কখনও এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা ঠিক নয়, তা যত মহান ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হোন না কেন

Published : 22 Feb 2017, 04:28 AM
Updated : 22 Feb 2017, 04:28 AM

যুক্তরাজ্যের জনগণ ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে গণভোটের (Referendum) মাধ্যমে মত দিয়েছে। এ নিয়ে আদালতে মামলা হয় এবং গত সপ্তাহে সেখানকার সুপ্রিম কোর্ট একটি রায় ঘোষণা করেছে। এ পটভূমিতে সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক কথা বলেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে। আমাদের জ্যেষ্ঠ আইন-আদালত বিষয়ক প্রতিবেদক প্রকাশ বিশ্বাস তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় তুলে এনেছেন আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, জনগণের স্বার্থ ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গও–

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: ১৯৭৩ সালে যুক্তরাজ্য যোগ দিয়েছিল ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে (ইইউ)। ৪৩ বছর পর গত বছররের জুনে অনুষ্ঠিত গণভোটের মাধ্যমে ব্রিটিশ জনগণ ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে, যদিও পক্ষ-বিপক্ষের মধ্যে দূরত্বটা খুবই সামান্য। আইনি জটিলতাসহ এর কিছু আর্থসামাজিক এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব আছে। ব্রিটেনে তো বটেই, আর্ন্তজাতিক পরিসরেও প্রসঙ্গটি বহুল আলোচিত। এর মধ্যে বিষয়টি আদালতে গড়াল। হাইকোর্টের রায়ের পরে সুপ্রিম কোর্টে আপিল হল এবং কয়েক দিন আগে সুপ্রিম কোর্ট একটি রায় দিয়েছে। আপনার কাছ থেকে এর আইনগত দিকটা জানতে চাই আমরা।

১৯৭৩ সালে যখন যুক্তরাজ্য ইউরোপিয়ন ইউনিয়নে যোগ দেয় তখন আপনি একজন আইনের ছাত্র হিসাবে লন্ডনে অবস্থান করছিলেন। তাই শুরুতেই জানতে চাইছি আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা।

বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক: বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশক থেকেই যুক্তরাজ্যে ইউরোপিয়ান কমিউনিটিতে যোগদান করা নিয়ে সাধারণ জনগণ, রাজনীতিবিদদের মধ্যে চিন্তাভাবনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। আমি যখন সত্তর সালের শেষভাগে লন্ডন যাই তখন দেখতাম যে, অনেকেই বিশেষ করে, তখনকার নুতন প্রজন্মের ছাত্রদের মধ্যে সবাই বলাবলি করত যে, এটা ভালো হবে না মন্দ হবে; একটা দোলাচল ছিল। কিন্তু বেশিরভাগ লোকেই মনে করত যে, ইউরোপিয়ান কমিউনিটিতে যোগদান করা উচিত, একটা বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞের অংশ হওয়া উচিত, বিশেষ করে ডলারের প্রচণ্ড প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসবার একটা সুপ্ত ইচ্ছা যেন সবার মধ্যেই ছিল। তবে যতদূর মনে পড়ে, যুক্তরাজ্যের ইইউতে যোগদানের ব্যাপারে ফ্রান্স ও জার্মানির আপত্তি ছিল। যা হোক, বহু আলোচনা, চিন্তাভাবনার পর ১৯৭২ সালে The European Communities Act 1972 আইন পাস হল। এই আইনের আওতায় যুক্তরাজ্য ১৯৭৩ সালে ইউরোপিয়ান কমিউনিটিতে যোগদান করল।

সবাই খুব খুশি। সবাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন ভাষা শিখছে। তখন সবাইকে খুব খুশি দেখেছিলাম যে, তারা ইউরোপিয়ান কমিউনিটিতে যোগদান করছে। একধরনের Euphoria লক্ষ করেছি। তারা ইংরেজির বাইরে কেউ ফ্রেঞ্চ, কেউ জার্মানসহ অন্যান্য ইউরোপিয়ান ভাষা শিখছে। আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম যে, 'তোমাদের ভাষা এত সম্বৃদ্ধ তবে অন্য ভাষা কেন শিখছ?' ও বলল যে,'ইটস এ গ্রেট মার্কেট। ইটস এ বিগ মার্কেট। আমরা সেখানে যাচ্ছি। সেখানে তো আমাদের সবার সঙ্গে কম্পিটিশন করতে হবে।' সে কারণে ওরা আগে থেকেই রেডি হচ্ছিল, মনে হয়েছিল যে, সবাই খুব খুশি হয়েই ইউরোপিয়ান কমিউনিটিতে জয়েন করতে যাচ্ছিল।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: দীর্ঘসময় ধরে তাদের অভিজ্ঞতা ভালো ছিল না। ১৯৭৫ সালেও একবার গণভোট হয়েছে; সে যাত্রা টিকে যায়। কিন্তু এবার বেরোনের প্রক্রিয়া আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ২০১৫ সালে পার্লামেন্ট European Union Referendum Act 2015 পাস করে। ওই আইনের আওতায় গত বছর অনুষ্ঠিত গণভোটে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার পক্ষে জনগণ মত দেয়। যদিও ভোটের পার্থক্য খুব একটা বেশি নয়। এই গণভোটে প্রকাশিত জনমত বাস্তবায়নে যুক্তরাজ্যে ক্যাবিনেট সরাসরি পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করলে বিষয়টি আদালতে গড়ায়। হাইকোর্ট আবেদনটি গ্রহণ করে, যুক্তরাজ্য সরকারের সরাসরি পদক্ষেপ বাতিল করে। সর্বশেষ সর্বোচ্চ আদালত যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টেও সেটি রিজেক্ট হল। এক্ষেত্রে ব্রিটেনের কনস্টিটিউশন, সুপ্রিম কোর্ট, পার্লামেন্ট এবং গণরায়– এই ধারণাগুলোর যেভাবে চর্চা হচ্ছে তা থেকে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় কিছু আছে কি না?

বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক: অনেক কিছুই শেখার রয়েছে, আইনের ছাত্র, শিক্ষক, আইনজীবী, বিচারক সকলেরই শেখার আছে, বিশেষ করে আমাদের বিচারব্যবস্থার অনেকটাই যুক্তরাজ্যের বিচারব্যবস্থার আদলে তৈরি। কাজেই ওদের অভিজ্ঞতার আলোচনা দ্বারা আমাদের আইনি চিন্তার জগৎ সমৃদ্ধ করার সুযোগ আছে। যা-হোক রেফারেন্ডামের পরে আমি কিন্তু প্রথমেই ভেবেছিলাম যে, শুধু রেফারেন্ডাম করে যুক্তরাজ্য সরকার ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না। কারণ রেফারেন্ডামের রাজনৈতিক মূল্য থাকলেও সাধারণভাবে এর কোনো আইনগত মূল্য থাকে না। সেজন্য যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের আইন পাস করতে হবে, এমনকি সাধারণ রেজ্যুলেশন নিলেও হবে না। অনেককে বলেছিলামও। তাদের পার্লামেন্টে আইন পাসের মাধ্যমেই ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

এটা ঠিক যে, এই রেফারেন্ডামের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যে গত চল্লিশ বছরের রাজনৈতিক মনোভাবের পরিবর্তন প্রস্ফুটিত করে– সেটা আমরা দেখতে পাই। তবু এই রেফারেন্ডামের ফলাফল কিন্তু খুব কাছাকাছি; মাত্র ৪৮/৫২। খুব যে Overwhelming মেজরিটি আছে তা-ও নয়। আমার মনে হয় যে, সত্তর দশকের প্রারম্ভে তখনকার নুতন প্রজন্ম যারা ইউরোপিয়ান ইউনিয়েনে প্রবেশ করার জন্য উৎসাহী ছিল, চল্লিশ বছর পর মনে হয় সেই প্রজন্মই বৃদ্ধ হয়ে ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট দিয়েছে।

কিন্তু শুধুমাত্র এই রেফারেন্ডাম যুক্তরাজ্যকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসতে আইনগত ক্ষমতা বা এখতিয়ার দেবে না, বরং এদের আলাদা করে পার্লামেন্ট থেকে আইন পাস করতে হবে। আমি সে জন্যই রেফারেন্ডাম-পরবর্তী ঘটনার উপর নজর রাখছিলাম। দেখা গেল, সরকার ইইউ থেকে বেরুবার প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে যাওয়া মাত্রই আদালতে চ্যালেঞ্জ হয়ে গেল। বর্তমান চিফ জাস্টিস Lord Thomas এর নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট হাইকোর্টের ডিভিশনাল বেঞ্চ শুধুমাত্র রেফারেন্ডামের ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যের ক্যাবিনেট কর্তৃক ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসবার প্রক্রিয়াকে বেআইনি ঘোষণা করেছে।

আমার মতে হাইকোর্ট সঠিক সিদ্ধান্তই দিয়েছিল যদিও এই সিদ্ধান্তে যুক্তরাজ্যের অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়েছিল। অনেক সংবাদপত্র এই রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে তীব্র সমালোচনাও করেছিল। যা হোক, Crown এর পক্ষ থেকে যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে আপিল হল। দীর্ঘ শুনানির পর সুপ্রিম কোর্টের ২৪ জানুয়ারির রায়ে Crown এর আপিল ৮-৩ মেজরিটিতে ডিসমিস করে। হাইকোর্টের রায় বহাল থাকে।

রেফারেন্ডামের মাধ্যমে প্রকাশিত জনগণের অভিমতই যথেষ্ট নয়। শতাব্দী ধরে লালিত আইনগত অভিমত যে পার্লামেন্টের মাধ্যমে প্রণীত আইনই Supreme, অন্য কিছুই নয়।ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার প্রস্তাবসহ বিধি অনুসারে পার্লামেন্টের বিল উপস্থাপন হবে। সেই বিল আইনে রূপান্তরিত হলেই শুধু ক্যাবিনেট ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসবার জন্য পদ্ধতিগত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ৫০ ধারায় নোটিশ দিতে পারবে, তার আগে নয়।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: এই রায়ের প্রসঙ্গে আপনার কোনো বিশেষ পর্যবেক্ষণ আছে কি না?

বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক: এই রায়টা নানান দিক দিয়ে আমার ভলো লেগেছে। আমি তো ২৪ তারিখ রাত্রেই আমার ট্যাবলেটে রায়টি পড়ে ফেলেছি। এ রায়টি যুগ যুগ ধরে যুক্তরাজ্যের আইন বিভাগ আইনের শ্রেষ্ঠতা, আদালতের সীমা Separation of powers, Crown এর নির্বাহী বিভাগের কর্মপরিসর, কোনটি আইনের প্রশ্ন, কোনটি নয়, কোনটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার– এ সম্বন্ধে প্রাঞ্জল ভাষায় চমৎকারভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। প্রত্যেকটি আইনের ছাত্রেরই উচিত রায়টি পড়া।

আইনের এই সুপ্রাচীন ও well established ভাষ্যগুলোই বর্তমান সুপ্রিম কোর্টের প্রেসিডেন্ট Lord Neubergerএর নেতৃত্বে যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টের সম্মুখে আনীত আপিলে মূল প্রশ্ন ছিল। আমি যেটুকু বুঝেছি, তা হল ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে নির্গমন হওয়ার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করার পূর্বে যুক্তরাজ্যে কোনো আইনের প্রয়োজন আছে কি না। রায়ের তৃতীয় প্যারাগ্রাফে বলেছে যে, এই মামলায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্তের 'wisdom' এর সঠিকতা আদালতের সিদ্ধান্তের বিষয়বস্তু নয়, বা কী কী শর্তাবলী সাপেক্ষে, কতদিনের মধ্যে, কী পদ্ধতিতে অথবা ভবিষ্যতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সহিত যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক কেমন হবে– এই বিষয়গুলি সবই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয় এবং এসব বিষয় ক্যাবিনেট ও পার্লামেন্ট সিদ্ধান্ত নেবে। এসব বিষয় বিচারকদের বিচার্য নয়, তাঁরা শুধুমাত্র আইনের প্রশ্ন সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত দেবেন, অন্য কোনো বিষয়ে নয়।

আদালতের স্বাধীনতা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে এই রায়ে বলা হয় যে, বিচারকগণ পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত আইনবহির্ভূতভাবে কোনো আইন সৃজন করতে পারে না।

রেফারেন্ডাম সম্বন্ধে এই রায়ে বলা হয় যে, রেফারেন্ডামের সিদ্ধান্ত যা-ই হোক না কেন তার অশেষ রাজনৈতিক মূল্য থাকতে পারে, কিন্তু কোনো আইনগত মূল্য নেই। রেফারেন্ডামের পক্ষে যদি মন্ত্রীগণ বক্তব্য প্রদান করেন সেসব বক্তব্যের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা মূল্যও থাকতে পারে, কিন্তু সেসব বক্তব্য যুক্তরাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রদত্ত, পার্লামেন্টের পক্ষ থেকে নয়।

রায়ের উপসংহারে বলা হয় যে, ২০১৬ সালের রেফারেন্ডাম কোনো আইন পরিবর্তন করেনি এবং রেফারেন্ডামের ভিত্তিতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের থেকে যুক্তরাজ্য সরকার বেরিয়ে আসবার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবে না। তার জন্য প্রথা অনুসারে পার্লামেন্টে আইন পাস করতে হবে। ২ ফেব্রুয়ারির সংবাদে দেখা যায় যে, পার্লামেন্টে দুইদিন ডিবেট হওয়ার পর বিপুল ভোটে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার বিল পাস হয়েছে।

এই যে রাজনৈতিক বিষয়বলী বা পলিসি ডিসিশনস, এমনকি জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা সম্পর্কিত বক্তব্যের বিষয়ে আদালত কোনো সিদ্ধান্ত দেবে না বা দিয়ে থাকে না, বরং ওই ধরনের মতামত আমলেই নেবে না– এই নীতিই যুগ যুগ ধরে ইংল্যান্ড, আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট 'Separation of Powers' এর নীতি হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিপালন করে এসেছে, এখনও করে যাচ্ছে; এ রায়ই তার প্রমাণ।

সুপ্রিম কোর্টের আরও একটি চমৎকার দৃষ্টিভঙ্গি এ রায়ে ফুটে উঠেছে। সেটা হল, হাইকোর্টের রায় প্রকাশিত হওয়ার পর ব্রেক্সিট ও সে-সম্পর্কিত আদালতের রায় নিয়ে অনেক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল যেগুলো সুপ্রিম কোর্টের বিচারকগণ শুধু পড়েননি, বরং প্রশংসা করে বলেছেন, 'It is a tribute to those articles', যে তারা অনেক refined argument ওই সব প্রবন্ধ থেকে পেয়েছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: বেক্সিট মামলায় হাইকোর্টের রায় প্রকাশের পরে দরখাস্তকারী জিনা মিলার বলেছেন, "the Brexit judgment isn't a victory for me, but for our constitution"– এই মন্তব্য কতটুকু যথার্থ?

বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক: জিনা মিলার চমৎকার ও যথার্থ মন্তব্য করেছে। যুক্তরাজ্যে আনুষ্ঠানিক কোনো লিখিত সংবিধান না থাকলেও Convention এর মূল্য অপরিসীম। Magna carta (1215), Petition of rights (1354), Petition of Rights (1628), Bill of Rights (1689), Act of Settlement (1701)– এই মূল আইনগুলি, conventions এবং পার্লামেন্টের পাস করা আইনের মাধ্যমেই গ্রেট ব্রিটেনের বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালিত হত, যেখানে একসময় সূর্যাস্ত হত না। এখন সাম্রাজ্য না থাকলেও Queen in Parliament এর মাধ্যমে সেখানেই বিশ্বের সর্বোৎকৃষ্ট গণতন্ত্রের চর্চা হয়।

পার্লামেন্ট, নির্বাহী সরকার এবং বিচার বিভাগ নিজ নিজ এখতিয়ারের মধ্যেই Separation of Powers এর মূলনীতি মেনেই যার যার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে যাচ্ছে। এ কারণেই রেফারেন্ডামের মাধ্যমে জনগণ তাদের মতামত প্রকাশ করলেও Bill of Rights এর নীতি অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের প্রতিনিধি পার্লামেন্টেরই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, নির্বাহী সরকারের ক্যাবিনেটের নয়। বিচার বিভাগেরও নয়, যা বিচার বিভাগও নির্দ্বিধায় ঘোষণা করল। কোনো ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নেই। এখানেই সংবিধানের জয়জয়কার। ওই দেশের নাগরিক সচেতনতা এবং সংবিধানকে সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার জিনা মিলারকে এই মামলাটি দায়ের করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। তাই মামলায় জেতার পরে তিনি যথাযথ ভাষায়ই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: বেক্সিটের এই রায়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি আদালত একটা পর্যায় পর্যন্ত এসে সিদ্ধান্ত না দিয়ে বলছেন, এটা পার্লামেন্টের কাজ। এই জায়গায় আদালত ও পার্লামেন্টের পৃথক কার্যক্ষেত্রটি কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়?

বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক: Separation of Powers এর নীতি মেনে যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করেছে যে, আইনের ব্যাখ্যা প্রদান করা আইন বিভাগের দায়িত্ব, Policy decision নেবে Queen in Parliament, তা কার্যকর করবে ক্যাবিনেট। বিভাগ তথা সুপ্রিম কোর্ট কখনও কোনো Policy decision নেবে না, তথাকথিত Public perception এর উপর ভিত্তি করে কোনো রায়ের সিদ্ধান্ত দেবে না।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে Separation of Power, Rule of law বিষয়গুলোর স্বরূপ কী? ভারত বা আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রে এগুলো কীভাবে কাজ করে?

বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক: বাংলাদেশের সংবিধানও Separation of Powers ও Rule of law বা আইনের শাসনের বিধান রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের সঙ্গে মিল রেখে আমাদের সংবিধান প্রণীত হলেও আমাদের গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা যুক্তরাজ্যের Westminster ধরনের গণতন্ত্র। বাংলাদেশের জনগণ সার্বভৌম। সার্বভৌম জনগণের অভিব্যক্তি সংবিধান। জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবে সংবিধান বাংলাদেশ নামক প্রজাতন্ত্রের তিনটি প্রধান বিভাগসহ সব বিভাগ, সব পদ সৃষ্টি করেছে। জনগণ শুধুমাত্র বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মালিক নয়, সব বিভাগ, সব প্রতিষ্ঠানেরও মালিক এবং সবার বেতন-ভাতাদি মালিক জনগণের কাছ থেকেই আসে। সব বিভাগ, সব পদাধিকারীগণ জনগণের নিকটই দায়বদ্ধ, accountable।

বাংলাদেশের সংবিধান Separation of Powers এর কথা বললেও আমরা প্রায়ই গুবলেট করে ফেলি, এ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এ ব্যাপারে ব্রেক্সিট মামলায় যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টের ন্যায় আমাদের সুপ্রিম কোর্টেরও অগ্রণী ভূমিকা পালন করার প্রয়োজন রয়েছে। কোনটা Policy decision, কোনটা নির্ভেজাল আইনের প্রশ্ন– সেটা সবাইকেই বুঝতে হবে, সেভাবেই পদক্ষেপ নিতে হবে।

এবার Rule of Law এর প্রশ্ন। এই তিনটি শব্দ মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উইলিয়াম ই হার্ন তাঁর 'Government of England' গ্রন্থে সম্ভবত ১৮৬৮ সনে সর্বপ্রথম বলেন। এই ধারণা A.V. Dicey তাঁর 'Law of Constitution' (১৮৮৫) গ্রন্থে rule of law ব্যাখ্যা করেন। এই ধারণা বা concept ১৯ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে Academically শুরু হলেও পশ্চিমা পণ্ডিতদের মতে, এর শুরু ১২১৫ সালের Magna Carta থেকে। এর ইতিহাস ও তাত্ত্বিক আলোচনা করতে গেলে কয়েকটা বই লেখা যায়। এই তত্ত্বের উপর শত শত প্রবন্ধ ও গ্রন্থ লেখা হয়েছে।

খুব সংক্ষেপে বলা যায় যে, Rule of law অর্থ Supremacy of law বা Governance by law, অর্থাৎ আইনই শাসক বা আইনের শাসন। মধ্যযুগ পর্যন্ত সমগ্র বিশ্বে তখন রাজা-বাদশাহদের কথাই ছিল আইন। আরেকভাবে বলা যায়, King's words were law বা King is law. এ জন্যই বলা হত King is the fountain of justice. সে কারণেই Thomas Paine তাঁর 'Common sense' গ্রন্থে ১৭৭৬ সালে বলেন যে, আমেরিকায় Law is the king। কারণ আমেরিকায় তখন কোনো রাজা ছিল না। কাজেই রাজার পরিবর্তে আইনই প্রজাতন্ত্রের শাসক। আরও পিছনে গেলে ১৩ শতকে বিচারপতি Henry de Bracton বলেছিলেন যে, 'রাজা কোনোভাবেই প্রজার অধীন নন, তবে তিনি অবশ্যই আইন এবং স্রষ্টার অধীন।'

কারণ Common Law অনুসারেই রাজার শাসন আইনানুগ হয়। এই কারণেই লে জে অলিভার ক্রমওয়েল ১৬৪৭ সালে পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করে রাজাকে হত্যা করা সত্ত্বেও তাঁর শাসনামল কোনো আইনগত ভিত্তি পায় না। সত্য কথা বলতে কি, আইনের শাসনের প্রারম্ভ ৭ম শতকে প্রথমত মদিনা শরিফে, ইসলামের প্রথম যুগে যখন সবাইকে একই আইনের আওতায় আনা হয়, একই ধরনের অন্যায়ের জন্য সবার একই শাস্তি, যে কারণে ২য় খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রা.) এর নিজ পুত্রকে পর্যন্ত আইন ভঙ্গের কারণে শাস্তি পেয়ে দোররার আঘাতে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল।

অল্প কথায় বলা যায় যে, আইনের শাসন অর্থ যে দেশে সব মানুষ একই আইন দ্বারা বাধ্য। এমনকী যারা আইনপ্রণেতা তারাও তাদের প্রণীত আইন দ্বারা বাধ্য, একইভাবে নিবার্হী বিভাগের যারা আইন প্রয়োগ করেন, এমনকী যারা বিচার করেন সেই বিচারকগণও একই আইন দ্বারা একইভাবে বাধ্য। তখন বলা যায় যে, সে দেশে আইনের শাসন রয়েছে। তবে এই নীতিটি হচ্ছে Rule of law, অর্থাৎ রাজার শাসনের পরিবর্তে আইনের শাসন কিন্তু প্রায়শই অনেকে Rule of law কে Rule by law মনে করেন, যা সঠিক নয়। যেমন অষ্টম হেনরি নিজের পছন্দমতো আইন তদানীন্তন পার্লামেন্টকে দিয়ে পাস করিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো প্রস্তুত আইন দিয়ে দেশ শাসন করতেন। এ ধরনের আইন দ্বারা শাসনকে যেমন আইনের শাসন বলা যায় না, তেমনি সামরিক ফরমান দ্বারা তৈরি আইনের মাধ্যমে প্রশাসন পরিচালনাকে আইনের শাসন বলা যায় না।

ডাইসির তত্ত্ব অনুসারে আইনের শাসনের তিনটি সুষ্পষ্ট অর্থ রয়েছে। প্রথমত, আইনের শ্রেষ্ঠত্ব; দ্বিতীয়ত, আইনের চোখে সবার সাম্যতা এবং তৃতীয়ত, আদালত কর্তৃক স্বীকৃত জনগণের সাধারণ অধিকার। এই তত্ত্বের পক্ষে-বিপক্ষে অনেক বক্তব্য আসলেও আইনের শাসনের মূল বক্তব্য ঘুরে ফিরে উপরোক্ত তিন নীতির মধ্যেই থেকেছে।

জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে পার্লামেন্ট আইন প্রণয়ন করবে, কিন্তু সেই আইন arbitrary হল কি না, despotic হল কি না, তা দেখার দায়িত্ব কিন্তু বিচারকগণের উপর ন্যস্ত, যারা জনপ্রতিনিধি নন। এই কারণে আমরা Dr. Bonham (১৬১০) এর মামলায় দেখতে পাই যে, প্রধান বিচারপতি Sir Edward Coke বলেছেন যে, Rule against bias দ্বারা কলুষিত কোনো আইনের বৈধতা থাকতে পারে না। অবশ্য তখনও Bill of Rights (১৬৮৯) আসেনি, যা King in Parliament কে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা প্রদান করে।

তবু Leslie Stephen ১৮৮২ সালে তাঁর 'The Science of Ethics' গ্রন্থে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের omnipotence বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে, পার্লামেন্ট ইচ্ছা করলে নীল চক্ষুবিশিষ্ট সব শিশুকে হত্যা করতে হবে বলে আইন পাস করতে পারে। কিন্তু সে ধরনের আইন পাস করার জন্য পার্লামেন্ট সদস্যগণের মস্তিস্কের সুস্থতা সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে এবং জনগণ যদি এ ধরনের আইন পালন করে তাহলে তাদেরও গবেট বলতে হবে, অর্থাৎ আইনকে অবশ্যই 'fair' বা ন্যায্য হতে হবে।

এ জন্যই প্রয়োজন checks and balance। কখনও এক ব্যক্তি বা এক প্রতিষ্ঠানের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা ঠিক নয়, তা যত মহান ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হোক না কেন।
সাধারণভাবে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত পার্লামেন্ট এবং সরকার দেশ পরিচালনা করবে, কিন্তু elected despotism, যেমন: ১৯৩৩ সালে হিটলার বিপুল ভোটে জয়যুক্ত হয়ে শুধু জার্মানি নয়, সারা বিশ্ব ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছিল। কারণ, সেখানে সাধারণ জনমতের বিরুদ্ধে 3rd Estate ও বিচার বিভাগ আইনের শাসন সমুন্নত করতে যুগপৎ ব্যর্থ হয়েছিল। Jus Civile এর আদি বাসভূমি জার্মানে আইনের শাসন ব্যর্থ হল। মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।

এখানেই আইনের শাসনকে অর্থবহ করে মহিমান্বিত করার দায় ও দায়িত্ব বিচার বিভাগের উপর ন্যস্ত। কীভাবে আইন বিভাগ এই মহান দায়িত্ব পালন করবে? বিচারক একজন নিঃস্ব ব্যক্তির অধিকার ও একজন কোটিপতির অধিকার একই আইনের আওতায় সমভাবে দেখবেন, তাঁর সম্মুখে অশিক্ষিত ও নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে সমভাবে বিচার করবেন, একজন নাস্তিক ও একজন High Priest কে একই আইনের তুলাদণ্ডে বিবেচনা করবেন, একজন সম্পূর্ণ ক্ষমতাহীন সাধারণ ব্যক্তির বিপরীতে রাষ্ট্রের পরাক্রমশীল ক্ষমতাবান ব্যক্তির বিচার একই আইনের ধারায় সমভাবে বিচার করতে হবে। তাহলেই বলা যাবে যে, এই বিচারব্যবস্থায় আইনের শাসন বা Rule of Law বিদ্যমান।

এখানেই আসে Doctrine of Judicial deference এর প্রশ্ন। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলতে হয় প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন বিভাগ সম্বন্ধে অ্যারিস্টোটলের ভাষ্য। এরই ধারাবাহিকতায় Baron Montesquieu তাঁর 'Del Esprit des Lois' (১৭৪৮) গ্রন্থে একটি সরকারের বিভিন্ন বিভাগ Separation of Powers and functions সম্বন্ধে আলোকপাত করেন। এই নীতি সর্বপ্রথম যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে পরোক্ষভাবে গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে প্রায় সকল রাষ্ট্রেই এই নীতি গ্রহণ করা হয়। এই নীতির একটা সবচেয়ে বড় সুবিধা রাষ্ট্রের প্রধান বিভাগগুলির মধ্যে একটা check and balance থাকে, ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ যেটা নির্বাহী বিভাগেই হোক বা পার্লামেন্টেই হোক বা আইন বিভাগের হোক তা অন্তত সহনীয় পর্যায়ে থাকে।

অনেকেই বলেন যে, আইনের হাত লম্বা। আইনের হাত লম্বা সন্দেহ নেই, কিন্তু বিচারকগণের হাত মোটেই লম্বা নয়, কারণ অন্যরা মেনে চলুক বা না চলুক অন্তত বিচারকগণকে আবশ্যিক ও সুনিশ্চিতভাবে সংবিধান ও সকল আইন মান্য করে চলতে হবে। এমনকি তারা ট্র্যাফিক আইনও ভঙ্গ করতে পারবেন না, ভঙ্গ করলে তিনিও শাস্তির আওতায় আসবেন। যুক্তরাজ্যের Court of Appeal এর একজন জ্যেষ্ঠ বিচারককে ট্র্যাফিক আইন ভঙ্গ করার কারণে ব্যক্তিগতভাবে থানায় গিয়ে ফাইন জমা দিতে হয়েছিল, তিনি বিন্দুমাত্র আপত্তি করেননি। কারণ তিনি Rule of Law বিশ্বাস করতেন। এটাই আমাদের সকলের শিক্ষণীয়।

বিচারকগণের দায়িত্ব দেশের সংবিধান ও আইন অনুসারে বিচার করা। এই গণ্ডির মধ্যে তিনি সম্পূর্ণভাবে আবদ্ধ। সংশ্লিষ্ট আইন তাঁর পছন্দ নাও হতে পারে। কোনো আইন বা এর কোনো বিধান সম্বন্ধে তিনি একমত নাও হতে পারেন, কিন্তু বিচারকালে তাঁর নিজের মতের বাইরে গিয়ে হলেও ওই আইন অনুসারেই তাঁকে বিচার করতে হবে। নিজস্ব কোনো মতবাদ বা নিজের কোনো agenda অনুসারে কোনো বিচারক বিচার করলে তিনি তাঁর শপথ ভঙ্গ করবেন, কারণ সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করবেন বলেই তিনি শপথ নিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত জুরিস্ট Sir Carleton Kemp Allen বলেন যে, বিচারকদের অনেক সময়ই এমন সব ধরনের আইন প্রয়োগ করতে হয় যা তাঁরা নিজেরাও ব্যক্তিগতভাবে অনুমোদন করেন না। যেমন একজন বিচারক তালাক প্রদানকে ক্যাথলিক ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে অন্যায় মনে করলেও বৈবাহিক আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাঁকে তা প্রয়োগ করতেই হয়। আবার কিছু সংখ্যক বিচারক আছেন যাঁরা মৃত্যুদণ্ড প্রদানের বিপক্ষে, কিন্তু আইন যদি মৃত্যুদণ্ডের বিধান দেয় তবে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড প্রদানই করতে হবে, যদি কোনো বিচারক সেক্ষেত্রে মৃত্যুদন্ড প্রয়োগ না করেন তাহলে তিনি আইন ভঙ্গকারী সাব্যস্ত হবেন।

Sir Carleton Kemp Allen আরও বলেন যে, অনেক আইন আছে যা বিচারকদের নিকট অন্যায্য বলে মনে হলেও তারা সেই আইনগুলো প্রয়োগ করেন। কারণ অন্যথায় সমাজে বিশৃঙ্খলা আসতে পারে।

বিচারকের সামনে যা উপস্থাপিত হয়েছে, তার ভিত্তিতেই তিনি বিচার করবেন। তিনি নিজে যদি কোনো বিষয় দেখেও থাকেন, তাহলে তিনি সাক্ষী হতে পারেন, কিন্তু বিচার করতে পারেন না।

যদি নির্বাহী বিভাগ অবৈধ আদেশ দেয়, আদালত তা সংশোধন করতে পারে। জাতীয় সংসদ যদি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আইন প্রণয়ন করে, তাও সুপ্রিম কোর্ট বেআইনি ঘোষণা করতে পারে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের বিচারকগণ যদি সংবিধানবিরোধী রায় দেন তখন আমরা কোথায় যাব? এই প্রশ্ন আমাকে প্রচণ্ডভাবে পীড়িত করে। কারণ আদালত তথা সুপ্রিম কোর্ট আমাদের শেষ ভরসাস্থল।

গত শতাব্দীর সাত দশকের শেষভাগে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট বেশ কয়েকটি রায়ে সামরিক ঘোষণা (Proclamation) ও সামরিক আইনকে Supraconstitution এর মর্যাদা দিয়েছিল। বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ফসল আমাদের পবিত্র সংবিধানকে সামরিক ঘোষণা বা আদেশের 'Subservient' ও 'Subordinate' বলেছিলেন। নিশ্চিতভাবে ওই সকল রায় সংবিধানকে, Rule of Law ভূলুণ্ঠিত করেছিল যা ছিল দেশদ্রোহিতা। কিন্তু কারও কিছুই করার ছিল না। বাধ্য হয়ে সকলকেই মেনে নিতে হয়েছিল। কপাল ভালো যে অনেক দেরিতে হলেও ৩০ বৎসর পর সুপ্রিম কোর্টের সেই রায়গুলি over ruled হয়েছিল, নাও হতে পারত। তাহলে জনগণ এই ধরনের Judicial despotism থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পেতে পারে। এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এখন over due।

১৮৫৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট Dred Scot মামলায় ঘোষণা করল যে, নিগ্রোরা নাগরিক নয় এবং তাদের কোনো নাগরিক অধিকারও নাই। আব্রাহাম লিংকন ১৮৬৩ সালের ১ জানুয়ারি Proclamation of Emancipation ঘোষণা করেন। ওই রায়কে supersede করে 'Civil Rights Act, 1866' পাস করা হয়। তাছাড়া সংবিধানের ১৪তম সংশোধনী (১৮৬৮) সকল নিগ্রো তথা আফরিকান-আমেরিকানদের পরিপূর্ণ নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। Dred Scot মামলায় প্রদত্ত সুপ্রিম কোর্টের রায় সম্পূর্ণভাবে অকার্যকর হয়ে যায়।

ভাগ্য ভালো যে তখনও Keshabananda Bharati মামলার রায় হয় নাই, নইলে ১৮৬৬ সালের আইন বা সংবিধানের ১৪তম সংশোধনী আমেরিকান সংবিধানের basic Structure বিরোধী বলে সুপ্রিম কোর্ট নাকচ করে দিত।

আমাদের সকলকে মনে রাখতে হবে যা Lord Goldsmith বলেছিলেন, সরকারের কাজ দেশ পরিচালনা করা, আদালত দৃষ্টি রাখবে যে সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ বা কার্যক্রম যেন আইন ভঙ্গ না করে। কিন্তু দেশ পরিচালনা ভালো হচ্ছে কী মন্দ হচ্ছে বা কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বা কী আইন পাস করা প্রয়োজন তা দেখা আদালতের কাজ নয়, সে কাজ পার্লামেন্টের, জনগণের প্রতিনিধিদের।

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতার সঙ্গে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ক্ষমতার সঙ্গে পার্থক্য রয়েছে। ভারতের সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট Original Jurisdiction, অর্থাৎ ভারতের সুপ্রিম কোর্টে সরাসরি কোনো মামলা দায়ের করা যায় কিন্তু আমাদের আপিল বিভাগে ওই আদালতের অবমাননা ব্যতিরেকে অন্য কোনো মামলা সরাসরি দায়ের করা যায় না।

আমাদের সংবিধানের ১০৩, ১০৪ ও ১০৫ অনুচ্ছেদ যথাক্রমে আপিল, ন্যায়বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় আদেশ-নির্দেশ ও এর রায়ের রিভিউ-সংক্রান্ত আদেশ প্রদান করতে পারে, কিন্তু original jurisdiction ব্যতিরেকে আপিল বিভাগে continuous mandamus এর ক্ষমতা কীভাবে থাকতে পারে তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। কারণ আপিল বিভাগের mandamus issue করার কোনো ক্ষমতাই নাই। সেই ক্ষমতা রয়েছে ১০২ অনুচ্ছেদের আওতায় শুধুমাত্র হাইকোর্ট বিভাগের। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হয়। সাধারণভাবে এর আপিল শুনানি করার ক্ষমতা শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টেটের মধ্যে উত্থাপিত কোনো বিরোধ বা বৈদেশিক রাষ্ট্রের দূত ইত্যাদি উত্থাপিত বিরোধ সম্পর্কে original jurisdiction থাকবে। এ কারণেই হয়তো Brown V Board of Education এর দ্বিতীয় রায়ের কার্যকরণ করার জন্য সুপ্রিম কোর্ট নিচের কোর্টে পাঠিয়ে দিয়েছিল।

এখানেই Brexit মামলায় যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টের কৃতিত্ব যে তারা গণভোটের রায় সত্ত্বেও Public perception সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সম্পূর্ণ নির্মোহভাবে শুধুমাত্র আইন অনুসারে রায় দিয়েছে। এ রায় Rule of Law এর বিজয়। কিন্তু আমরা কোন পথে যাচ্ছি, আত্মজিজ্ঞাসা ভীষণভাবে প্রয়োজন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এ-সংক্রান্ত বিল উঠলে লেবার পার্টির নেতার নির্দেশ না মেনে ছায়ামন্ত্রী সভার শিক্ষমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করেছেন টিউলিপ সিদ্দিক। উনার নির্বাচনী এলাকার ৭৫% ভোটার এর বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। তাঁর যুক্তি হল: "I have always been clear- I do not represent West minister is Hampstead and Kilburn, I represent Hampstead and Kilburn in Westminster." তিনি পার্লামেন্ট নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোটারদের মতের পক্ষে ভোট দিতে যাচ্ছেন। আপনার মন্তব্য কী?

বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক: আমার মনে হয় তিনি ঠিক কাজটিই করেছেন। কারণ তাঁর নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের প্রতি তাঁর কমিটমেন্ট রয়েছে। এটা ছিল তাঁর একরকম প্রোটেস্ট। তবে তিনি তাঁর সদস্যপদ থেকে কিন্তু পদত্যাগ করেননি, তা঳র সমর্থকদের প্রতি এটাও একটা কমিটমেন্ট যে তাঁকে হাউজে থেকে তাঁর এলাকার ভোটারদের প্রতিনিধিত্ব করতে হবে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: প্রসঙ্গত আমাদের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কথা এসে যায়। ওখানে বলা হচ্ছে: 'সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন' তাহলে ওই সংসদ সদস্যের পদটি শূন্য হবে। তবে কি আমাদের জনপ্রতিনিধিরা দলীয় শৃঙ্খলার নিগঢ়ে বাঁধা পড়ে আছেন? ভোটারদের মতামত কি মূল্যহীন হয়ে পড়ল?

বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক: না। আমি এটা মনে করি না। কারণগুলো সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ দ্বারা স্পষ্ট করা দরকার। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে বেশিরভাগ বিজ্ঞজনেরই একটা Confusion রয়েছে। এর প্রয়োজনীয়তা বা কার্যকারিতা সম্বন্ধেও জানা দরকার। প্রেক্ষাপটও বোঝা প্রয়োজন।

অনেকেই মনে করেন যে, ৭০ অনুচ্ছেদ সরকারি পক্ষের দলের স্বার্থেই সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়েছিল। কথাটি সঠিক নয়। বরঞ্চ গণতন্ত্রের স্বার্থে, palace clique থেকে পার্লামেন্টকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই এই অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করার প্রয়োজন হয়েছিল।

যারা আমার বয়সী বা আমার থেকে বয়জ্যেষ্ঠ তাদের ১৯৫৪-৫৫ সালের তদানীন্তন পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক পরিষদের কথা মনে থাকতে পারে। সেসময় কোনো একদলের প্রাদেশিক পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না বিধায় এক বা একাধিক দলের সমন্বয়ে প্রাদেশিক পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে সরকার গঠন করা হত, যাকে কোয়ালিশন গর্ভমেন্ট বলা হয়। কিন্তু প্রায়ই Floor Crossing এর মাধ্যমে এক দলের সাংসদ অন্য দলে যোগদান করত, সরকারি দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নষ্ট হত এবং সরকারের পতন হত, অন্য দলগুলির সদস্য সমন্বয়ে আবার নুতন সরকার গঠন করা হত।

আবার Floor Crossing হত তদানীন্তন সরকারি দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাত, সরকারের পতন ঘটত। এভাবে তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ সরকারের বাস্তব কোনো স্থায়িত্ব ছিল না। ফলে সুশাসন পরিচালনা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চরমভাবে ব্যহত হত। সরকার পর্যায়ে এরকম অনিশ্চিত অবস্থা চলেছিল দিনের পর দিন। এই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পরিপূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার। পূর্ববঙ্গের সর্বক্ষেত্রে নিগৃহীত হওয়ার এ-ও একটা কারণ ছিল।

মহান মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭২ সালে সংবিধান রচনাকালে বর্ষীয়ান সংবিধান প্রণেতাগণের মনে পঞ্চাশ শতকের এরূপ সংবিধানিক সংকটের কথা মনে ছিল বিধায় তাঁরা সংবিধান প্রণয়নের সময় তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে ভবিষ্যতে শিশু বাংলাদেশে ওই ধরনের জটিলতা ও সংকট এড়াবার লক্ষ্যে সংবিধানে অত্যন্ত সচেতনভাবে ৭০ অনুচ্ছেদটি সংযুক্ত করেন। মূল ৭০ অনুচ্ছেদের সংশ্লিষ্ট অংশে বলা হয়েছিল যে, 'যদি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হয়ে নির্বাচিত হন কিন্তু তিনি যদি উক্ত দল থেকে পদত্যাগ করেন বা সংসদে উক্ত দলের বিরুদ্ধে ভোটদান করেন, তবে সংসদে তার আসন শূন্য হবে।'

এখানে বেশির ভাগ মানুষেরই ধারণা যে, সংসদে কোনো বিল উস্থাপন করা হলে দল নির্বিশেষে সংসদে উপস্থিত সদস্যগণ ওই বিলের উপর আলোচনা করেন, ভালো-মন্দ সম্বন্ধে মতামত প্রকাশ করেন, অতঃপর বিলটি গ্রহণ করা হবে কি না, আইনে পরিণত হবে কি না, তার উপর ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়। এটাই সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি। এই ভোটাভুটির বিষয়বস্তু হচ্ছে একটি বিল, দল নয়। হতে পারে সরকার দলের পক্ষ হতে বিলটি উস্থাপন করা হয়েছে, সংসদের বিরোধী দলের পক্ষ থেকে এমনকী প্রাইভেট মেম্বারদের পক্ষ থেকেও বিলটি আনা হতে পারে, কিন্তু বিষয়টি কোনো দল নয়, কোনো বিশেষ সাংসদও নয়, বিবেচনার বিষয়টি হচ্ছে একটি বিল। কাজেই ভোটাভুটি হয় বিলের উপর, কোন দলের উপর নয়। সেহেতু কোনো দলের উপর ডিবেট বা ভোটাভুটিতে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কোনো প্রভাব নেই।

সরকার পক্ষ থেকে আনীত বিল যদি পাস নাও হয়, বিলের বিপক্ষে যদি ভোট বেশি হয় তবু সরকারি দলের সরকার পরিচালনা জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতার কোনো তারতম্য হবে না। যদি সরকারি দলের বিরুদ্ধে no confidence motion আনা হয় কেবল সে ক্ষেত্রেই ৭০ অনুচ্ছেদের কার্যকারিতা প্রাসঙ্গিক হবে, অন্য কোনো ক্ষেত্রে নয়। সাংসদগণ যে কোনো বিলের উপর বক্তব্য রাখতে পারবেন, বিলের বিরুদ্ধে ভোটও দিতে পারবেন, তাতে ৭০ অনুচ্ছেদের আওতায় তাদের সদস্যপদ শূন্য হবে না।

এটা মনে রাখতে হবে যে, ৭০ অনুচ্ছেদের দুবার সংশোধন করা হয়, প্রথমবার ১৯৭৫ সালে, দ্বিতীয় বার ১৯৯১ সালে। অতঃপর সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে মূল ৭০ অনুচ্ছেদটি ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: একেবারে ভিন্ন প্রসঙ্গ। হাইকোর্টের রায়ের পর ৪ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে 'দি ডেইলি মেইল' পত্রিকায় হেড লাইন দেয়: Enemies of the people: Fury over 'out of touch' judges who have 'declared war on democracy' by defying 17.4m Brexit voters and who could trigger constitutional crisis. রায় দানকারী তিন বিচারকের ছবিও ছাপা হয়েছে, নানাভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা খুঁজে বের করার প্রয়াশ নেওয়া হয়েছে। এনিয়ে রীতিমতো আলোচনার ঝড় উঠেছিল। আদালত অবমাননার সব রকম উপাদান থাকার পরও তখন কিন্তু বিচার বিভাগ ছিল একেবারেই নীরব। আপনার মত কী?

বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক: যুক্তরাজ্যের বিচার বিভাগের জন্য এটাই স্বাভাবিক। শুধু যুক্তরাজ্য কেন উন্নত বিশ্বের কোনো আদালতই তাদের রায়ের সমালোচনা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামায় না, আদালত অবমাননার কথা তো তারা চিন্তাই করবে না। এ প্রশ্ন উস্থাপন করলে বিচারকগণ বরঞ্চ অবাক হবেন। একবার কোনো এক পত্রিকা লিখেছিল যে Lord Denning is an ass. উনি শুনে মুচকি হেসেছিলেন মাত্র। ফলবান বৃক্ষের reaction এমনই হয়।

উন্নত বিশ্বের শুধু বিচারকগণ কেন প্রায় সবাই freedom of expression এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। কোনো রায় সম্বন্ধে সংবাদপত্র বা অন্যদের সমালোচনায় তাঁরা বিন্দুমাত্র প্রভাবিত হন না। তাঁরা নিজেদের কাজটি সংবিধান ও আইন অনুসারেই করে থাকেন, কে কোথায় কোন কথা বলল, তা নিয়ে তাদের মোটেও মাথাব্যাথা নেই। যদি কেউ কোনো অশ্লীল বা অপরাধমূলক কথাও বলে তাতে বক্তা সম্বন্ধেই মানুষ খারাপ ধারণা করে, তারই মানসিক দেউলিয়াত্বের প্রমাণ বহন করে, বিচারকদের সম্বন্ধে করে না।

আমাদের দেশে জেলা পর্যায়ের আদালতের জন্য ১৯২৬ সালের একটি আদালত অবমাননার আইন রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট এর অবমাননার জন্য সংবিধানে ১০৮ অনুচ্ছেদ রয়েছে কিন্তু এতদিনেও ঐ অনুচ্ছেদের আওতায় কোন আইন সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে করা হয় নাই।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: তাহলে আমাদের দেশে এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নটি আসে। সংবিধানে যেভাবে বিচার বিভাগের দায়-দায়িত্ব নির্ধারিত আছে সেভাবে কি বাস্তবে প্রয়োগ হচ্ছে?

বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক: এ ক্ষেত্রে সংবিধানের ৯৪ অনুচ্ছেদের ৪ দফা এবং ১১৬ অনুচ্ছেদ প্রাসঙ্গিক। ৯৪ অনুচ্ছেদের ৪ দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন। একই ভাবে সংবিধানের ১১৬ ক অনুচ্ছেদ এর আওতায় বিচার কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এবং ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন।

এই সাংবিধানিক নিশ্চয়তা বাংলাদেশের বিচার বিভাগের জন্য একটি আশীর্বাদ। এই নিশ্চয়তা অর্জন করতে যুক্তরাজ্যের বিচারকগণকে শত শত বৎসর সংগ্রাম করতে হয়েছিল। ১৭০১ সালের Act of Settlement ও তারপরে ১৭৬১ সালের আইন বিচারকগণকে তাদের বিচারিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা প্রদান করে।

আজকাল বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে প্রায়ই আলাপ হয় যা প্রায় প্রলাপের পর্যায়ে চলে যায়। এই প্রসঙ্গে স্বাধীনতা বলতে কী বোঝায় প্রথমে তা উপলব্ধি করতে হবে।

পরিপূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা বা ভোগ করতে পারা আধুনিক যুগে কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। সেই ১০ হাজার পূর্বে আদিম সমাজে বসবাসকালে হয়তো মানুষ পরিপূর্ণ স্বাধীন ছিল। তখন মানুষ যা ইচ্ছা তাই করতে পারত। কিন্তু সভ্যতার উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে একটি সভ্যসমাজকে গড়ে তুলতে আবশ্যিকভাবেই তাদের নিজেদের বিভিন্ন বিধানের আওতায় আসতে হয়। যুগে যুগে বিভিন্ন ধর্মের উন্মেষ মানুষকে পারষ্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ-লোভ-লালসা, দুর্বলের উপর অত্যাচার প্রভৃতি থেকে মুক্ত করবার জন্য সভ্য করার শৃঙ্খলমুক্ত করার প্রয়াশ পায়। এরই ধারাবাহিকতায় মানুষ জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে প্রয়াশ পায়। কিন্তু স্পার্টাকাসের আর্তনাদ এখনও শোনা যায়। প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার ইতিহাস মানুষের ইতিহাস, সভ্যতার ইতিহাস।

এই আধুনিক যুগেও মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন নয়। সভ্যতার স্বার্থে যে কোনো মানুষকেও বিভিন্ন ধরনের নিগঢ়, বাধ্যবাধকতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। Natural law, moral law রাষ্ট্রের আইন তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে, অবশ্যই সভ্যতার স্বার্থে, একটি ordered society এর স্বার্থে।

একটি খুব সাধারণ উদাহরণ হচ্ছে ট্রাফিক আইন। লাল বাতি জ্বললে বা ট্রাফিক অর্ডার বা পুলিশ হাত দেখালে আপনি যত বড় ব্যক্তিই হন না কেন আপনাকে থামতে হবে, নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে। মানব সমাজ ও সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সাক্ষীনীতির ইতিহাসও বিকশিত হয়েছে। এগুলো পরীক্ষার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে জড়িয়ে আছে। রাস্তায় চলাচলের শৃঙ্খলার স্বার্থে এই সাধারণ আইন আপনাকে মানতে হবে, অন্যথায় দুর্ঘটনা, মানুষের জীবন সংশয়, চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়, এমনকী জনজীবন ব্যহত হয়, যা আমরা ঢাকায় প্রায়ই দেখে থাকি। ট্রাফিক আইনের ঊর্ধ্বে উঠে যারা যাতায়াত করেন, তখন সাধারণ জনগণের নাকাল অবস্থাও আমরা প্রায়শই দেখে থাকি।

কাজেই সেই অর্থে আমরা কেউই পরিপূর্ণ স্বাধীন নই। তবে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার উপর আরোপিত বাধ্যবাধকতা অবশ্যই জনগণেরই স্বার্থে।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অর্থ অবশ্যই বিচারকগণের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নয়। তাঁরাও সমাজের একটি অংশ, হয়তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। কিন্তু সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে তাদের আদর্শিক অবস্থান থেকেও তাদের দেশের আইন মেনে চলতে হয়, মানতে তাঁরাও বাধ্য। বিচারক বলেই আরও বেশি করে বাধ্য, যাতে অন্যরা এই ধারণা যেন না পান যে তাঁরা আইনের ঊর্ধ্বে।

অতএব, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ধারণা অবশ্যই কোনো বিচারককে সাধারণ আইনের ঊর্ধ্বে ওঠাবে না। তাঁরা অবশ্যই সম্মানের পাত্র, কিন্তু এই সম্মান তাদের শুধু অর্জন নয়, ধরে রাখতে হবে। রাষ্ট্র অন্যদের তুলনায় তাদের অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেছে, ক্ষমতাও প্রদান করেছে, তা কিন্তু বিচারকের ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য নয়, বিচারক কোনো মহামানব নন, তাকে এই সুবিধাদী ও ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যাতে তাঁরা তাদের বিচারিক ক্ষেত্রে জনগণকে সেরা সেবা প্রদান করতে পারেন।

মনে রাখতে হবে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং বাংলাদেশের সংবিধানগুলি আরম্ভই হয়েছে We the people of বলে, অর্থাৎ জনগণই সংবিধান সৃষ্টি করেছে, তাদের সংবিধানের নির্দেশাবলীর মাধ্যমেই বিচার বিভাগসহ সকল বিভাগ সৃষ্টি হয়েছে। জনগণের কাছেই আমাদের সকলের দায়বদ্ধতা, এমনকি বিচার বিভাগেরও।

সংবিধানের ৯৪ ও ১১৬ক অনুচ্ছেদে বর্ণিত নির্দেশ বিচার বিভাগে কর্মরত বিচারকগণের বিচারিক কার্যে স্বাধীনতার যে নিশ্চিত নিশ্চয়তা প্রদান করেছে সেইরূপ কোনো নিশ্চয়তা ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা-পূর্ব কালে কোনো বিচারকের ছিল না। বরঞ্চ তাঁরা রাজার অধীন, তাঁরা রাজমন্ত্রীদের অধীন ছিলেন। তখন সকলেই পরাধীন ছিল, কিন্তু কোনো প্রকার সাংবিধানিক বা আইনগত safe-guard ব্যতিরেকেই বিচারকগণ প্রভাবমুক্তভাবে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে তাঁরা বিচারিক কার্যাদী নিরপেক্ষভাবে করে গেছেন। কারণ তাদের অন্তরে স্বাধীনতা ছিল, সেখানে ব্রিটিশ-রাজ্যের শৃঙ্খলা প্রবেশ করতে পারেনি, এ কারণে কোনো বিধি-বিধান ব্যতিরেকেই তাঁরা স্বাধীন থাকতে পেরেছিলেন। যদি হৃদয়ে নিরপেক্ষতা না থাকে, আত্মসচেনতা না থাকে, স্বাধীন চিন্তাধারা না থাকে, সর্বোপরি যদি আইন অনুসারে ন্যায়বিচার করার স্পৃহা না থাকে তাহলে কোনো সংবিধান কোনো বিধিবিধান তাদের স্বাধীন করতে পারবে না। তাঁরা অন্তরে পরাধীনই থেকে যাবেন।

আমাদের সংবিধান বিচারকগণকে তাদের বিচারিক কার্যে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। জেলা পর্যায়ের বিচারকদের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংবিধান রাষ্ট্রের অন্যান্য বিভাগসহ বিচার বিভাগেও দ্বৈতশাসনের ব্যবস্থা রেখেছে।

আমার মতে, এটা খারাপ কিছু নয়। বরং এই ব্যবস্থা বিচার বিভাগকে একটা চেক অ্য্যান্ড ব্যালেন্সের মধ্যেই রেখেছে। এক হাতে সম্পূর্ণ ক্ষমতা না থাকাই ভালো, তাতে ক্ষমতার অপব্যবহার হওয়ার সম্ভবনা থাকে।

অনেকে বলেন যে, মন্ত্রণালয়ের হাতে শৃঙ্খলার ক্ষমতা থাকায় জেলা পর্যায়ের বিচারকদের উপর সরকারের প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু বদলি ঠেকাবার জন্য সুপ্রিম কোর্টের জি এ কমিটির কোনো কোনো সদস্যের বাসায় গিয়ে আক্ষরিক অর্থে পা পর্যন্ত অনেক বিচারক ধরেছেন, এ সংবাদও শুনতে হয়েছিল। আবার সুপ্রিম কোর্টের অনেক মাননীয় বিচারক ফোনে নিম্ন আদালতের বিচারককে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে থাকেন, এই অভিযোগও শুনতে হয়েছিল।

অতএব, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অবস্থান বিচারকদের হ্নদয়ে, কোনো আইন বা বিধিবিধানে নয়। কোনো প্রকার আইন ব্যতিরেকেই যখন জনগণ তাদের বিচারকদের সম্মান করবে, মূল্যায়ন করবে, তখনই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পূর্ণ হবে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।