নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ও কর্পোরেট সংস্কৃতি

Published : 13 March 2017, 04:19 AM
Updated : 13 March 2017, 04:19 AM

আমি আবার নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি নিয়ে লিখতে বাধ্য হলাম। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে হলি আর্টিজানে ঘটেছিল যে ঘটনা তার প্রায় সম্পূর্ণ দায়ভার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘাড়ে চাপানোর যে অপচেষ্টা চলেছিল তারই পরিপ্রেক্ষিতে আমার প্রথম লেখা। এ জন্য বহু পাঠকের কাছে আমাকে নিগৃহীত হতে হয়েছে এবং উল্টোভাবে আমার অনেক প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্র এবং সহকর্মীর প্রশংসাও পেয়েছি। কিন্তু আমার আদি ধ্যান-ধারণা থেকে আমি বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হইনি, আর সেটি হল, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের একটি বিশিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় যার উল্লেখযোগ্য অবদান আছে বাংলাদেশের শিক্ষা কাঠামোতে। এর স্থান নির্দিষ্ট হয়ে গেছে এবং এখানে মৌলবাদের শিক্ষা দেওয়া বা চর্চা করা হয় না।

সম্প্রতি একটি ঘটনার সূত্র ধরে একটি কর্পোরেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের নিয়ে সন্ত্রাস ও মৌলবাদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে আবার দূরভিসন্ধিমূলক প্ররোচনায় মেতেছে। এদের নিজস্ব একাধিক প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মালিকানা থাকার কারণে সত্য-মিথ্যার এক গোয়েবলীয় জটিল মিশ্রণে যে খবর ও টক-শো প্রচারিত হচ্ছে তা শুনে ও পড়ে আমি মর্মাহত। কারণ যে তথ্যসমূহ পরিবেশিত হচ্ছে তা অধিকাংশই ২০১৬ সালের চর্বিতচর্বণ যার অনেকখানিই এখন হয় অপ্রচল কিংবা মিথ্যা প্রমাণিত।

শুধু একটি উদাহরণই যথেষ্ট: বলা হয়েছিল এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যুদ্ধাপরাধীদের সন্তানদের শিক্ষকতায় নিযুক্ত করা হয়েছিল। তথ্যটি অর্ধসত্য– এ কথা আমি আমার প্রথম প্রবন্ধে লিখেছিলাম। সত্যটি হল, তারা কেউই পূর্ণকালীন শিক্ষকরূপে এখানে শিক্ষকতা করেনি, করলেও তথ্য গোপন করেছিল এবং যে মুহূর্তে সত্য উদঘাটন হয়েছে সেই মুহূর্তে চাকরিচ্যুত হয়েছে।

আমি সেই প্রবন্ধে এবং পরবর্তী কিছু আলোচনায় বলেছিলাম, এমন উদাহরণ কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও নেই। কারণ এই মুহূর্ত পর্যন্ত অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যুদ্ধপরাধীদের এবং জামায়াত শিবিরের সন্তানরা কর্মরত আছে।

মনে পড়ছে অতি সম্প্রতি ওই কর্পোরেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রিত পত্রিকায় যখন খবর ছাপা হয়েছে নর্থ সাউথের ছাত্রদের সঙ্গে হিযবুত তাহরিরের বানোয়াট সম্পৃক্ততা নিয়ে, ওই একই কাগজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই একই মৌলবাদী ছাত্র সংগঠনের তৎপরতার ঘটনাও ছাপানো হয়েছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌলবাদী চক্রের পদচারণার সবচেয়ে বড় সাক্ষী বিশ্ববিদ্যালয়ে লাল, নীল, হলুদ ও সাদা শিক্ষক দলের অবস্থিতি ও দন্দ্ব, যা আজও সরকার নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। অবশ্য এটি নিয়ন্ত্রণে আনার প্রয়োজন কি না, সেটিও ভেবে দেখার আছে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় তো একাধিক ধ্যান-ধারণারই মুক্তাঙ্গন।

তাহলে কেন আবার নতুন করে নর্থ সাউথের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ যেখানে এমন লাল, নীল, হলুদ ও সাদার দৌরাত্ম নেই, কখনও ছিল না। বিষয়টি কর্পোরেট সংস্কৃতির অংশ হিসেবেই এই রূপ নিয়েছে। বলতে বাধ্য হচ্ছি, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় তার অবস্থিতির কারণেই বিপদে আছে। দুই কর্পোরেট দানবের মাঝখানে 'স্যান্ডউইজ' হয়ে থাকা যে কী সর্বনাশা, তা অতীত ও সাম্প্রতিক একাধিক ঘটনার দ্বারাই প্রমাণিত। মানতেই হবে বসুন্ধরা– যেখানে নর্থ সাউথের অবস্থান– একটি 'state within a state'। সেখানে সরকারেরও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এই এলাকার সব নিয়ম-কানুন বসুন্ধরা গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। আমি ব্যাক্তিগতভাবে একাধিকবার তাদের নিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে রীতিমতো অপমানিত হয়েছি, বিশেষ করে নিরাপত্তাকর্মীদের দ্বারা। সম্প্রতি যে ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে ছাত্রদের সঙ্গে সেটি বসুন্ধরার নিরাপত্তাকর্মীদের দ্বারাই।

তবে এ কথাও আমি মানি, ছাত্রদের মানসিকতা ও আবেগ অনেক ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয় না। ফলে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। কিন্তু কর্পোরেট সংস্কৃতির ধারায় ঢালাওভাবে শত্রুর বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই 'ট্রাম্পিও পদ্ধতি'তে দোষ চাপানো অবশ্যই অন্যায়। বসুন্ধরা গ্রুপ ঠিক এই কাজটিই করেছে এবং করতে চাচ্ছে।

অন্যদিকে আমি মনে করি, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও কর্পোরেট সংস্কৃতিতে পরিচালনা করা সঠিক নয়, যেটি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি করছে বা করতে চাইছে। হলি আর্টিজানের ঘটনার পর বর্তমান সরকারের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণার যত প্রকার উপকরণ অতিরঞ্জিতভাবে প্রদর্শন করা সম্ভব, তা এই বিশ্ববিদ্যালয় করতে তৎপর। মনে পড়ে বিষয়টি আমি আমার প্রথম প্রবন্ধে উল্লেখ করেছি। বঙ্গবন্ধু হত্যা নিয়ে নব্বইয়ের শেষ দশকে আমি কর্তৃপক্ষের নজর এড়িয়ে অনুষ্ঠান করেছি। এই যে অতীত থেকে বর্তমানের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এটিকেই আমি চিহ্নিত করছি কর্পোরেট সংস্কৃতি রূপে।

বিশ্বে অনেক অনেক ঐতিহাসিক সত্য আছে যা যে কোনো পরিস্থিতিতেই অপরিবর্তনীয় ও সত্য এবং একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তা যে কোনো মূল্যে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়, কর্পোরেট সংস্কৃতিতে যার স্বীকৃতি নেই। বঙ্গবন্ধুকে তাঁর পরিবারসহ যেভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং সেটি যে কত বড় অন্যায় ও কুকর্ম, তা ইতিহাস থেকে কখনও বাদ দেওয়া যাবে না। এবং এটিও ঐতিহাসিক সত্য– তাঁরই দীর্ঘ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলেই সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম ও অবস্থান। শিক্ষা ক্ষেত্রে এই সত্যের অন্য কোনো বিকল্প নেই।

তবে বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো আমিও বিশ্বাস করি কিংবা সেই বিজ্ঞানী গ্যালিলিও যিনি প্রথম প্রমাণ দিয়ে বুঝিয়েছেন, পৃথিবীর চারদিকে সূর্য ঘোরে না, পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে ঘোরে। পৃথিবী যে গোল তার প্রমাণ পেতে হলে প্রথমেই ধরে নিতে হবে পৃথিবী সমতল অথবা আলো কী, তা জানতে হলে অন্ধকার কী, সেটাই আগে আবিষ্কার করতে হবে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার সব মতবাদেরই মূল্যায়ন হওয়া বাঞ্ছনীয়, নইলে সত্য উদঘাটন করে মিথ্যা চিহ্নিত করা সম্ভব নয়।

মৌলবাদকে বাতিল করতে হলে জানা উচিত আসলে মৌলবাদটা কী। বাংলাদেশ কেন হয়েছে তা জানতে হলে জানতে হবে পাকিস্তান কেন হয়েছিল এবং তার ভিত্তিহীনতা কী। এ সবই শিক্ষায়তনের শিক্ষার বিষয়, কর্পোরেট ব্যবসার সুবিধা আদায়ের বিষয় নয়। সন্ত্রাস-মৌলবাদের শিক্ষায়তবনিক সমাধান কখনও কর্পোরেট দৃষ্টিভঙ্গিতে হয় না, হতে হয় উদার শিক্ষার মাধ্যমে। দুঃখজনক হল, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি এ পর্যন্ত শিক্ষায়তনের সব সমস্যার– যে কোনো প্রতিষ্ঠানে সমস্যা থাকতেই পারে– সমাধান করতে চায় কর্পোরেট সংস্কৃতি দ্বারা।

জানতে পেরেছি, সম্প্রতি নর্থ সাউথ কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতি সন্ত্রাসবাদের অঙ্গুলি নির্দেশ থেকে রক্ষা পেতে ভাটারা থানাকে দুটি মটরযান 'যৌতুক' দিয়েছে। ঠিক এটিই হল কর্পোরেট কায়দায় সমাধান বের করার চেষ্টা। বিষয়টি যদি সত্যি হয় তবে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রতিদ্বন্দ্বী বসুন্ধরা গ্রুপ ঠিক তেমন ভঙ্গিতেই প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করবে বা করছে– প্রচারণার মাধ্যমে নর্থ সাউথের কুৎসা রটিয়ে। এটি করা তাদের জন্যে ভীষণ সহজ, কারণ বসুন্ধরা একাধিক গণমাধ্যমের মালিক।

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা প্রদানে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিরাট ও সুস্পষ্ট স্থান নির্ধারিত হয়ে গেছে। এটিকে নিম্নগামী করার কোনো অবকাশ নেই এবং এই বিশ্ববিদালয়ের কর্তৃপক্ষের উচিত হবে শিক্ষার মান ও বিস্তারে যেটি সঠিক সিদ্ধান্ত সেটিই গ্রহণ করা।

কর্পোরেট সংস্কৃতি সম্পূর্ণ বর্জন করতে হবে তা সে সন্ত্রাসবাদ উন্মুলেই হোক বা বিশুদ্ধ উচ্চশিক্ষা প্রদানেই হোক কিংবা শিক্ষক ও শিক্ষার্থী নির্বাচনেই হোক। সঠিক পদে সঠিক শিক্ষক নির্বাচন বিশুদ্ধ শিক্ষায়তনিক সংস্কৃতির জন্য অপরিহার্য। এ বিষয়ে কর্পোরেট স্বার্থ বিবেচনায় আনা আত্মঘাতী হবে। কর্পোরেট সংস্কৃতি হল স্বার্থোদ্ধার বা বস্তুবাদ, অন্যদিকে শিক্ষায়তন সংস্কৃতি হল শিক্ষা প্রদান ও গ্রহণে স্বার্থহীনভাবে নিষ্ঠাবান হওয়া।