বাংলাদেশের মণিপুরী সম্প্রদায়

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
Published : 11 Feb 2012, 05:01 PM
Updated : 11 Feb 2012, 05:01 PM

মহাভারতে বর্ণিত আছে যে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পঞ্চপর্বত-বেষ্টিত মণিপুর রাজ্য নৃত্যগীতে পারদর্শী 'গন্ধব' নামে একটি জাতি বাস করত। সেই জাতির নামানুসারে সেদেশের আদিনাম 'গন্ধর্ব রাজ্য'। একসময় 'মেখলী' বলেও খ্যাত ছিল। অসমীয়রা একে 'মগলু' এবং ব্রহ্মদেশীয়রা একে 'কতে' বলত।

মণিপুর নামকরণের পেছনে একটা পৌরাণিক কাহিনি আছে। একদা দেবী দুর্গা মহাদেবের প্রেমে আসক্ত হয়ে আনন্দচিত্তে লীলা ও কীর্তন করার জন্য মহাদেবকে অষ্টপর্বত পরিবেষ্টিত অরণ্যময়, কুসুমে নর্তন সুরভিত এক উপত্যকা ভূমিতে উপনীত হন। বর্তমান মণিপুর ও লোকতাক হ্রদ। মহাদেব ত্রিশূলাঘাতে পর্বত ছিদ্র করে জল বের করেন। মহাদেব ও দুর্গা আহলাদে লীলাখেলা করছেন এমন সময় নাগপতি অনন্ত দুর্গা ও মহাদেবকে লীলাখেলার আনন্দে বিমূঢ় দেখে সেও আনন্দে আনন্দিত হয়ে মস্তকসমূহে মণি রাজি ছড়িয়ে দেয়। মণিসমূহে উপত্যকাভূমি উজ্জ্বলময় আলোকে আলোকিত হয়েছিল বলে ওই ভূভাগের নাম পরবর্তী সময় 'মণিপুর' নামে আখ্যায়িত হয়। মণিপুরের আদিবাসীদের মণিপুরী বলা হয়।

মণিপুরে তিন গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের বাস: বিষ্ণুপ্রিয়া, মৈতৈ ও পাঙান।
গন্ধর্বদের রাজত্বকালে মহাভারত-খ্যাত পঞ্চপাণ্ডবদের তৃতীয় ভ্রাতা অর্জুন মণিপুর রাজ্যে পরিভ্রমণে গিয়ে গন্ধর্ব রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিয়ে করেন। অর্জুনের সঙ্গে ক্ষত্রিয় যোদ্ধা যারা মণিপুর গিয়েছিল, তাদের অনেকে গন্ধর্ব কন্যাদের বিয়ে করে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। অর্জুন ও চিত্রাঙ্গদার একমাত্র ঔরসজাত সন্তান বভ্রূবাহন মণিপুরের সিংহাসনে অধিপতি হন। মণিপুরে গন্ধর্বদের পরে আর্য-ক্ষত্রিয়দের শাসন শুরু হয়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর যুধিষ্টির অশ্বমেধ যজ্ঞ করলে রাজা বভ্রূবাহন সেই যজ্ঞে যোগদান করতে মিথিলার রাজধানী হস্তিনায় গমন করেন। যজ্ঞশেষে মণিপুরে ফেরার সময় বভ্রূবাহন হস্তিনার বিষ্ণুপ্রিয়া মন্দিরস্থ অনন্তশায়ী সুবর্ণ ও বিশাল বিষ্ণুমূর্তি সঙ্গে নিয়ে আসেন। বিষ্ণুবিগ্রহ স্থাপনের পর থেকে মণিপুরের রাজধানী 'বিষ্ণুপুর' নামে পরিচিতি লাভ করতে থাকে। অর্জুনের বংশধর ক্ষত্রিয় বংশী এবং বিষ্ণুর উপাসক বলে তাদেরকে বিষ্ণুপ্রিয়া বলা হয়।

মোঙ্গলীয় তিব্বতিবর্মী-পরিবারের কুকি-চীন গোত্রভুক্ত মৈতৈগণ দশম-ত্রয়োদশ শতাব্দীর কোনো এক সময় চীন দেশ থেকে মণিপুরে প্রবেশ করেন। পৈরিতন নামে এক দলপতির নেতৃত্বে তারা মণিপুরের উত্তরে অবস্থিত কবরু পর্বতে উপনিবেশন স্থাপন করে। মৈতৈ মণিপুরীরা বিষ্ণুর উপাসক বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈরা সনাতন বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত বলে পেঁয়াজ, রসুন ও মাংস খায় না।

পাঙান
কথিত আছে যে, মণিপুর রাজ্যে ভারতবর্ষের কোনো এক অঞ্চলের পাঠান মুসলিম ব্যবসা-বাণিজ্য করতে মণিপুর গেছেন। তাঁদের একজন এক মৈতৈ মণিপুরী মেয়ের সঙ্গে প্রেমে আবদ্ধ হন এবং তাঁকে বিবাহ করে সন্তানাদিসহ সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। মা মৈতৈই ও পিতা পাঠান মুসলিম বংশোদ্ভূত সম্প্রদায়কে পাঙান জাতি বলে। তাদেরকে মণিপুরী মুসলিমও বলা হয়। তারা মায়ের ভাষায় কথা বলে এবং পিতার ইসলাম ধর্ম পালন করে। তারা পেঁয়াজ, রসুন ও মাংসভোজী। তাদের মেয়েরাও বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈই মেয়েদের মতো নিজস্ব উৎপাদিত পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করে।
সনাতনধর্মী মণিপুরীরা সাধারণত সাংস্কৃতিক জাতি হিসেবে উদারপন্থী। তাদের নারী-পুরুষদের মধ্যে মানববন্ধনে যুবক-যুবতী/নারী-পুরুষ একসঙ্গে খেলাধুলা, গান-বাজনা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে স্বাভাবিক চলাফেরা ও মেলামেশায় অভ্যস্ত। তাদের ছেলে-মেয়ে, নারী-পুরুষ সবাই নৃত্যগীতে অংশ গ্রহণ করে। পাঙান সম্প্রদায়ের মেয়ে-ছেলে ইসলামিক শরিয়ত অনুসরণ করার চেষ্টা করে।

সামরিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিবিধ কারণে মণিপুরীরা মণিপুরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। রাজা ভাগ্যচন্দ্রের (রাজত্বকাল ১৭৬৪-১৭৮৯) সময়ে প্রথম উল্লেখযোগ্য যে অভিবাসন শুরু হয়, তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় মণিপুর-মায়ানমার যুদ্ধের সময় (১৮১৯-১৮২৫)। মায়ানমার বা বর্মি দখলদার শক্তি প্রায় সাত বছর মণিপুরে রাজত্ব করে। ওই সময় মণিপুর রাজা চৌরাজিত সিংহ ও তাঁর দুই ভাই ধনসম্পদসহকারে সিলেটে আশ্রয় নেন এবং মির্জাজাঙ্গালে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, ময়মনসিংহের দুর্গাপুর ও ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় মণিপুরীদের উপনিবেশ গড়ে ওঠে। বর্তমানে তাদের প্রধান বাসস্থান বৃহত্তর সিলেটের সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের ছাতক অঞ্চলে।

ঐতিহ্যগতভাবে মণিপুরীদের সাতটি ইয়েক বা সালাইসে বিভক্ত। পরবর্তী সময়ে ইয়েক বা সালাইস বৈষ্ণ সম্প্রদায়ে রূপান্তরিত হয়ে নতুন নামে পরিচিত হয়। তারা বর্তমানে শাণ্ডিল্য, মৌদগল্য, আত্রেয়, অঙ্গীরাশ্ব, কাশ্যপ, বশিষ্ঠ, ভরদ্বাজ ও নৈমিষ্য নামে অভিহিত হয়।

কালক্রমে আর্য ও অন্যান্য রক্তের সংমিশ্রণে এবং ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মিথস্ক্রিয়ায় মণিপুর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর এক মিলনকেন্দ্র হয়ে ওঠে। এ ধরনের সংমিশ্রণে আধুনিক মেইতেই জনগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে, যাদের আজ মণিপুরী হিসেবে অভিহিত করা হয়।

মণিপুরীরা এখন বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ও মেইতেই লন মণিপুরী ভাষা দুটি প্রায় পৃথক ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। ভারতের সংবিধানে উভয় ভাষার স্বাতন্ত্র্যকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

মণিপুরী সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন ঔগগি একটি গীতিকবিতা। মণিপুরী রাজা পাখারবার সিংহাসনে আরোহণ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সূর্য দেবতার উদ্দেশে গীত হয় বলে অনুমিত। অষ্টম শতাব্দীর একটি তামার পাত্রে পাওয়া যায় প্রথম লিখিত সাহিত্য। মৌলিক রচনা ও অনুবাদের ক্ষেত্রে মণিপুরী সাহিত্য সমৃদ্ধ। আমি আমার Twenty Frist February Speaks For All Lauguages-এ মণিপুরীদের বিষ্ণুপ্রিয়া ও মেইতেই দুই ভাষা থেকে দুটি কবিতা অন্তর্ভুক্ত করেছি।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রাচীন মণিপুরী হরফকে বাংলা হরফে প্রতিস্থাপিত করা হয়।
ধর্মের বিচারে বেশির ভাগ মণিপুরী বর্তমান চৈতন্য ধারার সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই ধর্ম গ্রহণের আগে মণিপুরীরা যে অপ্কপা ধর্মচর্চা করত, তার প্রভাব এখনো কিছু কিছু অনুষ্ঠানে পরিলক্ষিত হয়। অনেক মণিপুরী আছেন, যাঁরা আগের কিছু কিছু আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে ইসলামধর্ম পালন করেন। তাঁদেরকে মেইতেই পানগন বা মণিপুরী মুসলমান বলা হয়।

সাহিত্য ও সংস্কৃতি
রাজা গোপাল সিংহ তথা পাম হেইবার আমলে সব ঐতিহাসিক গ্রন্থাদি ভস্মীভূত হওয়ায় তার আনুকূল্যে মৈতৈ ভাষা 'রাজ্য ভাষা' হিসেবে স্বীকৃত হয়। রাজার কোপানলে বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষা নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ায় সাহিত্যচর্চা ও ভাষার উন্নয়নে বিষ্ণুপ্রিয়ারা বেশ বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু বর্তমানে ভারতের আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষা রাজ্যসভা কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে এবং প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে উক্ত ভাষা শিক্ষার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। মণিপুরীদের সংস্কৃতি বিকাশের জন্য ১৯৭৬ সালে মৌলভীবাজার জেলাধীন কমলগঞ্জ থানার মাধবপুরে 'মণিপুরী ললিতকলা একাডেমী' স্থাপিত হয়। সিলেট বেতারকেন্দ্র থেকে বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ উভয় ভাষায় সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়।

নৃত্যের মুদ্রা ভঙ্গিই হলো এর মূল ভাষা। আগে নৃত্যকে শিল্পকলা হিসেবে সঠিক মূল্যায়ন করা হয়নি। মানুষ প্রকৃতির দাস, প্রাকৃতিক নিয়মেই মানুষ তার আদিম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে আদি রসাত্মকভাব-ব্যঞ্জক নৃত্যের প্রতি আকৃষ্ট ছিল। এ জন্য নৃত্য তখন শুধু রাজ-জমিদারদের বিলাস বসনের সামগ্রী হিসেবে প্রচলিত ছিল। এখনো বিশেষ অনুষ্ঠানে ও সিনেমায় সাধারণ মানুষের মনোরঞ্জনার্থে তথা ব্যবসায়িক দিককে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আদি রসাত্মক ভাবব্যঞ্জক নৃত্যকে প্রধান অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করছে। তা ছাড়া ক্লাসিক্যাল নৃত্য, যেমন ভারত নট্যম, কথক, কথাকলি ইত্যাদি উচ্চাঙ্গ নৃত্যের অঙ্গভঙ্গি, কলাকৌশল অতি উচ্চাঙ্গের হলেও এর মধ্যে রসাত্মক ভাব প্রকাশক মুদ্রার প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। মানুষ তখন এ নৃত্যকে উচ্চভাব প্রদর্শক হিসেবে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। এভাবেই মূলত দেবদাসী নৃত্য ও মণিপুরী নৃত্যের মতো ভক্তিমূলক উচ্চাঙ্গ নৃত্যের উৎপত্তি হয়।

সহজাত সৌন্দর্যবোধ স্মরণাতীতকাল থেকেই এদেরকে বিভিন্ন শিল্পকলার অনুশীলনে প্রবৃত্ত করেছে।

দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম তিনটি শাস্ত্রীয় নৃত্য ভরতনাট্যম, কথাকলি ও কথকের পরই মণিপুরী নৃত্যের নাম। মণিপুর সেই নৃত্যের উদ্ভবস্থল। প্রাচীন মণিপুরী নৃত্যধারা থাবল চেংবি ও লাইহরাউপর এবং নবীন নৃত্যধারা রাসের সংমিশ্রণে রাজা চিৎ সাং খম্বা বা ভাগ্যচন্দ্র জয়সিংহ এই নতুন নৃত্যধারার প্রবর্তন করেন। তিনি গোবিন্দসংগীত লীলাবিলাস নামক গ্রন্থে ওই নৃত্যকলার আঙ্গিক, পদ্ধতি, পোশাক ও সংগীতের তত্ত্বগত ভিত্তি রচনা করেন। তাঁর কন্যা বিম্বাবতী ছিলেন এই নৃত্যকলার প্রধান প্রচারক।
মণিপুরী নৃত্যের প্রধান মুদ্রার নাম কুরুম্বা বা নমস্কার জানানোর মুদ্রা। মণিপুরী নৃত্যকলা একধরনের আরাধনার পদ্ধতি। এই নৃত্য পরিবেশনের আগে নৃত্যস্থলী প্রস্তুত করা হয় এবং তা শুদ্ধ জলসিঞ্চন দ্বারা শুদ্ধ করা হয়। এরপর নৃত্যস্থলীকে ঘিরে শ্রীচৈতন্য-বন্দনা, রাজা ভাগ্যচন্দ্রের প্রশস্তি, বৃন্দাবন-বর্ণনা নিয়ে বিবিধ কীর্তন পরিবেশিত হয়। নৃত্যস্থলীর পাশে থাকে গায়ক ও বাদকের দল। নর্তক-নর্তকীরাও গানে অংশ নেন। কীর্তন শেষে নৃত্যের আয়োজন।

রাস নৃত্য বা রাস নৃত্যনাট্যের কুশীলব হচ্ছেন কৃষ্ণ, রাধা ও রাধার দ্বাদশ গোপীসখী। প্রথম নর্তক কৃষ্ণ নৃত্যস্থলে প্রবেশ করে দ্রুত পায়ের কাজ করে নাচেন। হঠাৎ রাধা আসতেই তিনি নিজেকে লুকিয়ে ফেলেন। এই অংশ কৃষ্ণ-অভিসার নামে অভিহিত। তারপর রাধারূপী নর্তকী নৃত্যস্থলে প্রবেশ করে কৃষ্ণকে খুঁজতে থাকেন। এই হলো রাধা-অভিসার। এরপর গোপী বৃন্দার আগমন। নৃত্য ও অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি রাধা ও কৃষ্ণের মিলনের আহ্বান জানান। রাধা ও কৃষ্ণের মিলন ঘটলে গোপীরূপী নর্তকীদের সবাই নৃত্যস্থলে প্রবেশ করেন। রাধা, কৃষ্ণ ও গোপীরা সবাই মিলে সম্মেলক রাস নৃত্য পরিবেশন করেন। এই সম্মেলক নৃত্য কুরুম্বা পেরেঙে নামে অভিহিত। রাধা ও কৃষ্ণকে মাঝখানে রেখে গোপীরা পরস্পরের কাঁধে হাত রেখে বৃত্তাকারে নৃত্য করেন। দ্রুতলয়ে সমবেত কণ্ঠে গান গাওয়া হয় ও করতাল বাজানো হয়। পরে গোপীদের প্রার্থনামূলক নৃত্য। তারপর আবির খেলা। রাত শেষে কৃষ্ণের আরতি সহযোগে নৃত্য সমাপ্ত হয়। নৃত্যশিল্পীরা প্রদীপ নিয়ে নৃত্য করেন ও শ্রোতা-দর্শকেরা দীপশিখা থেকে হাত বাড়িয়ে তাপ নেন। রাস নৃত্য কুরুম্বা বা নমস্কার জানিয়ে শঙ্খ বাজিয়ে সমাপ্ত করা হয়।

লাস্যপ্রধান মণিপুরী নৃত্যে তাণ্ডবেরও ব্যবহার আছে। অভিনয় একটি বিশেষ অংশ। সমভঙ্গ, আভঙ্গ, ত্রিভঙ্গ ও অতিভঙ্গ প্রভৃতি ভঙ্গির ব্যবহার দেখা যায়। মণিপুরী নৃত্যের একটা প্রধান উপাদান চালি। এই নৃত্যে ২৫ প্রকার অসংযুক্ত এবং ১২ প্রকার সংযুক্ত হস্তের মুদ্রা রয়েছে। এই নাট্যাভিনয়ে কণ্ঠ ও যন্ত্রসংগীতের স্থান যেমনি প্রশস্ত, তেমনি তাল-প্রয়োগের বিষয়টি জটিল। নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে নানাভাবে তালের বিস্তার করা হয়।

এই নৃত্যের গাম্ভীর্য ও নৃত্যভঙ্গিতে নিজেকে উৎসর্গ করার বিনয়ী ভঙ্গি দেখে তিনি চমৎকৃত ও মুগ্ধ হন। তিনি আগরতলা থেকে রাজকুমার বুদ্ধিমনতা সিংহকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে গিয়ে মণিপুরী নৃত্য প্রবর্তন করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতীতে মণিপুরী নৃত্যশিক্ষার ব্যবস্থা করলে সেই দৃষ্টান্ত ভারতের নানা সংগীতকেন্দ্রে এবং বহির্বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে। রবীন্দ্র নৃত্যধারাতে মণিপুরী নৃত্যের গভীর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মণিপুরী নৃত্য আগে শুধু ধর্মীয় উৎসব উদযাপনে ব্যবহৃত হতো। ১৯১৯ সালে কবিগুরু সিলেট ভ্রমণে এসে 'মাছিমপুর' নামে এক মণিপুরী পল্লি দেখতে যান। মাছিমপুরের আদিবাসীরা কবিকে মণিপুরী নৃত্যগীত দিয়ে আপ্যায়িত করেন। কবি মণিপুরী নৃত্য দেখে অভিভূত হন এবং শান্তিনিকেতনে মণিপুরী নৃত্য প্রবর্তন করার উদ্দেশ্যে মণিপুরী নৃত্যশিক্ষক হিসেবে কমলগঞ্জের নীলেশ্বর মুখার্জি এবং ভারতের আসাম থেকে সেনারিক সিংহ রাজকুমারকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যান।

কবি নীলেশ্বর মুখার্জির সহায়তায় মণিপুরী নৃত্যের গানের সুর ও তালের আদর্শে বেশ কটি গান সুরারোপিত করেন। গানগুলোর মধ্যে শ্রীবাস কাছে থেকে দূরে ছিল কেনগো আধার/রোদন ভরা এ বসন্ত কখনো আসেনি আগে/আমি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে/ওগো আঁখি মেলে চাও/বধূ কোন আলো লাগল চোখে/সখী দু'জনে দুলেছিনু বনে ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রনাথের বর্তমানে চিত্রাঙ্গদা, শাপমোচন, কালমৃগয়া, চণ্ডালিকা প্রভৃতি নৃত্যনাট্য এ উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে অভিনীত হয়েছিল।
সংস্কৃতির চরম নিদর্শন রাসনৃত্য বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের প্রধান অনুষ্ঠান। মণিপুরের রাজা ভাগ্যচন্দ্র সিংহ স্বপ্নদৃষ্ট হয়ে রাধাকৃষ্ণের লীলার অনুসরণে রাসনৃত্যের প্রবর্তনে প্রয়াসী হন। রস শব্দ হতেই 'রাস' শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে। রস আস্বাদনের জন্য যে নৃত্য বা লীলা তা-ই রাস নৃত্য। রাসনৃত্য ছয় ধরনের: কুঞ্জ রাস, গোপ রাস, মহারাস, বসন্ত রাস, নৃত্য রাস ও বেণি রাস।

কুঞ্জ রাস আশ্বিন মাসে, গোপ রাস কার্তিক মাসে, মহারাস শারদ তিথিতে, বসন্ত রাস ফাল্গুন-চৈত্র মাসে, নৃত্য রাস বছরের যেকোনো সময়ে এবং বেণি রাস দিনের বেলায় অনুষ্ঠিত হয়। কবি জয়দেব, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস প্রমুখ বিখ্যাত বৈষ্ণব কবিদের পদাবলিকে আশ্রয় করে মণিপুরী সমাজে রাস নৃত্যের রূপায়িত হয়।

গোষ্ঠলীলা মণিপুরীদের অন্যতম ধর্মীয় অনুষ্ঠান। যেসব ছেলে এ নৃত্যাভিনয়ে অভিনয় করে তাদের মধ্যে দুজনকে কৃষ্ণ ও বলরামের ভূমিকায় অভিনয় করতে হয়। অন্যেরা সব ব্রজের রাখাল। আর দুজন বিবাহিত মহিলাকে যশোদা ও রোহিণীর ভূমিকায় অভিনয় করতে হয়। কৃষ্ণ ও বলরাম গান গেয়ে যশোদার কাছে গোষ্ঠে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করে। কৃষ্ণসখারা ততক্ষণ রঙিন কাগজ জড়ানো বাঁশের তৈরি বাঁশি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানা ভঙ্গিমায় নৃত্য প্রদর্শন করে। হৃদয়ের আকুলতা এবং গোপালের প্রতি অপরিসীম বাৎসল্য ইত্যাদি মূর্ত হয়ে ওঠে গোষ্ঠলীলায়।

লাই হারাউবা মৈতৈই মণিপুরীদের প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান। 'লাই' শব্দের অর্থ দেবতা, 'হারাউবা' শব্দের অর্থ আনন্দ নৃত্য। অর্থাৎ দেবতাদের তুষ্টি সাধনের জন্য যে নৃত্য পরিবেশিত হয় সেটাই 'লাই হারাউবা নৃত্য'। মণিপুরীদের প্রাগৈতিহাসিক যুগের দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা খাম্বা-থৈবীর প্রেম কাহিনিই হচ্ছে এ নৃত্যের মূল পটভূমি। প্রতিবছর চৈত্র-বৈশাখ মাসে এক পক্ষকালব্যাপী এ নৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু কালের আবর্তে এ নৃত্য আস্তে আস্তে বিলুপ্তির পথে। লাই হারাউবা নৃত্যে অংশগ্রহণ করে দেবদাস ও দেবদাসীর জীবন শিব-পার্বতীর আরাধনায় উৎসর্গীকৃত এবং দৈব কথা বর্ণনা করাই মুখ্য উদ্দেশ্য। লাই হারাউবা নৃত্যের কয়েকটি স্তর রয়েছে। সব কটি স্তর মিলিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ প্রকাশ করাই এ নৃত্যের উদ্দেশ্য। স্তর ভেদগুলো হলো:১) লাই একাউবা ২) লাইথেম্বা ৩) লাইকাবা ৪) লাইহুম্বা ৫) জগোই অক্পা ও ৬) লাইপৌ।

মণিপুরী নৃত্যের প্রাচীন ধারার ঐতিহ্যবাহী রূপ হচ্ছে খুবাকুশেই বা করতালি নৃত্য। বিশেষ করে রথযাত্রার সময় দিনব্যাপী এই নৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। কবি জয়দেব রচিত 'গীত গোবিন্দের' গান গীত হয়। বছরের যেকোনো সময় খুবাকুশেই অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। এ ছাড়া আরও নৃত্য রয়েছে। পালা পূংচলোম (মৃদঙ্গ), থাংচোলবী, থাম্বা থৈবী, সাত সম্প্রদায় নৃত্য ইত্যাদি। প্রতিটি নৃত্য বৈষ্ণবীয় অভিসিদ্ধিতে। নৃত্যের সঙ্গে সংগীতের যোগসূত্র নিবিড়। তাই সংগীত ও নৃত্যের ভারসাম্য রক্ষার জন্য যেসব যন্ত্রের ব্যবহার প্রচলিত তার মধ্যে খোল, করতাল, মৃদঙ্গ, বাঁশি, হারমোনিয়াম, মন্দিরা, এস্রাজ ও তানপুরা ইত্যাদি প্রধান। সংগীত ও নৃত্য পরিবেশনার ক্ষেত্রে উভয় অবস্থাতেই প্রধান আশ্রয় হলো তাল ও লয়।

মণিপুরী নৃত্যের পোশাকের মধ্যে কোনো বাহুল্য নেই। ব্রজগোপীদের মাথায় পাতলা জালের মতো সাদা কাপড়ের ঢাকনা, মাইখুম্বী, গায়ে রেশমি ব্লাউজ, গলায় সোনার হার এবং পরিধানে উজ্জ্বল চুমকি ও আয়না বসানো ঘাগড়া জাতীয় পোশাক। আর কৃষ্ণের কটিতটে পীতধড়া, গলায় ও বুকে মণিমালা, মাথায় ময়ূরপুচ্ছ শোভিত মুকুট ও পরিধানে গেরুয়া বসন।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে রাজ-ভ্রাতৃ কলহের সুযোগে পার্শ্ববর্তী রাজ্য বার্মার অব্যাহত আক্রমণ ও অত্যাচারে মণিপুরের অধিকাংশ আদিবাসী দেশত্যাগী হয়ে পার্শ্ববর্তী রাজ্য আসাম, ত্রিপুরা এবং বার্মা ও বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। বাংলাদেশের সুসং, দুর্গাপুর, ঢাকার মণিপুরীপাড়া, কুমিল্লা ও বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে মণিপুরী বসতি গড়ে উঠেছিল। কিন্তু বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল ব্যতীত অন্যান্য অঞ্চলের মণিপুরী বস্তিগুলো কালের আবর্তে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের একমাত্র বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের তিন সম্প্রদায়ের মণিপুরী যেমন বিষ্ণুপ্রিয়া, মৈতৈই ও পাঙান জনগোষ্ঠীর লোকেরা বসবাস করে।

মণিপুরী প্রতিটি গৃহে কমপক্ষে একটি করে তাঁত থাকে। মণিপুরী মেয়েরা নিজেদের পরনের কাপড়, বিছানার চাদর, ঝুলন ব্যাগ, শাড়ি, টেবিল ক্লথ, ওড়না, গামছাসহ বিভিন্ন ডিজাইনের বস্ত্রসম্ভার তৈরি করে নিজেরা ব্যবহার করেন এবং বাজারজাতও করে থাকেন।

আত্মনির্ভরশীল মণিপুরীদের মধ্যে পেশাভিত্তিক কোনো ভিক্ষুক নেই। মণিপুরী মহিলারা পুরুষের পাশাপাশি কৃষিকাজসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত। পুরুষদের সঙ্গে হালচাষ ছাড়া কৃষিকাজে নারীরা সার্বিক সহযোগিতা করে থাকেন। যেমন: ধান রোপণ, ধান কাটা, সবজির বাগান করাসহ সব কাজে পারদর্শী। মণিপুরীরা স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য একমাত্র লবণ ও কেরোসিন ছাড়া নিজেদের উৎপদিত সামগ্রী ব্যবহার করে জীবন যাপন করতে পারে।

মণিপুরীদের মধ্যে তেমন উচ্চ বিত্তবান নেই, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সংখ্যায় বেশি। ঐতিহ্য-কৃষ্টির প্রতি যত্নশীল মণিপুরীরা সুশৃঙ্খল জীবন যাপনে অভ্যস্ত।

গর্ব করার মতো বিষয় হলো বাংলাদেশের মণিপুরীদের মধ্যে উচ্চ শিক্ষিতের হার কম হলেও বর্তমান প্রজন্মে সাধারণ শিক্ষার হার শতকরা ৮০ ভাগের ঊর্ধ্বে। মণিপুরীরা একটু দেরি করে বিয়ে করে থাকে।

বর্তমানে মণিপুরী সাহিত্যে মেইতেই ও বিষ্ণুপ্রিয়া উভয় ভাষাতেই এক অনিন্দ্য সার্বজনীনতা লক্ষ করা যায়। খোইরাম কামিনী কুমারগী শৈরং বলেন:
লম্মন তোল্লবনি ঐদি বাংলা ইমাগী মফমদা

ঐগী তেনাগী সমদ্রুদা
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ
মতমপুম্বদা ঈচেল ওইনা চেল্লি।
রবীন্দ্রনাথ না ঐগী খাজবা থম্মোয়গী ঙমখৈনি
নজরুল ঐগী নুংশিবা লালহৌনি
জীবনানন্দনা ঐগী লৈপাকনিঙবা
দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদনা ঐগী খোন্থোক্কী ঈশৈ;
লম্মন তোল্লবনি ঐদি
বাংলা অমসুং বাংলা ইমাগী মফমদা।

খোইরোম কামিনী কুমার-এর কবিতা

ঋণী আমি বাংলা মায়ের কাছে

আমার চেতনার সমুদ্রে সদা প্রবহমান
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ।
রবীন্দ্রনাথ আমার প্রত্যয় হৃদয়ের সীমানা
নজরুল আমার প্রেম-বিদ্রোহ
জীবনানন্দ আমার দেশপ্রেম,
দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ আমার কণ্ঠের গান।
ঋণী আমি বাংলা ও বাংলা মায়ের কাছে।

খৈরুদ্দিন চৌধুরী বলেন,

বাংলা নহাক্কী স্মৃতিদা
বাংলাগী মণিপুরী থম্মোয়গী কুচু শঙলবা
হে কৃষ্ণচূড়া- তঙাংলবী বসন্তগী লৈরাং।
ঙসিদি নহাকা নোকমী নোকমী ওকশিনবিরে ঐবু
নহাক্কী শংবান্নরবা খুঙ্গংগী নিংথিবীদা।

বাংলা তোমার স্মৃতিতে
বাংলার মণিপুরী হৃদয়ের প্রাণরসে রঞ্জিত
হে কৃষ্ণচূড়া- বর্ণিল বসন্তের রক্তলাল কুসুম।
আমাকে স্বাগত জানালে তুমি মিষ্টি হাসির সাদর সম্ভাষণে
তোমার নিবিড় জনপদের শ্যামল সৌন্দর্যে।

একে শেরাম বলেন,

ঐদি অতোপ্পা ম্যাজিক অমা পাম্মি,
মীওইববু অশেংবা মীওইবা ওইহনবা ঙম্বা।
মীওইবগী থোপতা-থম্মোয়দা
মাঙখ্রবা বাখলশিং অমুক হঞ্জিলহল্লকপা ঙম্বা ম্যাজিক অমা।
ঐ ম্যাজিক য়েংজগে,
য়েংহনবিয়ু ঐবু
অমাংবা-অমোৎপা পুমকপু মাঙহনখিদুনা
মীওইবগী মনুঙদা লৈবা 'মীওইবু' দুবু নৌনা মীকপ থোকহনবা ঙম্বা
অদুগুম্বা ম্যাজিক 'মতং।

আমি এমন একটি ম্যাজিক চাই
যে ম্যাজিক মানুষকে প্রকৃত 'মানুষ' বানাবে
মানুষকে ফিরিয়ে দেবে তার হারিয়ে যাওয়া বোধশক্তি,
আমাকে এমন একটি ম্যাজিক দেখাও
যা অনাকাঙ্খিত সমস্ত কিছুকেই আমূল বদলে দেবে
যা মানুষের ভেতর জাগিয়ে দেবে আসল 'মানুষ'কে।

এল পদ্মামণি দেবীগী শৈরেং

নিংশিংলি ঙসিসু
ফজবগী মপাল নাইদ্রবা
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকী লৈপাক বাংলাদেশ
জীবনানন্দগী ফজথোইবী বাংলানি,
কবি নজরুলগী থায়গী বাংলাদেশনি।

এল পদ্মামণি দেবীর কবিতা

স্মরণে রেখেছি আজো
কি অপূর্ব এই দেশ–বাংলাদেশ!
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা
জীবনানন্দের রূপসী বাংলা
কবি নজরুলের বাংলাদেশ।

যখন রণজিত সিংহ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষায় কথা বলেন, তখন তিনি সকল মাতৃভাষার কথা বলেন।
মা তি হিকাছাৎ নুং শিপা ঠারে
আমি হাদ্দিন ততারারাঙ,
তি হিকাছাৎ কঙানা রৌয়ে
হেক্করিষা এলা দেরাঙ

মা তোমার শেখানো মধুর ভাষায়
মোরা প্রতিদিন কথা বলি,
তোমরা শেখানো কোমল সুরে
স্বরে স্বরে গাই গানগুলি।

…মণিপুরী সমাজে এমন একজন পুরুষ কিংবা নারী, ছেলে কিংবা মেয়ে পাওয়া যাবে না যিনি এক বা একাধিক বার নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন নাই। মণিপুরীরা গৌড়ীয় বৈষ্ণব। তাদের যাবতীয় ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠান কৃষ্ণ-লীলাকেন্দ্রিক।

মণিপুরীরা মূলত কৃষিজীবী। কৃষিতে পুরুষ এবং নারী উভয়েই সম্পৃক্ত। মহিলারা পুরুষের চেয়ে বেশি সম্পৃক্ত। বর্তমানে কৃষি অলাভজনক পেশা হওয়াতে পুরুষ ও নারী সকলের মধ্যে চাকরিজীবী হওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়।

প্রত্যেক মণিপুরীপাড়ায় একটা মণ্ডপ আছে এবং সেখানেই তাদের যাবতীয় সামাজিক ও ধর্মীয় কৃত্য সম্পাদিত হয়।
একসময় জ্বালানি তেল এবং লবণ ছাড়া মণিপুরীরা স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। মণিপুরীদের বয়নশিল্প এখন নানা সমস্যায় জর্জরিত।
নিরামিষাশী গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারী মণিপুরীরা মাংসাশী লোকদের ছোঁয়া এড়িয়ে চলতে চান। বাজার কিংবা বাইরে গেলে পরিহিত কাপড়চোপড় বাড়ির বাইরে রেখে দিতেন কিংবা ধুয়ে ফেলতেন। এমনকি লবণসহ অন্যান্য সামগ্রী ধুয়ে নিতেন।
গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের আরাধ্য রাধা-কৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান আর রাধা যিনি ঈশ্বরের সাধনা করেন, ঈশ্বরের পূজা করেন তিনিই রাধা, তিনি ভক্ত। ঈশ্বরের সহিত ভক্তের মিলনের এ রূপকল্পকে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম হিসাবে স্বীকৃত। যেখানে শ্লীল-অশ্লীলতার প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের এ লীলা সংকীর্তন মণিপুরী সংস্কৃতির প্রাণ। এখানে রাগ সঞ্চারের মাধ্যমে কৃষ্ণের অঙ্গ নিরূপণ করা হয়।

যেমন অক্ষর-অঙ্গকৃষ্ণের; তা-বক্ষ, রি-নাভি; তা-কটি; না-পদ; রি-বাহু; তা-মুণ্ড; না-চক্ষু ও কর্ণ, তা-নাসা এবং না-মুখ।
মূর্তি বিনির্মাণে তাল, ছন্দ, লয় প্রভৃতিতে সামান্য বিচ্যুতি গুরুতর অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হয়। তার জন্য গায়ক বা বাদককে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ফল ভোগ করতে হবে বলে বিশ্বাস। এসব কৃত্যে সম্ভাব্য দোষত্রুটি লীলা সংকীর্তণের কারণে দূরীভূত হবে বলে মণিপুরীদের প্রায় যাবতীয় কৃত্যে লীলা সংকীর্তন সংযোজন হয়েছে।

মণিপুরীরা ক্ষত্রিয় এবং সামবেদের অনুসারী। অমণিপুরী ক্ষত্রিয়ের বিবাহ ও শ্রাদ্ধে যেসব মন্ত্র উচ্চারিত হয়, মণিপুরীদের বিবাহ ও শ্রাদ্ধে সেসব উচ্চারিত হয়। পার্থক্য শুধু মণিপুরীদের বিবাহ শ্রাদ্ধে সংকীর্তন অঙ্গীভূত করা হয়েছে, বিবাহে সংকীর্তনসংযোজন বিতর্ক হলেও।

মণিপুরীদের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মীয় অনুষ্ঠান শারদীয় মহারাসলীলা। ইদানীং শাক্তমতের দুর্গাপূজা দ্বিতীয় স্থানে এসেছে। শাক্তমতের দেবী দুর্গাকে মহান বৈষ্ণবী নাম দিয়ে সংকীর্তন সংযোজন করা হয়েছে। পূজার অধিবাসে সংকীর্তণ অপরিহার্য। শাক্ত ও বৈষ্ণব মতের এক সহমিলন।

প্রতি মাসে দুই-তিন খানা ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানে বিনোদনের ব্যবস্থার ফলে যেমন জন্মহার অন্য সমাজের চেয়ে কম, তেমনি সামাজিক অপরাধ সংগঠনের ঘটনাও কম।

সামাজিক বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমাজের প্রতি সদস্য আয়োজককে আর্থিক বা বৈষয়িক সাহায্য (থৌতাং) দিয়ে ব্যয়ভার লাঘবের বিধান রয়েছে।

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।