরিচিত এবং সেই আন্দোলন ভুল ছিল এমন দাবিও কেউ করতে পারবেন না। বাংলাদেশের প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের হিংস্র, দানবীয় মুখভঙ্গি তুলে ধরে যে পোস্টার এঁকেছিলেন তা সারা বিশ্বের মানুষকে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বর্বর অত্যাচার আর গণহত্যা সম্পর্কে সচেতন করেছিল। কামরুল হাসান ১৯৮৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি 'দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে' এই শিরোনামেও আরেকটি আলোচিত স্কেচ করেছিলেন যার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে তাঁর তীব্র সমালোচনা।

আমরা তো ভুলে যাব না নূর হোসেন ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর নিজের উদোম বুকে 'স্বৈরাচার নিপাত যাক' স্লোগান লিখে রাজপথে নেমে এসেছিলেন। তারপরই পুলিশের গুলিতে তাঁর মৃত্যু হয়।

১০ অক্টোবর ১৯৯০ এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন সময়ে ঢাকায় গুলিতে নিহত উল্লাপাড়া কলেজের ছাত্র জেহাদের লাশ ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিয়ে আসে। জেহাদের লাশ সামনে রেখে সব গণতন্ত্রমনা প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন এক হয়ে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে স্বৈরশাসন উৎখাতের শপথ নিয়েছিল। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে জেহাদের লাশের সামনে সমবেত হওয়া ছাত্রদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন তৎকালীন ৮ দল নেত্রী এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

[মোহাম্মদ হাননান, পৃষ্ঠা- ১৬৩; বেবী মওদুদ, পৃষ্ঠা- ৯০]

সেদিন থেকেই শুরু হয়েছিল এরশাদের বিরুদ্ধে নব্বইএর ঐতিহাসিক গণআন্দোলন। এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী তিন জোটের অন্যতম প্রধান নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা ৪ ডিসেম্বর ১৯৯০ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আয়োজিত জনসভায় দেশে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা সংগ্রামী মানুষদের ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে এরশাদের প্রতি এই হুঁশিয়ারি জানিয়ে তিনি বলেছিলেন,

"হাজার হাজার মানুষ বুলেট উপেক্ষা করে রাজপথে নেমে এসেছে– তারা আপনার বুলেটকে পরোয়া করে না। মানুষের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কাছে আপনার সমস্ত দমননীতি উড়ে গিয়েছে– এদেশের মানুষের আন্দোলনের তোড়ে।"

[বেবী মওদুদ, পৃষ্ঠা- ২৫]

ইংরেজিতে একটি কথা আছে– politics makes strange bedfellows– অর্থাৎ রাজনীতিতে কখনও এমন কেউ মিত্র হয়ে যায় যার মিত্র হওয়া প্রত্যাশিত বা কাম্য নয়। রাজনীতিবিদ শাহ আজিজুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। অথচ তাকেই প্রধানমন্ত্রীর পদ দিয়েছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান যিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার। একজন প্রাক্তন সামরিক অফিসারের লেখা বই থেকে জানা যায় ১৯৮১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকা সেনানিবাসে সেনাবাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানের দিন এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি জিয়ার সঙ্গে বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা অফিসারের তর্ক হয়েছিল। জেনারেল জিয়াকে ঘিরে ধরে মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা প্রশ্ন করেছিলেন:

"স্যার, আপনি রাজাকার শাহ আজিজকে কি করে দেশের প্রধানমন্ত্রী বানালেন?"

জেনারেল জিয়া নাকি তখন সঙ্গে সঙ্গেই বলেছিলেন:

"Politics makes strange bedfellows."

[ত্রিশোনকু মল্লিক, পৃষ্ঠা- ৮-১০]

জেনারেল জিয়া সেই সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই নিজের সুবিধার জন্যই নিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের প্রতিষ্ঠিত করার পদক্ষেপ বিপদগ্রস্ত করেছে পুরো দেশকে। পরবর্তীতে বিএনপির শাসনামলে আমরা দেখেছি চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীরা দেশের মন্ত্রী হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ, বিভ্রান্ত হয়েছে দেশের নতুন প্রজন্ম। সুবিধার এবং স্বার্থের রাজনীতি সঠিক ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অতীতে কার কী ভূমিকা ছিল তা ভুলে যাওয়া বা উপেক্ষা করার মাধ্যমে কখনও বর্তমান বা আগামী সময়ে সমাজের জন্য মঙ্গল নিশ্চিত করা যায় না। মনে রাখা প্রয়োজন সবার প্রতিটি কর্মকান্ডই ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। আর আগামী দিনে ইতিহাসের আলোকেই মূল্যায়ন করা হয় ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর সাফল্য এবং ব্যর্থতা। আজ যদি বর্তমান প্রজন্মের সদস্যদের মধ্যে পর্যাপ্ত ইতিহাস সচেতনতা দেখা না যায়, তাহলে কতটা নিষ্ঠা আর সততার সঙ্গে অতীতের বিভিন্ন ঘটনা আমরা সবাই মনে রাখছি সেই প্রশ্ন বিশ্লেষণ করতে হবে।

আমরা যদি নূর হোসেন, ডা. মিলন, রাউফুন বসুনিয়া, সেলিম, দেলোয়ার, জেহাদসহ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নিহত সব শহীদদের সম্মান জানাই তাহলে তাদের কেন মৃত্যু হয়েছিল তাও আমাদের মনে রাখতে হবে। যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নূর হোসেন, রাউফুন বসুনিয়ার ভাস্কর্য আর ডা. মিলনের স্মৃতিসৌধ থাকে, যদি নূর হোসেনের স্লোগান লেখা শরীরের প্রতিবাদ বাংলাদেশের সংগ্রামী ইতিহাসের একটি প্রতীক হিসেবে আমরা মনে রাখি, যদি ১৯৯০এর উত্তাল গণআন্দোলনের দিনগুলো আমাদের ইতিহাসের মূল্যবান অংশ বলে আমরা গণ্য করি তাহলে মধুর ক্যান্টিনে এরশাদের জন্মদিন পালনের দৃশ্য দেখে নির্লিপ্ত থাকার সুযোগ নেই।

আমাদের মুখোমুখি হওয়া উচিৎ আত্মজিজ্ঞাসার: আমরা কি গুরুত্ব দিয়ে মনে রাখছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের দীপ্ত সংগ্রামের ইতিহাস? তিন দশক আগে এই দেশের তরুণরা বার বার প্রতিবাদী হয়েছিল স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে। বর্তমান সময়ের তরুণদের প্রতি অনুরোধ রাখবো তারা যেন তাকিয়ে দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডা. মিলনের স্মৃতিসৌধ, যেখানে লেখা আছে 'নিঝুম স্থাপত্য আজ মিলনের প্রতিবাদী মুখ,' সেই স্থানটি অবহেলায়, অযত্নে অপরিচ্ছন্ন একটি স্থানে পরিণত হয়েছে কিনা। রাউফুন বসুনিয়ার ভাস্কর্য আর তার নিচে নামফলকের লেখাগুলো বিবর্ণ, মলিন হয়ে পড়েছে কিনা। এই স্থানগুলোর দিকে তাকিয়ে তারপর নিজেদের প্রশ্ন করা উচিৎ আমরা কি অবহেলা করছি গুরুত্বপূর্ণ, মূল্যবান কোনো স্মৃতি?

যদি তাই হয় তাহলে এই ইতিহাস-অবহেলা এই দেশের জন্য কোন মঙ্গলময় প্রাপ্তি নিয়ে আসবে?

কবি শামসুর রাহমান 'নব্বইয়ের একজন শহীদের স্ত্রীকে দেখে' শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। সেই কবিতার কয়েকটি স্তবক উল্লেখ করে শেষ করছি এই লেখা:

লোক থই থই এই সড়ক দ্বীপে
বিষাদাবৃতা নারীর আঁচলের খুঁট ধরে দাঁড়ানো
তার তিন বছরের কন্যা, যার খেলাঘরে
এখন মহররমের মর্সিয়া।

ইচ্ছে হলো এক্ষুনি রঙধনু পুরে দিই শিশুর মুঠোয়,
যার পিতার বুকে বুলেট ফুটিয়েছে রক্ত গোলাপ,
যিনি আলো ছিনিয়ে আনার ব্রত নিয়ে
কবরের অন্ধকারে নিদ্রিত,
যার মৃত্যু দুঃসময়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের ত্বকে লিখে গ্যাছে
প্রতিবাদী গাঁথা,
যার মৃত্যু ঘোষণা করেছে স্বৈরাচারের মৃত্যু,
যার মৃত্যু দুরাত্মাদের বুকে ধরিয়েছে ফাটল,
যার মৃত্যু এ মাটিতে পুঁতে দিয়েছে বিজয় নিশান।

বিষাদাবৃতা এই নারী কার কাছে জানাবেন অভিযোগ?
রৌদ্র-জ্যোৎ¯œার কাছে? বাতাসের কাছে?
বৃক্ষরাজি কিংবা আকাশের কাছে?
যারা ভরদুপুরে তার সত্তায় ছুয়ে দিয়েছে বৈধব্যের ধুধু শাদা,
তারা কি ক্ষমার ছায়ায় কাটাবে প্রহর?
যারা তার যৌবনের স্বপ্নমালাকে কুটি কুটি ছিঁড়ে
ফেলে দিয়েছে ধুলায়?
তারা কি সুখস্বপ্নে থাকবে বিভোর?
যারা তার সংসারকে করেছে ক্রুশবিদ্ধ,
তারা কি হেঁটে যাবে নিষ্কন্টক পথে?

এইতো সেদিনও বিষাদাবৃতা নারীর শরীর
ভিজে উঠতো সুখী বৃষ্টিতে,
আজ শামিয়ানার নিচে বসে তিনি বারবার আঁচলে ঢাকছেন মুখ
দুপুর বারোটায়,
যেন দুঃখিনী বাংলাদেশ চোখ থেকে
অবিরত মুছে ফেলছে অশ্রুধারা।

সহায়ক গ্রন্থসমূহ:

১. বেবী মওদুদ (সম্পাদিত), জনতার জয়: ১৯৯০এর স্বৈরাচারবিরোধী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের কথা ও ছবি (ঢাকা: শিখা প্রকাশনী, ১৯৯১);

২. ড. মোহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস: এরশাদের সময়কাল (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ২০০০);

৩. মেজর জেনারেল মনজুর রশীদ খান (অব.), আমার সৈনিক জীবন: পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ (ঢাকা: প্রথমা প্রকাশন, ২০১২);

৪. ত্রিশোনকু মল্লিক, চট্টগ্রাম সেনাবিদ্রোহ: ফিরে দেখা ২৯ বছর পর (ঢাকা: দিব্যপ্রকাশ, ২০১৫)।