গরিবের মাথায় গার্ডার পড়বে না তো কি ফুলচন্দন পড়বে?

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 15 March 2017, 03:21 AM
Updated : 15 March 2017, 03:21 AM

হুজুগে বাঙালি বলে কথা– না হলে সামান্য একজন দোকান কর্মচারীর মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে এত শোরগোল হয়! এর কোনো মানে আছে? আরে ভাই, উড়ালসড়ক মানে হচ্ছে 'উন্নয়ন', আর উন্নয়ন কোনো একক ব্যক্তির বিষয় নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বার্থ। বৃহৎ স্বার্থে ক্ষুদ্র ত্যাগ স্বীকারে যদি আমরা এখনও কুণ্ঠিত হই, তাহলে দেশের উন্নয়ন করে কার সাধ্য?

ঘটনাটি আকস্মিকই ঘটেছে। রাজধানীর মালিবাগ রেলগেট এলাকায় নির্মাণাধীন উড়ালসড়কের (ফ্লাইওভার) গার্ডার পড়ে স্বপন নামে এক ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েকজন। তারাও এমন কোনো 'বীরবাহাদুর' নয়, নিতান্তই খেটে খাওয়া কিছু লোক। গরিব, খেটে খাওয়া মানুষ হচ্ছে নিতান্তই ছোটলোক। এই ছোটলোকগুলোর জন্য ফালতু আবেগের কোনো মানে আছে? কয়েকটা ছোটলোক হতাহত হয়েছে, আর তাই নিয়ে মিডিয়ায় রীতিমতো ঝড় বয়ে যাচ্ছে! কেন এমন ঘটনা ঘটল, কার উদাসীনতা, কার গাফিলতি, এর জন্য কে দায়ী ইত্যাদি নিয়ে রীতিমতো গবেষণা শুরু হয়েছে।

গরিবের আবার নিরাপত্তা কী? ওরা আগাছার মতো জন্মাবে, খড়-কুটোর মতো ভেসে যাবে, কীটপতঙ্গের মতো মরবে, জন্তু-জানোয়ারের মতো উপেক্ষা-অবজ্ঞার পাত্র হবে– এটাই তো জগতের নিয়ম। তাহলে খামোকা কেন ওই লোকগুলোর জন্য এমন প্রাণপাত?

এ দেশে প্রতিনিয়ত গরিব-ছোটলোকরা মরছে। কখনও গার্ডারের নিচে চাপা পড়ে, কখনও ভবনধ্বসে, কখনও কারখানার আগুনে, কখনও যাকাতের কাপড় সংগ্রহ করতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে। এই ছোটলোকগুলো যেমন হালি হালি জন্মায়, তেমন গণ্ডায় গণ্ডায় মারা পড়ে। তাদের মৃত্যু নিয়ে ভাবা রীতিমতো 'মাছের মার পুত্রশোক'। যাদের জন্মই হয়েছে অপঘাতে, অবহেলায় অবজ্ঞায় পশুর মতো মরার জন্য, তাদের মৃত্যুতে বিচলিত হওয়া কী ভদ্রলোকের শোভা পায়?

সমাজ-সংসার-রাষ্ট্র-সরকার কখনও গরিব বা ছোটলোকের স্বার্থ রক্ষার জন্য বিচলিত হয় না। সবাই ভাবে বড়লোক বা ভদ্রলোকের স্বার্থের কথা। বড়লোকরাই রাষ্ট্রের মান-ইজ্জত বাড়ায়। সম্প্রতি আমাদের দেশের এক 'বড়লোক' বিশ্বের নামজাদা ধনীদের তালিকায় নাম লিখিয়ে দেশের মুখোজ্জ্বল করেছেন। বড়লোকরাই মানুষ, তারাই দেবতা। তারা যেমন 'মেরে খেতে' জানে, তেমন 'কেড়ে'ও খেতে জানে। তারাই বাপের ব্যাটা। তাদের জন্যই অভিজাত এলাকার বাড়ি, পতাকাশোভিত গাড়ি। আছে সান্ত্রী-সেপাই-পাইক-পেয়াদা। তাদের সেবা দিয়েই ধন্য গরিবের জীবন। এই গরিবরা দু-চারটা মরলে রাষ্ট্রের কী এমন এসে যায়?

এই গরিবগুলো অনেক সময় বস্তিতে বাসা বেঁধে থাকে। পরিবেশ নষ্ট করে। বড়লোকদের স্বাচ্ছন্দ্য চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়। তাইতো অজ্ঞাত শত্রুরা রাষ্ট্রের আজ্ঞাবাহীরা মাঝে মাঝে বস্তিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারপরও তাদের শায়েস্তা করা যায় না। 'কৈ মাছের প্রাণ' না বলে বলা উচিত ছোটলোকের প্রাণ। এরা যে কত নির্যাতন সহ্য করতে পারে তা আগুনদাতাও জানে না। যে কারণে বস্তিতে আগুন লাগার পরও তারা সেখানেই রয়ে যায়। পাড়ার নেড়ি কুত্তাগুলোকে যেমন হাজার পেটালেও কোথাও চলে যায় না তেমনি বস্তিবাসীও রয়ে যায়!

গরিবের পশ্চাৎদেশে লাথি না মারলে কোনোদিন উন্নতি হয়? নির্মাণ কাজে নিরাপত্তার দোহাই দেওয়া নিতান্তই ফাজলামো। নিরাপত্তা কাদের জন্য? নিশ্চয়ই কোনো ছোটলোকের জন্য নয়। এই নির্মাণপ্রক্রিয়া যত ঝুঁকিপূর্ণই হোক না কেন, সাধারণ মানুষ, পথচারীরা যে বিনা পয়সায় উন্নয়নের 'সার্কাস বা পথনাটক' দেখার সুযোগ পাচ্ছে, এর কি কোনো মূল্য নেই?

তাছাড়া মানুষ তো অমর নয়। সে মরবেই। গরিবরা না হয় একটু আগেভাগেই গেল! রবীন্দ্রনাথ তো 'রক্তকরবী' নাটকে বলেছিলেন:

"মৃত্যু ভিন্ন মুক্তির কোনো পথ নেই, মৃত্যুর অতলে তলিয়ে গিয়ে তবেই মুক্তি!"

গরিবরা মরে গিয়ে 'মুক্তি' লাভ করছে। রাষ্ট্র, নির্মাণ প্রতিষ্ঠান, বড়লোক-ক্ষমতাবানরা গরিবদের 'মুক্তি' অর্জনে সহায়তা করছে। এর আগে আমরা নির্মাণাধীন ভবনের উপর থেকে ইট পড়ে পথচারীর মৃত্যু হতে দেখেছি ঢাকার পান্থপথে। তারও আগে সাইন্সল্যাবরেটরি মোড়ে ফুটওভার ব্রিজ তৈরির সময় গার্ডার ভেঙে একজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল।

২০১২ সালে চট্টগ্রামে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙে নয়জন নিহত হয় ঘটনাস্থলেই। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও পাঁচজনের মৃত্যু হয়। ২০১৩ সালে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়াতে নির্মাণাধীন সেতুর গার্ডার ভেঙে মৃত্যু হয় এক শ্রমিকের। বয়লার বিস্ফোরণে, যানবাহনের তলায় পড়েও প্রায়ই মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। কিন্তু কে রাখে সেসব মৃত্যুর পরিসংখ্যান!

এ দেশে কেউ কারও মৃত্যুর দায় নেয় না। সরকার না, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান না, সিটি করপোরেশন না। তারা দায় নেবেই বা কেন? যারা মরছে, তারা তো বড়লোক নয়। ছোটলোকদের মৃত্যু নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো তাদের অবসর কোথায়? বাংলাদেশে বসবাস করতে হলে মৃত্যুঝুঁকি নিয়েই তা করতে হবে। এত যে অবহেলা, উপেক্ষা, উদাসীনতা, তারপরও ছোটলোকের বাচ্চাগুলো দল বেঁধে বিদ্রোহ করে না। দলে দলে আত্মহত্যাও করে না। রাষ্ট্র বিভিন্ন মৃত্যুফাঁদকে 'সুরক্ষা' দিলেও তার বিরুদ্ধে কারও রা নেই!

হে আহাম্মক সকল, তোমাদের মাথায় আরও আরও গার্ডার ভেঙে পড়ুক। মনে রেখ, গরিবের মাথায় গার্ডার পড়বে না তো কি ফুলচন্দন পড়বে?

কর্তাব্যক্তিদের অভিনন্দন এমন 'ভাবলেশহীন' ভূমিকার জন্য। আর না হয়েই-বা উপায় কী? সাধারণ মানুষ মরলে তাদের কী আর এমন যায় আসে? তাদের তো আপনজন মরছে না। তাদের আপনজনরা আরামে সবরকম সুযোগসুবিধা নিয়ে নিরাপদেই আছে। থাকছে। তাহলে তাদের গায়ে লাগবে কেন? গরিব মরলে তো দেশ থেকে দরিদ্র লোকের সংখ্যা কমে। 'উন্নয়নশীল' দেশের তকমা মাড়িয়ে 'উন্নত' দেশের পথে আরও একধাপ এগোতে পারি।

মরছে মানুষ মরুক, পুড়ছে মানুষ পুড়ুক, কাঁদছে মানুষ কাঁদুক। রাজনৈতিক নেতাদের কিচ্ছু আসে-যায় না। কারণ ক্ষমতাই আসল, ক্ষমতাই সর্বময়। ক্ষমতার বলি হোক এই দেশের সাধারণ নিরীহ মানুষ। আমাদের সম্মানিত নেতানেত্রীগণ নিরাপদ নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভেতরে থেকে মাঝেমধ্যে কুমিরের অশ্রু বিসর্জন করুন, আমরা তাতেই খুশি। আরও সুযোগ করে দিন যেন মানুষ মরে। গরিব মানুষ আরও কাতারে কাতারে মরুক। আমরা গরিবি হঠাতে না পারি গরিব মানুষদের তো কিছু কিছু হঠাতে পারছি! আমাদের উন্নয়নের জয়যাত্রা আর ঠেকায় কে?

সুনিপুণ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত 'গরিব হঠাও' কর্মসূচি সফল হোক!