বেহাত চেতনার পুনর্জাগরণ কি সম্ভব?

জাহান-ই-গুলশান
Published : 9 March 2017, 06:37 AM
Updated : 9 March 2017, 06:37 AM

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে কিছু কথা লিখব ভাবছি আর ঢুঁ দিচ্ছি অনলাইনের খবরে। হঠাৎ বিবিসির একটা খবরে চোখ আটকে গেল। ভারতের মহারাষ্ট্রের একটি হাসপাতালের পাশে গর্তে ১৯টি কন্যাশিশুর ভ্রূণ পাওয়া গেছে। একটি ভ্রূণ খুন করতে গিয়ে জীবন গেছে এক হতভাগা মায়ের। সেই থেকে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কয়েকটি প্রশ্ন: এসব ভ্রূণের 'অপরাধ' কি এই যে, তারা মেয়ে? ওদের জন্মদাতারাই বা কেন ওদের হত্যাকারী হল? পরিবারে-সমাজে ওরা এতটা অনাকাঙ্ক্ষিত কেন?

অনেকে বলবেন, বাংলাদেশে এ সমস্যা নেই। ঠিক তাই। এখানে ভারতের মতো কন্যাশিশুর ভ্রূণ হত্যা করা হয় না। তবে এ দেশে মেয়েদের জীবন কতখানি তাদের নিজেদের হাতে আর কতটুকু জীবনই-বা তাতে থাকে? এমন হাজারো 'কী', 'কেন' আর মেয়ে হওয়ার 'অপারাধে' হত্যা বা ছেলে জন্ম না দেওয়ার 'অপরাধে' লাঞ্ছনা অথবা সন্তান জন্ম না দিতে পারার 'অপরাধে' ডিভোর্সসহ হাজারো অপরাধের শাস্তি যখন নারীর কাঁধে তখন উদযাপিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি, কর্পোরেট বা বিজ্ঞাপনী সংস্থা নানা আয়োজনে ৮ মার্চ উদযাপন করে। পত্রিকায় বিশেষ নিবন্ধ ছাপা হয়। টেলিভিশনে কথা হবে। সেখানে সফল নারী-পুরুষরা আসবেন, যেমন আসেন ফি বছর। নারীদের জন্য কিছু দাবিও তোলা হবে। সেসব দাবির বেশিরভাগ হবে শহুরে শিক্ষিত, মধ্য ও উচ্চবিত্ত নারীর প্রয়াজন অনুযায়ী। এটি স্বভাবিকও। কেননা, আমরা যারা নারী অধিকার নিয়ে কথা বলি, দাবি তুলি, তারা আটকে আছি নিজ নিজ শ্রেণির মধ্যেই।

আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এ দেশের প্রত্যন্ত কোনো কোনো ইউনিয়ন পরিষদে সরকারিভাবে বা কোথাও কোথাও স্থানীয় এনজিও বা সংস্থা আর্ন্তজাতিক নারী দিবস উদযাপন করে। উদযাপন মানে র‌্যালি, আলোচনাসভা ইত্যাদি। সেখানে এনজিও থেকে লোন নেওয়া বা কোনো কার্যক্রমে যুক্ত গ্রামীণ নারীরা আসেন। দু-একজন নারী আলোচনায় অংশ নেন। তবে বেশিরভাগ আসেন তাদের স্যার-ম্যাডামরা বলেন বলে। তাদের জীবনের সঙ্গে ৮ মার্চের কোনো সম্পর্ক তৈরি হয় না। কারণ তাদের তো দেখা হয় কেবল র‌্যালিতে সংখ্যা বাড়ানোর, সফল অনুষ্ঠান করার 'উপাদান' হিসেবে।

অথচ উল্টোটা হওয়ার কথা ছিল। তাদের দাবি উত্থান ও আদায়ের একটি বিশেষ দিন হিসেবে ৮ মার্চে গ্রামীণ নারীদের যুক্ত করা প্রয়োজন ছিল। আমরা বোধহয় ভুলে যাই যে, নারী দিবস আসলে শ্রমজীবী নারীর সংগ্রামের ফসল। সেই যে ১৮৫৭ সালে নিউ ইয়র্কে সেলাই কারখানার শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, যৌক্তিত শ্রমঘণ্টা, স্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশের দাবির আন্দোলন শুরু করেন, মিছিল করেন, পুলিশের গুলিতে জীবন দেন, তারই ধারাবাহিকতায় ১৮৬০ সালে শ্রমিকরা 'ট্রেড ইউনিয়ন' গড়ে তোলেন।

সমাজতন্ত্রীদের নেতৃত্বে দাবি আদায়ের ধারাবাহিক সংগ্রাম অব্যাহত থাকে। ১৯১০ সালে সমাজতন্ত্রী নারীদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম নেতা ক্লারা জেটকিন শ্রমজীবী নারীদের জন্য বিশেষ দিবস উদযাপনের প্রস্তাব করেন। সে অনুযায়ী পরের বছর ১৯ মার্চ সমাজতন্ত্রের সমর্থক দেশগুলো 'নারী দিবস' উদযাপন করে। ১৯১৩ সাল থেকে ৮ মার্চ দিবসটি উদযাপিত হয়। পরে অবশ্য জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চকে 'আন্তর্জাতিক নারী দিবস' হিসেবে ঘোষণা করলে এর সদস্য রাস্ট্রগুলো দিবসটি উদযাপন করতে শুরু করে।

আর্ন্তজাতিক নারী দিবস উপলক্ষে রাশিয়া, লাওস, কিউবা, ভিয়েতনামসহ বেশ কয়েকটি দেশে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া ৮ মার্চে কেবল নারীদের ছুটি দেয় চীন, নেপাল, মাদাগাস্কার প্রভৃতি দেশ। বাংলাদেশের নারীরাও কি এ দিনটায় ছুটি পেতে পারে না?

আজ এ কথা সবাই স্বীকার করবে যে, নারী দিবস যাদের রক্তে অর্জিত– কী বিশ্বে কী বাংলাদেশে– সেই শ্রমজীবী নারীদের অংশগ্রহণ ৮ মার্চে কমই থাকে। জানা নেই এ দেশের সবচেয়ে বড় পোশাক খাতের নারীদের ৮ মার্চে ছুটি দেওয়া হয় কি না? তবে আর্ন্তজাতিক নারী দিবস একশ পেরুনোর পরও দেখি বাংলাদেশের শ্রমজীবী নারীরা এখনও ন্যায্য মজুরি, শ্রমঘণ্টা বা কর্মপরিবেশ থেকে বঞ্চিত।

আবার ইনফরম্যাল সেক্টরের নারী কর্মীদের মর্যাদা ও মজুরি দুটোই কম। অন্যদিকে নিরন্তর একঘেঁয়ে ছুটি ও বেতনবিহীন গৃহিনীদের শ্রমের সামাজিক স্কীকৃতি তো নেই-ই বরং আছে অবজ্ঞা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য। আবার শ্রমের বাজারে নারীদের যুক্ত হওয়ার সুযোগ আগের চেয়ে যে হারে বেড়েছে সে অনুপাতে শিশু বা বয়স্কদের দেখাশোনার কোনো প্রতিষ্ঠান (ডে-কেয়ার) হয়নি।

পারিবারিক রান্না, খাওয়া, সদস্যদের দেখাশুনা করা সেই কর্মজীবী নারীর হাতেই। ফলে ঘরে এবং বাইরে কর্মজীবী নারীর কাজের বোঝা বেড়েছে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ। সবদিক সামলানো কঠিন হয়ে পড়ায় পরিবার বা সন্তানের স্বার্থে নারীদের কাজ ছেড়ে দেওয়ার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তবে কমেনি পারিবারিক নির্যাতন। তা সে হোক শহরে কী গ্রামে।

মানতে কারও কারও কষ্ট হলেও এটি সত্য যে, এখন পর্যন্ত পরিবারেই নারী বেশি নির্যাতিত হয়। গ্রামে এমনকি পারিবারিক নির্যাতনের এক ধরনের সাংস্কৃতিক বৈধতা দেখতে পাওয়া যায়। তবে যৌতুকের কারণে যখন অনেক নারীকে প্রাণ দিতে হয়, তখন পাহাড়ের আদিবাসীদের মধ্যে এর কোনো প্রকোপ নেই। পাহাড়িরা বিয়েতে যৌতুক দেওয়া-নেওয়া না করার উন্নত সংস্কৃতি চর্চা করে। এটি অন্যদের জন্য উদাহরণ হতে পারে। শুধু তাই নয়, পাহাড়ি নারীরা চলাফেরায়ও অনেক স্বাবলীল। তবে আদিবাসী নারী হিসেবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের আক্রমণের বা ধর্ষণের আতংকে থাকতে হয় তাদের। যদিও আদিবাসী সমাজের ধর্ষণের ঘটনা নেই বললেই চলে; আদিবাসী পুরুষের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ কখনও শুনেছি বলে মনে হয় না।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সব সমাজের সব নারীর সমস্যা এক নয়। একেক উৎপাদন বা সামাজিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকা নারীর সমস্যার ধরন একেক রকম। এ জন্য সমাজের সব নারী একটি আলাদা সামাজিক স্তর বা শ্রেণি তৈরি করে না। তাই আর্থ-সামাজিক অবস্থা সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করে একটি সমাজের নারী সমস্যার সমাধান বা নারীর মুক্তির পথ বের করতে হবে। অনেক সময় বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়, পশ্চিমা নারীবাদ বা সংস্কারবাদ দিয়ে বুঝি-বা নারীর দাবি পূরণ হবে। এটি সত্যি যে, সামান্য কিছু দাবি পূরণ হবে বটে। কিন্তু দাবিগুলোই যখন সমাজের নির্দিষ্ট কিছু নারীর, তখন বৃহৎ নারীসমাজের দাবি আলোচনায় আসবে না।

এটা ভুলে গেলে আমাদের ভুল হবে যে, নারীর প্রশ্ন একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন। বাংলাদেশের মতো সেমি-কলোনিয়াল, সেমি-ফিউডাল সমাজে ধর্মের নামে নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শের আধিপত্য সব শ্রেণির নারীকেই অবদমিত রেখেছে। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় নারীকে পণ্যের চেয়ে বেশি কিছু তো গণ্য করা হয় না।

ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের নারীআন্দোলন কর্মীদের আজ নতুন করে ভাবতে হবে। ক্লারা জেটকিনদের ৮ মার্চের বেহাত হয়ে যাওয়া স্পিরিটের পুনর্জাগরণ ঘটাতে হবে। নারীর সংগ্রাম কেবল এককভাবে নারীর নয়, বরং একটি মানবিক সমাজ নির্মাণের সংগ্রামও। তাই এ আন্দোলনে মানবিক বোধসম্পন্ন পুরুষদেরও যুক্ত করতে হবে। নারী-পুরুষের যৌথ প্রয়াসেই সমাজের গণতান্ত্রিক রূপান্তর সম্ভব হবে। আর সে প্রক্রিয়ায় নারীর প্রতি বৈষ্যমেরও অবসান হবে।