ফারাক্কা বাঁধ এবং আঞ্চলিক রাজনীতি

মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান
Published : 3 March 2017, 12:53 PM
Updated : 3 March 2017, 12:53 PM

গত বছরের ২৩ আগস্ট বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করে ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে ফেলার দাবি জানিয়েছিলেন। আবার তিনি এ বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি একই দাবি তুলেছেন। তাঁর অভিযোগ, ফারাক্কা বাঁধের উজানে পলি জমে নদীবক্ষ ভরাট হয়ে যাচ্ছে এবং এর ফলে বিহারে বন্যার প্রকোপ বেড়ে গেছে।

প্রতিবছর গড়ে ৩২৮ মিলিয়ন টন পলি ফারাক্কার উজানে নদিবক্ষে জমা হচ্ছে, যা কিনা গঙ্গাবাহিত মোট পলির ৪০ শতাংশের বেশি।

উল্লেখ্য যে, নদীবাহিত পলির স্তরায়নেই লাখ লাখ বছর ধরে বাংলাদেশের উপকূলীয় ব-দ্বীপসহ দেশের প্রায় ৮০ ভাগ প্লাবনভূমি গড়ে উঠেছে। যে পলি ফারাক্কার উজানে জমা হয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে ব্যাপক সমস্যার সৃষ্টি করছে তা দিয়েই বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ব-দ্বীপ এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠের উপরে উঠে আসতে পারত।

ফারাক্কার উজানে বন্যাপ্রবণতা বেড়ে যাওয়া ছাড়াও ফারাক্কা বাঁধের ফলে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ এবং মালদহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে নদী ভাঙনের ফলে ১৯৭৯-১৯৯৮ সময়ে তিন হাজার হেক্টর এলাকা নদীতে তলিয়ে গেছে। অনেক মানুষ বাস্তুভিটা হারিয়েছে। মালদহ জেলার ভুতনি থেকে মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি পর্যন্ত ১৭৪ কিমি গঙ্গা নদীর পারজুড়েই ভাঙন চলছে। ফারাক্কা বাঁধের ফলে গঙ্গা নদীর ভূ-গাঠনিক ধরনই পাল্টে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের মৎসজীবীরা ফারাক্কা ভেঙে ফেলার জন্য আন্দোলন করেছে। তারচেয়ে বড় কথা, যে কোলকাতা বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধির অজুহাতে ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে হুগলী-ভাগিরথীতে পানি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে সে সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। ফারাক্কা বাঁধের অকার্যকারিতা বিষয়ে ভারতের ভেতরে ও বাইরে বেশ কিছু গবেষণা ও প্রকাশনাও হয়েছে।

নীতীশ কুমারের প্রস্তাবের সূত্র ধরে ভারতের বেশকিছু পরিবেশবাদী সংগঠন এবং ব্যক্তি ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে ফেলার পক্ষে-বিপক্ষে বেশ জোরালো বক্তব্য প্রকাশ করেছে। অথচ বাংলাদেশের সরকার কিংবা বড় কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে তেমন কিছু বলা হয়নি। যদিও পরিবেশবাদী কিছু সংগঠন অনেক বছর ধরেই ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে ফেলার পক্ষে দাবি জানাচ্ছে।

ভারতের পরিবেশবাদীদের কেউ কেউ বাঁধ ভেঙে ফেলার পক্ষে হলেও সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছে এই বলে যে, এতে করে নদীবক্ষের জীববৈচিত্র্য এবং বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কেউ কেউ আবার প্রস্তাবিত জাতীয় নৌপরিবহন গ্রিডের ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছে।

এখানে উল্লেখ্য যে, জাতীয় নৌপরিবহন গ্রিডের আওতায় ১০৫টি নৌপথের প্রস্তাবনা রয়েছে যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া বন্দর থেকে এলাহাবাদ পর্যন্ত এক নম্বর নৌপথটিও রয়েছে, এর বাস্তবায়ন হুগলী-ভাগিরথীর নাব্যতার ওপর নির্ভরশীল। ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে ফেললে উজানে জমে থাকা পলি ব্যবস্থাপনা নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন।

পশ্চিমবঙ্গের পানি বিশারদ হিসেবে খ্যাত এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপদেষ্টা কল্যাণ রুদ্র ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে ফেলার প্রস্তাবকে 'জঘন্য ও অলীক' বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এই বাঁধ সরিয়ে নিলে পশ্চিমবঙ্গের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হবে। তাঁর মতে, কোলকাতাসহ হুগলী-ভাগিরথীর পারে অবস্থিত ৩৮টি পৌরসভা এবং তিনটি কর্পোরেশনের পানীয় জলের উৎস হচ্ছে ফারাক্কা থেকে সরিয়ে নেওয়া পানি। এ ছাড়াও নবদ্বীপ থেকে জঙ্গীপুর পর্যন্ত ২০০ কিমি নদী শুকিয়ে যাবে। তিনি আরও বলেছেন যে, হুগলী মোহনার ডলফিন ও ইলিশ মাছ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফারাক্কা বাঁধ সরিয়ে নিলে উজানে জমাকৃত পলির প্রবাহ ভাটিতে অবস্থিত বাংলাদেশের নদনদীর ব্যাপক ক্ষতি করবে বলে তিনি বাংলাদেশিদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, "একটু ভাবুন, ভাবার অভ্যেস করুন।"

আমার মতে, শেষোক্ত কথাটাতে এক ধরনের রূঢ় মনোভাব ফুটে উঠেছে। এ কথাটি থেকে মনে হতে পারে বাংলাদেশের জন্য কী করলে মঙ্গল হবে সেটা তাঁর চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না এবং বাংলাদেশের মানুষ ভাবতেও জানে না!

বিজ্ঞানভিত্তিক কোন আলোচনায় এই ধরনের দাম্ভিকতার কোনো স্থান নেই। ফারাক্কা বাঁধ এবং অন্যান্য অভিন্ন নদীর বিষয়ে বেশিরভাগ ভারতীয় রাজনীতিবিদ ও পরিবেশবাদীর কথা শুনলে মনে হবে যে, কোনো অভিন্ন নদীই ভারতের ভাটিতে প্রবাহিত হচ্ছে না অথবা ভারতই সব অভিন্ন নদীর একছত্র মালিক; সেখানে বাংলাদেশ নামক একটি দেশের অবস্থান আছে বলেও উল্লখ করা হয় না।

ফারাক্কা বাঁধটি নির্মাণ করা হয়েছে একটি অভিন্ন নদীর ওপর। তাই এর রক্ষণাবেক্ষণ অথবা ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্তও নিতে হবে গঙ্গা অববাহিকার সব স্বত্তাধিকারীকে সঙ্গে নিয়ে। এই সিদ্ধান্ত যেমন নীতীশ কুমার নিতে পারেন না, তেমনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা নরেন্দ্র মোদীও নিতে পারেন না।

অবশ্য সব ভারতীয় জনসাধারণ এবং বিজ্ঞানীরা একইভাবে চিন্তা করে না, সেটাই হচ্ছে আশার ব্যাপার। 'সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক ফর ড্যাম, রিভার অ্যান্ড পিপল' সংগঠনটির সমন্বয়ক হিমাংশু ঠাক্কার সাম্প্রতিক একটি বিশ্লেষণে লিখেছেন:

"ফারাক্কার ফলে উজানে গঙ্গার নিষ্কাশন ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে, নদীবক্ষ উপরে উঠে এসেছে এবং পানিবহন ক্ষমতা কমে গেছে।"

একই লেখায় তিনি ফারাক্কার কার্যকারিতা বিষয়ে একটি নিরপেক্ষ তদন্তেরও দাবি করেছেন, যেখানে অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতির পাশাপাশি উজানে ও ভাটিতে এর অভিঘাত নিরূপন করার দাবি জানানো হয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, যে পলি ফারাক্কার উজানে সমস্যার সৃষ্টি করছে সেই পলিই ভাটিতে ব-দ্বীপ গঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারত। যদিও তিনি সেই ব-দ্বীপ বাংলাদেশে অবস্থিত কি না– এটা খোলাসা করে বলেননি।

ভূবিজ্ঞানীরা ব-দ্বীপ গঠন প্রক্রিয়ায় নদীবাহিত পলি সরবারাহ চলমান রাখার ওপর সবসময়ই জোর দেন। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের ক্রমবর্ধমান উপরে উঠে আসার বিপরীতে ব-দ্বীপসহ উপকূলীয় নিম্নাঞ্চলকে টিকে থাকতে হলে জোয়ার-ভাটার ও বন্যার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া পলি স্তরায়নের পরিমাণ যদি সমুদ্রপৃষ্ঠের উপরে উঠে আসার পরিমাণের চেয়ে বেশি না হয় তাহলে ভবিষ্যতে ওইসব অঞ্চল তলিয়ে যাবে।

ফারাক্কা বাঁধের ফলে উজান থেকে বাংলাদেশ আসা গঙ্গাবাহিত পলির পরিমাণ গত শতকের ষাটের দশকের তুলনায় বার্ষিক পলির পরিমাণ বর্তমানে অর্ধেকে (দুই বিলিয়ন টন থেকে এক বিলিয়ন টন) নেমে এসেছে। এর ফলে একই সময়ে মেঘনা মোহনায় অবস্থিত উপকূলীয় চরাঞ্চলের গঠন প্রক্রিয়া ব্যহত হয়েছে। এই ধারা চলমান থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ভূমি গঠন এবং ভূমি পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া আরও ব্যহত হবে।

ফারাক্কা বাঁধসহ অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানি এবং পলি ব্যবস্থাপনায় কার্যকর কোনো চুক্তি না থাকায় দুদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। গঙ্গা চুক্তি থাকা সত্ত্বেও সবসময় বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা অনুযায়ী পানি না পাওয়ার অভিযোগও রয়েছে। গঙ্গানির্ভর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতি-পরিবেশ-প্রতিবেশ এরই মধ্যে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই এলাকার প্রায় চার কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা, কৃষি, বাণিজ্য, পানীয় জল, নৌপরিবহন, শিল্প-কারখানা ও সুন্দরবনের ভূমিগঠন প্রক্রিয়া গঙ্গার স্বাভাবিক পানি এবং পলি প্রবাহের ওপর নির্ভরশীল। তাই ফারাক্কার ভবিষ্যৎ গঙ্গা চুক্তি এবং অন্যান্য বিদ্যমান জাতিসংঘের পানিপ্রবাহ আইনের (১৯৯৭) নিরিখে অববাহিকার সব অংশীদারের অংশগ্রহণেই হতে হবে– এটাই সবার কাম্য।

উপরোক্ত প্রেক্ষাপটে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না ভবিষ্যতে ফারাক্কা বাঁধ থাকবে নাকি পরিবেশ-প্রতিবেশ ও অববাহিকা অঞ্চলের সব মানুষের স্বার্থে তা ভেঙে ফেলা হবে। নীতীশ কুমার কি শুধুই বিহারের স্বার্থ বিবেচনায় রেখে ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে ফেলার কথা বলেছেন, নাকি পুরো অববাহিকার ভবিষ্যৎ বিবেচনায় নিয়ে এ প্রস্তাব করেছেন– সেটা সময়ই বলে দেবে। তিনি এ ব্যাপারে তাঁর অবস্থান আরও দৃঢ় এবং খোলাসা করবেন, এটাই আমাদের আশা। অন্যদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি শুধুই পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ নিয়ে ভাববেন, নাকি তাঁরও বোধোদায় হবে এবং সঠিক কাজটি করবেন, সেটাও দেখার বিষয়।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরে ফারাক্কা বাঁধের ভবিষ্যৎসহ অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানি-পলি ব্যবস্থাপনা ন্যায়ভিত্তিক করার উদ্যোগ নেওয়া হবে এবং দুদেশের ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের পথে আরও একটি মাইল ফলক যুক্ত হবে– এটা বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা।

আশা করা যাচ্ছে, ভবিষ্যতে শুধু পানি চুক্তি নয়, অববাহিকার সব নদীর জন্য জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের পানিপ্রবাহ আইনের স্পৃহায় সব দেশের অণুস্বাক্ষরের মাধ্যমে 'গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদী কমিশন' গঠন করা হবে, যার মাধ্যমে সমন্বিত পানি-পলি ব্যবস্থাপনা এবং শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার পথ সুগম হবে।

আরও আশা করা যাচ্ছে, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার সব মানুষ তাদের ভৌগলিক সীমারেখার ঊর্ধ্বে উঠে পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় একসঙ্গে কাজ করতে এগিয়ে আসবে।