তুহিন মালিকরা কি আইনের উর্ধ্বে?

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 18 March 2017, 06:46 AM
Updated : 18 March 2017, 06:46 AM

এক যাত্রায় পৃথক ফলের সমাজ আমাদের। লেখাপড়া না-জানা রসরাজ ফেসবুক চালাতে জানতেন না। তার আইডি ভুয়া জেনেও ধর্মীয় উসকানির দায়ে যে রসে ডুবে গেল নাসিরনগরের গ্রাম তাতে নিরীহ হিন্দুদের বাড়িঘর পুড়ে ছাই। নারীদের এমন করুণ দশা– গলাপানিতে ডুবে ইজ্জত বাঁচাতে হল 'ডিজিটাল' দেশে!

এমন তাণ্ডবের সমাজে আমরা আবার ঘটা করে 'গণহত্যা দিবস' পালনের কথা বলি। 'সংখ্যালঘু' শব্দটি যত আপত্তির হোক না কেন যারা এর আওতায় তারা জানে, যে যায় লংকায় তারই বিশ হাত দশ মাথা আর সে-ই রাবণ। রসরাজের দোষ থাক বা না থাক সে তাণ্ডবে দেশের হিন্দুদের একাংশের কপাল পুড়েছিল। আর বাকিরা আরও একবার বুঝে নিয়েছিল– 'যতই বল আর যতই বুলি আওড়াও ইহা তোমার দেশ নহে।'

এখন আমাদের বিস্ময় আইনজীবী তুহিন মালিক কি আইনের ঊর্ধ্বে? এই লোকটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলাকালীন রাজাকারদের ওকালতি করতেন। সেটা তার পেশা। তিনি কী করবেন না করবেন তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যাথার কারণ দেখি না। কিন্তু সে সময় যখনই তিনি মিডিয়ার সামনে আসতেন তার বক্তব্যগুলো ছিল সাংঘাতিক উসকানিমূলক। আইন ও বিচারের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা থাকলে কেউ তা বলতে পারে না। তারপরও 'ডিজিটাল' জাতি ও সরকারের লোকেরা হজম করে নিয়েছিল। যে কারণে এখন এই লোক দেশে সাম্প্রদায়িক উসকানি আর হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে কাহিনি প্রচারে নেমেছে।

কিছুদিন আগে ঢাকাসহ সারা দেশের মানুষ দোল উৎসবে মেতেছিল। এমন না যে, তা ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছিল। সীমার ভেতরেই উদযাপিত হয়েছিল সেই রঙ-উৎসব। বিবর্ণ অন্ধকারের পোকা এসব মানুষের মনে খায়েশ থাকলেও চোখে রঙ নেই– নেই অন্তরের আবীর। যখন যা দেখে বা বলে তার পেছনে যতটা ধর্ম তার চেয়ে বেশি থাকে অন্ধবিশ্বাস। সামাজিক মিডিয়া বা ফেসবুকে এখন মানুষের ঢল। সত্যি বলতে কী, কারও কারও পোস্ট বা লেখালেখিতে যে পরিমাণ 'লাইক', মন্তব্য বা সাড়া পড়ে তা অনেক খবরের কাগজের কাটতি বা টিভি অনুষ্ঠনের দর্শক শ্রোতার চেয়েও সংখ্যায় বেশি। বিশেষত আপনি যদি উসকানিমূলক বা নেগেটিভ কিছু লেখেন তাহলে আর দেখতে হবে না– এক পোস্টেই আপনি সেলিব্রেটি! এ জন্য এর সঠিক ইস্তেমাল বা কার্যকর ব্যবহার জরুরি।

কী করেছেন তুহিন মালিক? তিনি যদি দোলযাত্রা বা এ বিষয়ে তার অনীহা কিংবা অপছন্দের কথা জানাতেন বলার কিছু ছিল না। দুনিয়ায় সব মানুষ এক বিশ্বাস বা এক ধর্মের অনুসারী নয়। ফলে মতান্তর থাকবেই। কিন্তু তিনি লিখেছেন হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাসের মূলে আঘাত দিয়ে। তার মতে, শ্রীকৃষ্ণ নাকি রাধাকে মামি হওয়ার পরও সম্ভোগ করতে গিয়ে রক্তাক্ত করার কারণে পরদিন রাধার লজ্জা নিবারণের জন্য সবাইকে রঙ মেখে লাল হয়ে আসতে বলেন যাতে সেই দাগ বোঝা না যায়। উজবুক আর কাকে বলে! লজ্জা নিবারণের সময় এত কম যে, গায়ে রঙ মেখে আসতে হবে। আর রঙ কি কেবল লাল হয়? আসলে যারা খুন জখম আর রক্তের নেশায় থাকে তাদের কাছে সব রঙই লাল বৈকি।

আমরা কোনো ধর্ম বা বিশ্বাসে আঘাত করতে চাই না। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে তো বিছানা লাল না হলে কুমারী নয় ভেবে বিবাহ না করার রেওয়াজ ছিল। তার বেলায় কী হবে? যেসব কারণে হিন্দুদের ওপর তারা রাগ করে তার অনেকগুলো এখনও সেখানে চলমান। যেদিন 'টুইন টাওয়ার' ধসে পড়ে, সেখানকার নারীরা উলুধ্বনি দিয়ে তাদের আবেগ প্রকাশ করেছিল। যেটা তারা করতেই পারে। দুনিয়ার যে কোনো লেবানিজ রেস্তোরাঁয় খাবারের পাশাপাশি বেলি ড্যান্স কিংবা নাভি-নৃত্যের চল রয়েছে। আমি নিজেও তা উপভোগ করেছি। কিন্তু সেটা কামের চোখে দেখতে হবে কেন? অপরূপা কোনো নারীর তার শরীরের একটি অগোপন অংশে শিল্প ধারণ কি পাপ? সংযুক্ত আরব আমিরাতেও সেই নাচ জনপ্রিয়।

আমরা আসলে উত্তেজনা ও উসকানির দিকটা দেখছি। হিন্দুরা এ দেশের 'গিনিপিগ'। যখনই রাজনীতি অন্যভাবে সুবিধা করতে পারে না তখন এদের মঞ্চে নিয়ে আসা হয়। পাকিস্তানিরা সেটা করতে গিয়ে একটি বিরাট অংশ হারিয়ে ফেলায় আজ আমরা স্বাধীন। আমাদের একনায়ক এরশাদ গদি হারানোর শেষপ্রান্তে পরিকল্পিত দাঙ্গা বাঁধাতে গিয়ে আসন হারিয়ে শ্রীঘরে ঢুকেছিলেন। একটি ক্যাডারভিত্তিক দল হওয়ার পরও জামায়াত সে কারণে দিশেহারা। কারণ প্রকৃতি কিংবা খোদা কেউ মানুষের ওপর অকারণ অনাচার সহ্য করেন না।

তুহিন মালিক হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের বিশ্বাস ও ভক্তিবোধে আঘাত করেছেন। যাদের বিশ্বাস রাধা-কৃষ্ণের লীলা বা প্রেম স্বর্গীয় তারা জান্নাত-দোজখ কিংবা নানা বিষয়ে বহু কথা বলতে পারেন। তিনি কি সেসব মেনে নিতে প্রস্তুত আছেন? তাছাড়া সংখ্যাগুরু তরুণীদের যারা রঙ মাখাতে গিয়েছিল তাদের পরিচয়ও উদঘাটিত হয়েছে। তারা আর যে-ই হোক হিন্দু ছিল না।

তুহিনের পোস্টটি মূলত নিজের বিশ্বাস বা ধর্মের কারণে যতটা তার একশ গুণ বেশি আক্রমণাত্মক। এই চক্রান্ত বা দাঙ্গা-ফ্যাসাদ লাগানো ও ঘৃণা ছড়ানোর কাজটি নতুন কিছু নয়। প্রশ্ন একটাই– এ নিয়ে তলাহীন প্রগতিশীল ও ক্রমে সেবাদাসে পরিণত হয়ে ওঠা পঙ্গু সংস্কৃতবানদের কেউ উচ্চবাচ্য করেননি। দেশের রাজনীতির যে অংশ এ দেশের প্রগতিশীলতার ক্রিম খায় তারাও চুপ। এখন তাদের ভোজনকাল। ছলে-বলে-কৌশলে তারা 'দেশ-রুটি'র ওপর লাগানো ক্রিম খেতে ব্যস্ত। আর এদিকে ঘরের ইঁদুর বেড়া কাটছে।

তুহিন মালিকের জায়গায় কোনো হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান যদি এর সিকিভাগ কিছু লিখত আজ আমরা মিডিয়া খুলে দেখতাম তাণ্ডবে অসহায় সংখ্যালঘুরা কড়াইল বস্তির লোকদের পাশে বসে কান্নাকাটি করছে। তাদের কেউ কেউ সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার জন্য দালাল খুঁজতেও বেরিয়ে যেত। এই দুমুখো নীতি, আওয়ামী লীগের এই আপোসের রাজনীতি তাদের ভবিষ্যৎ ক্রমে বিপন্ন করে তুলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও দুচারজন ছাড়া কারও ভেতর এ সব নিয়ে মাথাব্যাথা বা উদ্বেগ নেই। তারা 'কানে দিয়েছি তুলো পিঠে বেঁধেছি কুলো' হয়ে আছে যার যার জায়গায়। ভাগ্যিস এখনও এ নিয়ে কোনো বড় অঘটন ঘটে যায়নি। তবে এটা ঠিক যে, এই প্ররোচনা বন্ধ না হলে অচিরেই আবার কোনো ঘটনা ঘটতে পারে।

আইন যে সবার জন্য সমান, আইন ও বিচার যে রসরাজ ও তুহিন মালিককে এক পাল্লায় মাপে– সেটাই দেখতে চায় জনগণ। তা না হলে আমরা বুঝে যাব তুহিন মালিকদের ওপরে যে মালিকরা দেশ চালায় তাদের লম্বা হাত সব জায়গায় পৌছুঁতে পারে না। যে কোনো সভ্য সমাজ বা দেশে এমন খোলামেলা ধর্মীয় অবমাননা ও লেখার জন্য ইতোমধ্যে কিছু একটা হয়ে যেত।

স্বাধীনতার এই মাসে জঙ্গিবাদের উসকানিদাতা, সাম্প্রদায়িক হিংসা উসকে দেওয়ার মানুষরা স্বাধীন নাকি জনগণ স্বাধীন– সেটাই জিজ্ঞাসা।