ভাষার বিড়ম্বনা

সৈয়দ বেলাল আহমেদ
Published : 3 Feb 2012, 07:38 AM
Updated : 3 Feb 2012, 07:38 AM

বাংলা ভাষার জন্য আমাদের ভালোবাসা আর ত্যাগ সারা বিশ্বে আজ স্বীকৃত। ধর্মের নামে জাতিকে ভাগ করা হয়েছিলো, ভাগ হয়েছিলো দেশ। কিন্তু আমরা ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত অধ্যায়ের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত স্বাধীন একটা দেশ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি।

আজ ৪০ বছরের পুরোনো এই দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী নিয়ে সগৌরবে বিশ্বের বুকে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ, এটা কম সাফল্য নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, যারা বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিলেন এবং মানবতাবিরোধী অবস্থানে ছিলেন, তারা তাদের ভুল স্বীকার করেন নি। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এসব যুদ্ধাপরাধীদের দাপটে বরং ৪০ বছর মুক্তিযোদ্ধারা হয়েছেন অপমানিত এবং দেশের ইতিহাস হয়েছে বিকৃত। এখন অনেক অপরাধীদের খুঁজে বিচার করতে হচ্ছে।

বিশাল জনগোষ্ঠী নিয়ে বাংলাদেশ আজ শুধু শক্তিশালী একটি দেশই নয়, এই দেশের লক্ষ লক্ষ সন্তান আজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাস করছেন। এসব প্রবাসী বাঙালিরা নিজেদের ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। বিশ্বব্যাপী বাঙালি পরিচয়ে তারা আজ গর্বিত। এই বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে এটা হতো না।

আমি নিজেও একজন প্রবাসী বাঙালি। কর্মসূত্রে বিভিন্ন দেশে যাবার সুযোগ হয়, বাঙালিদের সাথে দেখা হয়, কথা হয়, ভালো লাগে তাদের দেশপ্রেম দেখে। একথা ঠিক প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে নানা সমস্যা আছে, দলাদলি আছে কিন্তু তারপরেও সবার অন্তরে কিন্তু একটা বাংলাদেশের ছবি আছে, একথা নিশ্চিত বলতে পারি।

কর্মসূত্রে লন্ডনে থাকলেও আমাকে গত এক যুগ ধরে বছরে গড়ে অন্তত আট-দশ বার করে ঢাকা-কলকাতা সফর করতে হচ্ছে। দেশের ব্যাপক পরিবর্তন নজরে পড়ে, ভালো লাগে। কেন আরো উন্নয়ন হচ্ছে না এবং দ্রুত হচ্ছে না এই নিয়ে সমালোচনাও করি।

শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিবর্তনটি নজর কাড়ে, কিন্তু বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষার প্রতিও গুরুত্ব দেয়া উচিত। তথ্য প্রযুক্তি, কর্মসংস্থান, ভবিষ্যত সম্ভাবনা এবং আন্তর্জাতিক সংযোগের কথা বিবেচনা করে ইংরেজি শিক্ষা অবহেলা করলে চলবে না।

ভাষার বিড়ম্বনা নিয়ে আমার সাম্প্রতিক ঢাকা ও কলকাতা সফরের দুটো ঘটনা উল্লেখ করতে চাই।

লন্ডন-ঢাকা ও লন্ডন-কলকাতা এই দুটো যাত্রাপথেই সাধারণত আমি বেছে নেই এমিরেটস এয়ারলাইন্স। খাবার নিয়ে আমার ব্যবসা, তাই খাবারের প্রতি আগ্রহের সীমা নেই। বন্ধু বান্ধবরা আমার পেটের সাইজ নিয়ে তামাশা করতে অপেক্ষা করনে না, আর আমার স্ত্রী তো প্রতিদিনই জ্বালাতন করেন। আমি আর এসব গ্রাহ্য করি না, এটাকে আমি 'অকুপেশন্যাল হ্যাজার্ড' হিসাবে বিবেচনা করি!

যা হোক, কয়েক বছর ধরে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে লন্ডন ঢাকা ও লন্ডন কলকাতা রুটে তাদের খাবার মেন্যু বা খাদ্য তালিকা দেখে আমি অবাক হই। ঢাকা রুটে মেন্যুটি হলো দুই ভাষায়, ইংরেজী ও আরবীতে কিন্তু কলকাতা রুটে সেই শুরু থেকে মেন্যুটি হলো তিন ভাষায়: বাংলা, ইংরেজি ও আরবীতে। কিন্তু কেন? এর কোন সদুত্তর পাইনা। আমরা বাংলাদেশের বাঙালিরা ভাষার জন্য প্রাণ দিলাম, ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলাম। কলকাতায় আমরা সবাই জানি হিন্দির আগ্রাসনে বাংলা ভাষা কোণঠাসা। তবু কলকাতা রুটে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের বাংলা প্রচলনে আমার আপত্তি নেই, আপত্তি হলো ঢাকা রুটে নেই কোনো?

এ নিয়ে আমি এমিরেটস এয়ারলাইন্সের অভ্যন্তরে বহুবার তাদের কর্মকর্তাদের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করেছি, লিখিত অভিযোগ করেছি, কিন্তু কোন গ্রহণযোগ্য উত্তর পাইনি। শুধু আশ্বাস পেয়েছি তারা বিষয়টি দেখবেন।

অনেকেই হয়তো বলবেন, এটা এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। আমি আরো জানতে পারলাম কলকাতা থেকে ঢাকা রুটে এমিরেটসের ফ্লাইট অনেক বেশী এবং যাত্রী সংখ্যাও অনেক। এবার আমি বাংলা ভাষার জন্য বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামের কথা এবং ইউনেস্কো কর্তৃক মহান ২১ শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে বিশ্বব্যাপী উদযাপনের কথাসহ, বিভিন্ন ওয়েবসাইটের লিংক দিয়ে আবার লিখলাম এমিরেটসের কাছে। শেষ পর্যন্ত তাদের মুখপাত্রের বক্তব্য পাওয়া গেল। পাঠকদের জন্য এমিরেটসের মুখপাত্রের দেয়া বক্তব্যটি হুবহু এখানে তুলে ধরলাম। তাদের উত্তরের মধ্যে কোন চালাকি আছে কিনা সেটা আপনারাই বিবেচনা করুন।

'Emirates always aims to provide passengers with menus in a language they speak. This was the reason a third language has been introduced on Indian routes in recent years and following positive feedback, the airline is now actively considering the introduction of Bengali on menus in the near future on flights to and from Dhaka.

দ্বিতীয় বিষয়টি নজরে পড়লো ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমে। ডিসেম্বরের শেষ দিকে, বিজয়ের ৪০ বছর পূর্তি উৎসবের আমেজ তখনো শেষ হয়নি। এয়ারপোর্ট থেকে বের হবার আগে প্রধান ফটকে আমাদের বিজয়ের গৌরব গাঁথা নিয়ে নানা পোষ্টার। এর মাঝে একটাতে অনেক জাতীয় বীরদের ছবিসহ লেখা আছে Welcome to the Kingdom of Heroes'। খটকা লাগলো, বাংলাদেশ কি তাহলে একটা কিংডম? তাহলে আমাদের রাজা বা রাণী কোথায়? শেখ হাসিনা কি তাহলে আমাদের মহারাণী? না কি রাষ্ট্রের কর্ণধার হিসাবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান আমাদের রাজা? কিংডম প্রতিষ্ঠা করার জন্য কি আমাদের জাতীয় বীররা আত্মবলিদান করেছিলেন? Welcome to the land of Heroes' বললে দোষ কোথায় ছিলো? এই পোষ্টার যারা তৈরি করেছেন তারা কি না বুঝে নিতান্ত ভাষার বিড়ম্বনায় পড়ে এ কাজ করেছেন? নাকি জেনে শুনে?

সৈয়দ বেলাল আহমেদ
:লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক। সম্পাদক, কারি লাইফ।